বিশেষ প্রতিবেদনঃ উত্তরপ্রদেশের যোগী আদিত্যনাথ সরকার আন্তঃধর্মীয় বিবাহের বিরুদ্ধে একটি অধ্যাদেশ অনুমোদন করেছে। বিজেপি শাসিত আরও চারটি রাজ্য সরকার অনুরুপ অধ্যাদেশ আনার কথা বলেছে।
ভারতে এই বিষয়টি নিয়ে জোর বিতর্ক চলছে। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমও তাদের পৃষ্ঠাগুলোতে এই কথিত জোরপূর্বক আন্তঃধর্মীয় বিবাহ (যাকে বিজেপি ‘লাভ জিহাদ’বলে অভিহিত করে থাকে) অধ্যাদেশের বিরোধিতা করেছে।
সিঙ্গাপুরের স্ট্রেট টাইমস পত্রিকা তার এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, যে পাঁচটি রাজ্য ‘লাভ জিহাদ’ আনার কথা বলেছে,সেখানে বিজেপি-র সরকার রয়েছে। সংবাদপত্রের মতে, উত্তরপ্রদেশে আনা অধ্যাদেশ এবং অন্যান্য চারটি রাজ্যে এটির প্রস্তাবনা ‘লাভ জিহাদ’ ইস্যুকে উৎসাহিত করবে। পত্রিকাটি তার প্রতিবেদনে উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের বক্তব্যকে যথেষ্ট জায়গা দিয়েছে। মঙ্গলবার উত্তরপ্রদেশে এ সংক্রান্ত একটি অধ্যাদেশ অনুমোদিত হয়েছে।
সংবাদপত্রটি লিখেছে, ‘যোগী আদিত্যনাথ, একজন হিন্দু পুরোহিত যিনি ভারতের বৃহত্তম জনবহুল রাজ্য উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী। গত ৩১ অক্টোবর তিনি একটি নির্বাচনী সভায় বলেন, সরকার ‘লাভ জিহাদ’ বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। যারা তাদের পরিচয় গোপন করে আমাদের বোনদের অসম্মান করে, তাদের আমরা সতর্ক করছি। যদি তারা বিরত না হয় তাহলে, তাদেরকে শীঘ্রই অন্তিম সংস্কার করা হবে।’
‘ইউএস নিউজ’ নামের একটি মার্কিন মিডিয়া আউটলেট লখনউ ডেটলাইনে সাম্প্রতিক অধ্যাদেশ সম্পর্কে প্রতিবেদনে লিখেছে, ভারতীয় রাজ্য বিয়ের জন্য ‘জোরপূর্বক’ ধর্মান্তরিত করা অপরাধ হিসেবে সাব্যস্ত করেছে। সমালোচকদের উদ্ধৃত করে প্রতিবেদনে লেখা হয়েছে, ‘সমালোচকরা বলছেন যোগীর মন্ত্রিসভায় যে বেআইনি ধর্ম পরিবর্তন বিষয়ক অধ্যাদেশ অনুমোদন করা হয়েছে, এর উদ্দেশ্য ভারতের ১৭ কোটি মুসলিমকে মূল ধারা থেকে বিচ্ছিন্ন করা।
পত্রিকাটি ওই প্রতিবেদনে তৃণমূল কংগ্রেসের সংসদ সদস্যা নুসরত জাহানের একটি বিবৃতি উল্লেখ করেছে যাতে তিনি বলেছেন, ‘লাভ জিহাদ’ বলে কিছু নেই এবং এটি কেবল বিজেপির রাজনৈতিক কৌশল। তিনি বলেন, ‘লাভ বা ভালোবাসার মতো একান্ত ব্যক্তিগত বিষয় এবং জিহাদ এই দুটো কখনও একসঙ্গে যেতেই পারে না।’ নির্বাচনের আগেই কেন বারবার এ ধরনের বিষয়গুলো তোলা হয়, সেই প্রশ্ন তুলে ধর্মকে রাজনীতি থেকে দূরে রাখারও আবেদন জানান তিনি।
আল জাজিরা তাদের ওয়েবসাইটে ওই বিষয়ের উল্লেখ করেছে এবং পশ্চিমা দেশগুলোর কিছু গণমাধ্যমের ওয়েবসাইটেও এ সংক্রান্ত সংবাদ প্রকাশ করেছে। বেশিরভাগ প্রচারমাধ্যম ভারতে এ সম্পর্কিত ইস্যুগুলো শেয়ার করছে।
আল জাজিরা অক্টোবরের একটি ঘটনাকে উদ্ধৃত করেছে যাতে তানিস্কের গয়নার দোকানে মুসলিম স্বামীর সঙ্গে এক হিন্দু পুত্রবধূকে দেখানোর একটি বিজ্ঞাপন সরিয়ে ফেলতে হয়েছিল।
ফার্স্টপোস্ট ওয়েবসাইট নেটফ্লিক্সে দেখানো মীরা নায়ারের ফ্লিম ‘অ্যা সুইটেবল বয়’-এ একটি মন্দিরের ভিতরে একটি চুম্বনের দৃশ্যের বিতর্ককে ‘লাভ জিহাদ’-এর অধ্যাদেশের সঙ্গে সংযুক্ত করে ভারতে ক্রমবর্ধমান কথা বলেছে।
ওই চুম্বনের দৃশ্যে একজন মুসলিম যুবককে একটি মন্দিরের ভিতরে তাঁর হিন্দু বান্ধবীকে চুম্বন করতে দেখা গেছে, যার বিরুদ্ধে কয়েকটি হিন্দু সংগঠন পুলিশে অভিযোগ দায়ের করেছে। মধ্যপ্রদেশের নেটফ্লিক্সের কয়েকজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে এফআইআরও দায়ের করা হয়েছে।
হিন্দু ডানপন্থী সংগঠনগুলো কথিত ‘লাভ জিহাদ’কে একটি প্রেম বিবাহ বলে অভিহিত করে। তাদের দাবি, মুসলিম পুরুষ– হিন্দু নারীকে বিয়ে করে এবং তাকে ইসলামে ধর্মান্তর করার জন্য জোর করে। যদি বিপরীতটি সত্যি হয় অর্থাৎ কোনও মুসলিম নারী যদি কোনও হিন্দু পুরুষকে বিয়ে করে তাহলে অনেক হিন্দু সংগঠন এ বিষয়ে নীরব থাকে এবং কিছু সংগঠন এ ধরনের বিবাহকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন করে থাকে।
ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার এবং বেসরকারি সামাজিক প্রতিষ্ঠানের কাছে এ ধরনের বিবাহের কোনও পরিসংখ্যান নেই। কিন্তু একটি অনুমান অনুসারে এ জাতীয় বিবাহ তিন শতাংশেরও কম।
সরকারি বিভিন্ন এজেন্সির বেশ কয়েকটি প্রতিবেদনে হিন্দু নারী ও মুসলিম পুরুষের মধ্যে বিবাহের ক্ষেত্রে ‘জিহাদ’-এ অভিযোগ ভুল প্রমাণিত হয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও, বিজেপির পাঁচটি রাজ্য সরকার একে বন্ধ করতে আইনের আশ্রয় নিয়েছে।’
লাভ জিহাদ’ শধটি প্রথম কোথায় এবং কবে ব্যবহৃত হয়েছিল তা বলা মুশকিল, তবে ২০০৯ সালের দিকে কর্নাটক ও কেরলে এই শধটির ব্যবহারের উদাহরণ রয়েছে যেখানে কিছু হিন্দু ও খ্রিস্টান প্রতিষ্ঠান, মুসলিম পুরুষরা হিন্দু বা খ্রিস্টান মহিলাদের ইসলামে ধর্মান্তর করতে প্রতারণার মধ্য দিয়ে বিবাহের ষড়যন্ত্রের কথা উল্লেখ করেছে।
ভারতে আন্তঃধর্মীয় বিবাহ, বিশেষ বিবাহ আইন বা স্পেশাল ম্যারেজ অ্যাক্ট অনুসারে করা হয়, যার জন্য বিবাহ আদালতে নিবন্ধিত হতে হয় এবং তার আগে আদালত এক মাসের নোটিশ জারি করে, যাতে যে কেউ এই বিবাহের বিষয়ে আপত্তি জানাতে পারে এবং আদালতকে বলতে পারে।
‘লাভ জিহাদ’ শধের প্রচলনের পর থেকে ডানপন্থী হিন্দু সংগঠনগুলো আদালতে এমন বিয়ের বিরোধিতা করে আসছে যাতে দম্পতিকেও হুমকি দেওয়া হচ্ছিল, কিন্তু প্রকাশ্যে এটি করা হয়নি। ‘লাভ জিহাদ’-এর বিরুদ্ধে প্রচারণার অংশ হিসেবে হিন্দু-মুসলিম বিবাহগুলোর বিরোধিতা চলছে। বিশেষত উত্তরপ্রদেশের মানবাধিকার সংস্থাগুলো এবং গণমাধ্যম এটিকে নাগরিকেব মৌলিক অধিকারের উপরে আক্রমণ বলে অভিহিত করেছে।
সাধারণত উগ্র হিন্দুত্ববাদী বিভিন্ন সংগঠন ‘লাভ জিহাদ’ শধটি ব্যবহার করে। তাদের দাবি, মুসলিম তরুণরা হিন্দু মেয়েদের প্রেমের ফাঁদে ফেলে বিয়ে কবে কৌশলে ধর্মান্তর করায়। কিন্তু গত ফেব্রুয়ারিতে সংসদে কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছিল, কোনও কেন্দ্রীয় সংস্থাই ‘লাভ জিহাদ’-এর বিরুদ্ধে কোনও মামলা দায়ের করেনি। আইনেও ‘লাভ জিহাদ’-এর অস্তিত্ব নেই।
গত ৪ ফেব্রুয়ারি কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী জি কিষান রেড্ডি সংসদের নিম্নকক্ষ লোকসভায় একটি প্রশ্নের লিখিত উত্তরে বলেন, সংবিধানের ২৫ অনুচ্ছেদ যেকোনও ধর্মকে গ্রহণ, অনুশীলন ও প্রচারের স্বাধীনতা দেয়। ‘লাভ জিহাদ’ শধটি বর্তমান আইনে সংজ্ঞায়িত নয়। লাভ জিহাদের কোনও ঘটনা কোনও কেন্দ্রীয় এজেন্সিগুলোর নজরে আসেনি বলেও তিনি মন্তব্য করেন। যদিও ওই ইস্যুতে থেমে নেই উগ্র হিন্দুত্ববাদী দলবল। বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক প্রচারণা ও আইনি তৎপরতা শুরু হওয়ায় তা এবার দেশের সীমানা অতিক্রম করে বিদেশি গণমাধ্যমেও আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে উঠেছে।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন