সাইফুল্লা,কলকাতাঃএকটা সময়ে রাজ্য সরকারের তত্ত্বাবধানে এ রাজ্যের সরকার অনুমোদিত মাদ্রাসা সমূহে এখানকার শিক্ষার্থীদের জ্ঞানের পরিসরকে প্রসারিত করার লক্ষ্যে পাঠ্যসূচির বাইরে আরও সব বই সরবরাহ করার প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছিল এবং তা এখনও বহাল আছে। বিয়ষটি সত্যিই প্রশংসনীয়। তবে প্রশ্ন হল, এমন উত্তম বৃক্ষের ফল আদতে কতটা ফলছে! মাদ্রাসা শিক্ষার হাল-হকিকত সম্পর্কে যাঁরা ন্যূনতম ওয়াকিবহাল তাঁরাও জানেন, অবস্থাটা মোটেই ইতিবাচক নয়। অধিকাংশ মাদ্রাসায় উক্ত বইগুলি প্রায় অপঠিতভাবে কালযাপন করছে, আশু বিনষ্টির আশঙ্কাসহ। এ নিয়ে, কারও মধ্যে সেই অর্থে কোনও হেলদোল নেই। না থাক, তাতেও বিরাট কিছু ক্ষতি হত না হয়তো। অমন কতশত মহৎ প্রয়াস মরুপথে দিশা হারায়। সবকিছু নিয়ে আলাদা করে ভাবতে বসলে জীবন চলে না! তবে সমস্যা হল, এক্ষেত্রে আলাদা ভাবে ভাবনা করতেই হচ্ছে এবং সে ভাবনার প্রেক্ষিতে রীতিমতো মাথাব্যথার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে।
মাদ্রাসার জন্য ক্রীত বই মাদ্রাসা-পড়ুয়ারা পড়ুক আর না পড়ুক সে বই-এর বিপণনকে ঘিরে খেলা রীতিমতো জমে উঠেছে। বছরে অন্যূন্য এক কোটি টাকার ব্যবসা হওয়ার কথা। এমন বিরাট অঙ্কের টাকার অংশবিশেষ আয়ত্ত করতে পারলেও অনেকটা হতে পারে। এ রাজ্যে এখন সরকার অনুমোদিত মাদ্রাসার সংখ্যা ছয় শত চৌদ্দো। অর্থাৎ ৬১৪ ও বিবেচিত বই-এর গুণিতক-সংখ্যা সাপেক্ষে কার্যাদেশ পাওয়া যেতে পারে। প্রতি কপিতে পঞ্চাশ টাকা করে লভ্যাংশ থাকলেও পরিমাণটা কম নয়। বিশেষত ছোটো ছোটো প্রকাশকদের ক্ষেত্রে। তাঁরা তাই রীতিমতো তীর্থের কাকের মতো অপেক্ষা করেন।
অপেক্ষা করা হচ্ছে বটে কিন্তু দিন যত অগ্রসর হচ্ছে অপেক্ষা-ফল ততই কটু ও যন্ত্রণাকর হয়ে উঠছে। একটা সময় ছিল যখন সংশ্লিষ্ট দফতরের পক্ষ থেকে যথাযথভাবে বিষয়টি বিজ্ঞাপিত হত। বিজ্ঞাপন দেখে প্রকাশকরা যে যাঁর মতো করে আবেদন করতেন। এখন প্রতি বছর নিয়ম করে বই কেনা হচ্ছে না। কর্তৃপক্ষ দুই-তিন বছর পর পর খেয়ালখুশি মতো পদক্ষেপ করছেন। প্রকাশ্য বিজ্ঞাপন আর চোখে পড়ছে না বললেই চলে। নমঃ নমঃ করে কোনোক্রমে জানান দেওয়া হচ্ছে। এতে যাঁরা প্রথমাবধি দফতরের সঙ্গে সম্পৃক্ত রয়েছেন তাঁরাই বিষয়টার সুযোগ নিতে পারছে, অন্যেরা চুঁইয়ে পড়া জলের মতো হয়ে আসা সুযোগকে কাজে লাগানোর প্রাণপণ চেষ্টা করছেন মাত্র। এবং অনেক ক্ষেত্রেই সে চেষ্টা ফলপ্রসূ হচ্ছে না। অনেকেই সংবাদ না পাওয়ায় আবেদন করতে পারছেন না। শেষ সময়ে খবর পাওয়ায় সঠিক রুপে আবেদন করাও যাচ্ছে না। কেউ কেউ সময়াভাবে নিজেদের প্রকাশিত পুস্তকের পরিচয় যথাযথরুপে তুলে ধরতে অসমর্থ হচ্ছেন। ফলত,ফল যা হওয়ার তাই হচ্ছে।
লোকমুখে কয়েকটা প্রকাশক সংস্থার কথা শোনা যাচ্ছিল অনেক দিন ধর,যারা নাকি এখানে প্রায় মৌরসিপাট্টা গড়ে তুলেছে। বিষয়টি সরেজমিনে খতিয়ে দেখার লক্ষ্যে চোখ রাখা হল একটি মাদ্রাসার লাইব্রেরিতে। দেখা গেল, যা শোনা যাচ্ছিল তাই। মোট বই-এর সত্তর থেকে আশি শতাংশ হাতে গোনা কলকাতার দুই চারটি নামজাদা প্রকাশক সংস্থাজাত। তাদের সরবরাহ করা বই-এর নাম এবং দাম তাক লাগিয়ে দেওয়ার মতো। দীনেশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচনাসমগ্র ১,মূল্য ৪৫০ টাকা। লেখক দীনেশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বাংলা সাহিত্যক্ষেত্রে তেমন উল্লেখযোগ্য নাম নন। যদি ধরে নেওয়া হয়,তাঁর লেখা গুণগতমানে সামান্য নয়, তবু তারপরেও কথা থেকে যায়,তা মাদ্রাসার ওই কচিকাঁচা পড়ুয়াদের জন্য তো বটেই,তাদের শিক্ষকদের জন্যই বা কতটা বিশেষ পাঠ্য! এসব বইকে মাদ্রাসা-লাইব্রেরিতে মজুদ করার সার্থকতা কোথায়! বিশেষত সেখানে বিশ্বকোষ পরিষদ প্রকাশিত ‘জেগে উঠিলাম’-এর মতো গ্রন্থের কোনও স্থান হয় না। ওয়াকিবহাল মহল জানেন,‘জেগে উঠিলাম’ বাঙালি মুসলমান সমাজের সাংস্কৃতিক ইতিহাসের অনন্য দলিল।
উদাহরণের শেষ নেই। আপাতত ওসব উদাহরণকে ঝাঁপি চাপা দিয়ে অন্য কথায় আসা যাক। মাদ্রাসার বই-এর জন্য ধার্য এক কোটি টাকার যদি সুষ্ঠু বিলি-বন্টন হত তবে আর যাই হোক ছোটো ছোটো প্রকাশকরা একটু হালে পানি পেতেন। তাতে আখেরে লাভ হত অনেকটাই। বেশকিছু দিন ধরে বই-এর ব্যবসায় মন্দা চলছে। অস্তিত্ব রক্ষার জন্য জান প্রাণ দিয়ে লড়াই করছেন ছোটো প্রকাশকরা। করোনা পরিস্থিতিতে বিষয়টি আক্ষরিক অর্থেই দুঃসহ রুপ নিয়েছে। এমন কঠিনে সময়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে আশায় বুক বেঁধেছিলেন গোলাম রসুল, আবদুল মোমিন-এর মতো আরও অনেকে। মাদ্রাসা দফতর থেকে যদি দুই একটা বই-এর অর্ডার পাওয়া যায় তা হলেও বাঁচা যায়। কিন্তু হায়! নিরাশার চোরাবালিতে ক্রমশ তলিয়ে যেতে বাধ্য হচ্ছেন তাঁরা। তাঁরা একটা বই-এরও অর্ডার পাননি। কেবল গোলাম রসুল বা আবদুল মোমিন নয়, কোনোরকম কোনও অর্ডার পাননি তাঁদের সম্প্রদায়ের অধিকাংশজনই। স্বাধীনতার পর থেকে অদ্যাবধি কলেজ স্ট্রিটের মুসলিম প্রকাশক সংখ্যায় যৎসামান্য। অর্থনৈতিক দিক থেকে এঁদের অবস্থা খুবই শোচনীয়। এমন অবস্থায় মাদ্রাসার জন্য ক্রীত বই-এর তালিকায় তাঁদের বই স্থান পাবে না! এটা শুধু অস্বাভাবিক নয়, বিস্ময়কর।
এখানেই শেষ নয়। এক্ষেত্রে মুখোশ খসে গিয়ে ক্রমশ প্রকাশ্য হচ্ছে কিছু অতি অপ্রিয় বিষয়। মাদ্রাসার জন্য বই কেনা। কোনও কোনও প্রকাশক তাই তাঁদের দেয় তালিকায় মুসলিম সমাজ-সংস্কৃতি বিষয়ক বইকে কিছুটা অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন। কার্যাদেশ পাওয়ার পর তাঁরা অবাক হয়েছেন। সদ্য প্রয়াত স্বনামধন্য সাহিত্যিক সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজকে নিয়ে লেখা প্রখ্যাত লেখকের অতি গুণমানসম্পন্ন একটি রচনা প্রত্যাখাত হয়েছে,পরিবর্তে মনোনীত হয়েছে ওই প্রকাশকের নিতান্তই সাধারণ দুটি বই। এখনও পর্যন্ত যেটুকু খবর পাওয়া গেছে তা থেকে যেন মনে হচ্ছে, মুসলিম প্রকাশক ও মুসলিম সমাজ-সংস্কৃতি নির্ভর রচনা এক্ষেত্রে ব্রাত্য-তালিকার অন্তর্ভুক্তি হয়েছে। যদি সত্যিই তাই হয়, তবে এর থেকে বিপজ্জনক আর কী হতে পারে!
কিছুদিন আগে পর্যন্ত মাদ্রাসার বই বাছাই করার ক্ষেত্রে একটা স্বীকৃত কমিটি কাজ করত বলে জানা আছে। কমিটির সদস্যরা তাঁদের মতামত জানানোর সুযোগ পেতেন। এখন তেমন কোনও কমিটির অস্তিত্বের কথা শ্রুতিগোচর হচ্ছে না। খুবসম্ভব গুটিকয়েক মানুষের পছন্দ অপছন্দই এখানে শেষ কথা হয়ে উঠেছে, এবং তাঁদের পছন্দ অপছন্দের বিষয়টি নিছকই ব্যক্তিগত হয়ে পড়েছে। এই ব্যক্তিগত রঙের গভীরে আর কোনও রং মিশে আছে কিনা, কে জানে!
যদি ধরেও নেওয়া হয়,ম ব্যক্তি ইচ্ছার অতিরিক্ত আর কোনও রঙের অস্তিত্ব নেই এক্ষেত্রে, তবুও সংকটের গভীরতা রীতিমতো শঙ্কার। আমরা আগেই জেনেছি, বিশেষ কিছু প্রকাশকের প্রায় বাতিলের তালিকায় চলে যাওয়া বা নিতান্তই অবিক্রিত সব বইকে গছিয়ে দেওয়া হয়েছে মাদ্রাসার জন্য। এসব বই মাদ্রাসা গ্রন্থাগারের শোভাবর্ধনের অতিরিক্ত আর কিছু করবে না, তা জোর দিয়ে বলা যায়। নিশ্চয়ই কোনও দায়িত্বশীল বা দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি এমন বইকে মনোনীত করেছিলেন। এক্ষেত্রে তাঁদের দায়িত্বহীনতা জাতির অন্ধকার ভবিষ্যৎকে আরও অন্ধকারাচ্ছন্ন করেছে ও করছে। কিন্তু এহ বাহ্য। অনেক জঞ্জালের পাশাপাশি তখন কিছু ভাল বই মাদ্রাসা-গ্রন্থাগারে রক্ষিত হচ্ছিল। অন্তর্গত মুসলিম সমাজ-সংস্কৃতি সাপেক্ষ রচনাদি ব্রাত্য বলে বিবেচিত হচ্ছিল না। কিন্তু এখন এ কী আকাল শুরু হল! অন্যত্র তো দূরের কথা, মাদ্রাসা-গ্রন্থাগারেও মুসলিম সমাজ-সংস্কৃতি সম্পৃক্ত বই-এর জায়গা হচ্ছে না!
কেন হচ্ছে না! এর পিছনে কি সূদূরপ্রসারী কোনও দুরভিসন্ধি রয়েছে? যদি থেকে থাকে তবে তার ফল ভয়াবহ হতে বাধ্য। গোটা দেশ জুড়ে আজ উগ্রসাম্প্রদায়িকতা ছায়াবিস্তার করেছে। এমন ঘোর দুর্দিনে বাঙালি ও বঙ্গ সংস্কৃতিকে,সেই সঙ্গে ভারতীয়ত্বকে যদি হেফাজত করতে হয় তবে সম্ভাব্য সবপক্ষকে সর্বশক্তি সহকারে এ অপশক্তির বিরুদ্ধে গর্জে উঠতে হবে। আর একাজে ঋত্ত্বিকের ভূমিকা নিতে হবে মা-মাটি-মানুষের সরকারকে। বাঁচার সুযোগ দিতে হবে কলেজ স্ট্রিটের ছোটো প্রকাশকদের। মনে রাখতে হবে, যে টাকায় মাদ্রাসার জন্য বই কেনা হয় সে টাকা আসে রাজ্য সরকারের মাদ্রাসা ও সংখ্যালঘু উন্নয়ন মন্ত্রকের জন্য বরাদ্দ অর্থ থেকে।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন