রোগের নাম ডায়াবেটিস। বাংলায় মধুমেহ। নামে মধু থাকলেও আসলে এ হল ঘাতক অসুখ। নিঃশব্দ ঘাতকের তকমা পেয়ে গেছে অনেকদিন আগেই। কারণ এই রোগে একবার আক্রান্ত হলে শরীরের নানান অঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার প্রবল আশঙ্কা থাকে। কেন এই রোগের এত রমরমা? এই অসুখ হলে কী করতে হবে? আর প্রতিরোধের উপায়ই বা কী? বিস্তারিত জানাচ্ছেন বিশিষ্ট চিকিৎসক ডা. নারায়ণ বন্দ্যোপাধ্যায় ।
আমাদের দেশে ডায়াবেটিস তো হু হু করে বাড়ছে– কেন?
এখন নয়– এক দশকেরও বেশি সময় ধরে এদেশে ডায়াবেটিস বাড়ছে। এর প্রধান কারণ লাইফ স্টাইল বা জীবনযাপনের পরিবর্তন। এই কারণে মধ্য বয়সে তো আছেই তাছাড়া অনেক কম বয়সীরাও এই সমস্যার শিকার হচ্ছে। আর রোগটা বেশি হচ্ছে শহরের লোকেদের। বেশি জাংক ফুড খাওয়া ও কায়িক শ্রম না করার জন্যই সমস্যা বাড়ছে। তবে কারও পরিবারে বাবা– মা বা নিকটাত্মীয়ের ডায়াবেটিস থাকলে এই সব কারণ না থাকা সত্ত্বেও সমস্যা দেখা দিতে পারে। কারণ ডায়াবেটিসে জেনেটিক ফ্যাক্টরের ভূমিকা যথেষ্ট।
আমাদের দেশ বেশ কয়েক বছর ধরে এ রোগের রাজধানী ছিল অর্থাৎ সবচেয়ে বেশি ডায়াবেটিক রোগী এখানেই ছিল। যদিও সম্প্রতি চিন এ রোগে খানিকটা এগিয়ে গিয়ে শীর্ষ স্থান দখল করেছে।
রোগ আটকাব কী করে?
আগেই বললাম, এই রোগে লাইফ স্টাইল ভীষণভাবে দায়ী। কাজেই জাংক ফুডকে বিদায় দিতে হবে আর হাঁটতে হবে। হাঁটতে না পারলে ট্রেড মিল করা। এসব না করলে বিপদ আটকানো মুশকিল।
প্রি ডায়াবেটিস বলতে কী বোঝায়?
যদি কারও ফাস্টিং সুগার ১০০ এর নীচে থাকে তাহলে বলা হয় তাঁর ডায়াবেটিস নেই। কারও ১৪০ এর বেশি ফাস্টিং ব্লাড সুগার থাকলে বলা হয় ডায়াবেটিস আছে। আর কারো যদি ১০০ থেকে ১২৬-এর মধ্যে ফাস্টিং সুগার থাকে তাহলে তাদের প্রি ডায়াবেটিস বলে ধরা হয়। এই গ্রুপের লোকেদের তখন থেকে সাবধান হতে হবে। সতর্ক থাকতে হবে। নিয়মিত এক্সারসাইজ করতে হবে– জাংক ফুড ও মিষ্টি বাদ দিতে হবে। তাহলেই আর রোগ শরীরে চেপে বসবে না।
ডায়াবেটিসের উপসর্গ কী?
ডায়াবেটিসে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তেমন উপসর্গ থাকে না। টাইপ ওয়ান রোগীদের উপসর্গ থাকে। কিন্তু টাইপ টু-এর ক্ষেত্রে তেমন কোনও উপসর্গ থাকে না। অন্য কোনও সমস্যা নিয়ে ডাক্তারের কাছে গেলে তখন পরীক্ষায় ধরা পড়ে যে সুগার আছে। ৫০ শতাংশ ক্ষেত্রে রুটিন চেক আপ করার সময় ধরা পড়ে। অ্যাভারেজ ব্লাড সুগার করলে দেখা যায় তিন মাস ধরেই ডায়াবেটিসের সমস্যা আছে।
ডায়াবেটিস বাড়লেই কি ইনসুলিন দেওয়ার দরকার হয়?
কখন– কাকে ইনসুলিন দেওয়া হবে তা রোগীর অবস্থা বুঝে ডাক্তারবাবুই ঠিক করেন। তবে প্রেগন্যান্সির সঙ্গে টাইপ টু ডায়াবেটিস থাকলে ইনসুলিন দেওয়া হয়। প্রেগন্যান্সির অন্তত প্রথম ১৪ সপ্তাহ তো অবশ্যই। কাজেই প্রেগন্যান্ট ডায়াবেটিক মহিলাদের ইনসুলিন দিলে তা নিয়ে দুশ্চিন্তা করা উচিত নয়। এছাড়া ডায়াবেটিক কমপ্লিকেশন থাকলে– ইনফেকশন থাকলে– ডায়াবেটিক রোগীর কিডনি খারাপ হলে ও টাইপ ওয়ান রোগীদের ইনসুলিন দিতেই হয়।
আর্টিফিসিয়াল সুইটনার বড়ি খাওয়া কতটা নিরাপদ?
দিনে ২-৩ কাপ চা খেলে তাতে একটা করে বড়ি দিয়ে খেলে ক্ষতি নেই।
অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস থেকে কী কী সমস্যা দেখা দিতে পারে?
ডায়াবেটিসকে বলে সাইলেন্ট কিলার। নিঃশব্দ ঘাতক। অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস থাকলে আস্তে আস্তে শরীরের প্রত্যেকটা অঙ্গকে ক্ষতি করতে থাকে। চোখ– হার্ট– কিডনি– লিভার আর নার্ভ খারাপ হওয়ার প্রবণতা বাড়তে থাকে। তাই যখন কোনও রোগীর ডায়াবেটিস প্রথম ধরা পড়ে এই অঙ্গগুলো কী অবস্থায় আছে দেখা হয়। ডায়াবেটিকদের বছরে একবার চোখের রেটিনা ঠিক আছে কিনা দেখে নেওয়া খুব দরকার। কারণ ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি খুব বিপজ্জনক অসুখ। নন ডায়াবেটিক বা যাদের ডায়াবেটিস নেই তাদের তুলনায় ডায়াবেটিকদের হার্ট অ্যাটাকের চান্স অনেক বেশি। কারণ তাদের হার্টে কোলেস্টেরল অনেক বেশি জমে। এছাড়া কিডনি ইনজুরি বেশি হয়। তাই মাঝে মধ্যে কিডনি ও ইউরিন টেস্ট করে দেখতে হয় প্রোটিন বেরচ্ছে কিনা। ডায়াবেটিকরা মাঝে মধ্যেই হাত পা জ্বালা করছে বলেন, এটাকে বলে ডায়াবেটিক নিউরোপ্যাথি। আসলে তখন নার্ভগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কারও পাঁচ ছ বছর ধরে এই অসুখ থাকলে তখন লিভারের মধ্যে চর্বি জমে। যাকে বলা হয় ফ্যাটি লিভার। তার থেকে অনেকের সিরোসিস হয়। তাকে আমরা নন-অ্যালকোহলিক স্টিয়াটোহেপাটাইটিস বলা হয়। অনেক সময়েই যখন নজরে আসে তখন আর চিকিৎসার সুযোগ থাকে না। তাই রোগীদের ফাইব্রোস্ক্যান করে দেখা হয় লিভারে কতটা চর্বি জমেছে। তার থেকে সিরোসিস হওয়ার চান্স রয়েছে কিনা।
বলা হয় ডায়াবেটিস হলে পায়ের যত্নে বিশেষ নজর দেওয়া দরকার। কেন?
ডায়াবেটিসে রক্ত চলাচলের আর্টারি বা নালীগুলো অ্যাথরোসক্লেরোসিস হয়ে শক্ত হয়ে যায় বলে ভালভাবে রক্ত চলাচল করতে পারে না। স্বাভাবিকভাবে পায়েও রক্ত চলাচল করে কম। ফলে পায়ে কোনও চোট পেয়ে সেখানে কোনও ক্ষত হলেও তা বুঝতে পারে না। সেই ক্ষত জায়গাটা সারতেও চায় না। কারণ সারতে গেলে রক্ত চলাচল করতে হবে। তাই ডায়াবেটিকদের সামান্য কাটা থেকেও কোনও আঙুল বাদ চলে যেতে পারে। আসলে নিউরোপ্যাথি থাকার জন্য বুঝতে পারেনা সমস্যাটা। এই কারণে এই ধরনের রোগীদের খালি পায়ে হাঁটতে বারণ করা হয়। ভাল জুতো ব্যাবহার করার পরামর্শ দেওয়া হয়। প্রতিদিন রাতে শোয়ার আগে আয়না দিয়ে পা ভাল করে দেখা দরকার সেখানে কোনও ক্ষত আছে কিনা। সামান্য ক্ষত থেকেও বড়সড় সমস্যা দেখা দিতে পারে।
ব্লাড সুগার আচমকা কমে গেলে কী করণীয়?
ব্লাড সুগার আচমকা কমে যাওয়াকে বলে হাইপোগ্লাইসেমিয়া। এটা সবচেয়ে ভয়ের ব্যাপার। আচমকা কমে যাওয়ার কারণ হতে পারে কেউ ওষুধ খেল কিন্তু খাবার খেল না। কিংবা আস্তে আস্তে কিডনি খারাপ হয়ে গেছে। কারো ওষুধের পরিমাণ কমানো দরকার কিন্তু কমানো না হলে এই সমস্যা হতে পারে। উপসর্গ হিসেবে ঘাম হওয়া– বুক ধড়ফড় করা– চোখে অন্ধকার দেখা দিতে পারে। সঙ্গে সঙ্গে লজেন্স– ক্যাডবেরি বা নিদেনপক্ষে চিনি খেলে উপকার পাওয়া যায়। বেশিক্ষণ এভাবে রোগী থাকলে ব্রেনে স্থায়ী ক্ষতি হতে পারে। বাড়ে হার্ট অ্যাটাকের প্রবণতাও। এই কারণে ডায়াবেটিক রোগীদের সচেতনতা খুব জরুরি। অসুবিধা বুঝলেই মিষ্টি খাওয়া দরকার। আর বাড়িতে একটা সুগার মাপা যন্ত্র রাখা দরকার। আর ডাক্তারবাবুর সঙ্গে যোগাযোগ রাখা দরকার।
ডায়াবেটিক রোগীরা কী খাবেন আর কী খাবেন না?
কার্বোহাইড্রেট কম খাবে। ভাত– আলু ও মিষ্টি এড়িয়ে যেতে হবে। ফাইবার সমৃদ্ধ খাবার খেতে পারে। প্রায় সব ফল খাওয়া যায়। তবে কলা– সবেদা না খাওয়াই ভাল। আম এক চিলতের বেশি নয়। পেয়ারা– আপেল– কমলালেবু মুসম্বি লেবু খেতে পারে। মিষ্টি স্বাদযুক্ত খাবার তাই এড়িয়ে যাওয়াই ভাল।
সাক্ষাৎকার শ্যামলী বন্দ্যোপাধ্যায়
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন