পুবের কলম,ওয়েবডেস্ক: ভারত-পাকিস্তান ম্যাচে পাকিস্তান ক্রিকেট দলের জয় উদযাপন করা ভুয়ো মামলায় মধ্যপ্রদেশের একটি আদালতে বেকসুর খালাস পেলেন ১৭জন মুসলিম যুবক। অভিযোগ উঠেছিল, ২০১৭ সালে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির ফাইনালে ভারত-পাকিস্তান ক্রিকেট ম্যাচ চলাকালীন মধ্যপ্রদেশের বুরহানপুর জেলার আদিবাসী অধ্যুষিত মোহাদ গ্রামের কয়েক’জন মুসলিম যুবক নাকি পাকিস্তান দলের জয় উৎযাপন করছিলেন। দেশদ্রোহীতার অভিযোগে সেই সময় তাদের গ্রেফতার করে বুরহানপুরের পুলিশ। যদিও ঠিক ৬ বছর পর ওই মামলার রায় দিতে গিয়ে মধ্যপ্রদেশ আদালত জানিয়ে দেয়, মামলাটি পুরো ভুয়ো ছিল। ওই ১৭জনকে চক্রান্ত করে ফাঁসানো হয়েছিল। তাই ওদেরকে বেকসুর খালাস করা হল।
ঘটনাটি ঘটে মধ্যপ্রদেশের রাজধানী ভোপাল থেকে ৩৫০ কিমি দূরে অবস্থিত বুরহানপুর জেলার মোহাদ গ্রামে। এটি আসলে দলিত, উপজাতি এবং উপজাতীয়-মুসলিমদের একটি গ্রাম। বুরহানপুর শহর থেকে ২০ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত মোহাদ গ্রামটি। এই গ্রামের জনসংখ্যা প্রায় চার হাজার। পাহাড়ের পার্শ্ববতী এই অঞ্চলে পাকা ঘর-বাড়ি নেই বললে চলে। সেখানে ছোট মাটির ও টিনের চালা ঘর বেশি। স্বল্প সাক্ষরতার অধিকারী এই গ্রামের বেশিরভাগ মানুষই ক্ষুদ্র কৃষক কিংবা শ্রমিক। যাদের বেশিরভাগের সংসার চলে সরকারী রেশনে। গ্রামটিতে কোনও উন্নয়ন না থাকলেও,২০১৭ সালের জুন মাসের একটি গুজবের কারণে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসে। আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির ফাইনালে ভারত হেরে যাওয়ায় গুজব ছড়িয়েছিল এই গ্রামে নাকি পাকিস্তানের জয় উদযাপন করা হয়েছিল।
ভারতের মাটিতে পাকিস্তানের জয় উদযাপন করার খবরটি অনেকবেশি গতি পেয়েছিল ১৭জন মুসলিম যুবকের নাম ভেসে ওঠায়। সেই গুজবের ভিত্তিতে বুরহানপুরের শাহপুর থানায় এই গ্রামের ১৭ জন (দুই জন অপ্রাপ্তবয়স্ক) মুসলিম যুবকের বিরুদ্ধে আইপিসি ১২৪,এ (রাষ্ট্রদ্রোহ), ১২০,বি (দলগতভাবে আইনবিরুদ্ধ কাজ) এবং (অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র) ধারায় একটি এফআইআর নথিভুক্ত করা হয়। সেই সময় খবরটি দীর্ঘদিন সংবাদমাধ্যমের শিরোনামে থেকে গিয়েছিল। যদিও ওই ঘটনার শক্তিশালী প্রমাণ, ভিডিয়ো কিংবা কোনও প্রত্যক্ষদর্শী পাওয়া যায়নি। শুধুমাত্র ওই গ্রামের বাসিন্দা সুভাষ কলি নামক এক ব্যক্তি পুলিশের কাছে এফআইআর নথিভুক্ত করেছিলেন। সেটার ভিত্তিতে পুলিশ ১৭জন মুসলিম যুবককে গ্রেফতার করে। ঘটনাটি ২৩ রমযানে ঘটায় অভিযুক্তদের সবাইকে জেলেই ইদ কাটাতে হয়েছিল।
ঘটনার দুই সপ্তাহের মধ্যে প্রত্যেকেই জামিন পেয়েছিলেন। তবে তাদের প্রতি সপ্তাহে থানায় গিয়ে হাজিরা দিতে হত। হাজিরা দিতে মাসে তিনবার তাদের ২০ কিলোমিটার দূরে বুরহানপুর জেলা আদালতেও যেতে হত। থানায় হাজিরার সময় তাদেরকে নিয়মিত দেশদ্রোহী বলে অপমান করা হত। আদালতে হাজিরার সময় আইনজীবীরা ওই ১৭জনকে উদ্দেশ্য করে ‘দেশের গদ্দারদের গুলি কর’ বলে স্লোগান দিতেন। সেই অপমানে ২০১৯ সালে অভিযুক্তদের একজন রুবাব নবাব (৪০) আত্মহত্যা করেন। তিনি এক নিঃস্ব করে যান স্ত্রী এবং দুই ছেলেকে। এর মাঝে অভিযোগকারী সুভাষ কলি হাটের মাঝখানে হাঁড়ি ভেঙে দিয়ে জানিয়ে দেন, ওই ১৭জন মুসলিম ছেলে নিপরাদ। আদালতে একটি হলফনামা দিয়ে তিনি বলেন, তিনি কখনও এফআইআর দায়ের করেননি। যা কিছু করেছেন, স্থানীয় বিশ্বহিন্দু পরিষদের কয়েক’জন আধিকারিকের উসকানিতে করেছেন।
সুভাস কলির পাশাপাশি মোট ১২ জন সাক্ষীও ঘটনাটি অস্বীকার করেছেন। পাশাপাশি ভুয়ো এফআইআর দায়ের এবং নিরীহ মুসলিমদের ফাঁসানোর জন্য স্থানীয় পুলিশকে তারা দায়ী করেছে। মামলার পর্যবেক্ষণে আদালত জানায়, মামলাটি পুরোপুরী ভুয়ো। অভিযুক্তদের চক্রান্ত করে ফাঁসানো হয়েছে। সম্ভবত খেলায় ভারতের হেরে যাওয়া মেনে নিতে পারেনি অভিযোগকারীরা। তাই পাকিস্তানের জয় উৎযাপনের মিথ্যে ঘটনা তৈরি করে অভিযুক্তদের জেল খাটিয়েছে তারা। যাবতীয় বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করে বুরহানপুর আদালত প্রায় ৬ বছর পর এই মামলার রায় দেয় এবং সবাইকে খালাস করে দিল। আদালত সবাইকে বেকসুর খালাস দিলেও শুধুমাত্র ধর্মের ভিত্তিতে মিথ্যা মামলা দায়ের ও নির্যাতনের জন্য দায়ী কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। শোনা যায়, ওই ঘটনার পর থেকে মধ্যপ্রদেশের মোহাদ গ্রামে আজ পর্যন্ত কেউ ক্রিকেট ম্যাচ দেখেও না, আর খেলেও না। এমনকি ভারত-পাক ক্রিকেট ম্যাচ হলে পুরো এলাকা থমথমে হয়ে যায়। পিনপতন নীরবতা পালন হয় সেখানে।