কলকাতার ঐতিহ্য এখনও ধরে রেখেছে এই সুগন্ধি দোকান
খুসবুপ্রেমী নজরুলের বিশেষ পছন্দ ছিল আতর, দু’শো বছরের প্রাচীন আতরের দোকানে আসতেন নজরুল

- আপডেট : ২ জুলাই ২০২৫, বুধবার
- / 48
পুবের কলকাতা ওয়েবডেস্ক: কলকাতা তখন ব্রিটিশরাজের অধীনে। চিৎপুর তখন বাণিজ্যে জমজমাট। ভোর থেকেই শুরু হয়ে যেত বেচাকেনা। ভোর পাঁচটায় রবীন্দ্র সরণি আর কলুটোলার কোণে ফৌজদারি বালাখানার একতলায় দোকান খুলে বসে পড়তেন হাজি খুদা বক্স। সন্ধ্যায় ঝাঁপ পড়ে যেত। নির্বাসিত নবাব ওয়াজিদ আলি শাহ ১৮৫৬ সালে মেটিয়াবুরুজে আসার বহু আগেই কনৌজের কারখানা থেকে সুগন্ধি নিয়ে এ শহরে চলে আসেন খুদা বক্স ও তাঁর ছেলে নবি বক্স। ১৮২৪ সালে প্রতিষ্ঠিত সেই দোকান আজও একই জায়গায় রয়েছে। দু’শো বছরের এই দোকান কলকাতার ঐতিহ্য বহন করে চলেছে।

গরমে বেল, জুঁই, গোলাপ, রজনীগন্ধা, চন্দনের পাশাপাশি মনের আরাম দেয় সুগন্ধি। আগেকার দিনে গরমে, পাটের ঝোলানো খসে জল ছিটিয়ে ঠান্ডা রাখা হত ঘর। বিশেষ ঘাস থেকে তৈরি খস আতর সেই ঘ্রাণ মনে করায়। শীতকালে শামামা, মুস্ক, হিনার সুঘ্রাণ গায়ে মাখতে এখনও পছন্দ করেন গন্ধবিলাসীরা। জাফরান-সহ বিভিন্ন মশলার মিশ্রণে তৈরি হয় শামামা। মুস্ক তৈরিতেও লাগে বিভিন্ন মশলা। আতরের সব থেকে জরুরি উপাদান চন্দন তেল। দুর্মূল্য চন্দন তেল এবং বিভিন্ন প্রাকৃতিক উপাদানের মিশ্রণে তৈরি খাঁটি আতরের দাম তাই বেশি। দশ গ্রাম আতরের দাম হয় ছ’শো থেকে পাঁচ হাজারের মধ্যে। আতর তৈরি করতে কম করে সপ্তাহ দুয়েক সময় লাগে। তবে আগর গাছ থেকে বিশেষ প্রক্রিয়ায় তৈরি উদ আতর সময় ও খরচসাপেক্ষ। তাই এর দামও বহুগুণ বেশি। এ ছাড়া দু-তিন রকম খাঁটি আতর মিলিয়ে তৈরি হায়াতি, সাবা এবং অপ্সরাও জনপ্রিয়।

দু’শো বছর ধরে কলকাতার বুকে দাঁড়িয়ে থাকা এই সুগন্ধীর দোকান আমাদের ঐতিহ্য। কলুটোলা রোডে অবস্থিত হাজি খুদা বক্স নবী বক্স -এর দোকান আজও তার ঐতিহ্য বহন করে নিয়ে চলেছে। কলকাতার বেলেঘাটায় আতর কারখানার পাশাপাশি শিয়ালদহ অঞ্চলের বৈঠকখানায় তৈরি করেন বসবাসের জন্য বাড়ি। এখনও সেই বাড়ি বিদ্যমান। এই দোকানে আসতেন কাজী নজরুল ইসলাম থেকে শুরু করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মতিলাল নেহেরু, নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আতরের সুগন্ধীর টানে তাঁরা সকলে এই দোকানে নিয়মিত হাজির হতেন।

নিয়াজউদ্দিন আল্লাহ্ বক্স- এর কাছ থেকে জানা যায়, সুগন্ধপ্রেমী নজরুল বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে আতর সংগ্রহ করার জন্য এই দোকানে নিয়মিত আসতেন। স্বাভাবিকভাবেই কবিকে একটিবার দেখার জন্য লোকসমাগম হত, কবিও তাতে বিব্রতবোধ করতেন। আতরের প্রতি ভালোবাসা এতোটাই প্রবল ছিল যে নিজে না দেখে আতর কেনা নজরুল পছন্দ করতেন না। ‘নওরোজ’ কবিতায় নজরুল এই ‘আতর’ শব্দের চমৎকার প্রয়োগ করেছেন –
গুলে-বকৌলি উর্বশীর এ চাঁদনী-চক
চাও হেথায় রূপ নিছক।
শরাব সাকী ও রঙে রূপে
আতর লোবান ধূনা ধূপে
সয়লাব সব যাক ডুবে,
আঁখি-তারা হোক নিষ্পলক!
চাঁদো মুখে আঁক’ কালো কলঙ্ক তিল-তিলক!
চাও-হেথায় রূপ নিছক!
নজরুলের পছন্দের আতরের মধ্যে উল্লেখযোগ্য – রজনীগন্ধা, রুহ্ গুলাব, রুহ্ খস্ (গ্রীষ্মকালীন সময়ে ব্যবহার করতেন) এবং শমামা। পুষ্পপ্রেমী নজরুলের রজনীগন্ধার প্রতি বিশেষ আকর্ষণ ছিল। এ এফ এম হায়াতুল্লাহ্ ‘অন্যরকম নজরুল’ প্রবন্ধে লিখেছেন – “তিনি ফুল অত্যন্ত ভালোবাসতেন। ফুল নিয়ে তাঁর কতরকম গান-কবিতাই না আছে। ফুলের বন্দনাকারী এই অনন্য সাধারণ কবির বিশেষ ফুল ছিল রজনীগন্ধা।” রজনীগন্ধাকে নিয়ে একটি গানও রচনা করেন নজরুল ‘ওরে শুভ্র-বসনা রজনীগন্ধা’। গানটির সুরকার ছিলেন কমল দাশগুপ্ত। ১৯৩৯ সালে শিল্পী পদ্মরাণী চ্যাটার্জী এই গান রেকর্ড করেন। রজনীগন্ধার গন্ধে মাতাল কবি লিখলেন –
করুণ শুভ্র ভালোবাসা তোর
সুরভি ছড়ায় সারা নিশি ভোর,
প্রভাত বেলায় লুটাস ধূলায় যেন-কারে নাহি পেয়ে।।

২০০ বছর অতিক্রম করে নজরুলের প্রিয় আতর ‘রজনীগন্ধা’ আজও সুবাস ছড়াচ্ছে কলকাতার বুকে। ১ জুলাই ছায়ানট (কলকাতা) এর তরফে হাজি খুদা বক্স নবী বক্স- এর দোকানের বর্তমান সত্ত্বাধিকারী নিয়াজউদ্দিন আল্লাহ্ বক্স- এর হাতে স্মারক প্রদান করেন ছায়ানটের সভাপতি সোমঋতা মল্লিক। খুশবুপ্রেমিক নজরুল-স্মৃতি সম্পর্কে নজরুলপ্রেমীদের অবগত করার উদ্দ্যেশ্যেই ছায়ানটের এই উদ্যোগ।ছায়ানটের পক্ষ থেকে উপস্থিত ছিলেন বিচিত্রা ঘোষ, গোপা দাস মজুমদার, গৌরী ধর, চম্পা মিত্র এবং মৃত্যুঞ্জয় মিত্র।