১৯ জুলাই ২০২৫, শনিবার, ৩ শ্রাবণ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

‘বিপন্ন সুন্দরবনের ঐতিহ্য’ হারিয়ে যাচ্ছে বনবিবি পালা ও ম্যানগ্রোভ বন

ইমামা খাতুন
  • আপডেট : ১৮ জুলাই ২০২৫, শুক্রবার
  • / 40

কুতুব উদ্দিন মোল্লা , ঝড়খালী: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল এবং তার সঙ্গে জড়িয়ে থাকা লোকসংস্কৃতি আজ এক দ্বৈত সংকটের মুখে। একদিকে প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা করা ম্যানগ্রোভ বন ধ্বংসের মুখে, অন্যদিকে হারিয়ে যেতে বসেছে এই অঞ্চলের মানুষের আত্মপরিচয় ও বিশ্বাসের প্রতীক—বনবিবি পালা।

সুন্দরবনের মানুষ প্রাচীনকাল থেকে নদী, জঙ্গল ও প্রকৃতির সঙ্গে সহাবস্থানে অভ্যস্ত। মাছ ধরা, কাঁকড়া ও চিংড়ি ধরা , মধু সংগ্রহ করা ইত্যাদি ঝুঁকিপূর্ণ জীবিকার মধ্যেও তারা প্রকৃতির সঙ্গে একধরনের গভীর আত্মিক সম্পর্ক গড়ে তুলেছেন। এই জীবনযাত্রারই প্রতিচ্ছবি বনবিবি পালা—একটি লোকনাট্য, যা শুধু ধর্মীয় বিশ্বাস নয়, বরং জীবন সংগ্রামের সাহস ও আত্মবিশ্বাসের প্রতীক।

আরও পড়ুন: আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি ও সঠিক পরিকল্পনায় আজ উপকৃত সুন্দরবনের কৃষকরা

বনবিবি, দক্ষিন রায়, গাজি পীর ও ঢাকুরানির মতো চরিত্রদের ঘিরে গড়ে ওঠা পালাগান ছিল সুন্দরবনের মানুষের অন্তরের ভাষা। আগে প্রতিটি গ্রামে, হাটে বা উৎসবে বনবিবি পালার আসর বসত। এই পালা ছিল সমাজে ভ্রাতৃত্ব, ভক্তি ও পরিবেশ সম্পর্কে সচেতনতার বাহক। বহু শিল্পী এই পালা গেয়ে জীবিকা নির্বাহ করতেন। কিন্তু বর্তমানে এই লোকঐতিহ্য হারিয়ে যেতে বসেছে।

আরও পড়ুন: সুন্দরবনের লোকালয়ে বাঘের আগমন আটকাতে নাইলনের বদলে এবার স্টীলের নেট লাগাতে চলেছে বন দফতর

নতুন প্রজন্মের অনেকেই এখন আর বনবিবি পালার সঙ্গে পরিচিত নয়। মোবাইল ফোন, সোশ্যাল মিডিয়া, ডিজিটাল বিনোদনের জোয়ারে রীল বানাতে ডুবে থাকা তরুণ সমাজ এখন লোকসংস্কৃতির প্রতি আগ্রহ হারাচ্ছে। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অনুশীলনের অভাব, শিল্পীদের আর্থিক সংকট এবং সরকারি-বেসরকারি স্তরে উদ্যোগের ঘাটতি। ফলস্বরূপ, বনবিবি পালা আজ শুধুই স্মৃতির ঝাঁপিতে বন্দি।

আরও পড়ুন: বাসের মধ্যে বিজ্ঞান প্রদর্শনীতে আগ্রহ বাড়ছে পড়ুয়াদের সুন্দরবনে

অন্যদিকে, পরিবেশগত দিক থেকেও সুন্দরবন আজ গভীর সংকটে। বসতি সম্প্রসারণ, নদী বাঁধ ও চাষের জন্য ম্যানগ্রোভ বন ধ্বংস করা হচ্ছে অবলীলায়। এর ফলে বাড়ছে নদীভাঙন, ঘূর্ণিঝড়ের তীব্রতা এবং বাঘ-মানুষ সংঘর্ষ। অথচ এই ম্যানগ্রোভ বনই ছিল প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষার প্রাকৃতিক প্রাচীর।

'বিপন্ন সুন্দরবনের ঐতিহ্য' হারিয়ে যাচ্ছে বনবিবি পালা ও ম্যানগ্রোভ বন

এই দুই বিপন্নতা—পরিবেশ ও সংস্কৃতি—পরস্পরের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ম্যানগ্রোভ ধ্বংসের ফলে যেমন জীবিকার ওপর প্রভাব পড়ছে, তেমনই বনবিবি পালার মতো সংস্কৃতি হারালে হারিয়ে যাবে মানুষ ও প্রকৃতির মধ্যকার আত্মিক সম্পর্কের সেতুবন্ধন।

এই পরিস্থিতিতে জরুরি পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। স্থানীয় প্রশাসন, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়, পরিবেশবিদ ও শিক্ষাবিদদের একযোগে কাজ করতে হবে। স্কুল-কলেজে বনবিবি পালার পরিচিতি, লোকশিল্পীদের আর্থিক সহায়তা, ম্যানগ্রোভ রক্ষায় সচেতনতামূলক কর্মসূচি এবং মিডিয়ায় লোকঐতিহ্য প্রচারের মাধ্যমে আবার ফিরিয়ে আনতে হবে সুন্দরবনের প্রকৃত পরিচয়।

সুন্দরবন শুধু একটি ভৌগলিক অঞ্চল নয়, এটি এক বিস্ময়কর সহাবস্থানের নিদর্শন। সেই সহাবস্থান রক্ষা করতে হলে বন যেমন বাঁচাতে হবে, তেমনি বাঁচাতে হবে বনবিবির গানকেও।

Copyright © Puber Kalom All rights reserved.| Developed by eTech Builder

‘বিপন্ন সুন্দরবনের ঐতিহ্য’ হারিয়ে যাচ্ছে বনবিবি পালা ও ম্যানগ্রোভ বন

আপডেট : ১৮ জুলাই ২০২৫, শুক্রবার

কুতুব উদ্দিন মোল্লা , ঝড়খালী: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল এবং তার সঙ্গে জড়িয়ে থাকা লোকসংস্কৃতি আজ এক দ্বৈত সংকটের মুখে। একদিকে প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা করা ম্যানগ্রোভ বন ধ্বংসের মুখে, অন্যদিকে হারিয়ে যেতে বসেছে এই অঞ্চলের মানুষের আত্মপরিচয় ও বিশ্বাসের প্রতীক—বনবিবি পালা।

সুন্দরবনের মানুষ প্রাচীনকাল থেকে নদী, জঙ্গল ও প্রকৃতির সঙ্গে সহাবস্থানে অভ্যস্ত। মাছ ধরা, কাঁকড়া ও চিংড়ি ধরা , মধু সংগ্রহ করা ইত্যাদি ঝুঁকিপূর্ণ জীবিকার মধ্যেও তারা প্রকৃতির সঙ্গে একধরনের গভীর আত্মিক সম্পর্ক গড়ে তুলেছেন। এই জীবনযাত্রারই প্রতিচ্ছবি বনবিবি পালা—একটি লোকনাট্য, যা শুধু ধর্মীয় বিশ্বাস নয়, বরং জীবন সংগ্রামের সাহস ও আত্মবিশ্বাসের প্রতীক।

আরও পড়ুন: আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি ও সঠিক পরিকল্পনায় আজ উপকৃত সুন্দরবনের কৃষকরা

বনবিবি, দক্ষিন রায়, গাজি পীর ও ঢাকুরানির মতো চরিত্রদের ঘিরে গড়ে ওঠা পালাগান ছিল সুন্দরবনের মানুষের অন্তরের ভাষা। আগে প্রতিটি গ্রামে, হাটে বা উৎসবে বনবিবি পালার আসর বসত। এই পালা ছিল সমাজে ভ্রাতৃত্ব, ভক্তি ও পরিবেশ সম্পর্কে সচেতনতার বাহক। বহু শিল্পী এই পালা গেয়ে জীবিকা নির্বাহ করতেন। কিন্তু বর্তমানে এই লোকঐতিহ্য হারিয়ে যেতে বসেছে।

আরও পড়ুন: সুন্দরবনের লোকালয়ে বাঘের আগমন আটকাতে নাইলনের বদলে এবার স্টীলের নেট লাগাতে চলেছে বন দফতর

নতুন প্রজন্মের অনেকেই এখন আর বনবিবি পালার সঙ্গে পরিচিত নয়। মোবাইল ফোন, সোশ্যাল মিডিয়া, ডিজিটাল বিনোদনের জোয়ারে রীল বানাতে ডুবে থাকা তরুণ সমাজ এখন লোকসংস্কৃতির প্রতি আগ্রহ হারাচ্ছে। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অনুশীলনের অভাব, শিল্পীদের আর্থিক সংকট এবং সরকারি-বেসরকারি স্তরে উদ্যোগের ঘাটতি। ফলস্বরূপ, বনবিবি পালা আজ শুধুই স্মৃতির ঝাঁপিতে বন্দি।

আরও পড়ুন: বাসের মধ্যে বিজ্ঞান প্রদর্শনীতে আগ্রহ বাড়ছে পড়ুয়াদের সুন্দরবনে

অন্যদিকে, পরিবেশগত দিক থেকেও সুন্দরবন আজ গভীর সংকটে। বসতি সম্প্রসারণ, নদী বাঁধ ও চাষের জন্য ম্যানগ্রোভ বন ধ্বংস করা হচ্ছে অবলীলায়। এর ফলে বাড়ছে নদীভাঙন, ঘূর্ণিঝড়ের তীব্রতা এবং বাঘ-মানুষ সংঘর্ষ। অথচ এই ম্যানগ্রোভ বনই ছিল প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষার প্রাকৃতিক প্রাচীর।

'বিপন্ন সুন্দরবনের ঐতিহ্য' হারিয়ে যাচ্ছে বনবিবি পালা ও ম্যানগ্রোভ বন

এই দুই বিপন্নতা—পরিবেশ ও সংস্কৃতি—পরস্পরের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ম্যানগ্রোভ ধ্বংসের ফলে যেমন জীবিকার ওপর প্রভাব পড়ছে, তেমনই বনবিবি পালার মতো সংস্কৃতি হারালে হারিয়ে যাবে মানুষ ও প্রকৃতির মধ্যকার আত্মিক সম্পর্কের সেতুবন্ধন।

এই পরিস্থিতিতে জরুরি পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। স্থানীয় প্রশাসন, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়, পরিবেশবিদ ও শিক্ষাবিদদের একযোগে কাজ করতে হবে। স্কুল-কলেজে বনবিবি পালার পরিচিতি, লোকশিল্পীদের আর্থিক সহায়তা, ম্যানগ্রোভ রক্ষায় সচেতনতামূলক কর্মসূচি এবং মিডিয়ায় লোকঐতিহ্য প্রচারের মাধ্যমে আবার ফিরিয়ে আনতে হবে সুন্দরবনের প্রকৃত পরিচয়।

সুন্দরবন শুধু একটি ভৌগলিক অঞ্চল নয়, এটি এক বিস্ময়কর সহাবস্থানের নিদর্শন। সেই সহাবস্থান রক্ষা করতে হলে বন যেমন বাঁচাতে হবে, তেমনি বাঁচাতে হবে বনবিবির গানকেও।