১৮ অক্টোবর ২০২৫, শনিবার, ৩১ আশ্বিন ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

হাজী মুহাম্মদ মহসিনের অবদানকে কেন মুছে ফেলা হচ্ছে?

ইমামা খাতুন
  • আপডেট : ১ অগাস্ট ২০২৫, শুক্রবার
  • / 493

আহমদ হাসান : হাজী মুহাম্মদ মহসিন, এই নামটি পশ্চিমবঙ্গ, বাংলাদেশ, অসম, ত্রিপুরায় শিক্ষিত বাঙালি মুসলিমরা জানেন। তিনি আমাদের এই বাংলার কিংবা বলা যায় একজন ‘আইকন’ হয়ে উঠতে পারতেন। কিন্তু লক্ষ্য করা গেছে, নবাবী শাসনের পতনের পর বাংলার ভoবিত্ত সমাজের অনেকেই মুসলিমদের অবদানকে স্বীকৃতি দেননি। তারা অবহেলার অন্ধকারেই রয়ে গেছে।

ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগরের জন্ম ১৮২০ সালে ও মৃত্যু ১৮৯১ সালে। কিন্তু বাঙালি ভদ্রলোক সমাজ তাঁকে নিরক্ষরতা দূরীকরণের ‘আইকন’ হিসেবে গ্রহণ করেছেন। গ্রহণ করেছেন সমাজ সংস্কারক হিসেবে। তিনি বাঙালি হিন্দু সমাজে বিধবা বিবাহ প্রচলনের জন্য যৎপরনাস্তি চেষ্টা করেছিলেন। এছাড়া ইংরেজ কর্মকর্তাদের সঙ্গে তাঁর সুসম্পর্ক থাকায় তিনি সেই সময় ব্রিটিশদের কাছ থেকে হিন্দু সমাজের জন্য বেশকিছু সুবিধা আদায়ে সমর্থ হয়েছিলেন।।

আরও পড়ুন: হাজী মুহাম্মদ মহসিনই অবিভক্ত বাংলায় প্রথম শিক্ষা আন্দোলন শুরু করেন: ইমরান

আর হাজী মুহাম্মদ মহসিনের জন্ম ১৭৩২ সালে। সে সময় বাংলায় চলছে নবাবী শাসন। ১৭৫৭ সালে নবাব সিরাজ-উদ-দৌলাহ-র সঙ্গে ইংরেজ ও তাদের দাসানুদাস এদেশীয় কিছু বশংবদের নামকাবাস্তে সংঘর্ষ হয়। বিশ্বাস ঘাতকতার কারণে তরুণ নবাব সিরাজ পরাজয় বরণ করেন। আর হাজী মুহাম্মদ মহসিন ইন্তেকাল করেন ১৮১২ সালে। কিন্তু হাজী মুহাম্মদ মহসিন তাঁর হাতে যে বিপুল সম্পত্তি ন্যস্ত হয়েছিল, তা মূলত শিক্ষা বিস্তারের কাজে ব্যবহার করেন।

হুগলি মাদ্রাসা , হুগলি মহসিন কলেজ ছাড়াও উভয় বাংলার বিভিন্ন স্থানে তাঁর তৈরি মাদ্রাসা, স্কুল, কলেজ, ছাত্রাবাস, দাতব্য চিকিৎসালয় ইত্যাদি তৈরি হয়েছিল হয় তাঁর অনুদানে নতুবা তাঁর সম্পত্তিতে কিংবা তাঁর অর্থের মাধ্যমে।খুবই দুঃখের  বিষয়, বাঙালি জাতি তাঁকে তাঁর অবদানের স্বীকৃতি থেকেও বঞ্চিত করার চেষ্টা করছে।

সম্প্রতি হুগলি মহসিন কলেজের ল’ সেকশন থেকে মহসিন শব্দটি বাদ দেওয়া হয়েছে। অথচ অতীতে এখান থেকেই বড় বড় আইন বিশেষজ্ঞ, জর্জ ইত্যাদিরা পাশ করেছেন। এক হিসেবে জানা যায়, কলকাতা হাইকোর্টেরই ৮ জন বিচারপতি এই কলেজেরই প্রাক্তনী। কোথাও কোনও অসুবিধা ছিল না। তাও কিন্তু হাজী মুহাম্মদ মহসিন কলেজের ল’ সেকশন থেকে মহসিন নামটি বাদ দেওয়া হয়েছে।

নাম পরিবর্তন নিয়ে জানতে চাওয়া হলে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ ড. শশীনাথ মন্ডল বলেন, ২০০৮ সালে বার কাউন্সিল অফ ইন্ডিয়া নিয়ম করেছে যে, আইন পড়ানো হবে কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব ফ্যাকাল্টির মাধ্যমে বা আইনের পৃথক কলেজে। নয়া নিয়মে সাধারণ কোনও কলেজের সঙ্গে আইন বিভাগ রেখে পঠনপাঠন চলবে না। তাই বাধ্য হয়ে বিধানসভায় রীতিমতো আইন পাশ করে হুগলি মহসিন কলেজ ল’ সেকশনের নয়া নাম রাখা হয়েছে ‘গভর্নমেন্ট সেন্টার অফ লিগ্যাল এডুকেশন’।

জনাব ড. শশীনাথ মন্ডল স্বীকার করেছেন, আমাদের দেশের অর্থাৎ ভারতের আইন পঠনপাঠনের ক্ষেত্রে হাজী মুহাম্মদ মহসীন ল’ সেকশনের নাম ও অবদান রয়েছে। এই কলেজের প্রাক্তন ছাত্র হচ্ছে  আইনজ্ঞ সৈয়দ আমীর আলি। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এই কলেজ থেকে পাশ করে তখনকার দিনের বড় পোস্ট ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হয়েছিলেন। ২০২১ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে গভর্নমেন্ট সেন্টার অফ লিগ্যাল এডুকেশন নাম দিয়েই কাজকর্ম শুরু হয়। বার কাউন্সিল অফ ইন্ডিয়ার নিয়ম মানতে গিয়ে এটা করা হয়েছে বলে বর্তমান ভারপ্রাপ্ত প্রিন্সিপাল ড. শশীনাথ মন্ডল জানিয়েছেন। দেশের প্রথম আইন পড়াশোনা এই হুগলি মহসিন কলেজের ল’ সেকশনেই শুরু হয়েছিল।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ‘মহসিন’ নামটি ল’ সেকশন বা কলেজ থেকে বাদ দেওয়া কি অত্যাবশ্যকীয় ছিল? একজন বিশেষজ্ঞ জানাচ্ছেন, বার কাউন্সিল অফ ইন্ডিয়ার নিয়ম বা রুলস অনুযায়ী সেন্টার অফ লিগ্যাল এডুকেশন কোনও আইন কলেজের নাম ঠিক করতে পারে। বার কাউন্সিলের কোনও ল’ কলেজের নাম রাখার ব্যাপারে কোনও ভূমিকা নেই। গভর্নমেন্ট সেন্টার অফ লিগ্যাল এডুকেশন আগে পরিচিত ছিল ল’ ডিপার্টমেন্ট অফ হুগলি ল’ কলেজ।

শশীনাথ মন্ডল যিনি বর্তমানে হুগলি ল’ কলেজটি পরিচালনা করছেন আগে তিনি বিকাশ ভবনে জয়েন্ট ডিপিআই ছিলেন। তিনি হুগলি মহসিন ল’ কলেজ বা সেকশনের নাম পরিবর্তন করে গভর্নমেন্ট সেন্টার অফ লিগ্যাল এডুকেশন করার জন্য ফাইলটি মুভ করেছিলেন। সেই শশীনাথ মন্ডল অবশ্য এখন বলছেন, হুগলি মহসিন কলেজের গৌরব ও মর্যাদা রক্ষা করার কথা চিন্তা করতে হবে।

এখন বিদ্বজনদের অভিমত হল, গভর্নমেন্ট সেন্টার অফ লিগ্যাল এডুকেশনের সঙ্গে মহসিন নামটি যুক্ত করলে আইনগতভাবে বার কাউন্সিল বাধা দিতে পারে না। কিন্তু ইদানিং মুসলিম আইকনদের নাম উল্লেখ না করার জন্য একটি মহল চেষ্টা চালাচ্ছে। কাজেই হুগলি আইন কলেজ থেকে মহসিন নামটি যুক্ত করার জন্য বিশেষভাবে চেষ্টা না করলে এই মহাত্মার নামটি অবশ্যই মুছে যাবে।

প্রতিবেদক

ইমামা খাতুন

২০২২ সাল থেকে সংবাদ জগতের সঙ্গে যুক্ত। আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাংবাদিকতাতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেছে। ডিজিটাল প্লাটফর্মে রিপোর্টার হিসেবে হাতেখড়ি। ২০২২ সালের শেষান্তে পুবের কলম-এর সঙ্গে যুক্ত হয়। ইমামার ভাষ্যে, The First Law of Journalism: to confirm existing prejudice, rather than contradict it.

Copyright © Puber Kalom All rights reserved.| Developed by eTech Builder

হাজী মুহাম্মদ মহসিনের অবদানকে কেন মুছে ফেলা হচ্ছে?

আপডেট : ১ অগাস্ট ২০২৫, শুক্রবার

আহমদ হাসান : হাজী মুহাম্মদ মহসিন, এই নামটি পশ্চিমবঙ্গ, বাংলাদেশ, অসম, ত্রিপুরায় শিক্ষিত বাঙালি মুসলিমরা জানেন। তিনি আমাদের এই বাংলার কিংবা বলা যায় একজন ‘আইকন’ হয়ে উঠতে পারতেন। কিন্তু লক্ষ্য করা গেছে, নবাবী শাসনের পতনের পর বাংলার ভoবিত্ত সমাজের অনেকেই মুসলিমদের অবদানকে স্বীকৃতি দেননি। তারা অবহেলার অন্ধকারেই রয়ে গেছে।

ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগরের জন্ম ১৮২০ সালে ও মৃত্যু ১৮৯১ সালে। কিন্তু বাঙালি ভদ্রলোক সমাজ তাঁকে নিরক্ষরতা দূরীকরণের ‘আইকন’ হিসেবে গ্রহণ করেছেন। গ্রহণ করেছেন সমাজ সংস্কারক হিসেবে। তিনি বাঙালি হিন্দু সমাজে বিধবা বিবাহ প্রচলনের জন্য যৎপরনাস্তি চেষ্টা করেছিলেন। এছাড়া ইংরেজ কর্মকর্তাদের সঙ্গে তাঁর সুসম্পর্ক থাকায় তিনি সেই সময় ব্রিটিশদের কাছ থেকে হিন্দু সমাজের জন্য বেশকিছু সুবিধা আদায়ে সমর্থ হয়েছিলেন।।

আরও পড়ুন: হাজী মুহাম্মদ মহসিনই অবিভক্ত বাংলায় প্রথম শিক্ষা আন্দোলন শুরু করেন: ইমরান

আর হাজী মুহাম্মদ মহসিনের জন্ম ১৭৩২ সালে। সে সময় বাংলায় চলছে নবাবী শাসন। ১৭৫৭ সালে নবাব সিরাজ-উদ-দৌলাহ-র সঙ্গে ইংরেজ ও তাদের দাসানুদাস এদেশীয় কিছু বশংবদের নামকাবাস্তে সংঘর্ষ হয়। বিশ্বাস ঘাতকতার কারণে তরুণ নবাব সিরাজ পরাজয় বরণ করেন। আর হাজী মুহাম্মদ মহসিন ইন্তেকাল করেন ১৮১২ সালে। কিন্তু হাজী মুহাম্মদ মহসিন তাঁর হাতে যে বিপুল সম্পত্তি ন্যস্ত হয়েছিল, তা মূলত শিক্ষা বিস্তারের কাজে ব্যবহার করেন।

হুগলি মাদ্রাসা , হুগলি মহসিন কলেজ ছাড়াও উভয় বাংলার বিভিন্ন স্থানে তাঁর তৈরি মাদ্রাসা, স্কুল, কলেজ, ছাত্রাবাস, দাতব্য চিকিৎসালয় ইত্যাদি তৈরি হয়েছিল হয় তাঁর অনুদানে নতুবা তাঁর সম্পত্তিতে কিংবা তাঁর অর্থের মাধ্যমে।খুবই দুঃখের  বিষয়, বাঙালি জাতি তাঁকে তাঁর অবদানের স্বীকৃতি থেকেও বঞ্চিত করার চেষ্টা করছে।

সম্প্রতি হুগলি মহসিন কলেজের ল’ সেকশন থেকে মহসিন শব্দটি বাদ দেওয়া হয়েছে। অথচ অতীতে এখান থেকেই বড় বড় আইন বিশেষজ্ঞ, জর্জ ইত্যাদিরা পাশ করেছেন। এক হিসেবে জানা যায়, কলকাতা হাইকোর্টেরই ৮ জন বিচারপতি এই কলেজেরই প্রাক্তনী। কোথাও কোনও অসুবিধা ছিল না। তাও কিন্তু হাজী মুহাম্মদ মহসিন কলেজের ল’ সেকশন থেকে মহসিন নামটি বাদ দেওয়া হয়েছে।

নাম পরিবর্তন নিয়ে জানতে চাওয়া হলে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ ড. শশীনাথ মন্ডল বলেন, ২০০৮ সালে বার কাউন্সিল অফ ইন্ডিয়া নিয়ম করেছে যে, আইন পড়ানো হবে কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব ফ্যাকাল্টির মাধ্যমে বা আইনের পৃথক কলেজে। নয়া নিয়মে সাধারণ কোনও কলেজের সঙ্গে আইন বিভাগ রেখে পঠনপাঠন চলবে না। তাই বাধ্য হয়ে বিধানসভায় রীতিমতো আইন পাশ করে হুগলি মহসিন কলেজ ল’ সেকশনের নয়া নাম রাখা হয়েছে ‘গভর্নমেন্ট সেন্টার অফ লিগ্যাল এডুকেশন’।

জনাব ড. শশীনাথ মন্ডল স্বীকার করেছেন, আমাদের দেশের অর্থাৎ ভারতের আইন পঠনপাঠনের ক্ষেত্রে হাজী মুহাম্মদ মহসীন ল’ সেকশনের নাম ও অবদান রয়েছে। এই কলেজের প্রাক্তন ছাত্র হচ্ছে  আইনজ্ঞ সৈয়দ আমীর আলি। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এই কলেজ থেকে পাশ করে তখনকার দিনের বড় পোস্ট ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হয়েছিলেন। ২০২১ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে গভর্নমেন্ট সেন্টার অফ লিগ্যাল এডুকেশন নাম দিয়েই কাজকর্ম শুরু হয়। বার কাউন্সিল অফ ইন্ডিয়ার নিয়ম মানতে গিয়ে এটা করা হয়েছে বলে বর্তমান ভারপ্রাপ্ত প্রিন্সিপাল ড. শশীনাথ মন্ডল জানিয়েছেন। দেশের প্রথম আইন পড়াশোনা এই হুগলি মহসিন কলেজের ল’ সেকশনেই শুরু হয়েছিল।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ‘মহসিন’ নামটি ল’ সেকশন বা কলেজ থেকে বাদ দেওয়া কি অত্যাবশ্যকীয় ছিল? একজন বিশেষজ্ঞ জানাচ্ছেন, বার কাউন্সিল অফ ইন্ডিয়ার নিয়ম বা রুলস অনুযায়ী সেন্টার অফ লিগ্যাল এডুকেশন কোনও আইন কলেজের নাম ঠিক করতে পারে। বার কাউন্সিলের কোনও ল’ কলেজের নাম রাখার ব্যাপারে কোনও ভূমিকা নেই। গভর্নমেন্ট সেন্টার অফ লিগ্যাল এডুকেশন আগে পরিচিত ছিল ল’ ডিপার্টমেন্ট অফ হুগলি ল’ কলেজ।

শশীনাথ মন্ডল যিনি বর্তমানে হুগলি ল’ কলেজটি পরিচালনা করছেন আগে তিনি বিকাশ ভবনে জয়েন্ট ডিপিআই ছিলেন। তিনি হুগলি মহসিন ল’ কলেজ বা সেকশনের নাম পরিবর্তন করে গভর্নমেন্ট সেন্টার অফ লিগ্যাল এডুকেশন করার জন্য ফাইলটি মুভ করেছিলেন। সেই শশীনাথ মন্ডল অবশ্য এখন বলছেন, হুগলি মহসিন কলেজের গৌরব ও মর্যাদা রক্ষা করার কথা চিন্তা করতে হবে।

এখন বিদ্বজনদের অভিমত হল, গভর্নমেন্ট সেন্টার অফ লিগ্যাল এডুকেশনের সঙ্গে মহসিন নামটি যুক্ত করলে আইনগতভাবে বার কাউন্সিল বাধা দিতে পারে না। কিন্তু ইদানিং মুসলিম আইকনদের নাম উল্লেখ না করার জন্য একটি মহল চেষ্টা চালাচ্ছে। কাজেই হুগলি আইন কলেজ থেকে মহসিন নামটি যুক্ত করার জন্য বিশেষভাবে চেষ্টা না করলে এই মহাত্মার নামটি অবশ্যই মুছে যাবে।