১৩ অগাস্ট ২০২৫, বুধবার, ২৭ শ্রাবণ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
সাংবাদিক সম্মেলনে মত বিশিষ্টদের

বাঙালি পরিযায়ী শ্রমিকদের উপর নির্যাতন বন্ধ করতে আরও সচেষ্ট হতে হবে

মারুফা খাতুন
  • আপডেট : ১৩ অগাস্ট ২০২৫, বুধবার
  • / 38

আবুল খায়ের : দেশের অন্য বেশ কিছু রাজ্যে বাঙালি অভিবাসী শ্রমিকদের বিরুদ্ধে ধারাবাহিক নির্যাতনের বিরুদ্ধে ‘ক্যালকাটা রিসার্চ গ্রুপ’ ও ‘নো ইয়োর নেবার’-এর পক্ষ থেকে মঙ্গলবার কলকাতা প্রেসক্লাবে এক সাংবাদিক সম্মেলনের আয়োজন করা হয়।

এ দিনের এই সাংবাদিক সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন ক্যালকাটা রিসার্চ গ্রুপ-এর প্রফেসর এমিরিটার্স রনবীর সমাদ্দার, রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক তথা ক্যালকাটা রিসার্চ গ্রুপ-এর সভাপতি সব্যসাচী বসু রায়, পশ্চিমবঙ্গ সংখ্যালঘু কমিশনের চেয়ারম্যান তথা পুবের কলম পত্রিকার সম্পাদক আহমদ হাসান ইমরান, নো ইয়োর নেবারের আহ্বায়ক তথা ক্যালকাটা রিসার্চ গ্রুপ-এর সদস্য সাবির আহমেদ, সংস্কৃত কলেজের সহকারী অধ্যাপিকা তথা ক্যালকাটা রিসার্চ গ্রুপ-এর সদস্য সমতা বিশ্বাস।
আহমদ হাসান ইমরান বলেন, বাঙালি পরিযায়ী শ্রমিকদের উপর এই যে আক্রমণ হচ্ছে তা নিয়ে বাঙালি বুদ্ধিজীবী ও সমাজকর্মীদের আরও বেশি সরব হওয়া উচিত।

আরও পড়ুন: অবিলম্বে বাঙালি পরিযায়ীদের নির্যাতন বন্ধ করতে: অধীর চৌধুরী

আজকে পরিযায়ীরা যারা পশ্চিমবঙ্গ থেকে ঘর-পরিবার ছেড়ে ভিন রাজ্যে যাচ্ছেন তা শুরু বামফ্রন্টের আমলেই থেকেই। স্মৃতি চারণা করে তিনি বলেন, উত্তর দিনাজপুরের একটি মাদ্রাসার সম্মেলনে ২০০২ সালে গিয়েছিলেন। সেখানে রাতে যে বাড়িতে তিনি ছিলেন তার গৃহকর্তা বলেছিলেন, তারা সবাই কাশ্মীরে রয়েছে। সেখানে তারা আপেল বাগানের পরিচর্যা ও ধান কাটার কাজ করেন। সেই সময় পশ্চিমবঙ্গে কাজের সুযোগ কম বা বেশি পারিশ্রমিকের কারণে বাইরে যাওয়ার ট্র্যাডিশন গড়ে ওঠে।

আরও পড়ুন: বেকারি শিল্পের সমস্যাগুলিরও সমাধান করা জরুরি : ইমরান

বাঙালি পরিযায়ী শ্রমিকদের উপর নির্যাতন বন্ধ করতে আরও সচেষ্ট হতে হবে

এই যে পরিযায়ী শ্রমিকরা বাইরে যাচ্ছেন তাতে এক দিকে যেমন ভিন রাজ্যেগুলির উন্নয়নে তাঁরা অবদান রাখছেন, অন্যদিকে তাদের মেহনতের টাকায় পশ্চিমবঙ্গের অর্থনীতিও সমৃদ্ধ হচ্ছে। দেখা যাচ্ছে, সেই শ্রমিক বাইরে কাজ করে যে উপার্জন করছে সেই অর্থ দিয়ে পশ্চিমবঙ্গে ঘরবাড়ি তৈরি করছে, ছেলেমেয়েদের স্কুলে পাঠাচ্ছে। তিনি আরও বলেন, অনেকক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে বাড়ির পুরুষ সদস্যরা অষ্টম, নবম শ্রেণি পাস করে বাইরে ভিন রাজ্যে কাজের জন্য চলে যাচ্ছে। কিন্তু মেয়েরা লেখাপড়ে করছে। উচ্চশিক্ষাও লাভ করছে। বিভিন্ন প্রেক্ষাপট উল্লেখ করে পশ্চিমবঙ্গ সংখ্যালঘু কমিশনের চেয়ারম্যান প্রশ্ন তোলেন, বর্তমান সময়ে কেন পরিযায়ী শ্রমিকদের উপর এই নির্যাতন চালানো হচ্ছে? তাদের বাংলাদেশি বলে চিহ্নিত করে দেওয়া হচ্ছে।

তিনি বলেন, সামনেই ভোট আসছে। আর ইদানিং ভোটের সবচেয়ে বড় অস্ত্র হল ঘৃণা, বিদ্বেষ। এটি যদি ব্যাপকভাবে প্রয়োগ করতে পারা যায় তাতে ভোট বাজারে কিছুটা সুবিধা করতে পারা যেতে পারে। এমনকি দেশের প্রধানমন্ত্রীও ভোট আসলেই বিভিন্ন ধরনের মন্তব্য করেন যা বিভেদ সৃষ্টি করে। তবে পরিযায়ী শ্রমিকদের মধ্যে হিন্দু ধর্মালম্বীরাও আছে। তবে ভোটের সময় সরকারের দায়িত্ব শিক্ষা-স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থানে তারা কেমন সাফল্য পেয়েছে তার হিসাব দেওয়া। কিন্তু বর্তমানে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণকেই প্রধান বিষয় হিসেবে ভাবা হচ্ছে। তবে ভারতবর্ষের মানুষ এই বিভেদ সৃষ্টির ফাঁদে পা দেয়নি। সেই কারণেই গত নির্বাচনে বিজেপি প্রত্যাশার মতো ফল করতে পারেনি।

অন্যদিকে নো ইয়োর নেবারের আহ্বায়ক সাবির আহমেদ বলেন, কলকাতা শহর পরিযায়ী শ্রমিকদের ক্ষেত্রে অনেক উদার। দৃষ্টান্ত উল্লেখ করে তিনি বলেন, ওড়িশায় বাঙালি পরিযায়ী শ্রমিকরা নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। অথচ খিদিরিপুর অঞ্চল-সহ বাংলায় এখনও বেশ কিছু ওড়িয়া মাধ্যমের স্কুল চলে। কিন্তু সহিষ্ণুতার যে ইতিহাস ভারতে আছে বর্তমানে তা লঙ্ঘিত হচ্ছে। তিনি বলেন, বাংলায় কথা বলা, বাংলা গান করা বা বাংলার  সংস্কৃতির জন্য হেনস্থার শিকার হতে হবে, এমন ভারত হয়ত আমরা কল্পনাও করিনি। আমাদের রাজ্যের ছেলেরা শখ করে পরিযায়ী শ্রমিক হচ্ছে না।

বাংলার সংখ্যালঘু অধ্যুষিত যেকোন স্কুল বা মাদ্রাসায় গেলেই দেখা যায় ৭০ শতাংশ ছাত্রী, ৩০ শতাংশ ছাত্র। যা থেকে বোঝা যায় ছেলেরা আর্থিক কষ্টের জন্য বাধ্যতামূলক পরিস্থিতিতে পরিযায়ী শ্রমিক হচ্ছে। এর ফলে অন্য যে অধিকার আছে, ‘শিক্ষার অধিকার আইন’ তা লঙ্ঘিত হচ্ছে। সাবির আহমেদ আরও বলেন, আমাদের রাজ্যে অনেক কিছু নিয়ে তথ্য সংগ্রহ করা হলেও, কত পরিযায়ী শ্রমিক ভিন রাজ্যে কাজ করছে তা নিয়ে তেমন কোনও তথ্য নেই। তবে এই তথ্য খুব জরুরি, কোন কোন রাজ্যে পরিযায়ীরা কী কী কাজ করছে তা জানা খুব দরকার। তা না হলে পরিযায়ীদের নিয়ে কোনও পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করা সম্ভব হবে না।
অন্যদিকে গবেষক অধ্যাপক রনবীর সমাদ্দার কেন্দ্রীয় শ্রম দফতরের প্রতিমন্ত্রী মন্তব্যের উল্লেখ করেন। যেখানে মন্ত্রী সংসদে জানিয়েছেন, কোন রাজ্যে কত পরিযায়ী শ্রমিক আছে তা নথিভুক্ত করা রাজ্যের দায়িত্ব। রনবীর সমাদ্দার বলেন, পরিযায়ী শ্রমিকদের নিয়ে একটি আইন আছে কিন্তু বর্তমান সময়ে তা কোনও কাজে লাগছে না। এই প্রশ্নটা আরও বেশি আলোচনা করা দরকার, কেননা এই আইনটা ব্যবহার হচ্ছে না। কোভিড মহামারীর সময়ে এই আইনের কথা উঠলেও তা তেমনভাবে কাজে লাগেনি।

তিনি বলেন, কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নগুলিও এই সময় তাদের যথাযথ ভূমিকা পালন করছে না। তিনি আরও বলেন, আমি নিশ্চিতভাবে বলতে পারি, বর্তমানে পরিযায়ীদের নিয়ে এই বিতর্ক চলছে, তার সংবাদও আর কিছুদিন পরেই সংবাদমাধ্যম থেকে সরে যাবে। দিল্লিতে নির্বাচিত সাংসদের একটি দল বলছেন, নির্বাচনের অধিকার থেকে বিশাল সংখ্যক নাগরিক বাদ চলে যাচ্ছে। বাঙালি নির্যাতন হচ্ছে। আর এই দু’য়ের মাঝে পড়ে শ্রমিকদের অধিকারের কথা উপেক্ষিত থেকে যাচ্ছে।

বাঙালি পরিযায়ী শ্রমিকদের উপর নির্যাতন বন্ধ করতে আরও সচেষ্ট হতে হবে

সংস্কৃত কলেজের সহকারী অধ্যাপিকা তথা ক্যালকাটা রিসার্চ গ্রুপ-এর সদস্য সমতা বিশ্বাস বলেন, পরিযায়ী শ্রমিকদের উপর এই নির্যাতন বর্তমানে হচ্ছে তাই নয়, বেশকিছু বছর ধরেই তা হচ্ছে। তবে এখন তার পরিমাণ ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। সমতা বিশ্বাস পরিযায়ী শ্রমিকদের উপর নির্যাতন ও বঞ্চনা নিয়ে বেশকিছু তথ্য ও পরিসংখ্যান তুলে ধরেন। এ দিনের সাংবাদিক সম্মেলনের শুরুতেই ক্যালকাটা রিসার্চ গ্রুপ-এর সভাপতি সব্যসাচী বসু রায়, কোভিডের সময়ে পরিযায়ী শ্রমিকরা যেভাবে বিপন্নতা বোধ করেছেন, তখন তাদের নিয়ে অনেক কথা হয়েছিল।

কিন্তু তারপরেই বিষয়টি লোকচক্ষুর আড়ালে চলে যায়। তবে পরিযায়ী শ্রমিকদের তথ্য ভাণ্ডার যদি না থাকে, তবে কোনভাবেই তাদের নিরাপত্তা ও সুরক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা করা যাবে না। পাশাপাশি তিনি বলেন, বর্তমানে যে আইনটি আছে সেখানে পরিযায়ী শ্রমিকদের পারিশ্রমিক, বাসস্থান-সহ অনান্য বেশকিছু বিষয় বলা আছে। কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারগুলির কাছে আমাদের দাবি সেই বিষয়গুলিতে নজর দেওয়া হোক। তা কার্যকর করা হলে পরিযায়ীদের অধিকার হয়তো  খানিকটা সুরক্ষিত হবে।

ক্যালকাটা রিসার্চ গ্রুপের তরফ থেকে এ নিয়ে একটি তথ্য-পুস্তিকাও বিতরণ করা হয়। সাংবাদিকদের প্রশ্নোত্তরের সময় পরিযায়ী শ্রমিকদের ভোটাধিকারের কথাও আলোচিত হয়। আহমদ হাসান ইমরান বলেন, বর্তমানে টেকনোলজির দুনিয়ায় এর সমাধান করা বড় কোনও সমস্যা নয়। আমাদের সেনাবাহিনীর জওয়ানরা যেভাবে ভোট দেন সেই পদ্ধতি বিবেচনা করা যেতে পারে। কিছু দেশে অনলাইন ভোট দেওয়ার পদ্ধতিও রয়েছে। কাজেই পরিযায়ী শ্রমিকরা অবশ্যই পঞ্চায়েত থেকে জাতীয় নির্বাচনে ভোট প্রদান করতে পারবে। ইমরান আরও বলেন, অসমে যেভাবে বাংলাভাষীদের উচ্ছেদ করা হচ্ছে, তা নিয়েও সকলকে ভাবতে হবে।

Copyright © Puber Kalom All rights reserved.| Developed by eTech Builder

সাংবাদিক সম্মেলনে মত বিশিষ্টদের

বাঙালি পরিযায়ী শ্রমিকদের উপর নির্যাতন বন্ধ করতে আরও সচেষ্ট হতে হবে

আপডেট : ১৩ অগাস্ট ২০২৫, বুধবার

আবুল খায়ের : দেশের অন্য বেশ কিছু রাজ্যে বাঙালি অভিবাসী শ্রমিকদের বিরুদ্ধে ধারাবাহিক নির্যাতনের বিরুদ্ধে ‘ক্যালকাটা রিসার্চ গ্রুপ’ ও ‘নো ইয়োর নেবার’-এর পক্ষ থেকে মঙ্গলবার কলকাতা প্রেসক্লাবে এক সাংবাদিক সম্মেলনের আয়োজন করা হয়।

এ দিনের এই সাংবাদিক সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন ক্যালকাটা রিসার্চ গ্রুপ-এর প্রফেসর এমিরিটার্স রনবীর সমাদ্দার, রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক তথা ক্যালকাটা রিসার্চ গ্রুপ-এর সভাপতি সব্যসাচী বসু রায়, পশ্চিমবঙ্গ সংখ্যালঘু কমিশনের চেয়ারম্যান তথা পুবের কলম পত্রিকার সম্পাদক আহমদ হাসান ইমরান, নো ইয়োর নেবারের আহ্বায়ক তথা ক্যালকাটা রিসার্চ গ্রুপ-এর সদস্য সাবির আহমেদ, সংস্কৃত কলেজের সহকারী অধ্যাপিকা তথা ক্যালকাটা রিসার্চ গ্রুপ-এর সদস্য সমতা বিশ্বাস।
আহমদ হাসান ইমরান বলেন, বাঙালি পরিযায়ী শ্রমিকদের উপর এই যে আক্রমণ হচ্ছে তা নিয়ে বাঙালি বুদ্ধিজীবী ও সমাজকর্মীদের আরও বেশি সরব হওয়া উচিত।

আরও পড়ুন: অবিলম্বে বাঙালি পরিযায়ীদের নির্যাতন বন্ধ করতে: অধীর চৌধুরী

আজকে পরিযায়ীরা যারা পশ্চিমবঙ্গ থেকে ঘর-পরিবার ছেড়ে ভিন রাজ্যে যাচ্ছেন তা শুরু বামফ্রন্টের আমলেই থেকেই। স্মৃতি চারণা করে তিনি বলেন, উত্তর দিনাজপুরের একটি মাদ্রাসার সম্মেলনে ২০০২ সালে গিয়েছিলেন। সেখানে রাতে যে বাড়িতে তিনি ছিলেন তার গৃহকর্তা বলেছিলেন, তারা সবাই কাশ্মীরে রয়েছে। সেখানে তারা আপেল বাগানের পরিচর্যা ও ধান কাটার কাজ করেন। সেই সময় পশ্চিমবঙ্গে কাজের সুযোগ কম বা বেশি পারিশ্রমিকের কারণে বাইরে যাওয়ার ট্র্যাডিশন গড়ে ওঠে।

আরও পড়ুন: বেকারি শিল্পের সমস্যাগুলিরও সমাধান করা জরুরি : ইমরান

বাঙালি পরিযায়ী শ্রমিকদের উপর নির্যাতন বন্ধ করতে আরও সচেষ্ট হতে হবে

এই যে পরিযায়ী শ্রমিকরা বাইরে যাচ্ছেন তাতে এক দিকে যেমন ভিন রাজ্যেগুলির উন্নয়নে তাঁরা অবদান রাখছেন, অন্যদিকে তাদের মেহনতের টাকায় পশ্চিমবঙ্গের অর্থনীতিও সমৃদ্ধ হচ্ছে। দেখা যাচ্ছে, সেই শ্রমিক বাইরে কাজ করে যে উপার্জন করছে সেই অর্থ দিয়ে পশ্চিমবঙ্গে ঘরবাড়ি তৈরি করছে, ছেলেমেয়েদের স্কুলে পাঠাচ্ছে। তিনি আরও বলেন, অনেকক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে বাড়ির পুরুষ সদস্যরা অষ্টম, নবম শ্রেণি পাস করে বাইরে ভিন রাজ্যে কাজের জন্য চলে যাচ্ছে। কিন্তু মেয়েরা লেখাপড়ে করছে। উচ্চশিক্ষাও লাভ করছে। বিভিন্ন প্রেক্ষাপট উল্লেখ করে পশ্চিমবঙ্গ সংখ্যালঘু কমিশনের চেয়ারম্যান প্রশ্ন তোলেন, বর্তমান সময়ে কেন পরিযায়ী শ্রমিকদের উপর এই নির্যাতন চালানো হচ্ছে? তাদের বাংলাদেশি বলে চিহ্নিত করে দেওয়া হচ্ছে।

তিনি বলেন, সামনেই ভোট আসছে। আর ইদানিং ভোটের সবচেয়ে বড় অস্ত্র হল ঘৃণা, বিদ্বেষ। এটি যদি ব্যাপকভাবে প্রয়োগ করতে পারা যায় তাতে ভোট বাজারে কিছুটা সুবিধা করতে পারা যেতে পারে। এমনকি দেশের প্রধানমন্ত্রীও ভোট আসলেই বিভিন্ন ধরনের মন্তব্য করেন যা বিভেদ সৃষ্টি করে। তবে পরিযায়ী শ্রমিকদের মধ্যে হিন্দু ধর্মালম্বীরাও আছে। তবে ভোটের সময় সরকারের দায়িত্ব শিক্ষা-স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থানে তারা কেমন সাফল্য পেয়েছে তার হিসাব দেওয়া। কিন্তু বর্তমানে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণকেই প্রধান বিষয় হিসেবে ভাবা হচ্ছে। তবে ভারতবর্ষের মানুষ এই বিভেদ সৃষ্টির ফাঁদে পা দেয়নি। সেই কারণেই গত নির্বাচনে বিজেপি প্রত্যাশার মতো ফল করতে পারেনি।

অন্যদিকে নো ইয়োর নেবারের আহ্বায়ক সাবির আহমেদ বলেন, কলকাতা শহর পরিযায়ী শ্রমিকদের ক্ষেত্রে অনেক উদার। দৃষ্টান্ত উল্লেখ করে তিনি বলেন, ওড়িশায় বাঙালি পরিযায়ী শ্রমিকরা নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। অথচ খিদিরিপুর অঞ্চল-সহ বাংলায় এখনও বেশ কিছু ওড়িয়া মাধ্যমের স্কুল চলে। কিন্তু সহিষ্ণুতার যে ইতিহাস ভারতে আছে বর্তমানে তা লঙ্ঘিত হচ্ছে। তিনি বলেন, বাংলায় কথা বলা, বাংলা গান করা বা বাংলার  সংস্কৃতির জন্য হেনস্থার শিকার হতে হবে, এমন ভারত হয়ত আমরা কল্পনাও করিনি। আমাদের রাজ্যের ছেলেরা শখ করে পরিযায়ী শ্রমিক হচ্ছে না।

বাংলার সংখ্যালঘু অধ্যুষিত যেকোন স্কুল বা মাদ্রাসায় গেলেই দেখা যায় ৭০ শতাংশ ছাত্রী, ৩০ শতাংশ ছাত্র। যা থেকে বোঝা যায় ছেলেরা আর্থিক কষ্টের জন্য বাধ্যতামূলক পরিস্থিতিতে পরিযায়ী শ্রমিক হচ্ছে। এর ফলে অন্য যে অধিকার আছে, ‘শিক্ষার অধিকার আইন’ তা লঙ্ঘিত হচ্ছে। সাবির আহমেদ আরও বলেন, আমাদের রাজ্যে অনেক কিছু নিয়ে তথ্য সংগ্রহ করা হলেও, কত পরিযায়ী শ্রমিক ভিন রাজ্যে কাজ করছে তা নিয়ে তেমন কোনও তথ্য নেই। তবে এই তথ্য খুব জরুরি, কোন কোন রাজ্যে পরিযায়ীরা কী কী কাজ করছে তা জানা খুব দরকার। তা না হলে পরিযায়ীদের নিয়ে কোনও পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করা সম্ভব হবে না।
অন্যদিকে গবেষক অধ্যাপক রনবীর সমাদ্দার কেন্দ্রীয় শ্রম দফতরের প্রতিমন্ত্রী মন্তব্যের উল্লেখ করেন। যেখানে মন্ত্রী সংসদে জানিয়েছেন, কোন রাজ্যে কত পরিযায়ী শ্রমিক আছে তা নথিভুক্ত করা রাজ্যের দায়িত্ব। রনবীর সমাদ্দার বলেন, পরিযায়ী শ্রমিকদের নিয়ে একটি আইন আছে কিন্তু বর্তমান সময়ে তা কোনও কাজে লাগছে না। এই প্রশ্নটা আরও বেশি আলোচনা করা দরকার, কেননা এই আইনটা ব্যবহার হচ্ছে না। কোভিড মহামারীর সময়ে এই আইনের কথা উঠলেও তা তেমনভাবে কাজে লাগেনি।

তিনি বলেন, কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নগুলিও এই সময় তাদের যথাযথ ভূমিকা পালন করছে না। তিনি আরও বলেন, আমি নিশ্চিতভাবে বলতে পারি, বর্তমানে পরিযায়ীদের নিয়ে এই বিতর্ক চলছে, তার সংবাদও আর কিছুদিন পরেই সংবাদমাধ্যম থেকে সরে যাবে। দিল্লিতে নির্বাচিত সাংসদের একটি দল বলছেন, নির্বাচনের অধিকার থেকে বিশাল সংখ্যক নাগরিক বাদ চলে যাচ্ছে। বাঙালি নির্যাতন হচ্ছে। আর এই দু’য়ের মাঝে পড়ে শ্রমিকদের অধিকারের কথা উপেক্ষিত থেকে যাচ্ছে।

বাঙালি পরিযায়ী শ্রমিকদের উপর নির্যাতন বন্ধ করতে আরও সচেষ্ট হতে হবে

সংস্কৃত কলেজের সহকারী অধ্যাপিকা তথা ক্যালকাটা রিসার্চ গ্রুপ-এর সদস্য সমতা বিশ্বাস বলেন, পরিযায়ী শ্রমিকদের উপর এই নির্যাতন বর্তমানে হচ্ছে তাই নয়, বেশকিছু বছর ধরেই তা হচ্ছে। তবে এখন তার পরিমাণ ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। সমতা বিশ্বাস পরিযায়ী শ্রমিকদের উপর নির্যাতন ও বঞ্চনা নিয়ে বেশকিছু তথ্য ও পরিসংখ্যান তুলে ধরেন। এ দিনের সাংবাদিক সম্মেলনের শুরুতেই ক্যালকাটা রিসার্চ গ্রুপ-এর সভাপতি সব্যসাচী বসু রায়, কোভিডের সময়ে পরিযায়ী শ্রমিকরা যেভাবে বিপন্নতা বোধ করেছেন, তখন তাদের নিয়ে অনেক কথা হয়েছিল।

কিন্তু তারপরেই বিষয়টি লোকচক্ষুর আড়ালে চলে যায়। তবে পরিযায়ী শ্রমিকদের তথ্য ভাণ্ডার যদি না থাকে, তবে কোনভাবেই তাদের নিরাপত্তা ও সুরক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা করা যাবে না। পাশাপাশি তিনি বলেন, বর্তমানে যে আইনটি আছে সেখানে পরিযায়ী শ্রমিকদের পারিশ্রমিক, বাসস্থান-সহ অনান্য বেশকিছু বিষয় বলা আছে। কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারগুলির কাছে আমাদের দাবি সেই বিষয়গুলিতে নজর দেওয়া হোক। তা কার্যকর করা হলে পরিযায়ীদের অধিকার হয়তো  খানিকটা সুরক্ষিত হবে।

ক্যালকাটা রিসার্চ গ্রুপের তরফ থেকে এ নিয়ে একটি তথ্য-পুস্তিকাও বিতরণ করা হয়। সাংবাদিকদের প্রশ্নোত্তরের সময় পরিযায়ী শ্রমিকদের ভোটাধিকারের কথাও আলোচিত হয়। আহমদ হাসান ইমরান বলেন, বর্তমানে টেকনোলজির দুনিয়ায় এর সমাধান করা বড় কোনও সমস্যা নয়। আমাদের সেনাবাহিনীর জওয়ানরা যেভাবে ভোট দেন সেই পদ্ধতি বিবেচনা করা যেতে পারে। কিছু দেশে অনলাইন ভোট দেওয়ার পদ্ধতিও রয়েছে। কাজেই পরিযায়ী শ্রমিকরা অবশ্যই পঞ্চায়েত থেকে জাতীয় নির্বাচনে ভোট প্রদান করতে পারবে। ইমরান আরও বলেন, অসমে যেভাবে বাংলাভাষীদের উচ্ছেদ করা হচ্ছে, তা নিয়েও সকলকে ভাবতে হবে।