পঞ্চায়েতে জিতলেই টাকা,তাই এত মারামারি ‘ ব্যালট মামলায় প্রশ্ন বিচারপতি অমৃতা সিনহার

- আপডেট : ১৩ জুলাই ২০২৩, বৃহস্পতিবার
- / 15
পারিজাত মোল্লা: বৃহস্পতিবার কলকাতা হাইকোর্টের সিঙ্গেল বেঞ্চের বিচারপতি অমৃতা সিনহার এজলাসে ব্যালট পেপার রাস্তায় পড়ে থাকা মামলার শুনানি চলে। এদিন মামলার শুনানি পর্বে বিচারপতি প্রশ্ন করেন সংশ্লিষ্ট বিডিও কে -‘ব্যালট কীভাবে রাস্তায় গেল?’ বিচারপতির প্রশ্নের উত্তরে বিডিও জানান, ‘আমার দায়িত্ব ছিল না।’ এরপর ভিডিয়ো ফুটজ দেখতে চাইলেন বিচারপতি। সেটাও নেই কমিশনের কাছে!
হুগলির জাঙ্গিপাড়ার ঘটনা নিয়ে যে মামলা হয়েছিল, তার শুনানিতে রাজ্য নির্বাচন কমিশনকে কড়া ভর্ত্সনা করলেন বিচারপতি অমৃতা সিনহা। ‘পঞ্চায়েতে জিতলেই টাকা। তাই এত দৌড়াদৌড়ি-মারামারি-ভাঙচুর’।
বৃহস্পতিবার জাঙ্গিপাড়া ব্যালট মামলার শুনানিতে এমনই মন্তব্য করলেন কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি অমৃতা সিনহা। পাশাপাশি জাঙ্গিপাড়ার রিটার্নিং অফিসারের হলফনামাও তলব করা হয়েছে। গণনাকেন্দ্রের বাইরে থেকে উদ্ধার হওয়া ব্যালট নিয়ে হলফনামায় নিজের অবস্থান জানাতে হবে ওই রিটার্নিং অফিসারকে।’
কিভাবে ব্যালট পেপার বাইরে এল? কেন এত অভিযোগ সামনে আসছে? কোথায় কমিশনের স্বচ্ছতা? ‘ এমনই সব প্রশ্ন তুললেন বিচারপতি।
এই মামলায় রাজ্য নির্বাচন কমিশনকে হলফনামা জমা দেওয়ার নির্দেশও দিয়েছেন বিচারপতি।অভিযোগ রয়েছে , -‘ পঞ্চায়েত নির্বাচনের গণনার দিন রাস্তায় পড়েছিল কয়েকশো ব্যালট পেপার। সিপিএমে ভোট পড়া সেই সব ব্যালটে ছিল রিটার্নিং অফিসারের সই’।
গত বুধবার সেই সব ব্যালট পেপার পেশ করা হয় বিচারপতি অমৃতা সিনহার এজলাসে। এরপরই রিটার্নিং অফিসার এবং বিডিও-কে হাজিরার নির্দেশ দেন তিনি। বৃহস্পতিবার হাজিরা দেন তাঁরা। এদিন কলকাতা হাইকোর্টের সিঙ্গেল বেঞ্চে মামলাকারীদের অন্যতম আইনজীবী বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য জানান, -‘ একটা বা দুটো নয়, শয়ে শয়ে ব্যালট পেপার পড়েছিল রাস্তায়’।বিচারপতি রিটার্নিং অফিসারকে প্রশ্ন করেন, “কীভাবে বাইরে এল ব্যালট পেপার? আপনি এগুলো দেখেছেন? কাকে এগুলো ইস্যু করেছিলেন আপনি? প্রিসাইডিং অফিসারের সই আছে?” রিটার্নিং অফিসার উত্তরে জানান, -‘প্রিসাইডিং অফিসারকে দেওয়া হয়েছিল ব্যালটগুলি। তাঁর মাধ্যমে সেগুলি পোলিং স্টেশনের বাইরে যেতে পারে’। এরপর বিচারপতি জানতে চান, -‘ রিটার্নিং অফিসারের কি কোনও দায়িত্ব নেই’? ওই বুথে কোনও ভয়ের পরিবেশ ছিল কি না? সেটাও জানতে চান বিচারপতি। রিটার্নিং অফিসার জানান, -‘তেমন কোনও পরিবেশ ছিল না’। প্রিসাইডিং অফিসারের নাম সহ সব তথ্য জানতে চান বিচারপতি। সিসিটিভি ফুটেজও দেখতে চান তিনি।
মামলাকারীর আইনজীবী বিকাশ ভট্টাচার্যের দাবি, -‘গণনার দিন এই ঘটনা ঘটে। কমিশনের কাছে অভিযোগ জমা দিয়েও কোনও লাভ হয়নি’। গণনার সময় কোনও বিরোধী দলের এজেন্ট ছিলেন কি না? কখন গণনা শুরু হয়েছিল? প্রার্থীদের এজেন্টরা কখন ঢুকেছিলেন’? সে সব তথ্যও রিটার্নিং অফিসারের কাছে জানতে চান বিচারপতির। এই অভিযোগে কী ব্যবস্থাই বা নেওয়া হল?
এদিন কলকাতা হাইকোর্টের সিঙ্গেল বেঞ্চে রাজ্য নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে, -‘ ১০০০ ব্যালট পেপারের মধ্যে ৪০০ ব্যালট ব্যবহার করা হয়নি। সেগুলির মধ্যেই কিছু বাইরে দিয়ে থাকতে পারে’। কমিশনের তরফে জানানো হয়েছে, -‘ এ বিষয়ে কোনও অভিযোগ দায়ের করা হয়নি। মৌখিক বক্তব্যে আইন অনুমতি দেয় না’।
কমিশনের এই প্রসঙ্গে আইনজীবী বিকাশ ভট্টাচার্য দাবি করেন, -‘ ব্যালট পেপার রাস্তায় যেভাবে রাস্তায় পড়েছিল, সে ক্ষেত্রে অভিযোগ করার দরকার হয় না। কমিশন ব্যবস্থা না নিলে আদালতের হস্তক্ষেপ চাওয়া যেতে পারে’। এই মামলায় বিচারপতির পর্যবেক্ষণ, -‘ মৃত্যুর ঘটনা যে ঘটেছে সেটা অস্বীকার করতে পারবে না কমিশন’।
একজন প্রার্থী ৫ বছর ধরে কাজ করার পর তাঁকে জিততে এইভাবে কেন অশান্তি পাকাতে হবে, সেই প্রশ্নও তুলেছেন তিনি। বিচারপতির কথায়, -‘ ক্ষমতা দখলের জন্যই এই ধরনের ঘটনা ঘটেছে’।
রাজ্য নির্বাচন কমিশনের আইনজীবী কিশোর দত্ত সওয়াল করতে শুরু করলে মাঝপথেই এদিন তাঁকে থামিয়ে দেন বিচারপতি।
কমিশনকে বিচারপতি সিনহা বলেন, -‘ আপনাদের অফিসার বলছেন যে ব্যালট রাস্তায় পড়েছিল। সেগুলোতে তাঁদের সইও ছিল। তারপরও কেন অস্বীকার করতে চাইছে কমিশন? আদালত অনেক ধৈর্য ধরেছে। ব্যালট পেপার বাইরে! কোথায় নির্বাচনের স্বচ্ছতা?’
এদিন ভিডিয়ো ফুটেজ এবং সিসিটিভি ফুটেজ জমা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে রিটার্নিং অফিসারকে। বুথের ভিতরের ফুটেজ রেজিষ্ট্রার জেনারেলের কাছে জমা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
আগামী ২৬ জুলাই এই মামলার পরবর্তী শুনানি রয়েছে। হাইকোর্টের বিশেষজ্ঞ কমিটি এবং রেজিস্টার জেনারেলের বিশেষজ্ঞ টিম পুরো ভিডিয়ে খতিয়ে দেখে রিপোর্ট জমা দেবে।
আগামী ২০ জুলাইয়ের মধ্যে ওই অফিসারকে হলফনামা দিতে হবে বলে নির্দেশ দিয়েছে আদালত। মামলার পরবর্তী শুনানি ২৬ জুলাই। একইসঙ্গে গণনাকেন্দ্রের সিসিটিভি ফুটেজ হাইকোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেলের কাছে জমা থাকবে বলেও নির্দেশ দেন বিচারপতি।
এদিন বিচারপতি অমৃতা সিনহা রিটার্নিং অফিসারের কাছে জানতে চান, -‘প্রিসাইডিং অফিসারকে ইস্যু করা ব্যালট বাইরে এল কী করে’? এগুলি যে অপব্যবহার করা হয়নি? বা হবে না সেটা নিশ্চিত কে করবেন? ব্যালট পেপার যদি রাস্তায় গড়াগড়ি খায়, তবে আর নির্বাচনের স্বচ্ছতা থাকে কোথায়?’
রিটার্নিং অফিসার জানান, -‘এই ব্যালটগুলি আসল এবং প্রিসাইডিং অফিসারের নামে ইস্যু করা হয়েছিল। একবার ইস্যু করা হয় গেলে ব্যালটের দায়িত্ব প্রিসাইডিং অফিসারের।
এরপর বিচারপতি প্রশ্ন, তার মানে আপনার কোনও দায়িত্ব থাকে না? উত্তরে রিটার্নিং অফিসার বলেন, না, আমার দায়িত্বে ২১০টি পোলিং পার্টি ছিল। কোথাও কোনও অশান্তি হলে আমার কাজ জেলাশাসককে জানানো।
বিচারপতির প্রশ্ন, আপনার কাছে কোনও অশান্তির খবর এসেছিল? উত্তরে রিটার্নিং অফিসার জানান, না ।
এরপরই বিচারপতি অমৃতা সিনহার নির্দেশ, -‘প্রিসাইডিং অফিসারকে কোথায় পাওয়া যাবে, তাঁর নাম, ঠিকানা জমা দিন’।