মুসলিম ঐতিহ্যে আঘাত, বদলে ফেলা হল ঔরঙ্গাবাদ রেল স্টেশনের নাম
- আপডেট : ২৭ অক্টোবর ২০২৫, সোমবার
- / 69
পুবের কলম, মুম্বাই: ফের নাম পরিবর্তন করে ইতিহাস মুছে ফেলার চেষ্টা গেরুয়া শিবিরের। এবার ঔরঙ্গাবাদ রেলওয়ে স্টেশনের নাম পরিবর্তন করে ইতিহাস মুছে ফেলল কেন্দ্রের মোদি সরকার। ঐতিহাসিক স্টেশনটির নতুন নাম রাখা হয়েছে ‘ছত্রপতি সম্ভাজি নগর রেলওয়ে স্টেশন’। ইতিমধ্যে নাম পরিবর্তন করে নতুন নাম নিয়ে সরকারিভাবে বিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়েছে। কেন্দ্রের এই পদক্ষেপ তীব্র সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। অনেকের বক্তব্য, নাম পরিবর্তন আসলেই ভারতের ঐতিহাসিক দৃশ্যপট পরিবর্তন করার বৃহত্তর প্রচেষ্টার অংশ।
নিজাম যুগে ১৯০০ সালে স্টেশনটি নির্মিত হয়। উল্লেখযোগ্য ঐতিহাসিক মূল্য বহন করে আসছে স্টেশনটি। ওই সময়কালের ঐতিহ্যবাহী স্থাপত্যের একটি ঔরঙ্গাবাদ স্টেশন। ঐতিহাসিক এবং স্থানীয়রা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, যে নাম পরিবর্তন ভারতের ইতিহাস এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে মুসলমানদের অবদানকে মুছে ফেলবে। সূত্রের খবর, এদিন সরকারি বিজ্ঞপ্তিতে আনুষ্ঠানিকভাবে ভবনটির নাম রাখা হয়েছে ছত্রপতি সম্ভাজি নগর রেলওয়ে স্টেশন। হায়দরাবাদের শেষ নিজাম মীর ওসমান আলি খানের রাজত্বকালে নির্মিত শতাব্দী প্রাচীন স্টেশনটি এখন থেকে নতুন কোড ‘সিপিএসএন’-এর অধীনে পরিচালিত হবে। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, যে রেলের সমস্ত যোগাযোগ এবং সাইনেজ এখন থেকে নতুন নাম বহন করবে। ঔরঙ্গাবাদের ইতিহাসবিদ আব্দুল কাদির বলেন, “এটি কেবল নাম পরিবর্তন নয়, এটি আখ্যানের পরিবর্তন।” কাদিরের বক্তব্য, “তারা ভারতের উন্নয়নে মুসলিমদের অবদানের প্রতিটি চিহ্ন মুছে ফেলতে চায়। মুঘল সম্রাট ঔরঙ্গজেবের নামে ঔরঙ্গাবাদের নামকরণ করা হয়েছিল। কিন্তু এর ইতিহাস একজন শাসকের ঊর্ধ্বে অনেক বেশি। এটি ভারতের যৌগিক সংস্কৃতির অংশ।”
সতেরো শতাব্দীতে মুঘল গভর্নর মালিক আম্বর দ্বারা প্রতিষ্ঠিত ঔরঙ্গাবাদ বাণিজ্য, স্থাপত্য এবং শিক্ষার কেন্দ্র হিসাবে বিকশিত হয়েছিল। শহরটির নামটির সমৃদ্ধ ইসলামিক অতীতের প্রতীক। নিজাম আমলে, দাক্ষিণাত্যকে ভারতের বাকি অংশের সাথে সংযুক্ত করার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ রেলওয়ে কেন্দ্র হয়ে ওঠে। ঔরঙ্গাবাদ রেলওয়ে স্টেশন সেই ইতিহাসের ধ্বংসাবশেষ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এর স্থাপত্য এবং বিন্যাস হায়দারাবাদের আধুনিকীকরণের জন্য নিজামের দৃষ্টিভঙ্গির ছাপ বহন করে। অবসরপ্রাপ্ত রেলওয়ে ইঞ্জিনিয়ার সাঈদ আহমেদ বলেন, ‘এই রেলওয়ে স্টেশনটি একটি ভবনের চেয়েও বেশি কিছু। ঐতিহাসিক স্টেশনের নামটি পরিবর্তন করা মানেই ইতিহাস থেকে আসল তথ্য মুছে ফেলা।”
প্রসঙ্গত, কয়েক দশক আগে শিবসেনার প্রতিষ্ঠাতা বাল ঠাকরে ঔরঙ্গাবাদের নাম পরিবর্তন করে ছত্রপতি সম্ভাজি নগর করার দাবি তুলেছিলেন। তবে এর সাম্প্রদায়িক অভিব্যক্তির কারণে বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছিল। একনাথ শিন্ডের নেতৃত্বাধীন সরকার অবশেষে বিজেপির সাথে জোট বেঁধে এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করে। সমালোচকরা বলছেন, যে হিন্দু ভোট সংহত করার জন্য ঐতিহাসিক সংশোধনবাদ ব্যবহার করছে। সমাজকর্মী আসিফ খান বলেন, ‘যখনই নির্বাচন আসে, বিজেপি নাম বদলের রাজনীতি শুরু করে। মুসলিম ঐতিহ্যবাহী নাম এবং ইতিহাস মুছে ফেলতে তারা সবসময় চেষ্টা চালিয়ে যায়। মুসলমানদের নিজ দেশে বহিরাগত হিসেবে তুলে ধরতে বৃহত্তরভাবে চক্রান্ত করে যাচ্ছে তারা। দেশে বেকারত্ব বা মুদ্রাস্ফীতি মোকাবিলায় তাদের কোনও পদক্ষেপ নেই। শুধু তারা মুসলিমদের কিভাবে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক করা যায় তা নিয়ে ফন্দি তৈরি করে।”
গেরুয়া শিবিরের নাম বদলের রাজনীতি নতুন নয়। সাম্প্রতিক বছরগুলিতে বেশ কয়েকটি শহর এবং মুসলিম সম্পর্কিত নাম সহ ল্যান্ডমার্ক পরিবর্তন করা হয়েছে। এলাহাবাদের নাম পরিবর্তন করে হয়েছে প্রয়াগরাজ, ফৈজাবাদ হয়েছে অযোধ্যা। এবার ঔরঙ্গাবাদের বদলে করা হল ছত্রপতি সম্ভাজি নগর। অনেকের আশঙ্কা, মুসলিম শাসকদের দ্বারা গঠিত আরেকটি ঐতিহাসিক শহর হায়দরাবাদও শীঘ্রই নাম বদলের মুখে পড়তে পারে। তবে ওই শহরের বাসিন্দা আবদুল কাদির সাফ জানালেন, “আপনি নাম পরিবর্তন করতে পারেন, কিন্তু আপনি কোনওদিনই ইতিহাস মুছে ফেলতে পারবে না।” এই ধরনের পদক্ষেপগুলি ভারতের বহুত্ববাদী ইতিহাসকে বিকৃত করে বলে মন্তব্য করেছেন শিক্ষাবিদরা। মৌলানা আজাদ কলেজের ইতিহাসের অধ্যাপক ড. ফারজানা বেগম বলেন, “ভারতের শক্তিই হল বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য। আমরা যখন মুসলিমদের অবদান মুছে ফেলছি, তখন আমরা হিন্দুদের গর্ব রক্ষা করছি না, ভারতের অভিন্ন পরিচয়কে ক্ষুণ্ন করছি।”






























