০২ ডিসেম্বর ২০২৫, মঙ্গলবার, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

বাবা মারা গেলেন, ভাই জেলে পুড়িয়ে দেওয়া হল দোকান – দিল্লি দাঙ্গায় বিধ্বস্ত এক মুসলিম পরিবার

অর্পিতা লাহিড়ী
  • আপডেট : ১৬ ডিসেম্বর ২০২১, বৃহস্পতিবার
  • / 265

শাহনওয়াজের জামিনের অপেক্ষায় দিন গুণছেন আম্মা

 

পুবের কলম ওয়েবডেস্কঃ ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের শেষের দিকে উত্তেজিত ভিড় যখন ৩০ বছর বয়স্ক  শাহনওয়াজ আনসারির খোঁজে তার দোকানে হানা দিল– তখন নিজেকে বাঁচাতে সে দোকানের কোণে লুকোনোর চেষ্টা করেছিল। কিন্তু লোহার রড– লাঠি এবং মলোটেড ককটেল হাতে দাঙ্গাবাজরা দোকান ভেঙে তাঁকে টেনে-হিঁচড়ে বার করে বেদম প্রহার করল। শাহনওয়াজ দাঙ্গাবাজদের মধ্যে অনেককেই চিনত। সে হাতজোড় করে তাকে ছেড়ে দেওয়ার কাতর মিনতি জানিয়েছিল। দাঙ্গাবাজরা তাকে ছেড়ে দিয়েছিল বলে জানালেন শাহজেব আনসারি।

আরও পড়ুন: শারজিল ইমাম ও উমর খালিদদের জামিন মামলার শুনানি সোমবার

 

আরও পড়ুন: Delhi riots: ১৯ সেপ্টেম্বর উমর খালিদ, শারজিল ইমাম ও গুলফিশারদের জামিনের আবেদন শুনবে সুপ্রিম কোর্ট

কিন্তু শাহনওয়াজকে ছেড়ে দিলেও যাওয়ার সময় শাহনওয়াজ এবং তার পিতা মুহাম্মদ রশিদের দোকান-সহ গোটা বাজারে আগুন লাগিয়ে দিয়ে গেল। ঘটনাটি ঘটেছিল দিল্লির দাঙ্গার সময় উত্তর-পূর্ব দিল্লির শিববিহার অঞ্চলে। এই দাঙ্গায় মারা গিয়েছিলেন ৫০-এর বেশি মানুষ– যাদের অধিকাংশই ছিলেন মুসলিম সম্প্রদায়ের। দাঙ্গার এক সপ্তাহ পরে শাহনওয়াজের বাড়িতে পুলিশ হানা দিয়ে তাকে তুলে নিয়ে যায়। তিনদিন পরে শাহজেব এবং রশিদ থানায় যান শাহনওয়াজের খোঁজে। তাদের পুলিশ জানায় যে– শাহনওয়াজকে খুন– দাঙ্গা এবং অগ্নিসংযোগের ঘটনায় গ্রেফতার করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে আনা হয়েছে একডজনের বেশি অভিযোগ। তার ভাই জানায়– শাহনওয়াজের স্বীকারোক্তি নিতে পুলিশ তাকে বেদম পিটিয়েছে। তাকে দিয়ে সাদা কাগজে সইও করিয়ে নিয়েছে পুলিশ। সমাজকর্মীরা দাঙ্গার পর অভিযোগ করেছিলেন হিংসার ঘটনায় যারা জড়িত তাদের পুলিশ গ্রেফতার না করে যারা হিংসার শিকার তাদের গ্রেফতার করেছে পুলিশ। দাঙ্গাবাজরা ব্যাপক হারে হিংসা চালিয়ে মুসলিমদের বাড়ি-ঘর– দোকান– মসজিদ ধ্বংস করেছে। দোকান পুড়ে যাওয়ার পরেও শাহনওয়াজের উপর পুলিশি অত্যাচারের ফলে ভেঙে পড়েছিলেন তার বাবা। ২০২০ সালের জুন মাসে অবশেষে হার্ট অ্যাটাকে মারা যান তার বাবা বলে জানিয়েছেন শাহজেব। তাদের পরিবার উত্তরপ্রদেশের বদায়ুন থেকে দিল্লিতে এসে বসবাস শুরু করেছিলেন ২০০০ সালে। বাবা মারা যাওয়ার পরে গোটা পরিবারের ভরণপোষণের দায়িত্ব এসে পড়ে শাহজেবের উপর। কারণ তার বড় ভাই শাহনওয়াজ তখন জেলে। তাদের পরিবার বলতে মা– তিন বোন এবং সে নিজে। শাহজেবের ঝোঁক ছিল পড়াশোনার দিকে কিন্তু সংসারের বোঝা একা টানতে গিয়ে বাধ্য হয়ে পড়াশোনা তাকে ছাড়তে হয়। পুড়ে যাওয়া দোকানকে মেরামত করিয়ে সেখানে আবার ব্যবসা শুরু করার চেষ্টা করেছিল শাহজেব। কিন্তু বাড়ির মালিক দোকানের চাবি দিতে অস্বীকার করে।

আরও পড়ুন: দিল্লি দাঙ্গা: উমর খালিদের বিরুদ্ধে মামলা ইচ্ছাকৃতভাবে তৈরি, সওয়াল আইনজীবীর

দাঙ্গার আগে বেশ সুখী পরিবার ছিল শাহজেবদের। কিন্তু এখন খেয়ে পরে বেঁচে থাকাটাই সমস্যা হয়ে ওঠে। শাহনওয়াজের বন্ধুদের কাছ থেকে সাহায্য নিয়ে কোনওভাবে জীবন কাটাতে শুরু করে শাহজেবের পরিবার। একটি বাক্সের কারখানায় ৮০০০ টাকার মাইনের একটি চাকরি জোগাড় করে শাহজেব। কিন্তু এক বছরের মধ্যে সেই চাকরিও হাতছাড়া হয় শাহজেবের। কারণ ভাইয়ের মুক্তির জন্য আইনি লড়াইয়ে বারবার তাকে ছুটতে হত উকিল– থানা– আদালতে। তাই প্রায়শই কাজে কামাই করতে হত তাকে। শাহনজেব জানায়– পুলিশ তাকে বলেছে তার ভাই শাহনওয়াজের বিরুদ্ধে কোনও প্রমাণ নেই।

কিন্তু তবুও আদালত তাকে জামিনে মুক্তি দিচ্ছে না। শাহনওয়াজের হয়ে মামলা লড়ছেন জমিয়তে উলেমার সঙ্গে সংযুক্ত আইনজীবী জেড বাবর চৌহান। বাবর জানিয়েছেন– কিছু মামলায় শাহনওয়াজের জামিন হলেও অন্য মামলাগুলিতে তার জামিন এখনও মঞ্জুর করেনি আদালত। আমরা হাইকোর্টে আবেদন জানিয়েছি।

আশা করি– সব মামলায় শাহনওয়াজের জামিন হয়ে যাবে। শাহনওয়াজ পুরোপুরি নির্দোষ বলে মন্তব্য করেছেন আইনজীবী বাবর চৌহান। শাহনওয়াজের পরিবার জমিয়তের প্রতি কৃতজ্ঞ কারণ তারা সাহায্যের হাত না বাড়িয়ে দিলে শাহনওয়াজের মামলা লড়াও সম্ভব হত না এই পরিবারের। আমরা আমাদের বাড়িও বিক্রি করতে যাচ্ছিলাম কিন্তু সময়মতো জমিয়ত আমাদের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিল। আইনজীবী আমাদের কাছ থেকে ফি বাবদ একটি পয়সাও নেননি। শাহজেব একটি কম্পিউটার কোর্সে ভর্তি হয়েছে। কোনও এক সজ্জন ব্যক্তি তাকে একটি চাকরির প্রতিশ্রিুতি দিয়েছেন।

 

 

Copyright © Puber Kalom All rights reserved.| Developed by eTech Builder

বাবা মারা গেলেন, ভাই জেলে পুড়িয়ে দেওয়া হল দোকান – দিল্লি দাঙ্গায় বিধ্বস্ত এক মুসলিম পরিবার

আপডেট : ১৬ ডিসেম্বর ২০২১, বৃহস্পতিবার

 

পুবের কলম ওয়েবডেস্কঃ ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের শেষের দিকে উত্তেজিত ভিড় যখন ৩০ বছর বয়স্ক  শাহনওয়াজ আনসারির খোঁজে তার দোকানে হানা দিল– তখন নিজেকে বাঁচাতে সে দোকানের কোণে লুকোনোর চেষ্টা করেছিল। কিন্তু লোহার রড– লাঠি এবং মলোটেড ককটেল হাতে দাঙ্গাবাজরা দোকান ভেঙে তাঁকে টেনে-হিঁচড়ে বার করে বেদম প্রহার করল। শাহনওয়াজ দাঙ্গাবাজদের মধ্যে অনেককেই চিনত। সে হাতজোড় করে তাকে ছেড়ে দেওয়ার কাতর মিনতি জানিয়েছিল। দাঙ্গাবাজরা তাকে ছেড়ে দিয়েছিল বলে জানালেন শাহজেব আনসারি।

আরও পড়ুন: শারজিল ইমাম ও উমর খালিদদের জামিন মামলার শুনানি সোমবার

 

আরও পড়ুন: Delhi riots: ১৯ সেপ্টেম্বর উমর খালিদ, শারজিল ইমাম ও গুলফিশারদের জামিনের আবেদন শুনবে সুপ্রিম কোর্ট

কিন্তু শাহনওয়াজকে ছেড়ে দিলেও যাওয়ার সময় শাহনওয়াজ এবং তার পিতা মুহাম্মদ রশিদের দোকান-সহ গোটা বাজারে আগুন লাগিয়ে দিয়ে গেল। ঘটনাটি ঘটেছিল দিল্লির দাঙ্গার সময় উত্তর-পূর্ব দিল্লির শিববিহার অঞ্চলে। এই দাঙ্গায় মারা গিয়েছিলেন ৫০-এর বেশি মানুষ– যাদের অধিকাংশই ছিলেন মুসলিম সম্প্রদায়ের। দাঙ্গার এক সপ্তাহ পরে শাহনওয়াজের বাড়িতে পুলিশ হানা দিয়ে তাকে তুলে নিয়ে যায়। তিনদিন পরে শাহজেব এবং রশিদ থানায় যান শাহনওয়াজের খোঁজে। তাদের পুলিশ জানায় যে– শাহনওয়াজকে খুন– দাঙ্গা এবং অগ্নিসংযোগের ঘটনায় গ্রেফতার করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে আনা হয়েছে একডজনের বেশি অভিযোগ। তার ভাই জানায়– শাহনওয়াজের স্বীকারোক্তি নিতে পুলিশ তাকে বেদম পিটিয়েছে। তাকে দিয়ে সাদা কাগজে সইও করিয়ে নিয়েছে পুলিশ। সমাজকর্মীরা দাঙ্গার পর অভিযোগ করেছিলেন হিংসার ঘটনায় যারা জড়িত তাদের পুলিশ গ্রেফতার না করে যারা হিংসার শিকার তাদের গ্রেফতার করেছে পুলিশ। দাঙ্গাবাজরা ব্যাপক হারে হিংসা চালিয়ে মুসলিমদের বাড়ি-ঘর– দোকান– মসজিদ ধ্বংস করেছে। দোকান পুড়ে যাওয়ার পরেও শাহনওয়াজের উপর পুলিশি অত্যাচারের ফলে ভেঙে পড়েছিলেন তার বাবা। ২০২০ সালের জুন মাসে অবশেষে হার্ট অ্যাটাকে মারা যান তার বাবা বলে জানিয়েছেন শাহজেব। তাদের পরিবার উত্তরপ্রদেশের বদায়ুন থেকে দিল্লিতে এসে বসবাস শুরু করেছিলেন ২০০০ সালে। বাবা মারা যাওয়ার পরে গোটা পরিবারের ভরণপোষণের দায়িত্ব এসে পড়ে শাহজেবের উপর। কারণ তার বড় ভাই শাহনওয়াজ তখন জেলে। তাদের পরিবার বলতে মা– তিন বোন এবং সে নিজে। শাহজেবের ঝোঁক ছিল পড়াশোনার দিকে কিন্তু সংসারের বোঝা একা টানতে গিয়ে বাধ্য হয়ে পড়াশোনা তাকে ছাড়তে হয়। পুড়ে যাওয়া দোকানকে মেরামত করিয়ে সেখানে আবার ব্যবসা শুরু করার চেষ্টা করেছিল শাহজেব। কিন্তু বাড়ির মালিক দোকানের চাবি দিতে অস্বীকার করে।

আরও পড়ুন: দিল্লি দাঙ্গা: উমর খালিদের বিরুদ্ধে মামলা ইচ্ছাকৃতভাবে তৈরি, সওয়াল আইনজীবীর

দাঙ্গার আগে বেশ সুখী পরিবার ছিল শাহজেবদের। কিন্তু এখন খেয়ে পরে বেঁচে থাকাটাই সমস্যা হয়ে ওঠে। শাহনওয়াজের বন্ধুদের কাছ থেকে সাহায্য নিয়ে কোনওভাবে জীবন কাটাতে শুরু করে শাহজেবের পরিবার। একটি বাক্সের কারখানায় ৮০০০ টাকার মাইনের একটি চাকরি জোগাড় করে শাহজেব। কিন্তু এক বছরের মধ্যে সেই চাকরিও হাতছাড়া হয় শাহজেবের। কারণ ভাইয়ের মুক্তির জন্য আইনি লড়াইয়ে বারবার তাকে ছুটতে হত উকিল– থানা– আদালতে। তাই প্রায়শই কাজে কামাই করতে হত তাকে। শাহনজেব জানায়– পুলিশ তাকে বলেছে তার ভাই শাহনওয়াজের বিরুদ্ধে কোনও প্রমাণ নেই।

কিন্তু তবুও আদালত তাকে জামিনে মুক্তি দিচ্ছে না। শাহনওয়াজের হয়ে মামলা লড়ছেন জমিয়তে উলেমার সঙ্গে সংযুক্ত আইনজীবী জেড বাবর চৌহান। বাবর জানিয়েছেন– কিছু মামলায় শাহনওয়াজের জামিন হলেও অন্য মামলাগুলিতে তার জামিন এখনও মঞ্জুর করেনি আদালত। আমরা হাইকোর্টে আবেদন জানিয়েছি।

আশা করি– সব মামলায় শাহনওয়াজের জামিন হয়ে যাবে। শাহনওয়াজ পুরোপুরি নির্দোষ বলে মন্তব্য করেছেন আইনজীবী বাবর চৌহান। শাহনওয়াজের পরিবার জমিয়তের প্রতি কৃতজ্ঞ কারণ তারা সাহায্যের হাত না বাড়িয়ে দিলে শাহনওয়াজের মামলা লড়াও সম্ভব হত না এই পরিবারের। আমরা আমাদের বাড়িও বিক্রি করতে যাচ্ছিলাম কিন্তু সময়মতো জমিয়ত আমাদের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিল। আইনজীবী আমাদের কাছ থেকে ফি বাবদ একটি পয়সাও নেননি। শাহজেব একটি কম্পিউটার কোর্সে ভর্তি হয়েছে। কোনও এক সজ্জন ব্যক্তি তাকে একটি চাকরির প্রতিশ্রিুতি দিয়েছেন।