শিক্ষকতা থেকে ইউপিএসসি, সাফল্যের অপর নাম ওয়াকফ প্রধান মহম্মদ মণিরুজ্জামান

- আপডেট : ১৭ অগাস্ট ২০২১, মঙ্গলবার
- / 33
পুবের কলম প্রতিবেদক: মহম্মদ মণিরুজ্জামান। প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে উঠে আসা এক অজপাড়া গাঁয়ের ছেলে। যিনি নিজের শিক্ষাগত যোগ্যতা দিয়ে আর আল্লাহর প্রতি অগাধ বিশ্বাস রেখে নিজেকে প্রমাণ করতে পেরেছিলেন জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে। যিনি বিশ্বাস করতেন, নিজের প্রতি আস্থা আর বিশ্বাস রাখলে প্রতিবন্ধকতা পার করা সম্ভব অনায়াসেই।
জীবনের নানান ওঠাপড়া তার মোড় ঘুরিয়ে সাফল্যের পথে নিয়ে যায়। একদিকে যেমন আরবি নিয়ে পড়াশোনা তার কাজে দিয়েছিল, আবার সুন্দরবনের বাসন্তী হাইস্কুলে শিক্ষকতার কাজ ছেড়ে কলকাতার একটি ব্যাঙ্কে কাজ করতে করতেই ইউপিএসসিতে যোগদান। তারপর ওয়াকফের প্রধান হয়ে সৌদিতে গিয়ে হজের দায়িত্ব সামলানো। কর্ম সূত্রে পৃথিবীর নানা দেশে ঘুরে বেড়িয়েছেন তিনি। কখনো প্রাক্তন উপরাষ্ট্রপতি হামিদ আনসারির সফর সঙ্গী, তো আবার কখনো প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির! প্রত্যন্ত গ্রামের ছেলেটি বাবা মায়ের দুহাতভরা দোয়া নিয়ে নীরবে উড়িয়েছিল তাঁর স্বপ্নের উড়ান। মহম্মদ মনিরুজ্জামান সাহেবের কথায়, সবকিছু আল্লাহর পূর্ব নির্ধারিত পরিকল্পনার সফল রুপরেখা মাত্র।
হুগলি জেলার বলাগড় থানার অন্তর্গত প্রত্যন্ত গ্রাম দ্বারপাড়ায় জন্ম মহম্মদ মণিরুজ্জামান সাহেবের। সেখানে প্রাথমিক শিক্ষার শুরু। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত একতারপুর হাইস্কুলে পড়াশোনা। আশেপাশে স্কুলের মধ্যে ওটাই ছিল, হাইস্কুল। বাড়ি থেকে প্রায় দেড় কিলোমিটার পায়ে হেঁটে সেই স্কুলে যাতায়াত ছিল ছোট্ট ছেলেটির। মণিরুজ্জামানের কথায়, সেই জমানায় এটুকুই ছিল আমার কাছে অনেক বড় প্রাপ্তি। পান্ডুয়াও হুগলির এক মফস্বল শহর।
অষ্টম শ্রেণির পর আব্বার হাত ধরে পান্ডুয়াতে পাড়ি জমালেন ছোট্ট মণিরুজ্জামান। নবম শ্রেণিতে একটি হাই মাদ্রাসায় ভর্তি হওয়া। নাম মাদ্রাসা হলেও এটি ছিল আদতে হায়ার সেকেন্ডারি বোর্ডের অধীনস্থ একটি স্কুল। নাম ছিল পান্ডুয়া সুলতানিয়া হাই মাদ্রাসা। ওখানে তিন বছর পড়াশোনা।
মণিরুজ্জামানের কথায়, ছোট্ট গ্রাম থেকে বড় হয়ে ওঠা। আশেপাশের সবাই গরীব। তার মধ্যে তখন যেন নিজেকে স্বচ্ছল বলে মনে হত। জেলা বা এই থানার অধীনে আমাদের গ্রামে আমার আব্বাই ছিলেন একমাত্র গ্র্যাজুয়েট। আব্বার জীবন শুরু অবিভক্ত বাংলাদেশের ঢাকায়। চাকরিও করতেন সেখানে। তবে বাড়ির একমাত্র ছেলে ছিলেন আব্বা। সেই সময় নানা কারণে ঢাকা থেকে ওঁনাকে ফিরে আসতে হয়, এই পান্ডুয়াতে। পান্ডুয়া এসে চাকরি বলতে যেটা বুঝি, সেইভাবে আব্বা আর কিছু করতেন না। তবে আব্বা, হাজি মহম্মদ রহুল আমিন ছিলেন একজন ধর্মভীরু মানুষ। তবলীগ মারকাযের কর্মকর্তাদের মধ্যে উনিও একজন ছিলেন। আব্বা লিখতে ভালোবাসতেন। সাতটা বই উনি লিখেছিলেন। মনিরুজ্জামান সাহেবের কথায়, আমার যখন সাত-আট বছর, তখন আব্বা হজে যান। ওখান থেকে ফিরে এসে উনি একটা বই লেখেন, যার নাম ‘কাবা জিয়ারত’। সেই জমানায় হজের বই খুব কম ছিল। তখন এই বইটি খুব বিখ্যাত হয়ে উঠেছিল বাংলা-অসমের ঘরে ঘরে। বাই পোস্টে তখন যেত। ছোটবেলায় দেখতাম আব্বা সেই বইগুলিকে নিজের হাতে বাইন্ডিং করে রাখেতেন।
গ্রামে প্রভাবশালী ব্যক্তি ছিলেন আমার আব্বা। গ্রামের মোড়ল, উপপ্রধানের পদও সামলেছেন। আমার যে স্কুলে পড়াশোনা সেখানে তিনি প্রেসিডেন্ট ছিলেন। আমরা যেখানে বড় হয়েছি, সেটি মুসলিম পাড়া ছিল না। তাও আমার আব্বুকে সবাই খুব সম্মানের নজরে দেখতেন। পান্ডুয়া একটা বইয়ের দোকান ছিল। সেখানে স্কুলের পাঠ্য বই থেকে ধর্মীয় গ্রন্থ থাকত। নাম ছিল ‘কিতাব মঞ্জুরী’।

মণিরুজ্জামান সাহেব জানান, প্রাথমিকের পাঠ শেষ করে খন্যানে ইটাচূনা কলেজ, সেখানে ইকনমিক্স অর্নাস নিয়ে ভর্তি হই। ওই পান্ডুয়া থেকে যাতায়াত করতাম কলেজে। পান্ডুয়াই যেন আমার দেশ হয়ে উঠলো। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত আমি ক্লাসে প্রথম হতাম। এরপর পান্ডুয়া হাই মাদ্রাসায় যখন ভর্তি হই, সাইয়েন্স না নিয়ে আমি আর্টস নিয়ে পড়লাম। তবে ওখানে আরবি একটা বিষয় ছিল। সেটা আমি নিয়েছিলাম। আবার আমি আর্টসে পড়াকালীন সাইয়েন্সের ম্যাথামেটিক্স নিয়েও পড়ি। শিক্ষকরা বলতেন, ‘তুমি ম্যাথসটা ছেড়ো না’। যাতে আমি ম্যাথসটাও পড়তে পারি, তার জন্য রুটিনের একটা অ্যাডজাস্টমেন্ট করে দেন স্কুলের শিক্ষকরা। যাতে আমার আর্টস ক্লাসেও সমস্যা না হয়। সব দিকই একসঙ্গে চলতে থাকল। এই পড়ার সুফল পরবর্তী জীবনে অনেক পরে বুঝতে পেরেছি।

১৯৭৭ সালে ইটাচূনা কলেজ থেকে পাশ করি। এবার এম এ পড়ার তোড়জোড় শুরু হচ্ছে। পান্ডুয়া থেকে রবীন্দ্রভারতীতে আসা বেশ কঠিন ছিল। তখনই বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ পাই। ওখানে এমএ তে ইকনমিক্স নিয়ে ভর্তি হলাম। লোকাল ট্রেনে প্রতিদিন পান্ডুয়া থেকে বর্ধমানে আসতাম। আমার অনেক বন্ধুরা অনেক টিউশন নিত আলাদাভাবে। আমার সেই সময় হাতে পয়সা নেই। তাও টিউশন নিতে শুরু করি। টিউশনির পয়সা কষ্ট করে আব্বা জোগাড় করতেন। কষ্ট হলেও আব্বা আমাকে কিছু জানাতেন না, তবে ছেলে হিসেবে বুঝতাম অনেক কষ্ট করেই দিতে হচ্ছে তাঁকে। দু-তিনজন মিলে টিউশনি নিতাম এক প্রফেসরের কাছে। পড়তে গিয়ে দেখতাম নোট দিতেন, আমরা বসে বসে লিখতাম। আমি ভাবলাম টুকে নিয়েই যদি হয়ে যায়, তাহলে বন্ধুদের কাছ থেকে নোট এইভাবেই নেব। টিউশন ফি’সটা বাঁচবে। আমার বন্ধু ভোলাকে বললাম, তোর কাছ থেকে নোট নিয়ে নেব, আর টিউশনির অর্ধেক খরচ তোকে দিয়ে দেব। এইভাবেই চলল। এমএ পড়তে পড়তে লাস্ট ইয়ারে হস্টেলে চলে এলাম। এক অন্য রকম অভিজ্ঞতা হল। কত ছেলে। সেখানে গিয়ে জানতে পারলাম কত রকমের চাকরির পরীক্ষা হয়। ব্যাঙ্কিং, পিএসসি এসবে দেখি ওরা ফর্ম ফিলাপ করছে। পয়সা হাতে ছিল না, তাও যেগুলোতে একটু কম পয়সা লাগে, সেগুলো সুযোগ নিতাম। পরে ইউপিএসসি’র ফর্ম ফিলাপ করি। ওখানে থাকতে থাকতেই পরীক্ষা দিই। এরপর হস্টেলের পাঠ চুকিয়ে, রেগুলার পরীক্ষা সম্পন্ন করে বাড়ি এলাম।
সেই সময়, সুন্দরবনের বাসন্তী হাইস্কুলে একটা পদ খালি ছিল। ইকনমিক্সে ইলেভেন-টুয়েলভ ক্লাসের একটা ভ্যাকেন্সি দেখতে পেলাম। সেখানে আবেদন করি। ইন্টারভিউতে ডাকে। সিলেক্ট হলাম। পাশ করার পরেই এই শিক্ষকতা পাওয়া আমার জীবনের একটা ধাপ বলতে পারি। ৮০ সালের দিকে কর্মজীবন শুরু। সোনাখালিতে একটা বাড়ি ভাড়া নিলাম। বাড়িওলা বললেন, থাকবেন আর আমার ছেলেদেরও পড়িয়ে দেবেন। ১০ মাস মতো ওই স্কুলে শিক্ষকতা করি। এবার যে পরীক্ষাগুলো দিয়েছি, তার রেজাল্ট বের হওয়া শুরু হল। ব্যাঙ্কিং রিক্রুটমেন্ট বোর্ড থেকে জানানো হল আমার সিলেকশন হয়ে গেছে। পরে ফাইনাল সিলেকশন হল। পোস্টিং হল এলাহাবাদ শিবপুর ব্র্যাঞ্চ হাওড়া। স্কুল ছেড়ে এসে ব্যাঙ্কে জয়েন করলাম। পান্ডুয়া থেকে যাতায়াতেও সুবিধা হল। ওখানে ১০ মাস ছিলাম। এবার পেলাম রেলে চাকরি। অ্যাসিস্ট্যান্ট স্টেশন মাস্টারের চাকরি। রেলের চাকরিতে আর জয়েন করিনি। কারণ তখন মনে হয়েছিল হয়তো কোন প্রত্যন্ত গাঁয়ে চাকরি দেবে। অন্যরকম হয়ে যাবে জীবন। তাই রেলে আর জয়েন করিনি। ব্যাঙ্কের চাকরি করে যেতে থাকলাম। এরপর পালবিক সার্ভিস কমিশনের ক্লাস গ্রেড থেকে ডাক এল। বেলগাছিয়ায় অফিস। কিন্তু তখন আমার কাছে যাতায়াতের ব্যাপারটা অনেক বড় ছিল। কিন্তু এই চাকরিটাও করলাম না। ব্যাঙ্কের চাকরি করতে লাগলাম। এইবার ইউপিএসসি’র রেজাল্ট বেরিয়ে গেল। তখন সব কিছু ছেড়ে দিয়ে দিল্লি।
মগরাহাট বাঁকিপুরে ইস্তেমা হচ্ছে। তাবলীগ জামাতের ওখান থেকে এসে কলকাতায় পরীক্ষা দিতে এসেছিলাম ইউপিএসসি’র যেটা আজও স্মৃতির পাতায় জমে আছে।

ইউপিএসসিতে ‘ক্যাপিটালিজন ভার্সেস মার্ক্সসিজম’ এর উপরে লিখতে দেওয়া হয়েছিল একটি রচনা। আট দশ পাতার রচনা লিখি। আর আমার মনে হয় ওটি আমার ইউপিএসসিতে চাকরি পেতে একটি অনন্য মাত্রা যোগ করেছিল।
আমার ইউপিএসসি অ্যাসিস্টেন্ট গ্রেড এগজামিনার সুপার। এটাকে অ্যালেয়েড সার্ভিস বলা হত। সেই সার্ভিসে ট্যুরিজম অ্যান্ড সিভিল অ্যাভিয়েশন মিনিস্ট্রি। ৮৩’ ৭ এপিল মাসে দিল্লিতে আসি। কর্মজীবনের ৩০ থেকে ৩৫ বছর দিল্লিতে কাটিয়েছি। আমাদের সার্ভিস এর নাম ছিল সিএসএস (সেন্ট্রাল সেক্রেটারিয়েট সার্ভিস)। সেক্রেটারিয়াল ওয়ার্ক করতে হয়েছে। প্রত্যেক ৪ থেকে ৫ বছর অন্তর বিভিন্ন ১৩/১৪ মিনিস্ট্রিতে কাজ করেছি। সোশ্যাল, জাস্টিস, ফুড, ওয়েলফেয়ার এইভাবে চলতে থাকল।
ট্যুরিজম অ্যান্ড সিভিল অ্যাভিয়েশন মিনিস্ট্রি জয়েন করলাম। আর একটা ডিপার্মেন্টাল পরীক্ষা হয় প্রোমোশনের জন্য। সেই পরীক্ষা দিয়ে পাশ করে প্রমোশন পাই। আমি সাইয়েন্স অ্যান্ড টেকনলজি মিনিস্ট্রিতে লোয়ার পোস্টে কাজ করছি তখন। মিনিস্ট্রি অব ওয়েলফেয়ারে পোস্টিং, যার নাম হয়েছে সোশ্যাল জাস্টিস। সেখানে প্রমোশন হল। যিনি অ্যাডমিনিস্ট্রেশন দেখতেন, উনি বললেন আপনাকে আমরা ছাড়ব না(সাইয়েন্স অ্যান্ড টেকনলজি মিনিস্ট্রিতে লোয়ার পোস্ট)। আমরা এখানেই অ্যাডজাস্ট করে নেব। এইভাবে চলতে থাকল। এদিকে আমি দেখছি, আমার যত বন্ধু পাশ করেছে, সবাই পাস করে গেজেটেড অফিসার হয়ে গেল। এদিকে আমি এখানে পড়ে আছি। কি করব বুঝতে পারছি না। ওখানে মুসলিন একজন বর্ষীয়ান অফিসার ছিলেন। সাইয়েন্স অ্যান্ড টেকনলজি মিনিস্ট্রিতে লোয়ার পোস্টে থেকে ছাড়া হচ্ছে না, সেকথা জানাই ওঁনাকে। সব কথা মন দিয়ে শুনে একমিনিটের মধ্যে ব্যবস্থা নেন।
ওয়েলফেয়ারে একটা সেকশন ‘ওয়াকফ’। মিনিস্ট্রি অব ওয়েলফেয়ারের আন্ডারে ছিল ওয়াকফ। স্পেশালি মুসলিম বলে আমাকে সেখানে নেওয়া হল। পোস্টিং দেওয়া হল আমাকে। আমার আগে যিনি ছিলেন তার নাম খালিদ মহম্মদ সাহেব। তিনি তখনও ছিলেন। উনি খুব জ্ঞানী মানুষ। ১০ বছর কাজ করেছেন। আমাকে পুরো ভারতের সমগ্র ওয়াকফ বোর্ড, তার আইন নিয়ে সমস্ত বুঝিয়ে দেন। ওয়াকফের প্রধানের দায়িত্ব পাই। ওয়াকফ সম্পত্তি অধীনে মুসলিম দরগা, মাদ্রাসা, গোরস্থান। সেইসঙ্গে আজমীরের যে দরগা সেই, দরগাও হচ্ছে ওয়াকফ সম্পত্তি। সমগ্র ভারতের ওয়াকফ সম্পত্তির জন্য একটা ওয়াকস সেন্ট্রাল অ্যাক্ট আছে। ওয়াকফ অ্যাক্ট (১৯৫৪)।১৯৮৯ সালে, আমি যখন প্রধানে দায়িত্বে এলাম তখন ওই পূর্বতন আইন অ্যামেন্ডমেন্ট করার কাজ চলছিল। দরগা প্রপার্টির জন্য আর একটা সেন্ট্রাল অ্যাক্ট। আজমীর শরীফ, পুরো দরগা ছিল ওয়াকফের অধীনে। ওয়াকফ সম্পত্তি, দেশ, রাজ্যে, জেলায় যেমন আছে, তেমনি আমাদের কিছু ওয়াকফ প্রপার্টি সৌদি আরবেও আছে।কারণ, আমাদের যারা নবাব ছিলেন যেমন ভূপালের নবাব, আরকড নবাব, পতৌদি নবাব, তারা যখন হজ করতে যেতেন তখন সৌদিতে গিয়ে সেখানে থাকতেন।

প্রায় ২০-২৫টি তে ওয়াকফ প্রপার্টি করে গেছেন। আরবীতে যাকে বলা হত ‘হুবাদ’। পরবর্তীকালে নবাবরা চলে গেছেন। যার ফলে দেখভালের অভাবে কিছুটা কবজা হয়ে যায়। কিছু নষ্ট হয়ে গেছে। আমি যার জায়গায় এলাম, সেই খালিদ সাহেবকে পাঠানো হল সৌদি আরবে। সেই ওয়াকফের সম্পত্তি দেখভাল করতে। উনি চলে গেলেন আমি ওনার জায়গায় কাজ শুরু করলাম। সৌদি আরবে তিন বছরের বেশি পোস্টিং দেওয়া হয় না। তার পর আমার নাম এল। সৌদি আরবে আমাকে পাঠানোর তোড়জোড় শুরু হল।
ওই পোস্টটি ছিল আমার থেকে সিনিয়রদের জন্য। কিন্তু তাও আমাকে ডাকা হল ইন্টারভিউতে।
সেখানেই প্রথম প্রশ্ন, ‘আপনার হায়ার সেকেন্ডারিতে অ্যারাবিক ছিল। ইন্টারভিউতে তখন ওয়াকফে কাজ করছি তিন বছর হয়েও গেছে। বাকি তিনজনের নাম বাদ দিয়ে, সৌদির জন্য পোস্ট ডাউন গ্রেড করে আমাকে নির্বাচিত করা হল।
আমি সৌদিতে গেলে খালিদ সাহেব ফিরলেন।তবে তিন জনের নাম বাদ দিয়ে আমাকে সিলেকশন করায় অন্যপ্রার্থীরা মন্ত্রীমহলে অভিযোগ জানায়। তড়িঘড়ি আমাকে সৌদিতে যেতে বলা হয়। তখন রোযা ছিল। পরিবার আমার স্ত্রী, দুই মেয়েকে দিল্লিতে রেখে আমি সৌদি আরবের উদ্দেশে রওনা হই। গিয়ে জয়েন করি। পরে পরিবার যায়। আমি ওখানে গিয়ে রুবাদে যাই। রুবাদ মানে হাজিদের জন্য থাকার ব্যবস্থা। ওখানে আমার পোস্টের নাম ছিল ‘ভাইস কনসোল হজ অ্যান্ড রুবাদ’। হজের জন্য মেন অফিস হচ্ছে জেদ্দায়। মক্কা থেকে প্রায় ৮০ কিলোমিটার দূরে। খালিদ সাহেব দিল্লি ফিরে এলেন। সাড়ে তিন বছর থাকলাম সেখানে। হজ আর রুবাদের কাজ চলছিল।
১৯৯৬ সালে এক ভয়ঙ্কর ঘটনার সাক্ষী থাকলাম।মিনা ময়দানে আগুন লাগে। আগের দিন রাতে গেছি। প্রায় এক লক্ষ হাজি এসেছেন মিনার ময়দানে। সকালবেলায় সেখানে তাঁবুতে আগুন লেগে গেল। ২৫০ থেকে ৩০০ জন হাজি মারা যান। অনেকের খোঁজ পাওয়া যায়নি। আমার আব্বা, ভগ্নিপতী সবাই ছিলেন। খুব খারাপ অবস্থা। অবস্থা এমন গিয়ে দাঁড়ায় যে, হজ করার থেকে আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিল হাজিদের খোঁজ খবর নেওয়া। তাদের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করা। সেই সময় সেখান ছিলেন আমাদের দেশের প্রাক্তন উপরাষ্ট্রপতি হামিদ আনসারি সাহেব। উনি ছিলেন তখন অ্যাম্বাসাডর। আর কনসোল জেলারেল ছিলেন আফজল আমনউল্লা সাহেব।একজন দূরদর্শী মানুষ ছিলেন হামিদ আনসারি সাহেব।
সকালে জলখাবার খেয়ে বসেছি। উনি আমাকে আগুন লাগার খবর নিতে বললেন। আমি বললাম দূরে আগুন লেগেছে। উনি তখনই বললেন সব খালি করতে। এতটাই দূরদর্শিতা ছিল ওঁনার। আর একটু দেরি করলে, হয়তো কেউ বাঁচতাম না। পরিবার, আত্মীয়,স্বজন হজ করতে গিয়েছিলেন। রাত পর্যন্ত কোনও খবর নেই, কে কোথায় আছে। এক ভগ্নীপতির তো খোঁজই পায়নি।
হজের জন্য শারীরিক কর্মদক্ষতার খুব প্রয়োজন। কারণ ৫/ ১০ কিলোমিটার হাঁটতে হবে। বয়স্ক হাজিরাও দেখি হাঁটছেন। খুব ভীড় হয়। যেখানে শয়তানকে পাথর মারার জায়গা। একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ২০ লক্ষ হাজি যাবে, পাথর মারবে আবার ফিরে আসবে। সেই সব জায়গায় হাজিরা হারিয়ে যায়। অনেক বড় জায়গা। সেই সময় অফিসে বসে সব সামলাতে হত। যারা হজ করতে আসতেন তাদের প্রত্যকের হাতে ব্যান্ড লাগানো থাকত।পরিবার হারিয়ে রাস্তায় হয়তো দাঁড়িয়ে কাঁদছে। ভলেন্টিয়াররা গিয় ব্যান্ডের কভার নম্বর দেখে পরিবারদের সঙ্গে আবার মেলাতো। ‘হাজিদের খিদমত’ যেটা বলা হয়, আল্লাহর শুকরিয়া সেটা আমি করার সুযোগ পেয়েছি।
৯৭-এ সৌদি থেকে ফিরে আসি। সেই সময় মিনা ময়দানের ঘটনার পর এই হামিদ আনসারি সিদ্ধান্ত নেন এবার মক্কায় কন্ট্রোল রুম তৈরি করা হবে। তার জন্য আমাকে নির্বাচিত করা হয়। তিনি বলেন, ‘ভারত থেকে মুহম্মদ মণিরুজ্জামানকে পাঠানো হোক।‘ হামিদ আনসারি বিদেশমন্ত্রকে ফোন করে আমাকে যোগ্যতম ব্যক্তি হিসেবে আবার সৌদির জন্য নির্বাচন করেন। ৯৭-তে গেলাম তিন মাসের জন্য সৌদিতে। আবার ৯৮-তে একবছরের জন্য সৌদিতে।
তবে ওয়াকফ সম্পত্তি নষ্ট হতে দেখে খারাপ লাগে। কারণ মনে করি, ওয়াকফ সম্পত্তি মুসলিমদের আর্থ সামাজিক উন্নতিতে কাজে লাগানো যাবে। আমার খারাপ লাগে দেখে, কষ্ট হয় মতোয়ালিরাই কবজা করে কত সম্পত্তি বিক্রি করে দিয়েছে। ওয়াকফ সম্পত্তি এতটাই সঠিক ভাবে প্রয়োগ করলে কারুর কাছে আর হাত পাততে হত না দেশের গোটা মুসলিম সম্প্রদায়কে। অফিসাররাও হয়তো ঠিকভাবে দেখেনি। পুরো ওয়াকফ সম্পত্তিকে কাজে লাগানো গেলে মুসলিম কমিউনিটির জন্য বিশাল উন্নতি হতে পারে।
এত কাজে সব সময় স্ত্রীকে পাশে পেয়েছি। হজের কাজে একবার জেদ্দা অফিস, সেখান থেকে আবার মক্কায়। আবার মদিনায় আসতে হত। স্ত্রী সেই সময় সব কাজ একা হাতে সামলেছেন। মেয়েদের স্কুল, পরীক্ষা থেকে ঘরের আনুষঙ্গিক কাজকর্ম।
অবসর গ্রহণের পর ফিরে এসে, বিভিন্ন মিনিস্ট্রিতে যোগ দিই। কলকাতাতেও আসি। মনে করি সব কাজ ভালোভাবে হওয়ার পিছনে আল্লাহর মদত আছে।
অবসরের পর পশ্চিমবঙ্গ সংখ্যালঘু উন্নয়ন ও বিত্ত নিগমে কাজ। সরকারের ফ্ল্যাট ছেড়ে কলকাতায় এসে হাইকোর্টের পাশে ন্যাশনাল কোম্পানি ল ট্রাইবুন্যালে দেখি সারকুলার হয়েছে। অ্যাসিস্টেন্ট রেজিস্টারের পদ। সেখানে আবেদন করি। ইন্টারভিউ দিই। দুদিন পর ফোন আসে। আমাকে জানানো হয়, আপনি সিলেকটেড। ৫৫ হাজার বেতন। কাজ করছি। কিন্তু আমি মানসিকভাবে মোটেও ভালো ছিলাম না। কারন আমি দীর্ঘদিন ওয়াকফের দায়িত্ব সামলেছি, আর তাই মনেপ্রাণে চাইছিলাম যদি আমার কমিউনিটি ও পিছিয়ে পড়া সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে নিয়ে কাজ করার সুযোগ পাই তাহলে কিছুটা মানসিক প্রশান্তি আসবে। কিন্তু আমার সেসময় কলকাতাতে খুববেশি পরিচিতি নেই।
হঠাৎ সৈয়দ আহমেদ বাবার সঙ্গে দেখা, তিনি কনসোল জেনারেল ছিলেন। উনি তখন স্পোর্টস মিনিস্ট্রিতে। তিনি বিত্ত নিগমের চেয়ারম্যান ডা. পিবি সেলিম সাহেবকে ফোন করলেন। আমি ওনার অফিসে গেলাম। আমার বায়োডাটা দেখে সেলিম সাহেব কাজে জয়েন করার প্রস্তাব দিলেন।
একটা অ্যাড বের হল। আমি আবেদন করলাম। কর্পোরেশনে ইন্টারভিউ হল। বেতনের কথা জিজ্ঞাসা করায় আমি বলি, যদি কিছু নাও দেন, তাও কাজ করতে রাজি আছি। অফার লেটার পেলাম। আগের অফিস থেকে রিজাইন দিই। এখন পশ্চিমবঙ্গ সংখ্যালঘু উন্নয়ন ও বিত্ত নিগমের এডুকেশন লোন ও স্কলারশিপ দেখছি।
আগামী প্রজন্মে জন্য বলতে চাই, সুন্দর হৃদয়ে নিয়ে কেউ যদি মানুষকে সাহায্য করে, তাহলে তার ফল সে অবশ্যই পাবে। অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানো খুব জরুরি। পরিবেশ পরিস্থিতি বিরুদ্ধ হতেই পারে, সেই সময় মাথা ঠিক রাখাটাই আমাদের ঐতিহ্য আর সব থেকে বড় চ্যালেঞ্জ।
সবাইকে যৌথ উদ্যোগে কাজ করতে হবে। সৎ থাকা খুব প্রয়োজন। সৎ থাকলে আল্লাহ সহায় থাকবেন। এত কাজের মধ্যে আমার পরিবার নিয়ে আমাকে কোনও কষ্ট পেতে হয়নি।আমার দুই মেয়ে প্রতিষ্ঠিত চিকিৎসক। দুজনেই আলিগড় থেকে এমডি করেছেন। বড় মেয়ে স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ, ছোট মেয়ে প্যাথলজিস্ট। জীবনে সৎ থাকা খুব জরুরি বলে মনে করি। তাহলে আল্লাহর আশীর্বাদও মাথার ওপর থাকবে।