ভারত বাছ-বিচার না করেই বাসিন্দাদের বিতাড়ন করছে, দরিদ্র বলে তারা আদালতে যেতে পারছে না

- আপডেট : ১১ জুন ২০২৫, বুধবার
- / 86
পুবের কলম ওয়েবডেস্ক: ভারত এমন মানুষদের প্রতিবেশী বাংলাদেশে বিতাড়িত করতে শুরু করেছে যাদের ভারত মনে করে যে তারা অবৈধ অভিবাসী। কিন্তু মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, কর্তৃপক্ষ ইচ্ছেমতো বাছাই করে মানুষদের দেশ থেকে বের করে দিচ্ছে।
মে মাস থেকে, ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্য অসম থেকে ৩০৩ জন নারী-পুরুষকে বাংলাদেশে ‘পুশব্যাক’ করেছে। এদের মধ্যে বিভিন্ন ট্রাইব্যুনাল বিগত বেশকিছু বছরে ৩০,০০০ জনকে ‘বিদেশি’ বলে ঘোষণা করেছে। রয়টার্সকে এই তথ্য দিয়েছেন একজন শীর্ষ কর্মকর্তা।
এইসব মানুষ অসমে বহু বছর ধরে বসবাস করে আসছেন, তাদের অনেকের পরিবার ও জমিজমা রয়েছে সেখানে। এদের অধিকাংশই বাংলা ভাষাভাষী, যাদের পূর্বপুরুষদের শিকড় বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত।
মানবাধিকার কর্মীদের অভিযোগ, অনেক নিরীহ ও দরিo মানুষকে ভুলভাবে ‘বিদেশি’ হিসেবে ট্রাইব্যুনালগুলি ঘোষণা করছে। তারা এতটাই দরিদ্র যে উচ্চ আদালতে গিয়ে নিজেদের নাগরিকত্ব প্রমাণ করার আর্থিক সামর্থ্য নেই। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন বলেন, এই বিতাড়ন কার্যক্রমে মূলত মুসলিম সম্প্রদায়কে টার্গেট করা হয়েছে। যদিও অসম সরকার এ নিয়ে আনুষ্ঠানিক কোনও মন্তব্য করেনি।
বাংলাদেশের সঙ্গে অসমের ১৬০ মাইল দীর্ঘ সীমান্ত রয়েছে। বিজেপি সরকার গঠিত ফরেনার্স ট্রাইব্যুনাল মে মাস থেকে যাদের ‘বিদেশি’ বলে ঘোষণা দিয়েছে, তাদের বাংলাদেশে বিতাড়ন করতে শুরু করেছে। এই ধরনের উদ্যোগ অসমে খুবই জনপ্রিয়। কারণ, অসমের বাংলাভাষীদের অনেকরই সম্ভাব্য শিকড় রয়েছে বাংলাদেশে এবং তারা অসমীয়াভাষীদের সঙ্গে চাকরি এবং সম্পদের বিষয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে থাকে।
অসমের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা বিধানসভায় জানান, ‘বিদেশি’দের বিতাড়নের জন্য সুপ্রিম কোর্টের চাপ রয়েছে। তিনি বলেন, ‘আমরা এখনও পর্যন্ত ৩০৩ জনকে ফেরত পাঠিয়েছি এবং এই পুশব্যাক আরও জোরদার করা হবে। রাজ্যকে রক্ষা করতে আমাদের আরও সক্রিয় হতে হবে।’
এদিকে, বাংলাদেশের বিদেশ উপদেষ্টা জানান, ভারত থেকে কিছু মানুষকে বাংলাদেশে পাঠানো হচ্ছে এবং এ নিয়ে দুই দেশের মধ্যে আলোচনা চলছে।
নাগরিকত্ব বিষয়ক আইনজীবী এবং কংগ্রেস দলের সদস্য আমান ওয়াদুদ বলেন, ‘সরকার নির্বিচারে মানুষকে দেশ থেকে বের করে দিচ্ছে। এখন মানুষের মধ্যে চরম আতঙ্ক বিরাজ করছে।’ কিছু মানুষকে ফেরতও আনা হয়েছে।মুখ্যমন্ত্রী শর্মা বলেন, প্রকৃত ভারতীয় নাগরিকদের কাউকেই বিতাড়িত করা হবে না। তিনি আরও জানান, চারজন মানুষকে ফেরত আনা হয়েছে, যাদের মামলাগুলো এখনও আদালতে বিচারাধীন।
তাঁদের একজন খাইরুল ইসলাম, ৫১ বছর বয়সি একজন প্রাক্তন স্কুল শিক্ষক। ২০১৬ সালে তাকে ‘বিদেশি’ ঘোষণা করে একটি ট্রাইব্যুনাল। তিনি দুই বছর ডিটেনশন সেন্টারে কাটান এবং ২০২০ সালে জামিনে মুক্তি পান।
খাইরুল জানান, ২৩ মে পুলিশ তাকে বাড়ি থেকে আটক করে পুনরায় ডিটেনশন ক্যাম্পে নিয়ে যায়। পরে আরও ৩১ জনকে একসঙ্গে এনে একটি ভ্যানে তুলে চোখ এবং হাত বেঁধে সীমান্ত এলাকায় নিয়ে যাওয়া হয় এবং বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়া হয়।
‘রাতের অন্ধকারে আমাদের ঠেলে দেওয়া হয় সীমান্ত পেরিয়ে। পরে এক স্থানীয় গ্রামবাসী বাংলাদেশের সীমান্ত রক্ষীদের খবর দেন। তাঁরা আমাদের ‘নো ম্যানস ল্যান্ড’-এ প্রচণ্ড রোদের মধ্যে দাঁড় করিয়ে রাখেন সারাদিন।’
তার স্ত্রী অসম পুলিশকে জানান, যেহেতু মামলাটি আদালতে বিচারাধীন, তাই তাকে ফেরত আনা উচিত। কয়েকদিন পর খাইরুলকে ভারতীয় পুলিশের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। তবে তার সঙ্গে থাকা অন্যদের ভাগ্যে কী ঘটেছে, তিনি তা জানেন না।অসম ছাড়াও অন্য রাজ্যেও চলছে অভিযান।অসমের বাইরে, গুজরাতের আহমদাবাদ শহরের পুলিশ জানায়, তারা ২৫০ জনেরও বেশি বাংলাদেশি অভিবাসীকে শনাক্ত করেছে যারা সেখানে অবৈধভাবে বসবাস করছেন। তাদের বিরুদ্ধেও বিতাড়নের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা।
পুবের কলম প্রতিবেদক দিল্লি থেকেও জানিয়েছেন, সেখানেও বহু বাংলাভাষীকে পুলিশ ধরে আটক করছে। এদের অনেকে পশ্চিমবঙ্গের অধিবাসী। একজন সমাজকর্মী বলেন, বাংলাদেশিদের বিতাড়ন করলে আপত্তির কিছু নেই। কিন্তু বাংলাদেশি বিতাড়নের নামে আসলে পশ্চিমবঙ্গের মানুষকেই কয়েদ করা হচ্ছে এবং তারা ভোটার কার্ড, আধার কার্ড ইত্যাদি দেখালেও তাদের ছাড়া হচ্ছে না। ফলে বাংলাদেশি ধরার নামে বাংলাভাষী ভারতীয় মুসলিমদেরই হয়রান করা হচ্ছে।
অসমের আর একজন সমাজকর্মী জানিয়েছে, ১০০ বছর ধরে যাদের পরিবার অসমে বসবাস করছে, তাদের সন্তানদেরও বাংলাদেশি আখ্যায়িত করা হচ্ছে। আর সীমান্তে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে পাঠানো হচ্ছে। তারা যে ভারতীয় নাগরিক তা প্রমাণ করার সুযোগটুকুও তারা পাচ্ছে না।