মাস্ক রোগ ঠেকায়– তবুও অনীহা কেন?

- আপডেট : ৩০ জুলাই ২০২১, শুক্রবার
- / 14
ডা. প্রদীপ কুমার দাস
যে কোনও হাসপাতালের অপারেশন থিয়েটরে ঢুকতে গেলে নিজের ড্রেস ছেড়ে গায়ে গাউন– মাথায় কাপড়ের আচ্ছাদন– পায়ে আলাদা জুতো– নাক-মুখ-চিবুক ঢাকার জন্যে সার্জিকাল বিশোধিত মাস্ক ও হাতে বিশোধিত গ্লাভস পরে তবেই টেবিলের সামনে আসা যায়। কেননা এইসব প্রথায় একটি মাত্র লক্ষ্য রোগীর দেহে কোনোমতেই সংক্রমণ না প্রবেশ করতে পারে। অপারেশন টেবিলে মুখে মাস্ক পরার ধারণাটা প্রথমে দেন ফরাসি সার্জেন পল বার্গার ১৮৯৭ সালে। তাঁর বক্তব্য ছিল মাস্ক ছাড়া কথা বলার সময়ে ড্রপলেটের মাধ্যমে জীবাণু ছিটকে বেরিয়ে এসে অপারেশন ক্ষতটাকে বিষিয়ে দিতে পারে। সেই কারণে তিনি ও তাঁর অপারেশনের সঙ্গীসাথীরা সার্জিকাল গজ দিয়ে নাকমুখ ঢেকে অপারেশন করতেন। তাঁর মতে সায় দিয়ে বিজ্ঞানী হুবনার সার্জিকাল গজটাকে বেশ পুরু করে পরে অপারেশন টেবিলে নামেন। এরপরে মাস্ক পরার চল শুরু হয় ও অপারেশনের সময়ে ডাক্তার সহ সহকর্মীরা মাস্ক পরে অপারেশনের কাজে নামেন।
শুধু অপারেশনের সময়ে নয়– মাস্কের ব্যবহার শুরু হয় নানাবিধ রোগ ঠেকাতে। ১৮৯৯ সালে টিবি বা যক্ষা রোগ ঠেকাতে মাস্ক পরার কথা বলা হয়। ১৯০৫ সালে বিজ্ঞানী হ্যামিলটন জানান– scarlet fever ছড়ায় ড্রপলেটের মাধ্যমে। তাই এই রোগ ঠেকাতে মাস্কের কোনও জুড়ি নেই। ১৯১০-১১ সালে মাঞ্চ$রিয়ায় প্লেগ মহামারি আটকাতে নাক-মুখ ঢাকতে সাহায্য নেওয়া হয়েছিল মাস্কের। ওই একই বছরে চিনে নিউমোনিক প্লেগ অতিমারির সময়ে রোগের প্রকোপ কমাতে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছিল মাস্ক। ১৯১৮ সালে ইনফ্লুয়েঞ্জা অতিমারির সময়ে মাস্ককে ঢাল হিসেবে কাজে লাগানো হয়েছিল। একই ভাবে জাপানে স্প্যানিশ ফ্লু রুখে দেওয়া সম্ভব হয়েছিল মাস্ককে অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে। ১৯১৮ সালে চিকিৎসক ওয়েভার ডিপথেরিয়া রোগ ঠেকাতে মাস্কের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছিলেন। এছাড়া সাধারণ হাঁচি-কাশি– ফ্লু– সোয়াইন ফ্লু– ধুলো ও বায়ু দূষণ– পোলেন ও সাধারণ অ্যালার্জী– ধূমপানের পরোক্ষ ক্ষতি এবং বায়ুদূষণের হাত থেকে রেহাই পাওয়ার অন্যতম হাতিয়ার হল মাস্ক ব্যবহার করা। বর্তমানে করোনা অতিমারিতেও মাস্ক ব্যবহার অনেকখানি ভরসা জুগিয়েছে।
তবে এই মাস্ক পরা নিয়ে পুরুষ ও মহিলাদের মধ্যে বিস্তর ফ্যারাক রয়েছে।
সম্প্রতি আমেরিকার প্রায় আড়াই হাজার নারী-পুরুষের মধ্যে এক সমীক্ষা চালান কানাডীয় বিশেষজ্ঞরা। তাঁদের সমীক্ষা ধরা পড়ে মহিলাদের থেকে পুরুষদের মধ্যে মাস্ক পরতে অনীহা বেশি। গবেষকরা এও লক্ষ্য করেছেন– যেসব জায়গায় মাস্ক পরাটা বাধ্যতামূলক নয় সেখানেও বিশেষ বিশেষ সামাজিক এবং পারিবারিক অনুষ্ঠানে পুরুষদের চেয়ে নারীরা মাস্ক ব্যবহারে দায়িত্বশীল ও তৎপর। পুরুষরা সেক্ষেত্রে অনেক বেশি ‘কেয়ারলেস’। এই ধরণের বেহিসেবী আচরণের কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে গবেষকরা দেখেছেন– পুরুষদের মধ্যে ভ্রান্ত অহমিকা আছে যে তারা মেয়েদের তুলনায় কম সংক্রামিত হন কেননা তাদের দৈহিক গঠন অনেক মজবুত মেয়েদের তুলনায়। বাস্তবে কিন্তু উল্টোটাই ঘটতে দেখা যাচ্ছে। একইভাবে গবেষকরা লক্ষ্য করেছেন মাস্ক পরা ছাড়া করোনা সংক্রমণের অন্য একটি হাতিয়ার ঘনঘন হাত ধোওয়ার ক্ষেত্রেও পুরুষদের থেকে নারীরা অনেক বেশি এগিয়ে রয়েছেন। এর উদাহরণ হিসেবে গবেষকরা তুলে ধরেছেন ২০০৯ সালের মেক্সিকোয় সোয়াইন ফ্লু সংক্রমণ ও ২০০২-২০০৩ সালে হংকংয়ে সার্স মহামারির ছবিটা। সেখানে লক্ষ্য করা গিয়েছিল মহামারির সময়ে গণপরিবহন বিশেষ করে মেট্রোরেল ব্যবহারের সময়ে পুরুষদের তুলনায় নারীরা বেশি বেশি সংখ্যায় হাত ধোওয়া ও মুখে মাস্ক পরার কাজে অনেক বেশি দায়িত্বের পরিচয় রেখেছিলেন।
অনুলিখন ওসিউর রহমান