প্রফেটের দেখানো মানবিকতার পথ ধরে হাঁটতে হবে: চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য

- আপডেট : ২৪ অক্টোবর ২০২২, সোমবার
- / 9

রবিবার উর্দু অ্যাকাডেমিতে নবী উদযাপনের মঞ্চে বক্তব্য রাখছেন অর্থমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য। রয়েছেন আহমদ হাসান ইমরান, গৌতম পাল, মন্ত্রী গোলাম রব্বানি, ওয়ায়েজুল হক। (পিছনের সারিতে বাঁদিক থেকে) নুসরত হাসান, ড. মেহেদি হাসান, জনাব মইনুল হাসান, হারুন রশিদ, ফরিদ খান, সোমঋতা মল্লিক, ফারুক আহমেদ, নাসির আহমেদ। (ছবি-খালিদুর রহিম)
গোলাম রাশিদ: ধর্মীয় বিদ্বেষ ও অসহিষ্ণুতা যখন সমাজকে ক্রমশ কলুষিত করার চেষ্টা করছে, ঠিক তার উলটো দিকে সম্প্রীতি ও সহাবস্থানের শিক্ষার আলো ছড়াচ্ছেন অনেকেই। ইসলামের নবীকে নিয়ে কেউ যখন অবমাননাকর মন্তব্য করছে, তখন তার বিপরীতে রয়েছে মুহাম্মদ সা.-এর প্রতি মানুষের ভালোবাসা ও তাঁকে জানার আগ্রহ। তারই নজির দেখা গেল রবিবারের উর্দু অ্যাকাডেমিতে। অডিটোরিয়ামে উপচে পড়া ভিড় সে-কথারই সাক্ষ্য দেয়। এদিন উদযাপিত হল পুবের কলম-এর নবী দিবস অনুষ্ঠান।
উঠে এল বিশ্বনবীর সর্বজনীন মানবতা ও শান্তির শিক্ষার কথা। এদিনের অনুষ্ঠানে অমুসলিম রাজনীতিক ও বুদ্ধিজীবীদের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। সারা বিশ্বে যখন প্রফেটের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ছড়ানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে কিছু প্রতিক্রিয়াশীল গ্রুপ, তখন পুবের কলম-এর উদ্যোগে নবী দিবসের অনুষ্ঠানে অমুসলিমদের অংশগ্রহণ এক তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। অনুষ্ঠানের শুরুতেই পত্রিকার সম্পাদক ও প্রাক্তন সাংসদ আহমদ হাসান ইমরান এই বিষয়ে জানান, ‘এই সময় বড় অশান্ত। মানুষের অধিকার কেড়ে নেওয়া হচ্ছে, যুদ্ধ চলছে।
এই প্রেক্ষিতে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে, সমাজকে আলোকিত করতে দরকার মুহাম্মদ সা.-এর শিক্ষা। আমরা চাইলে বিখ্যাত আলিম ও ইসলামের বিশেষজ্ঞদের এই অনুষ্ঠানে দাওয়াত দিতে পারতাম। কিন্তু বর্তমানে অমুসলিম রাজনীতিক ও বুদ্ধিজীবীরা নবীকে নিয়ে কী ভাবছেন, তা জানার জন্যই আমরা তাঁদের আমন্ত্রণ জানিয়েছি। বিদ্বেষের বাতাবরণ সরিয়ে এক আলোকিত সমাজ গড়ার জন্য এটা প্রয়োজন।’
তিনি আরও বলেন, আল্লাহ্ শেষ বিচারের দিন তার বান্দাহ্কে বলবেন, আমি অসুস্থ ছিলাম তুমি আমাকে দেখতে যাওনি। আমার অমুক বান্দাহ ক্ষুধার্ত ছিল, বস্ত্রহীন ছিল। তোমরা তাদের ক্ষুধা দূর করনি। বস্ত্র দাওনি। আল্লাহ্ এভাবে আসলে সমস্ত সৃষ্টির সেবা করতে বলছেন। খিদমতে খালকের সেবা। এভাবেই মানুষ, পরিবেশ, গাছপালা, পশুপাখির সেবা করতে উদ্বুদ্ধ করেছে ইসলাম। সেই শিক্ষাই সারাজীবন ধরে দিয়েছেন মহানবী সা.।
এদিন ইমরানের বক্তৃতার প্রসঙ্গ টেনেই ভাষণ দেন রাজ্যের অর্থমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য। তিনিও নবীর শিক্ষার বিশ্বজনীনতার দিকটি তুলে ধরেন। চন্দ্রিমা বলেন, ‘আমরা যদি মানুষকে না দেখি তবে ঈশ্বর বা আল্লাহ্ আমাদের ভালোবাসবেন না। নিজ ধর্মের আচরণ পালন করেই প্রফেটের দেখানো মানবিকতার পথ ধরে হাঁটতে হবে আমাদের। এই অঙ্গীকার করতে হবে সবাইকে।’
এদিন দৈনিক পুবের কলম-এর তরফ থেকে তাঁকে পবিত্র কুরআনের ইংরেজি তরজমা উপহার দেওয়া হয়, যা পেয়ে তিনি আপ্লুত হয়ে বলেন, এর জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ। আমার সুযোগ হয়নি কুরআন পড়ার। এবার পড়তে পারব।
মন্ত্রী চন্দ্রিমা বাংলায় হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতির বিষয়টিও চমৎকারভাবে তুলে ধরেন। ভাষণমঞ্চে দাঁড়িয়ে বলেন, ‘এই মঞ্চে কুমারেশ চক্রবর্তী, দীপঙ্কর ভট্টাচার্য, আমি চন্দ্রিমা যেমন রয়েছে, তেমনই রয়েছেন ইমরান, মইনুল ওয়ায়েজুলরা। আমাদেরকে ভাগ করা সম্ভব নয়। স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় মুসলিম বা হিন্দু কেউই মেপে রক্ত দেয়নি। রবীন্দ্রনাথ-নজরুলের বাংলা ভাগ করতে পারবে না কেউ। আজ সোমঋতার কণ্ঠে নাত-এ রসূল শুনলাম। এই হচ্ছে আমাদের বাংলা। সম্প্রীতির বাংলা। আমরা এমন এক সমাজ গড়ব যেখানে সব ধর্মকে শ্রদ্ধা করা হবে। ধর্মের নামে দেশ ভাগ করতে চাইলে কেউ মেনে নেবে না। মত যত থাকবে পথ তত বেশি হবে। মতের জন্য বিভাজন হয় না। আমাদের নারীদের প্রসবের যন্ত্রণার কি বিভাজন করা যায়?
রক্তের কি বিভাজন করা যায়? সবার ব্যথা অনুভব করতে হবে। প্রফেট দেখিয়ে দিয়ে গিয়েছেন, শিখিয়ে দিয়ে গিয়েছেন —মানুষকে ভালোবাসো। তার পাশে থাকো। এমন মানব ধর্মের কথাই তিনি বলে গিয়েছেন।’
রাজ্যের সংখ্যালঘু বিষয়ক মন্ত্রী গোলাম রব্বানিও পশ্চিমবঙ্গের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ছবিটিই তুলে ধরেন তাঁর বক্তব্যে। মুসলমানদের উন্নতির জন্য শিক্ষার গুরুত্বটিও উঠে আসে তাঁর ভাষণে।
মুহাম্মদ সা.-এর শিক্ষা ও জীবনের কথা উঠে আসে অধ্যাপক, চিন্তাবিদ কুমারেশ চক্রবর্তীর ভাষণেও। তিনি বলেন, ‘মার্কিন সংবিধানের অনেক আগে মদিনা সনদ তৈরি হিয়েছে। আমরা এটাকে উপেক্ষা করি। মুহাম্মদ সা. প্রথম সংবিধান তৈরি করেছেন। তিনিই প্রথম নারী মুক্তির দিশারি। তার আগে সমাজে মেয়েদের কোনও সম্মান বা মর্যাদা ছিল না। নবী সা. বলেছিলেন, যদি মুসলিম অমুসলিম কাউকে হত্যা করতে যায় তবে আমি বাধা দেব।’ তাঁর কথাগুলো সমাজে প্রয়োগ করলে অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে বলে মতপ্রকাশ করেন তিনি।
দৈনিক পুবের কলম, বঙ্গীয় সংখ্যালঘু বুদ্ধিজীবী মঞ্চ ও সাংস্কৃতিক সংস্থা একটি কুসুম-এর আয়োজনে মুহাম্মদ সা.-এর জন্মমাস রবিউল আউয়ালে উর্দু অ্যাকাডেমিতে এদিনের মহত্ত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানে নবীর শিক্ষা ও জীবনের নানা দিক উঠে আসে। বিশেষ করে মুহাম্মদ সা.-কে নিয়ে প্রতিবেশী সমাজের ভাবনা ফুটে ওঠে সমগ্র অনুষ্ঠানে। চন্দ্রিমা, কুমারেশ চক্রবর্তীর পাশাপাশি শিক্ষাবিদ দীপঙ্কর ভট্টাচার্য, গৌতম পাল প্রফেটের বিশ্বজনীন শিক্ষা ও ন্যায়বিচারের কথা তুলে ধরেন। দীপঙ্কর ভট্টাচার্য মহাত্মা গান্ধির কথা উদ্ধৃত করে বলেন, গান্ধিজি বলেছিলেন, মুহাম্মদ সা. সত্যান্বেষী।
যত বাধাবিপত্তি আসুক না কেন সত্যকে তিনি আঁকড়ে ধরেছেন। কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-উপাচার্য ও প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের চেয়ারম্যান গৌতম পাল বলেন, ‘মানুষের মধ্যে একতা তৈরি করতে পারে ধর্মই। অসহিষ্ণু উপায়ে বিভিন্ন ধর্মের মানুষের মধ্যে বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি করার চেষ্টা হচ্ছে, সেটা ৫ হাজার বছরেও সফল হবে না। হিন্দু-মুসলিম সবচেয়ে সুখে বাস করেন বাংলায়। মুসলমানরা গণতন্ত্রের অন্যতম শক্তি। তাদের বাদ দিয়ে কেউ ক্ষমতায় থাকতে পারবে না।’
তবে তিনি অভিযোগ তোলেন, সংখ্যাগুরুরা ধর্মনিরপেক্ষতা থেকে বিচ্যুত হচ্ছে। অন্যদিকে, সংখ্যালঘুরা ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক দেশের অন্যতম রক্ষক হয়ে উঠবেন বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।
গৌড়বঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মেহেদি হাসান বলেন, মাইকেল এইচ হার্টের ‘দ্য হান্ড্রেড’ বইতে বিশ্বের সেরা ১০০ মনীষীর মধ্যে প্রথম স্থান পেয়েছেন প্রিয়নবী সা.। তিনি ছিলেন সকলের জন্য করুণাস্বরূপ। পরিপূর্ণ মানুষ। তাঁর শিক্ষায় শিক্ষিত হতে হবে আমাদের। বঙ্গীয় সংখ্যালঘু বুদ্ধিজীবী মঞ্চের সভাপতি ওয়ায়েজুল হক এদিনের অনুষ্ঠানটি সুচারুভাবে সঞ্চালনা করেন। রাসুলের শিক্ষার অনুসারী হয়ে চললেই যে সমাজের সার্বিক উন্নতি ঘটবে, সেকথা তুলে ধরেন তিনি।
নবীদিবস উদযাপনের অনুষ্ঠানটি শুধু ভাষণে ঠাসা ছিল না। উর্দু অ্যাকাডেমির হলভর্তি মানুষজনকে স্বস্তি দিয়েছে পলাশ চৌধুরীর সংগীত —‘মুহাম্মদের নাম জপেছিলি বুলবুলি তুই আগে, এবং ‘দে দে পাল তুলে দে মাঝি হেলা করিস না’। পাশাপাশি, কলকাতার ছায়ানটের প্রধান সোমঋতা মল্লিক ‘ত্রিভুবনের প্রিয় মুহাম্মদ’, ‘তোরা দেখে যা আমিনা মায়ের কোলে’ শীর্ষক নাত পরিবেশনের মাধ্যমে সম্প্রীতির বাংলার অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। নবীকে নিয়ে রচিত কবিতা পাঠ করেন পুবের কলম-এর সাহিত্য সম্পাদক শফিকুল ইসলাম, কবি ও উদার আকাশ-এর সম্পাদক ফারুক আহমেদ।
দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার পূর্বাভাস থাকলেও বাংলার বিভিন্ন জেলা থেকে বহু বিশিষ্ট মানুষ নবীকে নিয়ে আলোচনা শুনতে হাজির হয়েছিলেন এদিন। তাদের উৎসাহ-উদ্দীপনা বাড়তি প্রেরণা জুগিয়েছে আয়োজকদের। বিশিষ্টদের মধ্যে লেখক ও প্রাক্তন সাংসদ মইনুল হাসান, শিক্ষাবিদ সেলিম শাহী, সমাজসেবী কুতুবউদ্দিন তরফদার, হারুন রসিদ ডাক্তার প্রকাশ মল্লিক, তৃণমূল নেতা একে এম ফারহাদ, সফিকুল ইসলাম দুলাল, প্রাবন্ধিক একরামুল হক শেখ, আবু সালেহ মুহাম্মদ রেজওয়ানুল করিম, পুবের কলম-এর ডিরেক্টর নুসরত হাসান প্রমুখ হাজির ছিলেন। মাওলানা আবদুর রহমানের কুরআন তিলাওয়াত দিয়ে অনুষ্ঠানটির সূচনা হয়েছিল। শেষ হয় হাজি কুতুবউদ্দিনের দোয়ার মাধ্যমে।