ভয়কে উপেক্ষা করে কাশ্মীরে যাচ্ছেন অনেক পর্যটক, তাঁদের সকলের বক্তব্য সন্ত্রাসকে জিততে দেওয়া যাবে না

- আপডেট : ২৮ এপ্রিল ২০২৫, সোমবার
- / 211
পুবের কলম, ওয়েবডেস্ক: ২২ এপ্রিল, মঙ্গলবার আচমকা জঙ্গি হামলায় রক্তাক্ত হয়ে ওঠে ভূস্বর্গ। সন্ত্রাসের বলি হয় ২৬টি তরতাজা প্রাণ। সারা দেশজুড়ে হামলার তীব্র নিন্দা জানানো হয়। জঙ্গিহানায় প্রশ্নের মুখে পড়ে জম্মু-কাশ্মীরের পর্যটনশিল্পের ভবিষ্যৎ। ঘটনার পর থেকে অনেকে কাশ্মীরের বুকিং বাতিল করে দেয়। আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি হয়। কাশ্মীরের ব্যবসায়ী থেকে দোকানদার সকলেই হামলার নিন্দা জানিয়ে কাশ্মীরে আসার অনুরোধ জানান। কাশ্মীরিয়ত, মেহমান নবাজি ভূস্বর্গের প্রাণ। কাশ্মীরে আসার জন্য সবাইকে স্বাগত জানান সেখানকার স্থানীয় বাসিন্দারা। উপত্যকার বাসিন্দাদের একাংশের মত, পর্যটকদের উপর হামলা আসলে পর্যটন শিল্পকেই ধ্বংসের চেষ্টা। সেখানকার মানুষরা সরব হন, জম্মু-কাশ্মীরের অর্থনীতিতে পঙ্গু করার চেষ্টা চলছে। পহেলগাঁওয়ের ঘটনার অভিঘাতে উপত্যকা ছাড়ার ঢলও নামে। তাতে সেই আশঙ্কা আরও প্রকট হয়ে ওঠে। তবে সার্বিক চিত্রটা আদতে তা নয় বলে অনেকেই মনে করছেন। কাশ্মীর একেবারেই পর্যটক শূন্য হয়ে যায়নি। ভয়কে উপেক্ষা করেই ভূস্বর্গে যাচ্ছেন অনেকে। পহেলগাঁওতেও যাচ্ছেন। কারও কারও মুখে এ-ও শোনা যাচ্ছে— সন্ত্রাসবাদকে জিততে দেওয়া যাবে না।
মঙ্গলবার পহেলগাঁওয়ের বৈসরন উপত্যকায় ওই ঘটনার পর পর্যটকদের অনেকেই কাশ্মীর ছেড়ে জম্মুতে চলে গিয়েছিলেন। যাঁদের জম্মু থেকে কাশ্মীর যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল, তাঁদের অনেকে সেই পরিকল্পনা বাতিল করে দ্রুত ফেরার চেষ্টা করেছেন। এর জেরে এক ধাক্কায় পর্যটকদের সংখ্যা অনেকটাই কমে যায় উপত্যকায়। আগে যেখানে প্রত্যেকদিন পাঁচ থেকে সাত হাজার পর্যটকের আনাগোনা ছিল এখন সেখানে পর্যটকের সংখ্যা এসে দাঁড়িয়েছে ৫০-১০০ জন। জম্মু-কাশ্মীর হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি বাবর চৌধরী বলেছেন, ‘‘পহেলগাঁওয়ের ঘটনার পর অন্তত ১৩ লাখ বুকিং বাতিল হয়েছে।’’
তবে যে সব পর্যটক এখনও কাশ্মীরে রয়েছেন, তাঁদের অধিকাংশেরই বক্তব্য, ভূস্বর্গের পরিস্থিতি এখন স্বাভাবিক। রবিবার বলিউড অভিনেতা অতুল কুলকুর্নি কাশ্মীরে গিয়েছেন। রবিবার শ্রীনগর থেকে পহেলগাঁও উদ্দেশে রওনা দেন। তিনি বলেন, “এটাই কাশ্মীর আসার পিক সিজন। কিন্তু ৯০ শতাংশ বুকিং ক্যানসেল হয়ে গেছে। কাশ্মীরিয়ত সামলাতে হবে। কাশ্মীরিদের পাশে আমাদের থাকতে হবে। পর্যটনশিল্প মানে শুধুই ব্যবসা নয়। মানুষের সঙ্গে মানুষের মেল বন্ধন।গত দু-তিন বছর ধরে কাশ্মীরে প্রচুর পর্যটক আসছিল। হঠাৎ যদি তা বন্ধ হয়ে যায় তাহলে কাশ্মীরের সঙ্গে যে মেলবন্ধন তৈরি হয়েছিল তা বন্ধ হয়ে যাবে।” তিনি আরও বলেন, “সন্ত্রাসবাদীদের কিছুতেই জিততে দেওয়া যাবে না। আমরা এখানে আসব। প্রচুর পরিমাণে আসুন। বুকিং ক্যানসেল করবেন না। আর যারা অন্য কোথাও যাবেন ঠিক করেছেন, তারা সেখানকার বুকিং ক্যানসেল করে কাশ্মীরে চলে আসুন। কা্শ্মীরিয়ত আমাদের সামলাতে হবে। কাশ্মীরিদের ভালবাসা দরকার। ওদের মুখে হাসি ফোটাতে হবে।” কাশ্মীরে ঘুরতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে কোনও রকম ভয় হয়নি বলেও জানান বলিউড অভিনেতা অতুল কুলকুর্নি।
এছাড়া কলকাতার বাসিন্দা জয়দীপ ঘোষ দস্তিদার বলেন, “গত শুক্রবার কাশ্মীরে এলাম। এখানে সব কিছুই স্বাভাবিক। বাজার, দোকানপাট সে ভাবে খোলা নেই। নিরাপত্তাবাহিনী এবং স্থানীয়েরা খুবই সাহায্য করছেন। বৈসরন যাওয়া যাচ্ছে না, যা খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু অন্যান্য জায়গায় দিব্যি ঘোরা যাচ্ছে।” রবিবারই কাশ্মীর থেকে কলকাতায় ফিরেছেন টালার বাসিন্দা সৌমি ঘোষ। ঘটনার দিন তিনি পহেলগাঁওয়েই ছিলেন। পহেলগাঁওয়ের আশেপাশে ঘুরতে বেরিয়েছিলেন। সেখান থেকে ফেরার পর হোটেলে ঢুকে জঙ্গি হামলার খবর জানতে পারেন। সৌমি জানান, “গত ২২ এপ্রিল ওই ঘটনার পর ২৩ তারিখেও তাঁরা বেরিয়েছিলেন। কাটরার উদ্দেশে রওনা দিয়েছিলেন। কিন্তু পুলিশ তাঁদের আটকে দেয়। হোটেলে ফিরে যেতে হয়েছিল। পর দিন থেকে আর কোনও সমস্যা হয়নি।” তবে পর্যটকের সংখ্যা কম ছিল বলে জানান সৌমি।
সৌমি বলেন, ‘‘আমাদের একটাই বক্তব্য, সন্ত্রাসবাদকে কোনও ভাবেই জিততে দেওয়া যাবে না। তাই আমরা ফিরে আসিনি। পরিকল্পনা মতোই ঘুরেছি। আমরা যে হোটেলে ছিলাম, সেই হোটেলের লোকেরা আমাদের ক্রমাগত আশ্বাস দিয়ে গিয়েছেন।” বার বার বলেছেন, “আপনাদের দায়িত্ব আমাদের। আপনারা যাবেন না।” কাশ্মীরের মূল আয় পর্যটনশিল্প। হামলার পর থেকে কাশ্মীরিরা সে কথা বারবার বলে এসেছেন। কাশ্মীরের আয়ের কোমড় ভাঙা হচ্ছে বলেও তাঁরা সরব হন। চলতি বছরের শুরু থেকে অন্তত লক্ষাধিক পর্যটন কাশ্মীরে আসায় কিছুটা আশার আলো দেখেছিলেন নানা ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত মানুষরা। করোনায় লকডাউনের পর এবছরই সবচেয়ে বেশি পর্যটক হয়েছিল বলে মনে করেছিলেন কাশ্মীরিরা। তবে পহেলগাঁওতে জঙ্গি হামলার পরে সে আশা ক্রমশ ক্ষীণ হতে বসেছিল। কাশ্মীর পর্যটকশূন্য হলে স্থানীয়দের রুজিরুটি ধাক্কা খাবে বলে মনে করা হচ্ছিল। হামলার ঘটার প্রতিবাদে কাশ্মীরে সর্বাত্মক বনধও পালিত হয়। দেশ-বিদেশের পর্যটকদের উদ্দেশে তাঁদের আর্জি ছিল, ‘‘আপনারা কাশ্মীর ছেড়ে যাবেন না। আপনার দয়া করে এখানে আসুন।’’
পর্যটকেরাও ভয় কাটিয়ে কাশ্মীর যাচ্ছেন। খুব বেশি সংখ্যায় না হলেও কাশ্মীর ভ্রমণ পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়নি। যাঁরা কাশ্মীরে ঘুরতে যাচ্ছেন, তাঁদের সবারই একটিই কথা পর্যটকরা কাশ্মীরে আসা বন্ধ করে দিলে সন্ত্রাসবাদীদের জয় হবে। তা হতে দেওয়া যাবে না। কাশ্মীরকে এ ভাবে শেষ করে দেওয়া যাবে না।
সোমবার কাশ্মীর বিধানসভায় বিশেষ অধিবেশন ডাকা হয়। সেখানে মুখ্যমন্ত্রী জঙ্গি হামলার দায় নিজের কাঁধে তুলে নিয়ে ক্ষমা প্রার্থনা চান। মুখ্যমন্ত্রী এবং পর্যটন মন্ত্রী হিসাবে নিহত ও তাঁদের পরিবারের কাছে ক্ষমা চেয়ে নেন ওমর আবদুল্লা। এই হামলা কাশ্মীরিয়তের ওপর হামলা বলে জানান। ঘটনায় মাথা নত হয়ে গেছে বলেও জানান মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লা।
View this post on Instagram