০১ মে ২০২৫, বৃহস্পতিবার, ১৮ বৈশাখ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সরানো হল রবীন্দ্রনাথের ভাস্কর্য

ইমামা খাতুন
  • আপডেট : ২৪ ফেব্রুয়ারী ২০২৩, শুক্রবার
  • / 16

বিশেষ প্রতিবেদন: বিষণ্ণ মুখে দাঁড়িয়ে আছেন কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। বিশ্বখ্যাত যে গ্রন্থের জন্য তিনি প্রায় এক শতাদ্বী আগে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন, সেই  ‘গীতাঞ্জলি’র বুক ভেদ করেছে এক ঘাতক পেরেক। রবীন্দ্রনাথের মুখও বন্ধ। সেখানে আছে টেপের শক্ত বাঁধন। সাড়ে ১৯ ফুট উচ্চতার এই ভাস্কর্যটি নির্মাণ করেছিল বাংলাদেশের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের একদল পড়ুয়া। কিন্তু এখন আর সেই ভাস্কর্য নেই। গায়েব হয়ে গিয়েছে। বাংলাদেশের সচেতন নাগরিকরা বলছেন, রবীন্দ্রনাথ ‘গুম’ হয়ে গিয়েছেন।

পরে ফেরত পাওয়া গেলেও ফের তা সরিয়ে ফেলা হয়েছে পাকাপাকিভাবে। ১৯৭১ সালে ভারতের সাহায্যে স্বাধীনতা লাভের পর বঙ্গবন্ধু মুজিবর রহমানের নেতৃত্বে নবগঠিত বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত হিসেবে রবীন্দ্রনাথের ‘আমার সোনার বাংলা’কে মর্যাদা দেওয়া হয়। দেশটিতে পশ্চিমবঙ্গের মতোই তাঁকে যথাযোগ্য সম্মান দেওয়া হয়েছে। তাঁর স্মৃতিবিজড়িত বিভিন্ন স্থানগুলিকে হেরিটেজ তকমা দিয়ে সংরক্ষণ করেছে বাংলাদেশ সরকার।

কিন্তু সাম্প্রতিক এই ঘটনার মাধ্যমে বাংলাদেশে রবীন্দ্রনাথের মর্যাদাহানি করা হয়েছে বলে অনেকেই মনে করছেন। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার প্রধানমন্ত্রিত্বে এটা কীভাবে সম্ভব হচ্ছে, তা ভেবে পাচ্ছেন না কলকাতার রবীন্দ্রভক্ত ও বুদ্ধিজীবীরা। তাঁদের মনে নিদারুণ দুঃখ দিয়েছে এই ‘গুম’-এর ঘটনা। বাংলাদেশের পত্রপত্রিকায় মাঝেমধ্যেই বিভিন্ন ব্যক্তিকে গুম করে দেওয়ার ঘটনা চোখে পড়ে। কিন্তু স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের ভাস্কর্যের সঙ্গে এই ‘ছ্যাবলামি’ মেনে নিতে পারছেন না সংস্কৃতি জগতের মানুষ।

সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিখ্যাত রাজু ভাস্কর্যের পাশে ভাস্কর্যটি স্থাপন করা হয়েছিল। এই উদ্যোগের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন ছাত্র সংগঠনগুলোর নেতা-কর্মীরা। তাঁরা বলছেন, লেখক,  শিল্পী, সাংবাদিক-সহ দেশের সব পর্যায়ের মানুষের স্বাধীন মতপ্রকাশে বাধার প্রতিবাদে ভাস্কর্যটি নির্মাণ করা হয়েছিল। বাংলাদেশে বই প্রকাশ ও বিক্রিতেও নিষেধাজ্ঞা জারি করা হচ্ছে বলে তাদের দাবি। এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদের হাতিয়ার হয়ে উঠেছিল রবীন্দ্র-ভাস্কর্য।

জানা গেছে, এবারের একুশে বইমেলায় আদর্শ প্রকাশনীকে স্টল না দেওয়া, দেশটির চলচ্চিত্র পরিচালক মোস্তফা সরয়ার ফারুকির ‘শনিবার বিকেল’ নামের চলচ্চিত্রকে ছাড়পত্র দিতে সেন্সর বোর্ডের সময় নেওয়া, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে সাংবাদিকদের গ্রেফতার-হয়রানির মতো বিভিন্ন ঘটনার প্রতিবাদে পেরেকবিদ্ধ ‘গীতাঞ্জলি’ হাতে বাক্রুদ্ধ ও বিষণ্ণ রবীন্দ্রনাথের ভাস্কর্যটি নির্মাণ করা হয়েছিল।

বাঁশ, থার্মোকল আর বইয়ের কাগজ ব্যবহার করে সাড়ে চার ফুটের বেদিসহ মোট সাড়ে ১৯ ফুট উচ্চতার এই ভাস্কর্য নির্মাণ করা হয়। এই উদ্যোগের নেতৃত্বে ছিলেন চারুকলার ভাস্কর্য বিভাগের ছাত্র শিমুল কুম্ভকার। তিনি বলেন, ‘শেখ হাসিনা সরকারের বাংলাদেশে মুক্তচিন্তা, সৃজনশীলতা ও স্বাধীন মতপ্রকাশ এখন পদে পদে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। আদর্শ প্রকাশনীকে বইমেলায় স্টল না দেওয়ার উদাহরণটি তো সামনে আছেই।

কোনও বই বা লেখার উপর সেন্সরশিপ আরোপ করা উচিত নয়। বই বা লেখা যাঁর পড়ার ইচ্ছা, তিনি পড়বেন। যাঁর ইচ্ছা নেই, তিনি পড়বেন না। একইসঙ্গে সাংবাদিকদেরও লিখতে দেওয়া হচ্ছে না। এই ভাস্কর্য এ সব কিছুর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। মুক্তচিন্তা ও সৃজনশীলতার প্রতীক হিসেবে রবীন্দ্রনাথ অতুলনীয়। তাই তাঁকে ভাস্কর্যের বিষয় করা হয়েছিল।’

কিন্তু দুঃখের বিষয়, দিনকয়েক পরেই এটি উধাও হয়ে যায় টিএসসি চত্বর থেকে। গত সপ্তাহের মঙ্গলবার বিকেলে রাজু ভাস্কর্যের পাশে ভাস্কর্যটি স্থাপন করা হয়েছিল। পরবর্তীতে ওই সপ্তাহের বৃহস্পতিবার ‘নীতিমালা বহির্ভূত’ উল্লেখ করে ভাস্কর্যটি সরিয়ে ফেলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। পরে ভাস্কর্যের ভাঙা অংশ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে পাওয়া যায়। এরপর শুক্রবার দুপুরে সেই ভাঙা অংশ দিয়েই আবারও ভাস্কর্যটি স্থাপন করা হয়। তবে তাতে বিতর্ক থামেনি।

পরিশেষে ভাস্কর্যটি পুরোপুরি সরিয়ে ফেলা হয়েছে। বুধবার রাতে ভাস্কর্য স্থাপনের সঙ্গে যুক্ত চারুকলার শিক্ষার্থীরাই এটি সরিয়ে ফেলে। শিমুল কুম্ভকার জানান, আমরাই বুধবার রাতে এটি সরিয়ে ফেলেছি। এর মাথা নিচের দিকে হেলে পড়েছিল। ওই অবস্থায় ভাস্কর্যটিকে একটু দৃষ্টিকটুও লাগছিল। তিনি সরকারি চাপের মুখেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলে অনেকের ধারণা।

অপরদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর এ কে এম গোলাম রব্বানী বলেন, ‘একটা ভাস্কর্যের পাশে আরেকটা ভাস্কর্য স্থাপন করা নিয়ে প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। অনুমতি ছাড়া ক্যাম্পাসে কারা এ কাজটি করল, সেটা আমরা জানার চেষ্টা করছি। যে চিন্তা থেকেই ভাস্কর্যটি বসানো হয়ে থাকুক, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে অবশ্যই আগে জানানো উচিত ছিল।’

Copyright © Puber Kalom All rights reserved.| Developed by eTech Builder

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সরানো হল রবীন্দ্রনাথের ভাস্কর্য

আপডেট : ২৪ ফেব্রুয়ারী ২০২৩, শুক্রবার

বিশেষ প্রতিবেদন: বিষণ্ণ মুখে দাঁড়িয়ে আছেন কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। বিশ্বখ্যাত যে গ্রন্থের জন্য তিনি প্রায় এক শতাদ্বী আগে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন, সেই  ‘গীতাঞ্জলি’র বুক ভেদ করেছে এক ঘাতক পেরেক। রবীন্দ্রনাথের মুখও বন্ধ। সেখানে আছে টেপের শক্ত বাঁধন। সাড়ে ১৯ ফুট উচ্চতার এই ভাস্কর্যটি নির্মাণ করেছিল বাংলাদেশের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের একদল পড়ুয়া। কিন্তু এখন আর সেই ভাস্কর্য নেই। গায়েব হয়ে গিয়েছে। বাংলাদেশের সচেতন নাগরিকরা বলছেন, রবীন্দ্রনাথ ‘গুম’ হয়ে গিয়েছেন।

পরে ফেরত পাওয়া গেলেও ফের তা সরিয়ে ফেলা হয়েছে পাকাপাকিভাবে। ১৯৭১ সালে ভারতের সাহায্যে স্বাধীনতা লাভের পর বঙ্গবন্ধু মুজিবর রহমানের নেতৃত্বে নবগঠিত বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত হিসেবে রবীন্দ্রনাথের ‘আমার সোনার বাংলা’কে মর্যাদা দেওয়া হয়। দেশটিতে পশ্চিমবঙ্গের মতোই তাঁকে যথাযোগ্য সম্মান দেওয়া হয়েছে। তাঁর স্মৃতিবিজড়িত বিভিন্ন স্থানগুলিকে হেরিটেজ তকমা দিয়ে সংরক্ষণ করেছে বাংলাদেশ সরকার।

কিন্তু সাম্প্রতিক এই ঘটনার মাধ্যমে বাংলাদেশে রবীন্দ্রনাথের মর্যাদাহানি করা হয়েছে বলে অনেকেই মনে করছেন। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার প্রধানমন্ত্রিত্বে এটা কীভাবে সম্ভব হচ্ছে, তা ভেবে পাচ্ছেন না কলকাতার রবীন্দ্রভক্ত ও বুদ্ধিজীবীরা। তাঁদের মনে নিদারুণ দুঃখ দিয়েছে এই ‘গুম’-এর ঘটনা। বাংলাদেশের পত্রপত্রিকায় মাঝেমধ্যেই বিভিন্ন ব্যক্তিকে গুম করে দেওয়ার ঘটনা চোখে পড়ে। কিন্তু স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের ভাস্কর্যের সঙ্গে এই ‘ছ্যাবলামি’ মেনে নিতে পারছেন না সংস্কৃতি জগতের মানুষ।

সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিখ্যাত রাজু ভাস্কর্যের পাশে ভাস্কর্যটি স্থাপন করা হয়েছিল। এই উদ্যোগের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন ছাত্র সংগঠনগুলোর নেতা-কর্মীরা। তাঁরা বলছেন, লেখক,  শিল্পী, সাংবাদিক-সহ দেশের সব পর্যায়ের মানুষের স্বাধীন মতপ্রকাশে বাধার প্রতিবাদে ভাস্কর্যটি নির্মাণ করা হয়েছিল। বাংলাদেশে বই প্রকাশ ও বিক্রিতেও নিষেধাজ্ঞা জারি করা হচ্ছে বলে তাদের দাবি। এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদের হাতিয়ার হয়ে উঠেছিল রবীন্দ্র-ভাস্কর্য।

জানা গেছে, এবারের একুশে বইমেলায় আদর্শ প্রকাশনীকে স্টল না দেওয়া, দেশটির চলচ্চিত্র পরিচালক মোস্তফা সরয়ার ফারুকির ‘শনিবার বিকেল’ নামের চলচ্চিত্রকে ছাড়পত্র দিতে সেন্সর বোর্ডের সময় নেওয়া, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে সাংবাদিকদের গ্রেফতার-হয়রানির মতো বিভিন্ন ঘটনার প্রতিবাদে পেরেকবিদ্ধ ‘গীতাঞ্জলি’ হাতে বাক্রুদ্ধ ও বিষণ্ণ রবীন্দ্রনাথের ভাস্কর্যটি নির্মাণ করা হয়েছিল।

বাঁশ, থার্মোকল আর বইয়ের কাগজ ব্যবহার করে সাড়ে চার ফুটের বেদিসহ মোট সাড়ে ১৯ ফুট উচ্চতার এই ভাস্কর্য নির্মাণ করা হয়। এই উদ্যোগের নেতৃত্বে ছিলেন চারুকলার ভাস্কর্য বিভাগের ছাত্র শিমুল কুম্ভকার। তিনি বলেন, ‘শেখ হাসিনা সরকারের বাংলাদেশে মুক্তচিন্তা, সৃজনশীলতা ও স্বাধীন মতপ্রকাশ এখন পদে পদে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। আদর্শ প্রকাশনীকে বইমেলায় স্টল না দেওয়ার উদাহরণটি তো সামনে আছেই।

কোনও বই বা লেখার উপর সেন্সরশিপ আরোপ করা উচিত নয়। বই বা লেখা যাঁর পড়ার ইচ্ছা, তিনি পড়বেন। যাঁর ইচ্ছা নেই, তিনি পড়বেন না। একইসঙ্গে সাংবাদিকদেরও লিখতে দেওয়া হচ্ছে না। এই ভাস্কর্য এ সব কিছুর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। মুক্তচিন্তা ও সৃজনশীলতার প্রতীক হিসেবে রবীন্দ্রনাথ অতুলনীয়। তাই তাঁকে ভাস্কর্যের বিষয় করা হয়েছিল।’

কিন্তু দুঃখের বিষয়, দিনকয়েক পরেই এটি উধাও হয়ে যায় টিএসসি চত্বর থেকে। গত সপ্তাহের মঙ্গলবার বিকেলে রাজু ভাস্কর্যের পাশে ভাস্কর্যটি স্থাপন করা হয়েছিল। পরবর্তীতে ওই সপ্তাহের বৃহস্পতিবার ‘নীতিমালা বহির্ভূত’ উল্লেখ করে ভাস্কর্যটি সরিয়ে ফেলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। পরে ভাস্কর্যের ভাঙা অংশ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে পাওয়া যায়। এরপর শুক্রবার দুপুরে সেই ভাঙা অংশ দিয়েই আবারও ভাস্কর্যটি স্থাপন করা হয়। তবে তাতে বিতর্ক থামেনি।

পরিশেষে ভাস্কর্যটি পুরোপুরি সরিয়ে ফেলা হয়েছে। বুধবার রাতে ভাস্কর্য স্থাপনের সঙ্গে যুক্ত চারুকলার শিক্ষার্থীরাই এটি সরিয়ে ফেলে। শিমুল কুম্ভকার জানান, আমরাই বুধবার রাতে এটি সরিয়ে ফেলেছি। এর মাথা নিচের দিকে হেলে পড়েছিল। ওই অবস্থায় ভাস্কর্যটিকে একটু দৃষ্টিকটুও লাগছিল। তিনি সরকারি চাপের মুখেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলে অনেকের ধারণা।

অপরদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর এ কে এম গোলাম রব্বানী বলেন, ‘একটা ভাস্কর্যের পাশে আরেকটা ভাস্কর্য স্থাপন করা নিয়ে প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। অনুমতি ছাড়া ক্যাম্পাসে কারা এ কাজটি করল, সেটা আমরা জানার চেষ্টা করছি। যে চিন্তা থেকেই ভাস্কর্যটি বসানো হয়ে থাকুক, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে অবশ্যই আগে জানানো উচিত ছিল।’