০১ জুলাই ২০২৫, মঙ্গলবার, ১৬ আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

প্রতিশোধ! প্রতিশোধ! ইতিহাস পালটে প্রতিশোধ

বিপাশা চক্রবর্তী
  • আপডেট : ১ মার্চ ২০২৩, বুধবার
  • / 46

তাজমহল তৈরি করেছিলেন মোঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের পিতা শাহজাহান। সেই তাজমহল কি 'তেজোমহালয়া' হবে?

প্রতিশোধ! প্রতিশোধ! ইতিহাস পালটে প্রতিশোধআহমদ হাসান ইমরান: দেশে সংখ্যালঘু বিদ্বেষী উগ্র রাজনীতি বিগত এক দশকে তুঙ্গে উঠেছে। একটি গোষ্ঠী মানুষ ভাবতে শুরু করেছে, তাঁরাই দেশের মালিক, তাঁরাই দেশের প্রভু, তাঁরাই দেশের শাসক। তাঁদের ইচ্ছেই হচ্ছে আইন। সংবিধান, সম্প্রীতি, ভ্রাতৃত্ববোধ এসব কিছুই তাঁদের কাছে গৌণ। তাঁরা যেভাবে ভারতকে কল্পনা করেন, তা সমগ্র দেশবাসীর উপর চাপিয়ে দিতে চান।

আর তাঁদের কথা যারা মানবে না তারা দেশদ্রোহী। ভারতে তাদের কোনও জায়গা নেই। তাঁদের টার্গেট বা নিশানার তালিকায় শুধু মুসলিম, খ্রিস্টানরাই নয়, রয়েছে দলিত, আদিবাসী এবং সমস্ত নিম্নবর্ণের মানুষ। দেশের আদি ভূমিপুত্র সাঁওতাল এবং ওঁরাও, মুণ্ডা, ভিল এদের ধর্ম সারি ও সারনাকে তাঁরা স্বীকৃতি দিতে রাজি নয়। তাঁদের বক্তব্য, ভারতে ১০ কোটির বেশি আদিবাসী জনজাতিকে ‘হিন্দু’ হতে হবে এবং হিন্দুত্বকে মেনে নিতে হবে।

আরও পড়ুন: ঔরঙ্গজেবের সমাধি রক্ষা করার আর্জি জানিয়ে রাষ্ট্রসংঘকে চিঠি মুঘল বংশধর ইয়াকুব হাবিবুদ্দিনের

অবশ্য এ কাজ একদিনে হয়নি, দীর্ঘদিন ধরে সংঘ পরিবার এবং সংশ্লিষ্ট বুদ্ধিজীবীরা এই কাজ করে যাচ্ছেন। বিভেদ নীতির সমর্থক ইংরেজ ঐতিহাসিকরাও অনেক সময় বিকৃত ইতিহাস ও ইতিহাস পালটানোর অভিযানে হাওয়া দিয়েছেন।

বর্তমানে ক্ষমতাসীন হওয়ার পর সংঘ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সংগঠন বজরং দল, বিশ্বহিন্দু পরিষ, বিজেপির নেতৃবৃন্দ মুসলিম শাসকদের উপর ‘প্রতিশোধ’ নেওয়ার অভিযানে নেমে পড়েছেন। যেমন মুঘলসরাই রেলওয়ে স্টেশনের নাম হয়েছে পণ্ডিত দিনদয়াল উপাধ্যায় স্টেশন, ইলাহাবাদ শহরের নাম হয়েছে প্রয়াগরাজ, দিল্লির মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের নামে যে বিখ্যাত রাস্তা ছিল, তা পরিবর্তন করে এপিজে আবদুল কালাম রোড করা হয়েছে।

এ ছাড়া সম্রাট আওরঙ্গজেবের নামে ছিল মহারাষ্ট্রের একটি ঐতিহাসিক শহর আওরঙ্গাবাদ। আওরঙ্গজেবের মাজার ও তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আরও অনেক ঐতিহাসিক সৌধ রয়েছে এই এলাকায়। আওরঙ্গজেবের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য তাঁর নাম পরিবর্তন করে নয়া নামকরণ হয়েছে ছত্রপতি শামবাজি নগর। ছত্রপতি শিবাজির সঙ্গে আওরঙ্গজেবের যুদ্ধের কথা সকলেরই জানা। কিন্তু এখন বিজেপির হাতে আওরঙ্গজেব পুরোপুরি পর্যুদস্ত হলেন। তাঁর নামটি বিলকুল গায়েব করে দেওয়া হল। এর থেকে বড় পরাজয় ভারতের শাহানশাহ আওরঙ্গজেবের জন্য, আর কি হতে পারে? শেষপর্যন্ত তাঁর মাজারটির দশা কী হবে, তা এখনই সঠিক করে বলা যাচ্ছে না।

মহারাষ্ট্রের ওসমানাবাদের নাম রাখা হয়েছে ধারাশিব। দৌলতাবাদ কেল্লার নাম পরিবর্তন করে দেওগিরি কিল্লা রাখা হয়েছে। এই তালিকা খুবই দীর্ঘ। মুসলিম বিশেষ করে মুঘলদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবকিছুর নামের বর্ণবাদী হিন্দুত্বকরণ করা হচ্ছে। পাঠ্য ইতিহাস থেকেও মুসলিম ও মুঘলদের ইতিহাস ও অবদান অদৃশ্য হওয়ার পালা চলছে। এর দ্বারা হাসিল হচ্ছে মুসলিম ও মোঘলদের প্রতি ঘৃণা প্রচার ও তাঁদের অবদানকে অস্তিত্বহীন করে দেওয়ার প্রচেষ্টা চলছে।

তবে এখানেই শেষ নয়, নিশানার তালিকায় রয়েছে আরও অনেক নাম।

যেমন হায়দরাবাদ শহর, গোলকুন্ডা ফোর্ট, লালকেল্লা ইত্যকার বিরাট তালিকা হাতে ধরে বসে আছেন প্রতিশোধকামীরা।

এমনকী তাজমহলেরও নাম ‘তেজোমহালয়া’ করার পরিকল্পনাও রয়েছে। এ বিষয়ে যোগী, মোদি, উদ্ধব ঠাকরে, একনাথ শিন্ডের মধ্যে কোনও ফারাক নেই। ইতিহাস মুছে ফেলে কল্পিত ইতিহাস যোগ করা হচ্ছে।

এ দিকে আরও ১০০০ নাম পরিবর্তন করার জন্য সংঘ পরিবারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এক উকিল অশ্বিনী উপাধ্যায় সুপ্রিম কোর্টে এক জনহিতের মামলা দায়ের করে বলেছিলেন, মুসলিম আক্রমণকারীদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নামগুলি পরিবর্তন করার জন্য সুপ্রিম কোর্ট যেন নির্দেশ দেয়। তবে সুপ্রিম কোর্ট এই জনহিতের আবেদনকে খারিজ করে দিয়েছে। শীর্ষ আদালত বলেছে, দেশ অতীতের মধ্যেই নিমজ্জিত থাকতে পারে না।

শীর্ষ আদালতের বিচারপতিরা বলেন, কোনও দেশের অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে এতটা হয়রানি করতে পারে না যে, তারা ইতিহাসের কয়েদি হিসেবে থেকে যায়। ভারত এক ধর্মনিরপেক্ষ দেশ। কিন্তু আপনারা চান এসব অতীতের ইস্যুগুলি টগবগ করে ফুটতে থাকুক। আপনারা কোনও এক বিশেষ সম্প্রদায়কে নীচু করে দেখাতে চান। এটা চলতে পারে না।

কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট বললে কী হবে, মুসলিম নাম পরিবর্তনের এই ঘৃণা অভিযানে দেশ ও রাজ্যে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। কোনও প্রস্তাব এলেই তাঁরা বদবিচার নাম করে তা মেনে নিচ্ছেন। এর ফলে ভারতের ঐক্য ও সংহতি কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, তার কোনও ভাবনা এদের মধ্যে নেই। এভাবে দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়গুলিকে যেভাবে আহত ও অপমানিত করা হচ্ছে, তা কিন্তু একদিন সমগ্র দেশকেই বিভীষিকাময় এক গহ´রে নিমজ্জিত করবে। আশার কথা, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানে এই ধরনের বিদ্বেষমূলক নাম পরিবর্তনের খেলা এখনও শুরু হয়নি। কারণ, এভাবে ইতিহাসকে মুছে দেওয়া যায় না। এ কথা এত তাড়াতাড়ি উপলব্ধি করা যায়, ততই কল্যাণ।

Copyright © Puber Kalom All rights reserved.| Developed by eTech Builder

প্রতিশোধ! প্রতিশোধ! ইতিহাস পালটে প্রতিশোধ

আপডেট : ১ মার্চ ২০২৩, বুধবার

প্রতিশোধ! প্রতিশোধ! ইতিহাস পালটে প্রতিশোধআহমদ হাসান ইমরান: দেশে সংখ্যালঘু বিদ্বেষী উগ্র রাজনীতি বিগত এক দশকে তুঙ্গে উঠেছে। একটি গোষ্ঠী মানুষ ভাবতে শুরু করেছে, তাঁরাই দেশের মালিক, তাঁরাই দেশের প্রভু, তাঁরাই দেশের শাসক। তাঁদের ইচ্ছেই হচ্ছে আইন। সংবিধান, সম্প্রীতি, ভ্রাতৃত্ববোধ এসব কিছুই তাঁদের কাছে গৌণ। তাঁরা যেভাবে ভারতকে কল্পনা করেন, তা সমগ্র দেশবাসীর উপর চাপিয়ে দিতে চান।

আর তাঁদের কথা যারা মানবে না তারা দেশদ্রোহী। ভারতে তাদের কোনও জায়গা নেই। তাঁদের টার্গেট বা নিশানার তালিকায় শুধু মুসলিম, খ্রিস্টানরাই নয়, রয়েছে দলিত, আদিবাসী এবং সমস্ত নিম্নবর্ণের মানুষ। দেশের আদি ভূমিপুত্র সাঁওতাল এবং ওঁরাও, মুণ্ডা, ভিল এদের ধর্ম সারি ও সারনাকে তাঁরা স্বীকৃতি দিতে রাজি নয়। তাঁদের বক্তব্য, ভারতে ১০ কোটির বেশি আদিবাসী জনজাতিকে ‘হিন্দু’ হতে হবে এবং হিন্দুত্বকে মেনে নিতে হবে।

আরও পড়ুন: ঔরঙ্গজেবের সমাধি রক্ষা করার আর্জি জানিয়ে রাষ্ট্রসংঘকে চিঠি মুঘল বংশধর ইয়াকুব হাবিবুদ্দিনের

অবশ্য এ কাজ একদিনে হয়নি, দীর্ঘদিন ধরে সংঘ পরিবার এবং সংশ্লিষ্ট বুদ্ধিজীবীরা এই কাজ করে যাচ্ছেন। বিভেদ নীতির সমর্থক ইংরেজ ঐতিহাসিকরাও অনেক সময় বিকৃত ইতিহাস ও ইতিহাস পালটানোর অভিযানে হাওয়া দিয়েছেন।

বর্তমানে ক্ষমতাসীন হওয়ার পর সংঘ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সংগঠন বজরং দল, বিশ্বহিন্দু পরিষ, বিজেপির নেতৃবৃন্দ মুসলিম শাসকদের উপর ‘প্রতিশোধ’ নেওয়ার অভিযানে নেমে পড়েছেন। যেমন মুঘলসরাই রেলওয়ে স্টেশনের নাম হয়েছে পণ্ডিত দিনদয়াল উপাধ্যায় স্টেশন, ইলাহাবাদ শহরের নাম হয়েছে প্রয়াগরাজ, দিল্লির মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের নামে যে বিখ্যাত রাস্তা ছিল, তা পরিবর্তন করে এপিজে আবদুল কালাম রোড করা হয়েছে।

এ ছাড়া সম্রাট আওরঙ্গজেবের নামে ছিল মহারাষ্ট্রের একটি ঐতিহাসিক শহর আওরঙ্গাবাদ। আওরঙ্গজেবের মাজার ও তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আরও অনেক ঐতিহাসিক সৌধ রয়েছে এই এলাকায়। আওরঙ্গজেবের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য তাঁর নাম পরিবর্তন করে নয়া নামকরণ হয়েছে ছত্রপতি শামবাজি নগর। ছত্রপতি শিবাজির সঙ্গে আওরঙ্গজেবের যুদ্ধের কথা সকলেরই জানা। কিন্তু এখন বিজেপির হাতে আওরঙ্গজেব পুরোপুরি পর্যুদস্ত হলেন। তাঁর নামটি বিলকুল গায়েব করে দেওয়া হল। এর থেকে বড় পরাজয় ভারতের শাহানশাহ আওরঙ্গজেবের জন্য, আর কি হতে পারে? শেষপর্যন্ত তাঁর মাজারটির দশা কী হবে, তা এখনই সঠিক করে বলা যাচ্ছে না।

মহারাষ্ট্রের ওসমানাবাদের নাম রাখা হয়েছে ধারাশিব। দৌলতাবাদ কেল্লার নাম পরিবর্তন করে দেওগিরি কিল্লা রাখা হয়েছে। এই তালিকা খুবই দীর্ঘ। মুসলিম বিশেষ করে মুঘলদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবকিছুর নামের বর্ণবাদী হিন্দুত্বকরণ করা হচ্ছে। পাঠ্য ইতিহাস থেকেও মুসলিম ও মুঘলদের ইতিহাস ও অবদান অদৃশ্য হওয়ার পালা চলছে। এর দ্বারা হাসিল হচ্ছে মুসলিম ও মোঘলদের প্রতি ঘৃণা প্রচার ও তাঁদের অবদানকে অস্তিত্বহীন করে দেওয়ার প্রচেষ্টা চলছে।

তবে এখানেই শেষ নয়, নিশানার তালিকায় রয়েছে আরও অনেক নাম।

যেমন হায়দরাবাদ শহর, গোলকুন্ডা ফোর্ট, লালকেল্লা ইত্যকার বিরাট তালিকা হাতে ধরে বসে আছেন প্রতিশোধকামীরা।

এমনকী তাজমহলেরও নাম ‘তেজোমহালয়া’ করার পরিকল্পনাও রয়েছে। এ বিষয়ে যোগী, মোদি, উদ্ধব ঠাকরে, একনাথ শিন্ডের মধ্যে কোনও ফারাক নেই। ইতিহাস মুছে ফেলে কল্পিত ইতিহাস যোগ করা হচ্ছে।

এ দিকে আরও ১০০০ নাম পরিবর্তন করার জন্য সংঘ পরিবারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এক উকিল অশ্বিনী উপাধ্যায় সুপ্রিম কোর্টে এক জনহিতের মামলা দায়ের করে বলেছিলেন, মুসলিম আক্রমণকারীদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নামগুলি পরিবর্তন করার জন্য সুপ্রিম কোর্ট যেন নির্দেশ দেয়। তবে সুপ্রিম কোর্ট এই জনহিতের আবেদনকে খারিজ করে দিয়েছে। শীর্ষ আদালত বলেছে, দেশ অতীতের মধ্যেই নিমজ্জিত থাকতে পারে না।

শীর্ষ আদালতের বিচারপতিরা বলেন, কোনও দেশের অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে এতটা হয়রানি করতে পারে না যে, তারা ইতিহাসের কয়েদি হিসেবে থেকে যায়। ভারত এক ধর্মনিরপেক্ষ দেশ। কিন্তু আপনারা চান এসব অতীতের ইস্যুগুলি টগবগ করে ফুটতে থাকুক। আপনারা কোনও এক বিশেষ সম্প্রদায়কে নীচু করে দেখাতে চান। এটা চলতে পারে না।

কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট বললে কী হবে, মুসলিম নাম পরিবর্তনের এই ঘৃণা অভিযানে দেশ ও রাজ্যে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। কোনও প্রস্তাব এলেই তাঁরা বদবিচার নাম করে তা মেনে নিচ্ছেন। এর ফলে ভারতের ঐক্য ও সংহতি কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, তার কোনও ভাবনা এদের মধ্যে নেই। এভাবে দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়গুলিকে যেভাবে আহত ও অপমানিত করা হচ্ছে, তা কিন্তু একদিন সমগ্র দেশকেই বিভীষিকাময় এক গহ´রে নিমজ্জিত করবে। আশার কথা, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানে এই ধরনের বিদ্বেষমূলক নাম পরিবর্তনের খেলা এখনও শুরু হয়নি। কারণ, এভাবে ইতিহাসকে মুছে দেওয়া যায় না। এ কথা এত তাড়াতাড়ি উপলব্ধি করা যায়, ততই কল্যাণ।