০৪ অক্টোবর ২০২৫, শনিবার, ১৭ আশ্বিন ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
প্রশাসনিক পক্ষপাতে ভয় ও নিরাপত্তাহীনতায় মুসলিমরা

সম্ভল হিংসায় পুলিশের বাড়াবাড়ি, বেছে বেছে আইনের প্রয়োগ: এপিসিআর রিপোর্ট

কিবরিয়া আনসারি
  • আপডেট : ৩ জুলাই ২০২৫, বৃহস্পতিবার
  • / 79

পুবের কলম ওয়েবডেস্ক: উত্তরপ্রদেশের সম্ভল -এ সহিংসতা ঘটনায় বিস্ফোরক তথ্য প্রকাশ করল মানবাধিকার সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন ফর প্রোটেকশন অফ সিভিল রাইটস (এপিসিআর)। সংগঠনটি দাবি করেছে, গত নভেম্বরে সম্ভলে সংঘটিত হিংসায় প্রশাসনিক পক্ষপাতিত্ব, পুলিশের বাড়াবাড়ি, নির্বিচারে গ্রেফতার এবং বেছে বেছে নিদিষ্ট সম্প্রদায়ের ওপর আইন প্রয়োগের ফলে পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছে। প্রশাসনের পক্ষপাতমূলক আচরণের ফলে মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে ভয় ও নিরাপত্তাহীনতার বোধ তৈরি হয়েছে।

অ্যাসোসিয়েশন ফর প্রোটেকশন অফ সিভিল রাইটস (এপিসিআর) এবং কারওয়ান-ই-মোহাব্বত যৌথভাবে মঙ্গলবার দিল্লির প্রেস ক্লাবে “সম্ভল: অ্যানাটমি অফ অ্যান ইঞ্জিনিয়ারড ক্রাইসিস” এবং ডকুমেন্টারি “সম্ভল মসজিদ কিলিংস” প্রকাশ করেছে। তাতেই উঠে এসেছে এসব তথ্য। ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং দলটি পুলিশি পদক্ষেপ, ধর্মীয় লক্ষ্যবস্তু এবং ন্যায়বিচার সম্পর্কে উদ্বেগজনক তথ্য সামনে এনেছে। এপিসিআর-এর ন্যাশনাল সেক্রেটারি নাদিম খান হিংসার ঘটনা নিয়ে প্রশ্ন তুলে বলেন, “কেন যথাযথ প্রক্রিয়া ছাড়া দুটি জরিপ চালানো হলো। কেন স্লোগানে উদ্বুদ্ধ জনতাকে মসজিদে ঢুকতে দেওয়া হলো। কেন সম্প্রদায়ের সঙ্গে আলোচনা করা হলো না। তা জানতে সহিংসতার ছয় মাস পর আমরা এই প্রতিবেদন প্রকাশ করছি। আইনের এই বেছে বেছে ব্যবহারের ফলে সম্ভলে পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছে।” উল্লেখ্য, ২০২৪ সালের ১৯ নভেম্বর স্থানীয় আদালত শাহি জামা মসজিদে জরিপের নির্দেশ দেওয়ার পরে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। ২৪ নভেম্বর পরিচালিত দ্বিতীয় জরিপে বহু জনতার উপস্থিতি এবং মসজিদের জন্য অপমানজনক কর্মকাণ্ড সাম্প্রদায়িক হিংসায় রুপ নিয়েছিল।

স্থানীয় বাসিন্দা ও স্কুলের ম্যানেজার শ্যাভেজ পুলিশি নিপীড়নের কথা উল্লেখ করে বলেছেন, অনেক নিরপরাধ মানুষকে জেলে ঢোকানো হয়েছে। তারা সব দরিদ্র পরিবারের মানুষ, এখনও কেউ জামিন পায়নি। বিনা নোটিশে আমার স্কুলের একাংশ দখল করে নেওয়া হয়েছে। আমি প্রতিরোধ করার চেষ্টা করলে আমাকে হুমকি দেওয়া হয়। পরিস্থিতি ক্রমেই খারাপের দিকে যাচ্ছে।

আরও পড়ুন: দেশজুড়ে মুসলিমদের বিরুদ্ধে ১৮৪টি হামলা-আক্রমণ ও নির্যাতন: রিপোর্ট

ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং টিমের গবেষক প্রকৃতির বক্তব্য, “সফরের সময় সব সময় আমাদের ওপর নজর রাখা হয়েছে। আমরা যখন নিহতদের বাড়িতে পৌঁছাই তখন পুলিশ উপস্থিত ছিল। এটি শক্তি এবং ভয় ব্যবহার করে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণের একটি পরীক্ষা বলে মনে হয়েছিল। আমরা দেখেছি ভাঙচুর এবং আসল নথি গ্রহণে অস্বীকৃতি জানানো হয়েছে।” বিশিষ্ট মানবাধিকার কর্মী হর্ষ মান্দারও তথ্য-অনুসন্ধানের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। তিনিই সম্ভলের ঘটনা নিয়ে ডকুমেন্টারিটি তৈরি করেন। যোগী সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষোভ উগরে মান্দারের প্রশ্ন, “হঠাৎ করে লোকে দাবি করে সম্ভল কল্কির জন্মস্থান! সহিংসতাকে ন্যায্যতা দেওয়ার জন্য আমরা ইতিহাসে কতদূর গিয়েছি? মসজিদ খুঁড়লে মন্দির পাওয়া যায়। একটি মন্দির খনন করুন, এবং আপনি একটি স্তূপ পাবেন। এর শেষ কোথায়? সম্ভলের হিন্দু-মুসলিম সংঘর্ষের কোনও রেকর্ড নেই। এখন তারা এটিকে আরেকটি অযোধ্যায় পরিণত করার চেষ্টা করছে।” আইনজীবী আহমেদ ইব্রাহিম আইনি জটিলতার কথা তুলে ধরে বলেন, “পুলিশ নিয়ম মেনে চলছে কি না, তা জানতে চেয়ে ২৪ নভেম্বর আমরা মামলা করেছি। বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে বন্দুকের কোনও প্রমাণ মেলেনি। পুলিশ যদি গুলি চালায়, তাহলে কারা এবং কেন মারা গেছে তার একটি প্রতিবেদন দরকার। এখনও কোনও উত্তর আসেনি। আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগ হলে এ ধরনের ঘটনা কখনোই ঘটত না।”

এপিসিআর ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং রিপোর্টকে ‘গভীর বিরক্তিকর’ বলে বর্ণনা করেছেন নভশরণ সিং। তাঁর কথায়, “মহিলা পুলিশ অফিসারের উপস্থিতি ছাড়াই মেয়েদের গ্রেফতার করা হয়েছে। তিন দিন পর পাঁচজনের লাশ উদ্ধার করা হয়। মৃতদেহগুলি ফিরে পেতে পরিবারগুলিকে ফাঁকা কাগজে স্বাক্ষর করতে হয়েছিল। ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং কাউকে সম্ভলে যেতে দেওয়া হয়নি। গোটা এলাকাকে লকডাউনের মত করে রাখা হয়। যাদের মৃত্যু হয় তারা নূন্যতম সম্মানটুকুও পাননি।”

রিপোর্টে বলা হয়েছে, সহিংসতা এড়ানো যেত। শান্তি সভা এবং ভিড় নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে মৌলিক পদক্ষেপগুলি উপেক্ষা করা হয়েছিল। অনেকে বলছেন, এই ঘটনা বাবরি মসজিদ ধ্বংসের আগের সময়ের কথা মনে করিয়ে দেয়। এপিসিআর জানিয়েছে, এই প্রতিবেদনটি ঘৃণ্য অপরাধের বিরুদ্ধে লড়াই এবং সহিংসতার শিকারদের পাশে দাঁড়ানোর বৃহত্তর প্রচেষ্টার অংশ। কংগ্রেস সাংসদ ইমরান মাসুদ গণতন্ত্রের অবস্থা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘোষণা করেন। তিনি মন্তব্য করেন, “সম্ভলের মানুষ ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন। কারা গুলি চালিয়েছিল? আইন সবার জন্য সমান হওয়া উচিত। কিন্তু আমাদের দেশের বর্তমান পরিবেশ গণতান্ত্রিক নয়। এমনকি ইউটিউব চ্যানেলগুলোও নিষিদ্ধ। বিজেপির তল্পিবাহকরা বছরের পর বছর ধরে ঘৃণা ছড়াতে চায়।”

প্রতিবেদক

কিবরিয়া আনসারি

Kibria obtained a master's degree in journalism from Aliah University. He has been in journalism since 2018, gaining work experience in multiple organizations. Focused and sincere about his work, Kibria is currently employed at the desk of Purber Kalom.

Copyright © Puber Kalom All rights reserved.| Developed by eTech Builder

প্রশাসনিক পক্ষপাতে ভয় ও নিরাপত্তাহীনতায় মুসলিমরা

সম্ভল হিংসায় পুলিশের বাড়াবাড়ি, বেছে বেছে আইনের প্রয়োগ: এপিসিআর রিপোর্ট

আপডেট : ৩ জুলাই ২০২৫, বৃহস্পতিবার

পুবের কলম ওয়েবডেস্ক: উত্তরপ্রদেশের সম্ভল -এ সহিংসতা ঘটনায় বিস্ফোরক তথ্য প্রকাশ করল মানবাধিকার সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন ফর প্রোটেকশন অফ সিভিল রাইটস (এপিসিআর)। সংগঠনটি দাবি করেছে, গত নভেম্বরে সম্ভলে সংঘটিত হিংসায় প্রশাসনিক পক্ষপাতিত্ব, পুলিশের বাড়াবাড়ি, নির্বিচারে গ্রেফতার এবং বেছে বেছে নিদিষ্ট সম্প্রদায়ের ওপর আইন প্রয়োগের ফলে পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছে। প্রশাসনের পক্ষপাতমূলক আচরণের ফলে মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে ভয় ও নিরাপত্তাহীনতার বোধ তৈরি হয়েছে।

অ্যাসোসিয়েশন ফর প্রোটেকশন অফ সিভিল রাইটস (এপিসিআর) এবং কারওয়ান-ই-মোহাব্বত যৌথভাবে মঙ্গলবার দিল্লির প্রেস ক্লাবে “সম্ভল: অ্যানাটমি অফ অ্যান ইঞ্জিনিয়ারড ক্রাইসিস” এবং ডকুমেন্টারি “সম্ভল মসজিদ কিলিংস” প্রকাশ করেছে। তাতেই উঠে এসেছে এসব তথ্য। ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং দলটি পুলিশি পদক্ষেপ, ধর্মীয় লক্ষ্যবস্তু এবং ন্যায়বিচার সম্পর্কে উদ্বেগজনক তথ্য সামনে এনেছে। এপিসিআর-এর ন্যাশনাল সেক্রেটারি নাদিম খান হিংসার ঘটনা নিয়ে প্রশ্ন তুলে বলেন, “কেন যথাযথ প্রক্রিয়া ছাড়া দুটি জরিপ চালানো হলো। কেন স্লোগানে উদ্বুদ্ধ জনতাকে মসজিদে ঢুকতে দেওয়া হলো। কেন সম্প্রদায়ের সঙ্গে আলোচনা করা হলো না। তা জানতে সহিংসতার ছয় মাস পর আমরা এই প্রতিবেদন প্রকাশ করছি। আইনের এই বেছে বেছে ব্যবহারের ফলে সম্ভলে পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছে।” উল্লেখ্য, ২০২৪ সালের ১৯ নভেম্বর স্থানীয় আদালত শাহি জামা মসজিদে জরিপের নির্দেশ দেওয়ার পরে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। ২৪ নভেম্বর পরিচালিত দ্বিতীয় জরিপে বহু জনতার উপস্থিতি এবং মসজিদের জন্য অপমানজনক কর্মকাণ্ড সাম্প্রদায়িক হিংসায় রুপ নিয়েছিল।

স্থানীয় বাসিন্দা ও স্কুলের ম্যানেজার শ্যাভেজ পুলিশি নিপীড়নের কথা উল্লেখ করে বলেছেন, অনেক নিরপরাধ মানুষকে জেলে ঢোকানো হয়েছে। তারা সব দরিদ্র পরিবারের মানুষ, এখনও কেউ জামিন পায়নি। বিনা নোটিশে আমার স্কুলের একাংশ দখল করে নেওয়া হয়েছে। আমি প্রতিরোধ করার চেষ্টা করলে আমাকে হুমকি দেওয়া হয়। পরিস্থিতি ক্রমেই খারাপের দিকে যাচ্ছে।

আরও পড়ুন: দেশজুড়ে মুসলিমদের বিরুদ্ধে ১৮৪টি হামলা-আক্রমণ ও নির্যাতন: রিপোর্ট

ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং টিমের গবেষক প্রকৃতির বক্তব্য, “সফরের সময় সব সময় আমাদের ওপর নজর রাখা হয়েছে। আমরা যখন নিহতদের বাড়িতে পৌঁছাই তখন পুলিশ উপস্থিত ছিল। এটি শক্তি এবং ভয় ব্যবহার করে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণের একটি পরীক্ষা বলে মনে হয়েছিল। আমরা দেখেছি ভাঙচুর এবং আসল নথি গ্রহণে অস্বীকৃতি জানানো হয়েছে।” বিশিষ্ট মানবাধিকার কর্মী হর্ষ মান্দারও তথ্য-অনুসন্ধানের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। তিনিই সম্ভলের ঘটনা নিয়ে ডকুমেন্টারিটি তৈরি করেন। যোগী সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষোভ উগরে মান্দারের প্রশ্ন, “হঠাৎ করে লোকে দাবি করে সম্ভল কল্কির জন্মস্থান! সহিংসতাকে ন্যায্যতা দেওয়ার জন্য আমরা ইতিহাসে কতদূর গিয়েছি? মসজিদ খুঁড়লে মন্দির পাওয়া যায়। একটি মন্দির খনন করুন, এবং আপনি একটি স্তূপ পাবেন। এর শেষ কোথায়? সম্ভলের হিন্দু-মুসলিম সংঘর্ষের কোনও রেকর্ড নেই। এখন তারা এটিকে আরেকটি অযোধ্যায় পরিণত করার চেষ্টা করছে।” আইনজীবী আহমেদ ইব্রাহিম আইনি জটিলতার কথা তুলে ধরে বলেন, “পুলিশ নিয়ম মেনে চলছে কি না, তা জানতে চেয়ে ২৪ নভেম্বর আমরা মামলা করেছি। বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে বন্দুকের কোনও প্রমাণ মেলেনি। পুলিশ যদি গুলি চালায়, তাহলে কারা এবং কেন মারা গেছে তার একটি প্রতিবেদন দরকার। এখনও কোনও উত্তর আসেনি। আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগ হলে এ ধরনের ঘটনা কখনোই ঘটত না।”

এপিসিআর ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং রিপোর্টকে ‘গভীর বিরক্তিকর’ বলে বর্ণনা করেছেন নভশরণ সিং। তাঁর কথায়, “মহিলা পুলিশ অফিসারের উপস্থিতি ছাড়াই মেয়েদের গ্রেফতার করা হয়েছে। তিন দিন পর পাঁচজনের লাশ উদ্ধার করা হয়। মৃতদেহগুলি ফিরে পেতে পরিবারগুলিকে ফাঁকা কাগজে স্বাক্ষর করতে হয়েছিল। ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং কাউকে সম্ভলে যেতে দেওয়া হয়নি। গোটা এলাকাকে লকডাউনের মত করে রাখা হয়। যাদের মৃত্যু হয় তারা নূন্যতম সম্মানটুকুও পাননি।”

রিপোর্টে বলা হয়েছে, সহিংসতা এড়ানো যেত। শান্তি সভা এবং ভিড় নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে মৌলিক পদক্ষেপগুলি উপেক্ষা করা হয়েছিল। অনেকে বলছেন, এই ঘটনা বাবরি মসজিদ ধ্বংসের আগের সময়ের কথা মনে করিয়ে দেয়। এপিসিআর জানিয়েছে, এই প্রতিবেদনটি ঘৃণ্য অপরাধের বিরুদ্ধে লড়াই এবং সহিংসতার শিকারদের পাশে দাঁড়ানোর বৃহত্তর প্রচেষ্টার অংশ। কংগ্রেস সাংসদ ইমরান মাসুদ গণতন্ত্রের অবস্থা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘোষণা করেন। তিনি মন্তব্য করেন, “সম্ভলের মানুষ ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন। কারা গুলি চালিয়েছিল? আইন সবার জন্য সমান হওয়া উচিত। কিন্তু আমাদের দেশের বর্তমান পরিবেশ গণতান্ত্রিক নয়। এমনকি ইউটিউব চ্যানেলগুলোও নিষিদ্ধ। বিজেপির তল্পিবাহকরা বছরের পর বছর ধরে ঘৃণা ছড়াতে চায়।”