০৩ নভেম্বর ২০২৫, সোমবার, ১৬ কার্তিক ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

তুরস্কে ‘উলট পুরাণ’, হিজাবের অধিকার নিশ্চিত করতে সংবিধান সংশোধন

বিপাশা চক্রবর্তী
  • আপডেট : ১৩ ডিসেম্বর ২০২২, মঙ্গলবার
  • / 124

তুরস্কে 'উলট পুরাণ', হিজাবের অধিকার নিশ্চিত করতে সংবিধান সংশোধনআহমদ হাসান ইমরান: ১০০ বছরের কম সময়ের মধ্যে তুরস্কে ‘উলট পুরাণ’ দেখা যাবে, এক দশক আগেও এটা ভাবা যেত না। কিন্তু মুসলিম জগতের খিলাফতের কেন্দ্রভূমি তুরস্কে সেই বেনজির চিত্রই এখন দেখা যাচ্ছে। কোনও দেশ বা সমাজের মুসলিম পরিচয় প্রকটিত হয় জনগণের মূল্যবোধ ও জীবনধারা দিয়ে। অনেকের মতে, মুসলিম নারীদের হিজাব হচ্ছে এমনই এক ইসলামি পরিচিতির বাহক।

তুরস্কে খিলাফত বিনাশকারী মুস্তাফা কামাল আতাতুর্ক এবং পরে তাঁর সহযোগীরা প্রকাশ্যে তুর্কি নারীদের হিজাব পরার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। সেই থেকে পুলিশ, প্রশাসন, সরকার, আদালত দ্বারা বজায় ছিল এই ধারা। নব্বইয়ের দশকের শেষে তার্কীস গ্র্যান্ড ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি বা পার্লামেন্টে হাভার্ড থেকে পাশ করা তুর্কি ছাত্রী মার্ভে কেভাকসি, যিনি আমেরিকার নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রফেসর হিসেবে কর্মরত ছিলেন, তিনি ইস্তাম্বুলে ফিরে আসেন এবং রাজনীতিতে যোগ দেন। তিনি তৎকালীন ইসলামপন্থী দল ভার্চু পার্টির টিকিটে পার্লামেন্টের সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন।

আরও পড়ুন: ‘রাহুলও সংবিধান রক্ষার জন্য লড়ছেন’ — নোবেলজয়ী মাচাদোর সঙ্গে তুলনা টেনে বার্তা কংগ্রেসের

১৯৯৯ সালে ২ মার্চ তিনি মাথায় হিজাব পরে তুর্কি পার্লামেন্টে প্রবেশ করেন। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল, অন্যান্য ডেপুটি বা পার্লামেন্ট সদস্যদের মতো তিনিও সংসদের সদস্য হিসেবে শপথ গ্রহণ করবেন। কিন্তু সেখানে উপস্থিত অন্যান্য সেক্যুলার দলের সদস্যরা তাঁর রাস্তা অবরোধ করেন এবং তাঁকে ‘বেরিয়ে যাও’ বলে শুধু শ্লোগান নয়, শারীরিকভাবেও হেনস্থা করারও চেষ্টা করেন। পরে তাঁর হিজাব পরার অপরাধে পার্লামেন্টের সদস্যপদ ও নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়া হয়। তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে  চলে যেতে বাধ্য হন।

আরও পড়ুন: রাষ্ট্রসংঘ থেকে ইসরাইলকে বরখাস্তের দাবি তুলল তুরস্ক

তারপর অবশ্য বসফরাস প্রণালী দিয়ে অনেক পানি বয়ে গেছে। রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোগানের দল একে পার্টি ক্ষমতায় এসেছে। তারা হিজাব পরার উপর নিষেধাজ্ঞা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তুলে দিয়েছে। কিন্তু এবার হিজাব পরার সাংবিধানিক অধিকার নিশ্চিত করার জন্য তুর্কি পার্লামেন্টে একটি বিল আনা হচ্ছে। এজন্য এরদোগানের দল একে পার্টি সংবিধান সংশোধন করার প্রস্তাব নিয়ে এসেছে।

আরও পড়ুন: দাবানলে জ্বলছে তুরস্কের ইজমির, গ্রাম খালি, বিমানবন্দর বন্ধ

এ পর্যন্ত সবই ঠিক আছে। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে কামাল আতাতুর্কের দল সিএইচপি পার্টি সংবিধান সংশোধনের এই দাবি তোলার ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এতদিন পর কট্টর সেক্যুলারপন্থী সিএইচপি পার্টি বুঝে গিয়েছে, মুসলিম ঐতিহ্য ও মূল্যবোধ বাদ দিয়ে   তারা জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক ক্রমশ হারিয়ে ফেলেছে। তাই তারা এখন মুসলিম জনগণের সমর্থন আদায়ের জন্য চেষ্টা শুরু করেছে।

১৯১৯ সালে কামাল আতাতুর্ক দ্বারা প্রতিষ্ঠিত সিএইচপি বা রিপাবলিকান পিপলস পার্টির বর্তমান প্রধান কেমাল কিলিকদারোগলু বলেছেন, অতীতে হিজাবের উপর নিষেধাজ্ঞা দিয়ে আমরা ভুল করেছি। তাই এখন আমাদের দল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও কর্মক্ষেত্রে নারীদের মাথা আবৃত করার সাংবিধানিক অধিকার নিশ্চিত করতে চায়। তবে এরদোগান বলেছেন, সিএইচপি এখন এইসব কথা বললে কি হবে, তুর্কি মুসলিম নারীদের হিজাব পরার অধিকার অর্জন করতে আমাদের দল প্রথম থেকেই লড়াই করে আসছে।

আর নারীদের হিজাব পরার অধিকার আমাদেরই অর্জন। ইতিহাসবিদ বেরিন সনমেতজ বলেন, রাষ্ট্র হিজাবের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি কিংবা না পরার ক্ষেত্রে বাধ্য সৃষ্টি করলে সেটা নারীর মর্যাদা ও অধিকারকে ক্ষুন্ন করে। ২০১২ সালের এক জরিপের তথ্য অনুযায়ী, তুরস্কের ৬৫ শতাংশ নারীই হিজাব পরিধান করেন।

আর একটি কথা, বহিষ্কৃত এমপি মার্ভে কেভাকসি পরে তুর্কিতে ফিরে আসেন এবং তাঁকে সম্মানের সঙ্গে ফের নাগরিকত্ব দেওয়া হয়। বর্তমানে তিনি মালয়েশিয়ার তুরস্কের রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি যদি এখন তুর্কি পার্লামেন্টে আসতেন,  তাহলে দেখতে পেতেন, একজন নয়, বেশকিছু তুর্কি নারী এখন প্রতি নির্বাচনে জয়ী হয়ে পার্লামেন্ট আলোকিত করছেন। তবে তাঁরা স্বীকার করেন, অনেক নির্যাতন সহ্য করে মার্ভে কেভাকসি তাঁদের পথ দেখিয়েছেন।

এ ছাড়া বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কামাল আতাতুর্কের ‘কট্টর সেক্যুলার রাষ্ট্র’ গড়ার যে স্বপ্ন ছিল, ১০০ বছরের মধ্যেই তা ক্রমশ ভেঙে চুরমার হয়ে যাচ্ছে। কারণ, তাঁর নীতির মধ্যে শাশ্বত কোনও মূল্যবোধ ছিল না।

Copyright © Puber Kalom All rights reserved.| Developed by eTech Builder

তুরস্কে ‘উলট পুরাণ’, হিজাবের অধিকার নিশ্চিত করতে সংবিধান সংশোধন

আপডেট : ১৩ ডিসেম্বর ২০২২, মঙ্গলবার

তুরস্কে 'উলট পুরাণ', হিজাবের অধিকার নিশ্চিত করতে সংবিধান সংশোধনআহমদ হাসান ইমরান: ১০০ বছরের কম সময়ের মধ্যে তুরস্কে ‘উলট পুরাণ’ দেখা যাবে, এক দশক আগেও এটা ভাবা যেত না। কিন্তু মুসলিম জগতের খিলাফতের কেন্দ্রভূমি তুরস্কে সেই বেনজির চিত্রই এখন দেখা যাচ্ছে। কোনও দেশ বা সমাজের মুসলিম পরিচয় প্রকটিত হয় জনগণের মূল্যবোধ ও জীবনধারা দিয়ে। অনেকের মতে, মুসলিম নারীদের হিজাব হচ্ছে এমনই এক ইসলামি পরিচিতির বাহক।

তুরস্কে খিলাফত বিনাশকারী মুস্তাফা কামাল আতাতুর্ক এবং পরে তাঁর সহযোগীরা প্রকাশ্যে তুর্কি নারীদের হিজাব পরার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। সেই থেকে পুলিশ, প্রশাসন, সরকার, আদালত দ্বারা বজায় ছিল এই ধারা। নব্বইয়ের দশকের শেষে তার্কীস গ্র্যান্ড ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি বা পার্লামেন্টে হাভার্ড থেকে পাশ করা তুর্কি ছাত্রী মার্ভে কেভাকসি, যিনি আমেরিকার নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রফেসর হিসেবে কর্মরত ছিলেন, তিনি ইস্তাম্বুলে ফিরে আসেন এবং রাজনীতিতে যোগ দেন। তিনি তৎকালীন ইসলামপন্থী দল ভার্চু পার্টির টিকিটে পার্লামেন্টের সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন।

আরও পড়ুন: ‘রাহুলও সংবিধান রক্ষার জন্য লড়ছেন’ — নোবেলজয়ী মাচাদোর সঙ্গে তুলনা টেনে বার্তা কংগ্রেসের

১৯৯৯ সালে ২ মার্চ তিনি মাথায় হিজাব পরে তুর্কি পার্লামেন্টে প্রবেশ করেন। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল, অন্যান্য ডেপুটি বা পার্লামেন্ট সদস্যদের মতো তিনিও সংসদের সদস্য হিসেবে শপথ গ্রহণ করবেন। কিন্তু সেখানে উপস্থিত অন্যান্য সেক্যুলার দলের সদস্যরা তাঁর রাস্তা অবরোধ করেন এবং তাঁকে ‘বেরিয়ে যাও’ বলে শুধু শ্লোগান নয়, শারীরিকভাবেও হেনস্থা করারও চেষ্টা করেন। পরে তাঁর হিজাব পরার অপরাধে পার্লামেন্টের সদস্যপদ ও নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়া হয়। তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে  চলে যেতে বাধ্য হন।

আরও পড়ুন: রাষ্ট্রসংঘ থেকে ইসরাইলকে বরখাস্তের দাবি তুলল তুরস্ক

তারপর অবশ্য বসফরাস প্রণালী দিয়ে অনেক পানি বয়ে গেছে। রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোগানের দল একে পার্টি ক্ষমতায় এসেছে। তারা হিজাব পরার উপর নিষেধাজ্ঞা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তুলে দিয়েছে। কিন্তু এবার হিজাব পরার সাংবিধানিক অধিকার নিশ্চিত করার জন্য তুর্কি পার্লামেন্টে একটি বিল আনা হচ্ছে। এজন্য এরদোগানের দল একে পার্টি সংবিধান সংশোধন করার প্রস্তাব নিয়ে এসেছে।

আরও পড়ুন: দাবানলে জ্বলছে তুরস্কের ইজমির, গ্রাম খালি, বিমানবন্দর বন্ধ

এ পর্যন্ত সবই ঠিক আছে। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে কামাল আতাতুর্কের দল সিএইচপি পার্টি সংবিধান সংশোধনের এই দাবি তোলার ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এতদিন পর কট্টর সেক্যুলারপন্থী সিএইচপি পার্টি বুঝে গিয়েছে, মুসলিম ঐতিহ্য ও মূল্যবোধ বাদ দিয়ে   তারা জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক ক্রমশ হারিয়ে ফেলেছে। তাই তারা এখন মুসলিম জনগণের সমর্থন আদায়ের জন্য চেষ্টা শুরু করেছে।

১৯১৯ সালে কামাল আতাতুর্ক দ্বারা প্রতিষ্ঠিত সিএইচপি বা রিপাবলিকান পিপলস পার্টির বর্তমান প্রধান কেমাল কিলিকদারোগলু বলেছেন, অতীতে হিজাবের উপর নিষেধাজ্ঞা দিয়ে আমরা ভুল করেছি। তাই এখন আমাদের দল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও কর্মক্ষেত্রে নারীদের মাথা আবৃত করার সাংবিধানিক অধিকার নিশ্চিত করতে চায়। তবে এরদোগান বলেছেন, সিএইচপি এখন এইসব কথা বললে কি হবে, তুর্কি মুসলিম নারীদের হিজাব পরার অধিকার অর্জন করতে আমাদের দল প্রথম থেকেই লড়াই করে আসছে।

আর নারীদের হিজাব পরার অধিকার আমাদেরই অর্জন। ইতিহাসবিদ বেরিন সনমেতজ বলেন, রাষ্ট্র হিজাবের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি কিংবা না পরার ক্ষেত্রে বাধ্য সৃষ্টি করলে সেটা নারীর মর্যাদা ও অধিকারকে ক্ষুন্ন করে। ২০১২ সালের এক জরিপের তথ্য অনুযায়ী, তুরস্কের ৬৫ শতাংশ নারীই হিজাব পরিধান করেন।

আর একটি কথা, বহিষ্কৃত এমপি মার্ভে কেভাকসি পরে তুর্কিতে ফিরে আসেন এবং তাঁকে সম্মানের সঙ্গে ফের নাগরিকত্ব দেওয়া হয়। বর্তমানে তিনি মালয়েশিয়ার তুরস্কের রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি যদি এখন তুর্কি পার্লামেন্টে আসতেন,  তাহলে দেখতে পেতেন, একজন নয়, বেশকিছু তুর্কি নারী এখন প্রতি নির্বাচনে জয়ী হয়ে পার্লামেন্ট আলোকিত করছেন। তবে তাঁরা স্বীকার করেন, অনেক নির্যাতন সহ্য করে মার্ভে কেভাকসি তাঁদের পথ দেখিয়েছেন।

এ ছাড়া বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কামাল আতাতুর্কের ‘কট্টর সেক্যুলার রাষ্ট্র’ গড়ার যে স্বপ্ন ছিল, ১০০ বছরের মধ্যেই তা ক্রমশ ভেঙে চুরমার হয়ে যাচ্ছে। কারণ, তাঁর নীতির মধ্যে শাশ্বত কোনও মূল্যবোধ ছিল না।