মালেগাঁও বিস্ফোরণ মামলায় ১৭ বছর পর রায় ; অভিযুক্তদের কেন মুক্তি দেওয়া হল, জানালেন বিচারক

- আপডেট : ৩১ জুলাই ২০২৫, বৃহস্পতিবার
- / 25
রুবাইয়া জুঁই : ভারতের বিচার ব্যবস্থার ইতিহাসে মালেগাঁও বিস্ফোরণ মামলা এক গভীর আলোচিত এবং বহু বিতর্কিত অধ্যায়। প্রায় ১৭ বছর ধরে চলা এই মামলায় অবশেষে বিশেষ এনআইএ আদালতের রায় ঘোষিত হয়েছে। ৬ জন নিরীহ মানুষের মৃত্যু এবং শতাধিক আহতের ঘটনায় যাদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসের অভিযোগ উঠেছিল তাদের সবাইকেই আদালত বেকসুর মুক্তি দেয়। এই রায় শুধুমাত্র একটি মামলার পরিসমাপ্তি নয়, বরং ভারতের তদন্ত প্রক্রিয়া, রাজনৈতিক প্রভাব, এবং সন্ত্রাস দমন নীতির বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়েও বহু প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।
এই মামলার সবচেয়ে আলোচিত অভিযুক্ত ছিলেন বিজেপি নেত্রী সাধ্বী প্রজ্ঞা এবং লেফটেন্যান্ট কর্নেল শ্রীকান্ত পুরোহিত। সাধ্বী প্রজ্ঞা তখন ভোপাল থেকে বিজেপির সাংসদ ছিলেন। ২০০৮ সালের ২৯শে সেপ্টেম্বর, মহারাষ্ট্রের মালেগাঁওয়ে একটি মসজিদের কাছে পার্ক করা একটি মোটরসাইকেলে রাখা বিস্ফোরক থেকে এই বিস্ফোরণ ঘটে। এর আগে, ৮ মে বিশেষ এনআইএ বিচারক এ কে লাহোটি সমস্ত অভিযুক্তকে ৩১ জুলাই আদালতে হাজির হতে নির্দেশ দেন। বিচার চলাকালীন রাষ্ট্রপক্ষ ৩২৩ জন সাক্ষীর জবানবন্দি গ্রহণ করে, যার মধ্যে ৩৭ জন সাক্ষ্য থেকে সরে আসেন। পরে মামলার তদন্তভার দেওয়া হয় এনআইএ-র হাতে।
এই মামলায় লেফটেন্যান্ট কর্নেল প্রসাদ পুরোহিত, বিজেপি নেত্রী প্রজ্ঞা ঠাকুর, মেজর রমেশ উপাধ্যায় (অবসরপ্রাপ্ত), অজয় রাহিরকর, সুধাকর দ্বিবেদী, সুধাকর চতুর্বেদী এবং সমীর কুলকার্নির বিরুদ্ধে বেআইনি কার্যকলাপ প্রতিরোধ আইন (UAPA) ও ভারতীয় দণ্ডবিধির (IPC) অধীনে মামলা দায়ের করা হয়। প্রাথমিকভাবে তদন্ত করছিল মহারাষ্ট্র সন্ত্রাসবিরোধী স্কোয়াড (ATS), কিন্তু ২০১১ সালে তদন্তের দায়িত্ব যায় জাতীয় তদন্ত সংস্থা (NIA)-এর হাতে।
রায় দেওয়ার সময় বিচারক কী বলেছিলেন?
সরকারি পক্ষ প্রমাণ করতে পেরেছিল যে বিস্ফোরণ ঘটেছিল, কিন্তু বিস্ফোরকটি মোটরসাইকেলের মধ্যেই রাখা হয়েছিল – এই দাবির সপক্ষে কোনও সুনির্দিষ্ট প্রমাণ তারা দিতে পারেনি। দাবি করা হয়েছিল লেফটেন্যান্ট কর্নেল পুরোহিত কাশ্মীর থেকে আরডিএক্স এনেছিলেন, কিন্তু তারও প্রমাণ মেলেনি। এমনকি প্রমাণ হয়নি যে পুরোহিত নিজের বাড়িতে বোমা তৈরি করেছিলেন।
রমজান মাসের কারণে ওই সময় এলাকাটি বন্ধ ছিল এবং মোটরসাইকেলটি সেখানে কীভাবে এলো, তা স্পষ্ট নয়। দাবি করা হয়েছিল ষড়যন্ত্রের জন্য ইন্দোর, উজ্জয়িনী ও নাসিকে বৈঠক হয়েছিল, কিন্তু আদালতে এমন কোনও বৈঠকের বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ পেশ করা যায়নি।আদালত আরও জানায়, তদন্তকারী অফিসাররা ফোন রেকর্ড পরীক্ষার অনুমতি নেননি। অভিনব ভারত মামলায় পুরোহিত, রাহিরকর ও উপাধ্যায়ের মধ্যে কিছু আর্থিক লেনদেনের প্রমাণ মিললেও, সেই অর্থ সন্ত্রাসে ব্যবহৃত হয়েছে তা প্রমাণ হয়নি।
প্রসিকিউশন তাদের অভিযোগ প্রমাণে বিশ্বাসযোগ্য এবং নির্দিষ্ট প্রমাণ দিতে ব্যর্থ হয়। সব প্রমাণ বিচার করে আদালত রায় দেয় অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণের যথেষ্ট আইনি ভিত্তি নেই। এটি একটি গুরুতর অপরাধ ছিল, তবে দোষী সাব্যস্ত করতে দৃঢ় ও অকাট্য প্রমাণ প্রয়োজন। ফলে সন্দেহের সুবিধা দিয়ে সকল অভিযুক্তকে বেকসুর মুক্তি দেওয়া হয়েছে।
মুখ্যমন্ত্রীর প্রতিক্রিয়া
মালেগাঁও বিস্ফোরণ মামলায় আদালতের রায়ের পর মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী দেবেন্দ্র ফড়নবীস প্রতিক্রিয়া জানান। তিনি সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম X-এ লেখেন “সন্ত্রাসবাদে গেরুয়া কখনও ছিল না, নেই, আর হবেও না!”
এটিএস ও এনআইএ তদন্তে কী পার্থক্য ছিল?
মহারাষ্ট্র এটিএস শুরুতে তদন্ত চালায়। এটিএস দাবি করেছিল, সাধ্বী প্রজ্ঞার এলএমএল ফ্রিডম বাইকটি বিস্ফোরক বহনে ব্যবহৃত হয়েছিল। লেফটেন্যান্ট কর্নেল পুরোহিতের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, তিনি অভিনব ভারত নামে এক হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের মাধ্যমে আরডিএক্স পরিকল্পনা ও সংগ্রহ করেছিলেন।
তবে যখন এনআইএ তদন্ত নেয়, তখন অনেক অভিযোগ প্রত্যাহার করা হয়। এনআইএ-র মতে, এটিএস এর তদন্তে অনেক ভুল ছিল, তবে UAPA ধারাগুলি রাখা হয়।
মালেগাঁও বিস্ফোরণ মামলা
২০০৮ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর রাত ৯টা ৩৫ মিনিটে মালেগাঁওয়ের আঞ্জুমান চক ও ভিক্কু চকের মাঝে শাকিল গুডস ট্রান্সপোর্টের সামনে বিস্ফোরণ ঘটে। এতে ৬ জন নিহত এবং শতাধিক মানুষ আহত হন।
এই বিস্ফোরণে ব্যবহৃত মোটরসাইকেলটি ছিল প্রজ্ঞা ঠাকুরের নামে, এনআইএ রিপোর্টে এমনটাই বলা হয়।
হেমন্ত করকারের নেতৃত্বে মহারাষ্ট্র এটিএস তদন্ত করে দেখে যে, মোটরসাইকেলের তার সুরাটের মাধ্যমে প্রজ্ঞা ঠাকুরের সঙ্গে যুক্ত। প্রজ্ঞা ছিলেন অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদের সদস্য। পুলিশ পুনে, নাসিক, ভোপাল এবং ইন্দোরে তদন্ত চালায়। সেনা অফিসার কর্নেল প্রসাদ পুরোহিত এবং অবসরপ্রাপ্ত মেজর রমেশ উপাধ্যায়কেও গ্রেফতার করা হয়।
এই ঘটনায় হিন্দু সংগঠন অভিনব ভারত এবং সুধাকর দ্বিবেদী ওরফে দয়ানন্দ পাণ্ডের নাম উঠে আসে।
মোটরসাইকেল ও প্রজ্ঞার সংযোগ
এটিএসের চার্জশিট অনুযায়ী, প্রজ্ঞার বিরুদ্ধে বড় প্রমাণ ছিল, বিস্ফোরণে ব্যবহৃত মোটরসাইকেলটি তার নামে ছিল। এরপর প্রজ্ঞাকে গ্রেফতার করা হয় এবং তার বিরুদ্ধে মহারাষ্ট্র সংগঠিত অপরাধ নিয়ন্ত্রণ আইন (MCOCA) প্রয়োগ করা হয়। চার্জশিটে বলা হয়, তদন্তকারীরা রমেশ উপাধ্যায় ও কর্নেল প্রসাদ পুরোহিতের কথোপকথনে প্রজ্ঞা ঠাকুরের ভূমিকার কথা জানতে পারেন। যদিও পরে তদন্তভার যায় এনআইএ-র হাতে। এনআইএ চার্জশিটেও প্রজ্ঞার নাম থাকে। ২০০৯ ও ২০১১ সালে এটিএস যে চার্জশিট জমা দেয় তাতে ১৪ জন অভিযুক্তের নাম ছিল।
কিন্তু ২০১৬ সালে এনআইএ চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেয়, যাতে ১০ জন অভিযুক্তের নাম ছিল।হাস্যকরভাবে এই রিপোর্টে প্রজ্ঞাকে নির্দোষ বলা হয়। এমসিওসিএ তুলে নেওয়া হয় এবং বলা হয় যে মহারাষ্ট্র এটিএস পরিচালিত তদন্তে অসঙ্গতি ছিল।
এমনকি অভিযোগপত্রে বলা হয় মোটরসাইকেলটি প্রজ্ঞার নামে থাকলেও বিস্ফোরণের দুই বছর আগে থেকেই সেটি কালসাংরা ব্যবহার করছিল।
জামিন পেলেও প্রজ্ঞার বিরুদ্ধে মামলা চলতে থাকে। ২০১৯ সালে তিনি ভোপাল থেকে লোকসভা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে জয়ী হন। ভোটে অংশ নেওয়ার সময়, তিনি মালেগাঁও বিস্ফোরণ মামলায় নিজের অবস্থান ব্যাখ্যা করেন। বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, এমন কিছু তিনি করেননি যাতে মালেগাঁওয়ের ভূত তাকে তাড়া করবে। ভোপালকে বিজেপির অন্যতম নিরাপদ আসন মনে করা হয়। ১৯৮৯ সাল থেকে বিজেপি এখানে জিতে আসছে।
তবে যেদিন বিজেপি প্রজ্ঞা ঠাকুরকে প্রার্থী করে, কংগ্রেস সেখানে প্রবীণ নেতা দিগ্বিজয় সিংকে দাঁড় করায়। তার আগে মধ্যপ্রদেশ বিধানসভা নির্বাচনে কংগ্রেস জয় পেয়েছিল।
দুই বছরে দুটি বিস্ফোরণ
২০০৮ সালের সেপ্টেম্বরে মালেগাঁওয়ে দুই বছরের মধ্যে দ্বিতীয় বিস্ফোরণ ঘটে। তার আগে ২০০৬ সালের ৮ সেপ্টেম্বর শবে বরাতের দিন একাধিক বিস্ফোরণ ঘটে। মসজিদের কাছে চারটি বিস্ফোরণ হয়। এতে ৩১ জন নিহত এবং ৩১২ জন আহত হন। এই মামলাটি এখনও নিষ্পত্তিহীন। শুরুতে কিছুজন গ্রেফতার হলেও পরে তারা মুক্তি পান। পরে তদন্তে কিছু হিন্দু চরমপন্থীর নাম সামনে আসে।
মালেগাঁও বিস্ফোরণ মামলার ১৭ বছরের দীর্ঘ লড়াই শেষে যখন আদালতের রায় ঘোষিত হল, তখন নিহত ৬ জনের পরিবার আর আহত শতাধিক মানুষ কোনো সান্ত্বনা পেলেন না। দীর্ঘ বিচারপ্রক্রিয়ার পরও তারা জানতে পারলেন না যে কারা দায়ী, কেন তাঁদের প্রিয়জনেরা প্রাণ হারালেন, কেন তাঁদের জীবন ছিন্নভিন্ন হলো। রাষ্ট্রের নানা সংস্থা, আইন, তদন্ত ও আদালতের মধ্যেকার অসঙ্গতির ভার পড়ল সাধারণ মানুষের স্মৃতির ওপর। বিচার হল, কিন্তু ন্যায় হল কি !