আলোকছায়ার সাহিত্যিক বিজয়: আন্তর্জাতিক বুকার জয় করে ইতিহাস গড়লেন ভারতের বানু মুশতাক

- আপডেট : ২১ মে ২০২৫, বুধবার
- / 72
পুবের কলম, ওয়েবডেস্ক: লন্ডনের আকাশে সেদিন যেন এক অভূতপূর্ব সাহিত্য-বৃষ্টি নামল। সময় ছিল মে মাসের কুয়াশাচ্ছন্ন এক সন্ধ্যা, তারিখ ২০ মে ২০২৫, স্থান- টেট মডার্ন গ্যালারি। লাল গালিচার আলোকিত ধাপ বেয়ে এগিয়ে এলেন এক বৃদ্ধা, চোখে চশমা, মুখে শান্ত অভিব্যক্তি, হৃদয়ে শত বছরের কাহিনির ভার। তিনি বানু মুশতাক—লেখক, সমাজকর্মী, আইনজীবী এবং ইতিহাসের পাতায় সদ্য লেখা এক উজ্জ্বল নাম।
তাঁর ছোটগল্প সংকলন ‘হার্ট ল্যাম্প’ কন্নড় ভাষায় লেখা প্রথম গ্রন্থ হিসেবে আন্তর্জাতিক বুকার পুরস্কার জয় করে ভেঙে দিল ভাষার সীমা, সাহিত্যের প্রাচীর। পুরস্কারের ৫০,০০০ ব্রিটিশ পাউন্ড—এ যেন শুধু একটি অঙ্ক নয়, বরং কন্নড় সাহিত্যের দিকে ছুঁড়ে দেওয়া আলোর ফুলকি। অনুবাদক দীপা ভাস্তির সঙ্গে তিনি সমানভাবে ভাগ করে নিলেন এই গৌরব ও পুরস্কার—যেমন গল্পে ভাগ হয় মানবতা ও হৃদয়ের আলো।
৭৭ বছর বয়সে এসে বানু মুশতাক যেন এক দীপ্ত প্রদীপ, যিনি শুধু নিজেকে নয়, কন্নড় ভাষা ও দক্ষিণ ভারতের মুসলিম সমাজকেও জাগিয়ে তুলেছেন এক নতুন আলোয়। তাঁর গল্পগুলো যেন কিশোরী মেয়েদের মুখ থেকে ঝরে পড়া নীরব আর্তনাদ, কিংবা মায়েদের বুকের নিঃশব্দ যন্ত্রণা—যা শব্দে বাঁধা আর হৃদয়ে শোনা।
পুরস্কার গ্রহণ করতে গিয়ে তিনি বললেন,
“এই মুহূর্তটা যেন এক আকাশজুড়ে হাজারো জোনাকি একসঙ্গে জ্বলে ওঠার মতো—ক্ষণিক, উজ্জ্বল এবং ভয়াবহ রকমের যৌথ প্রচেষ্টা প্রসূত।” কী আশ্চর্য, এমন ব্যঞ্জনায় তিনি শুধু নিজের জয় নয়, গোটা এক সমাজের নিঃশব্দ উচ্চারণকে ভাষা দিলেন।
‘হার্ট ল্যাম্প’ সংকলনে থাকা ১২টি গল্প যেন সমাজের অন্ধকারে জ্বলে ওঠা ছোট ছোট বাতি। নারী-জীবনের অন্তর্গত দুঃখ, স্বপ্ন, বিদ্রোহ আর বিনম্র আশা- সব মিলিয়ে এক একেকটি গল্প হয়ে দাঁড়িয়েছে সমাজের আয়না।
বিচারক ম্যাক্স পোর্টার বললেন, “এটি একটি বিপ্লবাত্মক অনুবাদ- যা ভাষার গতিপথ বদলে দেয়।”
এ যেন শব্দের মিছিল, যার প্রতিটি পদক্ষেপ সাহিত্যের সীমানা প্রসারিত করে দেয়।এই পুরস্কার শুধু একটি বইয়ের জয় নয়, একটি ভাষার জয়, একটি জাতির জয়, নারীর জয়, আর সেই সব হারিয়ে যাওয়া কণ্ঠস্বরের জয়—যারা চুপচাপ থেকে গেছে এতদিন। বানু মুশতাকের কলম তাই আর শুধু একটি সাহিত্যিক অস্ত্র নয়—এটি এখন ইতিহাস রচনার কলম, যা লিখে চলেছে নারী জীবনের নবজাগরণ, সমাজচেতনার নবস্বর।
কর্নাটকের এক ছোট্ট শহরের ধূলিধুসর পাড়ায় জন্মেছিলেন বানু মুশতাক। ঘর ছিল সাদামাটা, কিন্তু মনটি ছিল কাব্যের আলোয় দীপ্ত। ছোটবেলাটা কেটেছে মুসলিম পাড়ার গলিঘুঁজিতে, কোরআনের আয়াত মুখস্থ করতে করতে। তখনও তিনি জানতেন না, শব্দের জাদু একদিন তাঁকে সাহিত্যিক করে তুলবে।
আট বছর বয়সে তাঁর বাবা, যিনি সরকারি চাকরির চাপে চাপা স্বপ্ন দেখতেন মেয়ের জন্য, বানুকে ভর্তি করিয়ে দিলেন এক কনভেন্ট স্কুলে। কন্নড় ভাষা, যা ছিল সে সময় তাঁর কাছে প্রায় অজানা, ধীরে ধীরে হয়ে উঠল তাঁর আপন, তাঁর আত্মার ভাষা। কন্নড়ই হয়ে উঠল তাঁর কলমের কালি।
বানুর বাল্যকালে বিয়ের মিছিল লেগে থাকত চারপাশে। সমবয়সীরা সংসারের ঘানি টানছিল, আর তিনি টানছিলেন বইয়ের গন্ধ। সমাজের বাধা, পারিবারিক চাপ—সব পেরিয়ে তিনি উচ্চশিক্ষার পথে এগিয়ে গেলেন। লেখার প্রতি তাঁর প্রেম ছিল চিরন্তন, অথচ ছাপার অক্ষরে আসতে সময় লেগে গেল অনেকটা। শেষমেশ ২৭ বছর বয়সে, বিয়ের এক বছর পর, একটি স্থানীয় পত্রিকায় প্রকাশ পেল তাঁর প্রথম ছোটগল্প। যেন এক সূর্যোদয়—নীরব আকাশে শব্দের আলো ছড়িয়ে দিল বানু।
বানু মুশতাক কেবল একজন লেখিকা নন, তিনি এক প্রতীক—সংগ্রামের, সাহসের, এবং ভাষার প্রতি ভালোবাসার। তাঁর কলমে শুধু গল্প নয়, উঠে আসে জীবন, আত্মার স্পর্শ, আর সমাজের নীরব প্রতিবাদ।