আলিয়ায় শেষ স্বাধীন নবাব-এর শাহাদত দিবসে বললেন বিশিষ্টরা
‘স্বাধীনচেতা মনের পাশপাাশি সিরাজ-উদ-দৌলাহ’র দেশপ্রেমও ছিল নিখাদ’

- আপডেট : ৪ জুলাই ২০২৫, শুক্রবার
- / 91
পুবের কলম, প্রতিবেদক: বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজ-উল-দৌলাহ তৎকালীন নবাব আলিবর্দী খানের দৌহিত্র হিসেবে বাংলায় বর্গী আক্রমণের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। পরে সিংহাসনে তাঁর অভিষেক ঘটে। কিন্তু ভিতরে ও বাইরে এই তরুণ নবাব বেশকিছু কুচক্রীর চক্রান্তের শিকার হন। একদিকে মীরজাফর ও তাঁর পুত্র মীরন ও অন্যদিকে জগৎ শেঠ, উমি চাঁদ বা রায় বল্লাভরা ইংরেজদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে সিরাজকে গদিচ্যুত করতে তৎপর হন।
শেষমেশ পলাশির যুদ্ধে পরাজয়ের মাধ্যমে ইংরেজ-শাসনের শুরু হয়। তারপর কেটে গিয়েছে বহু বছর। বদলেছে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট। শাসকও বদলে গিয়েছে দেশে। কিন্তু সিরাজকে নিয়ে সঠিক চর্চা হয়নি। এই খামতি দূর করতে এবং সময়ের প্রেক্ষিতে সিরাজ উদ-দৌলাহ’কে তুলে ধরতে বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছিল বেশ কিছু সংস্থা।
বৃহস্পতিবার বিকালে আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগ, দৈনিক পুবের কলম, নো ইওর নেবার, সবর ইনস্টিটিউট-এর উদ্যোগে আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের পার্ক সার্কাস ক্যাম্পাসের অডিটোরিয়ামে নবাব সিরাজকে নিয়ে অনুষ্ঠিত হয় আলোচনাচক্র। অংশগ্রহণ করেন রাজ্য সংখ্যালঘু কমিশনের চেয়ারম্যান ও পুবের কলম-এর সম্পাদক আহমদ হাসান ইমরান, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. কাজী সুফিউর রহমান, বিশিষ্ট অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ শাহনূরুর রহমান, আলিয়ার ইতিহাস বিভাগের প্রধান ড. মুহাম্মদ শামিম ফিরদাউস, ড. ইসতিয়াক হুসেন, মিল্লি আল-আমীন গার্লস কলেজের অধ্যাপিকা ড. সমহিতা সেন, সমাজ-গবেষক সাবির আহমেদ, সংগীতশিল্পী ও ছায়ানট-এর প্রধান সোমঋতা মল্লিক প্রমুখ।
স্বাগত ভাষণে ড. মুহাম্মদ শামিম ফিরদাউস বলেন, ইতিহাসে নবাব সিরাজের পরাজয় ও ইংরেজদের ক্ষমতা দখল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। আমরা দেখতে পাই মাত্র ১৪ মাস ১৪ দিন শাসন ক্ষমতায় থাকাকালে সিরাজকে ঘরে-বাইরে সমানভাবে লড়াই করতে হয়েছে। তিনি ছিলেন আপোসহীন, স্বাধীনচেতা। সিরাজের দেশপ্রেম ও তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করতে ষড়যন্ত্রীদের কথা তুলে ধরতে ঐতিহাসিক ব্রিজেন গুপ্ত, অক্ষয়কুমার মৈত্রদের নাম নেন।
বারবার ইতিহাস পালটে দেওয়া বা বিকৃত তথ্যের উপস্থাপনায় সঠিক ইতিহাসচর্চাকে ব্যহত হয় বলে উল্লেখ করেন সাবির আহমেদ। তিনি আরও বলেন, পলাশির ঘটনা না ঘটলে হয়ত আজকের কলকাতা ‘আলিনগর’ নামেই অভিহিত হতো। সিরাজের রাজ-দরবারে ১৮জন প্রধান কর্মচারীর মধ্যে ১৯জনই যে সংখ্যাগুরু সমাজের প্রতিনিধি ছিল সে কথা উল্লেখ করেন সাবির আহমেদ বলেন, যুক্তসাধনা ও ইনক্লুসিভ সোসাইটির প্রকৃষ্ট উদাহরণ ছিল সিরাজের দরবার। কিন্তু সিরাজকে নিয়ে কোনও সংগঠন বা রাজ্য প্রশাসনের কেন উদ্যোগ নেই, সেই প্রশ্নও তোলেন সাবির আহমেদ। তাঁর দাবি, সিরাজকে যথাযোগ্য সম্মান জানাতে অন্তত একটা পার্ক, স্কুল, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁর নামে করা হোক।
সিরাজ উদ দৌলাহ’র নামে অনেক মিথ্যা-প্রচারণা আছে বলে উল্লেখ করেন আহমদ হাসান ইমরান। বলেন, খুব কম সময় শাসন-ক্ষমতায় ছিলেন সিরাজ, ফলে আরাম-আয়েশের সুযোগই ছিল না। শত্রুদের মোকাবিলা করতেই সময় কেটে গিয়েছে। ইমরান বলেন, শাসকের কৃপা পাওয়ার জন্য অনেকেই তাঁদের মতো করে লিখতেন, ফলে ইতিহাস বিকৃত হয়েছে। মুসলিমদের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সাহিত্য ইত্যাদি নিয়ে চর্চার অভাব আছে। আমরা দেখতে পাচ্ছি সিধু-কানহুর নামে বিশ্ববিদ্যালয় আছে, কিন্তু সিরাজকে ভুলে গিয়েছি। একটা ছোট রাস্তা আছে ঠিকই কিন্তু ক’জন সে কথা মনে রেখেছে। ইমরান আরও বলেন, শিক্ষা-বিস্তারে বিদ্যাসাগরের অবদান উচ্চারিত হলেও বেগম রোকেয়ার কথা কেউ মনে রাখে না। প্রকৃত ইতিহাস উঠে আসুক ও সত্য ঘপনা মানুষ জানুক, এটাই সময়ের দাবি বলে উল্লেখ করেন তিনি।
আলিয়ার অধ্যাপক ড. ইসতিয়াক হুসেন ও মিল্লি আল-আমীন গার্লস কলেজের অধ্যাপিকা ড. সমহিতা সেনের বক্তব্যে সিরাজের বেশকিছু কাজের কথা উঠে আসে। তাঁর বিরুদ্ধে চলমান ষড়যন্ত্রের প্রেক্ষিতে সিরাজের প্রতিরোধের কথা যেমন উল্লেখ করেন ড. ইসতিয়াক হুসেন। অন্যদিকে ড. সমহিতা সেনের উপস্থাপনায় ছিল সিরাজের তদারকি ও সাহায্যে তৈরি হওয়া স্থাপত্যের কথা।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের অধ্যাপক ড. কাজী সুফিউর রহমান বলেন, একজন ব্যক্তির কাজকেই মূল্যায়ণ করা দরকার, কারও ব্যক্তিগত চরিত্র তুলে ধরে আসল বিষয়কে আড়াল করা ঠিক নয়। বিভিন্ন-কালে সিরাজকে নিয়ে চর্চার ক্ষেত্রে অক্ষয়কুমার মৈত্র, উইলিয়াম হলওয়েল, ম্যালেশন প্রমুখের মতো ঐতিহাসিকদের নাম নেন সুফিউর রহমান। তাঁর কটাক্ষ, বর্তমানে যেমন বুদ্ধিজীবীরা দলবদল করেন, সেইসময়ও এটা হতো, ফলে ইতিহাস বিকৃত হয়েছে। অন্য প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সিরাজকে শেষ নবাব না বলে আমরা শেষ স্বাধীন নবাব বলতে পারি।
অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ শাহনূরুর রহমান বলেন, ইতিহাস সবাই লিখতে পারেন না। বাস্তবতা এটই যে আমাদের দেশের ইতিহাস হয়েছে। স্বয়ং বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বলেছিলেন যে বাংলার ইতিহাস নেই, ইতিহাস রচনা করতে হবে। আন্নদামঙ্গল কাব্যে হিন্দু-মুসলমানের মিলনের চেষ্টা থেকে শুরু করে সিরাজকে নিয়ে চক্রান্তের নানান ঘটনাপ্রবাহ তাঁর বক্তব্যে উঠে আসে।
এ দিকে সোমঋতা মল্লিক বলেন, কাজী নজরুল ও সিরাজের মধ্যে মিল দেখা যায়। সিরাজ যেমন স্বাধীনচেতা ছিলেন, তেমনি কাজী নজরুল ইসলাম প্রথম পুর্ণ স্বরাজ দাবি করেছিলেন। এখানেই শেষ নয়, সচীন্দ্রনাথ সেনগুপ্তর সিরাজ নাটকের জন্য পাঁচটি গান লিখে সুরও দিয়েছিলেন নজরুল। তিনি একটি সংগীতও পরিবেশন করেন।