০১ মে ২০২৫, বৃহস্পতিবার, ১৮ বৈশাখ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

মারণযজ্ঞকামীরা মুক্ত কেন?

বিপাশা চক্রবর্তী
  • আপডেট : ৩১ ডিসেম্বর ২০২১, শুক্রবার
  • / 9

কিছু উগ্র গেরুয়াপন্থী ‘ব্যক্তি ও সাধুদের’ হত্যালোলুপ ও মানবতা বিরোধী বক্তব্য ও আচরণের নজির ইতিহাসে খুব অল্পই দৃষ্টিগোচর হইবে। বিশেষ করিয়া কোনও সভ্য ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের এই ধরনের হত্যালোলুপ ব্যক্তিদের অবস্থান যে কোনও দেশের জন্যই লজ্জাজনক। ইহা অপেক্ষাও লজ্জাজনক হইতেছে– দেশে যদি কোনও সংবিধানসম্মত– গণতান্ত্রিক ও আইন দ্বারা পরিচালিত সরকার থাকে– তাহাদের নীরবতা ও নিষ্ক্রিয়তা। সেই ক্ষেত্রে যথার্থ অর্থে ওই দেশটিকে ফ্যাসিবাদী বলিয়া চিহ্নিত করিতে হইবে।

দেখা যাইতেছে– ভারতে ধর্মীয় ফ্যাসিবাদীদের ‘হরিদ্বার ঘোষণা’ সারা বিশ্বে নিন্দিত হইয়াছে। কারণ–হিন্দুদের পবিত্র শহর হইতে ‘হরিদ্বার ডিক্লারেশন বা ঘোষণা’য় সংখ্যালঘু বিশেষ করিয়া মুসলিমদের বিরুদ্ধে জেনোসাইডের খুল্লমখুল্লা আহ্বান জানানো হইয়াছে। এভাবে দেশের নাগরিকদের উপর গণহত্যার প্রকাশ্য আহ্বান গণতান্ত্রিক দেশে এক নজিরবিহীন ঘটনা।

এমনকি ফ্যাসিবাদী জার্মানিতেও অ্যাডলফ হিটলার ইহুদি নিধনের লক্ষ্যে এই ধরনের কোনও ঘোষণা দেন নাই। ইহুদিরা দাবি করে– জার্মানিতে হাজার হাজার ইহুদি নিধন বা কথিত হলোকাষ্ট সংঘটিত হইয়াছিল। কিন্তু ইহুদি গণনিধনের জন্য ‘হরিদ্বার ঘোষণা’র মতো কোনও প্রকাশ্য ঘোষণা হিটলার বা তাঁহার সহযোগীরা দেন নাই।

ইদানিং খোদ জার্মানি ও ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশে তরুণ সমাজের মধ্যে ফ্যাসিজিমের বহিঃপ্রকাশ দেখা যাইতেছে। তাহারা অবশ্য ফেসবুক বা টু্যইটারে বেশি সক্রিয়। কিন্তু তাহা সত্ত্বেও ইউরোপীয় এই দেশগুলির সরকার বাখবর এবং সচেতন রহিয়াছেন। সেইসব দেশে পুলিশ ফ্যাসিবাদী প্রবণতার শরিক তরুণদের বিরুদ্ধে আইনি ও পুলিশি ব্যবস্থা লইয়া থাকে।

কিন্তু বর্তমানে যে সরকার ক্ষমতাসীন রহিয়াছেন–তাহা দুই ধরনের নীতি অবলম্বন করিতেছেন। কেহ গেরুয়াপন্থী কোনও নেতার নামে সামান্য মন্তব্য করিলেও তাহার বিরুদ্ধে ‘দেশদ্রোহ মামলা’ দায়ের করিয়া গ্রেফতার করা হইতেছে। যোগী কিংবা হিমন্ত বিশ্বশর্মা নানা অপবাদ দিয়া মানুষকে মিথ্যা এনকাউন্টারে হত্যাও করিতেছেন।

সংবিধান ও আইন বর্হিভূত কার্যকলাপের কথা স্বয়ং উচ্চারণ করিতেছেন অসম ও উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী কিছু সাংসদ ও বিধায়কবৃন্দ। অথচ তাঁহারা এই বলিয়া শপথ গ্রহণ করিয়াছেন যে– ভারতের সকল ব্যক্তি–ভাষা-ভাষী– ধর্মাবলম্বীদের তাঁহারা সমদৃষ্টিতে দেখিবেন।

গণহত্যার আহ্বান প্রচার করিবার পরও সরকার বা পুলিশ এই অপরাধীদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা লয় নাই। হরিদ্বার ঘোষণায় বিশেষ সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে হত্যাযজ্ঞ শুরু করিবার আহ্বান দ্বারা এই মানবতাবিরোধী অপরাধীরা মাটি পরীক্ষা করিতে ছিলেন মাত্র। যখন দেখিলেন সরকার– প্রশাসন ও আইন তাহাদের পক্ষে রহিয়াছে– তখন তাঁহারা আর একটি নতুন ও ঘৃণ্য উদ্যোগ লইলেন। এইবার তাঁহারা ‘হত্যা চক্রান্তের জন্য দায়ি’ বলিয়া পবিত্র কুরআন– রাসূল মুহাম্মদ সা.– খলিফা– আবুবকর– উমর ও ওসমান রা.-এর বিরুদ্ধে পুলিশে মিথ্যা অভিযোগে এফআইআর দায়ের করিলেন। অথচ যেখানে এই দেশে ধর্ষিতা নারী পুলিশে এফআইআর করিতে চাহিলে তাহাকে এক থানা হইতে অন্য থানায় ছুটিতে হয়– অনুনয়-বিনয় ও  প্রমাণাদি দিয়াও এফআইআর দায়ের করা সম্ভব হয় না– সেখানে পুলিশ শুধু অম্লান বদনে নহে– হাস্য মুখে এই ঘৃণা বা বিদ্বেষ ছড়ানো এফআইআর গ্রহণ করে!

হরিদ্বার পুলিশ স্টেশনে স্থানীয় ইমাম ও মাওলানাদের বিরুদ্ধেও এফআইআর করা হইয়াছে। হিন্দুরক্ষা সেনার প্রভোধানন্দ গিরি– ধর্ম সংসদের আয়োজক নরসিমানন্দ– সাধ্বী অন্নপূর্ণা প্রমুখ এই এফআইআর দায়ের করে। ইহাদের পিছনে যে সরকারের কখনও প্রচ্ছন্ন– আবার কখনও বা প্রকাশ্য সমর্থন রহিয়াছে তাহা বলাই বাহুল্য।

স্পষ্ট বোঝা যায়– ভারতবর্ষের সংবিধান বর্ণিত নীতিমালা লঙ্ঘন করিয়া ধর্মে ধর্মে লড়াইকে উৎসাহ দিয়া যাহারা বিপর্যয় সৃষ্টি করিতে চাহিতেছেন– দেশকে বিশ্বের বিবেচনায় কলঙ্কিত করিবার পরিকল্পনা করিয়াছেন তাহারা কোনও অবস্থাতেই দেশের ভাল কামনা করেন না। তাহারা এই দেশকে ধ্বংসের পথে লইয়া যাইতে চাহেন। ভারতের সকল সচেতন নাগরিক– সুশীল সমাজ এবং রাজনীতিবিদদের এই কথাটি উপলব্ধি করিতে হইবে। রুখিতে হইবে মারণযজ্ঞের পরিকল্পক এইসব হত্যাকারীকে।

 

 

Tag :

Copyright © Puber Kalom All rights reserved.| Developed by eTech Builder

মারণযজ্ঞকামীরা মুক্ত কেন?

আপডেট : ৩১ ডিসেম্বর ২০২১, শুক্রবার

কিছু উগ্র গেরুয়াপন্থী ‘ব্যক্তি ও সাধুদের’ হত্যালোলুপ ও মানবতা বিরোধী বক্তব্য ও আচরণের নজির ইতিহাসে খুব অল্পই দৃষ্টিগোচর হইবে। বিশেষ করিয়া কোনও সভ্য ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের এই ধরনের হত্যালোলুপ ব্যক্তিদের অবস্থান যে কোনও দেশের জন্যই লজ্জাজনক। ইহা অপেক্ষাও লজ্জাজনক হইতেছে– দেশে যদি কোনও সংবিধানসম্মত– গণতান্ত্রিক ও আইন দ্বারা পরিচালিত সরকার থাকে– তাহাদের নীরবতা ও নিষ্ক্রিয়তা। সেই ক্ষেত্রে যথার্থ অর্থে ওই দেশটিকে ফ্যাসিবাদী বলিয়া চিহ্নিত করিতে হইবে।

দেখা যাইতেছে– ভারতে ধর্মীয় ফ্যাসিবাদীদের ‘হরিদ্বার ঘোষণা’ সারা বিশ্বে নিন্দিত হইয়াছে। কারণ–হিন্দুদের পবিত্র শহর হইতে ‘হরিদ্বার ডিক্লারেশন বা ঘোষণা’য় সংখ্যালঘু বিশেষ করিয়া মুসলিমদের বিরুদ্ধে জেনোসাইডের খুল্লমখুল্লা আহ্বান জানানো হইয়াছে। এভাবে দেশের নাগরিকদের উপর গণহত্যার প্রকাশ্য আহ্বান গণতান্ত্রিক দেশে এক নজিরবিহীন ঘটনা।

এমনকি ফ্যাসিবাদী জার্মানিতেও অ্যাডলফ হিটলার ইহুদি নিধনের লক্ষ্যে এই ধরনের কোনও ঘোষণা দেন নাই। ইহুদিরা দাবি করে– জার্মানিতে হাজার হাজার ইহুদি নিধন বা কথিত হলোকাষ্ট সংঘটিত হইয়াছিল। কিন্তু ইহুদি গণনিধনের জন্য ‘হরিদ্বার ঘোষণা’র মতো কোনও প্রকাশ্য ঘোষণা হিটলার বা তাঁহার সহযোগীরা দেন নাই।

ইদানিং খোদ জার্মানি ও ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশে তরুণ সমাজের মধ্যে ফ্যাসিজিমের বহিঃপ্রকাশ দেখা যাইতেছে। তাহারা অবশ্য ফেসবুক বা টু্যইটারে বেশি সক্রিয়। কিন্তু তাহা সত্ত্বেও ইউরোপীয় এই দেশগুলির সরকার বাখবর এবং সচেতন রহিয়াছেন। সেইসব দেশে পুলিশ ফ্যাসিবাদী প্রবণতার শরিক তরুণদের বিরুদ্ধে আইনি ও পুলিশি ব্যবস্থা লইয়া থাকে।

কিন্তু বর্তমানে যে সরকার ক্ষমতাসীন রহিয়াছেন–তাহা দুই ধরনের নীতি অবলম্বন করিতেছেন। কেহ গেরুয়াপন্থী কোনও নেতার নামে সামান্য মন্তব্য করিলেও তাহার বিরুদ্ধে ‘দেশদ্রোহ মামলা’ দায়ের করিয়া গ্রেফতার করা হইতেছে। যোগী কিংবা হিমন্ত বিশ্বশর্মা নানা অপবাদ দিয়া মানুষকে মিথ্যা এনকাউন্টারে হত্যাও করিতেছেন।

সংবিধান ও আইন বর্হিভূত কার্যকলাপের কথা স্বয়ং উচ্চারণ করিতেছেন অসম ও উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী কিছু সাংসদ ও বিধায়কবৃন্দ। অথচ তাঁহারা এই বলিয়া শপথ গ্রহণ করিয়াছেন যে– ভারতের সকল ব্যক্তি–ভাষা-ভাষী– ধর্মাবলম্বীদের তাঁহারা সমদৃষ্টিতে দেখিবেন।

গণহত্যার আহ্বান প্রচার করিবার পরও সরকার বা পুলিশ এই অপরাধীদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা লয় নাই। হরিদ্বার ঘোষণায় বিশেষ সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে হত্যাযজ্ঞ শুরু করিবার আহ্বান দ্বারা এই মানবতাবিরোধী অপরাধীরা মাটি পরীক্ষা করিতে ছিলেন মাত্র। যখন দেখিলেন সরকার– প্রশাসন ও আইন তাহাদের পক্ষে রহিয়াছে– তখন তাঁহারা আর একটি নতুন ও ঘৃণ্য উদ্যোগ লইলেন। এইবার তাঁহারা ‘হত্যা চক্রান্তের জন্য দায়ি’ বলিয়া পবিত্র কুরআন– রাসূল মুহাম্মদ সা.– খলিফা– আবুবকর– উমর ও ওসমান রা.-এর বিরুদ্ধে পুলিশে মিথ্যা অভিযোগে এফআইআর দায়ের করিলেন। অথচ যেখানে এই দেশে ধর্ষিতা নারী পুলিশে এফআইআর করিতে চাহিলে তাহাকে এক থানা হইতে অন্য থানায় ছুটিতে হয়– অনুনয়-বিনয় ও  প্রমাণাদি দিয়াও এফআইআর দায়ের করা সম্ভব হয় না– সেখানে পুলিশ শুধু অম্লান বদনে নহে– হাস্য মুখে এই ঘৃণা বা বিদ্বেষ ছড়ানো এফআইআর গ্রহণ করে!

হরিদ্বার পুলিশ স্টেশনে স্থানীয় ইমাম ও মাওলানাদের বিরুদ্ধেও এফআইআর করা হইয়াছে। হিন্দুরক্ষা সেনার প্রভোধানন্দ গিরি– ধর্ম সংসদের আয়োজক নরসিমানন্দ– সাধ্বী অন্নপূর্ণা প্রমুখ এই এফআইআর দায়ের করে। ইহাদের পিছনে যে সরকারের কখনও প্রচ্ছন্ন– আবার কখনও বা প্রকাশ্য সমর্থন রহিয়াছে তাহা বলাই বাহুল্য।

স্পষ্ট বোঝা যায়– ভারতবর্ষের সংবিধান বর্ণিত নীতিমালা লঙ্ঘন করিয়া ধর্মে ধর্মে লড়াইকে উৎসাহ দিয়া যাহারা বিপর্যয় সৃষ্টি করিতে চাহিতেছেন– দেশকে বিশ্বের বিবেচনায় কলঙ্কিত করিবার পরিকল্পনা করিয়াছেন তাহারা কোনও অবস্থাতেই দেশের ভাল কামনা করেন না। তাহারা এই দেশকে ধ্বংসের পথে লইয়া যাইতে চাহেন। ভারতের সকল সচেতন নাগরিক– সুশীল সমাজ এবং রাজনীতিবিদদের এই কথাটি উপলব্ধি করিতে হইবে। রুখিতে হইবে মারণযজ্ঞের পরিকল্পক এইসব হত্যাকারীকে।