সংগ্রামপুর বিষ মদ কাণ্ড অন্তর্তদন্ত রিপোর্ট

- আপডেট : ২৯ মার্চ ২০২২, মঙ্গলবার
- / 14
সাকিল আহমেদঃ অন্ধজনে দেহ আলো, মৃতজনে প্রাণ। মহান করুণাময় দৃষ্টি দিয়েছে। কিন্তু সেই চোখ রক্ষার দায়িত্ব থাকে নিজের। কেউ সেই চোখ দিয়ে বিশ্ব জগৎ দ্যাখেন কেউ নিজের দোষে হারান চোখ। সংগ্রামপুর বিষ মদ কাণ্ড প্রায় এক যুগের কাছাকাছি। বিষ মদ খেয়েছিল একই পরিবারের তিন ভাই। সংগ্রামপুর রেল স্টেশনে কুলি-মজুরের কাজ করে দিন চলছিল বেশ ভালোই। দু’বেলা জুটে যাচ্ছিল ডাল-ভাত। তিনভাই বিষ মদ খায়। দুই ভাই ডায়মন্ড হারবারের জেলা হাসপাতালে মারা যায়। তাদের মধ্যে দু’চোখ হারিয়ে অন্ধ হয়ে বেঁচে আছে সংগ্রামপুর রেল স্টেশন সংলগ্ন গায়েনপাড়ার হাসিবুর গায়েন। বয়স মাত্র চল্লিশ ছুঁই-ছুঁই।
তাগড়াই চেহারা। গায়ে ছিল বিশাল শক্তি। রেল স্টেশন সংলগ্ন সংগ্রামপুর রেল বাজারে ভোর থেকে উঠে রাত পর্যন্ত তিনভাই এবং এদের বাবা কুলি-মজুরের কাজ করত। সবজি বোঝাই বড় বড় বোঝা ট্রেনের ভেন্ডার কামরায় তুলে দিত। দিনের শেষে চোলাই খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ত। কিন্তু সেদিন বিষ মদ খেয়ে দু’ভাই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে আর বেঁচে যায় হাসিবুর। ডাক্তার বৈদ্য অনেক করে জানা যায় হাসিবুর তার দুই চোখের রেটিনা হারিয়েছে। পুরো নার্ভ সিস্টেম অকেজো হয়ে গেছে। কোনোদিন আর ফিরবে না দৃষ্টি। চক্ষু বিশেষজ্ঞ ডাক্তার মিহিরলাল চৌধুরী, কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ জানিয়ে দেয় আর সম্ভব নয় দৃষ্টিশক্তি ফেরার। হতাশ হাসিবুরের পরিবার।
এ জীবন রেখে কি দরকার? স্ত্রী মুজিদাকে রেখে ভোরে একবার বাড়ির অদূরে রেললাইনে আত্মহত্যার চেষ্টা করে হাসিবুর। যিনি জীবনরক্ষার মালিক তিনিই বাঁচালেন। মহান আল্লা তায়ালার কৃপায় প্রাণ বাঁচে। মসজিদের নামাজিরা তার প্রাণ বাঁচায়।জুম্মা মসজিদের পাশ দিয়ে হেঁটে হাসিবুরের বাড়ি। আত্মহত্যা যে মহাপাপ সেটা এখন মেনে নিয়েছে হাসিবুর। কুলি মজুর হয়েও একসময় ভিখারির সে ভিক্ষা দিয়েছে। এখন সে নিজেই হাত পাতে। ভিক্ষা চায় রেল গেটে। সে এখন নিজেই সংসারের বোঝা। লেখাপড়া না জানায় নামায পড়ায় তার অনীহা।জর্দা,পান,সুপারিতে বেড়েছে তার আসক্তি। পান খায়, গজল গায়, ভিক্ষা করে রেলের রাস্তায়।
বিষমদ কাণ্ডের পর এখন কেমন আছে সংগ্রামপুর?
স্থানীয় সংগ্রামপুর গোল্ডেন ক্লাবের তখনকার সম্পাদক আবুল বাসার হালদার, শিক্ষক সাবির হোসেন পুবের কলম প্রতিবেদককে জানান, এলাকার মানুষ তুলে দিয়েছে ভাটিখানা। আমরা ক্লাবের তরফে নজর রাখি। মদ ছেড়ে মসজিদমুখী হয়েছেন মানুষ। মুসল্লির ভিড়ে স্টেশন সংলগ্ন জামে মসজিদ হয়েছে দোতলা। মগরাহাটের বিলন্দপুরের খোঁড়া বাদশার খাবার হোটেলের গ্যাসের ব্যবসার হালাল রোজগারে তৈরি জামে মসজিদের নামায চলছে যথারীতি। দাদা শওকত ফকির জানালেন, বিষ মদ কাণ্ডের কিছুদিন আগে সে আমাকে কথা দিয়েছিল সে আর মদ ব্যবসা করবে না। মসজিদে যাবে আর কুকর্ম থেকে দূরে থাকবে। হালাল পথে থাকবে। কিন্তু তার পরেও কেন ঘটল বিষমদ কাণ্ড? তাহলে কি প্রতিপক্ষের কারুর ইন্ধনে এই অবনতি এই মৃত্যুমিছিল। সে উত্তর জানা নেই মগরাহাট সংগ্রামপুরের। প্রতিবন্ধী ‘খোঁড়া বাদশা’র বানানো মসজিদে নামায আদায় করছেন পাড়া-প্রতিবেশী এমনকি খোঁড়া বাদশার বড় ছেলে সাবির ফকিরও। সাবিরও শুনে এগিয়ে আসছেন ‘হাইয়া আলাল ফালাহ’ (এসো মানুষের কল্যাণে এসো)।
আত্মশ্লাঘায় ভোগা সংগ্রামপুর থেকে সরেছে মদের ভাটিখানা। মধ্যরাতে আর শোনা যায় না রাতের কড়া নাড়া। কমেছে ট্রেন ডাকাতি, গৃহস্থের বাড়িতে চুরি, ছিনতাই। কমেছে মদ্যপান করা মানুষের সংখ্যা। বিষ মদ কাণ্ডে মিলেছে ডায়মন্ড হারবার পোস্ট অফিসে মাসিক ভাতা। প্রতি মৃত পরিবারের অ্যাকাউন্টে মমতা সরকার দিয়েছে দু’লাখ টাকার রেকারিং ডিপোজিট। তাতে প্রতি মাসে আসে ১২০০ থেকে ১৩০০ টাকা। তাতে চলে সংসার।
বিষমদ কাণ্ডে মরতে মরতে বেঁচে যাওয়া হাসিবুর চোখে সত্যিই অন্ধকার দেখে। দশ বারো বছরের ছোট্ট ছেলেটা এখন তার ‘লাঠি’। ২০১১ সালের ১৩ ডিসেম্বর মগরাহাট, উস্তি-সহ আশপাশের বিস্তীর্ণ এলাকায় বিষমদ থেকে মৃত্যু হয় ১৭২ জনের। যা সংগ্রামপুর বিষমদ কাণ্ড হিসেবে পরিচিত। এই ঘটনায় মগরাহাট এবং উস্তি থানায় পৃথক মামলা হয়। তাতে বেশ কয়েকজন মদ বিক্রেতা আলিপুর আদালতে দোষী সাব্যস্ত হয়। তাদের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়। ভুলের মাশুল গুনে ফিরছে সংসারের হাল। দু’বছর করোনার গ্রাসে সারা পৃথিবী ভারাক্রান্ত। সংসার চলে না। তবু ওদের ছেলেমেয়েরা স্কুলে যায়, কাজে যায়, অভাব ঘুচেছে। এগারো বছরের নাবালক ছেলেমেয়েরা সাবালক হয়েছে আজ। সংগ্রামপুর, মগরাহাট বুঝতে শিখেছে মদ্যপ বাবার জীবনের পথ ঠিক ছিল না।
রেল লাইনের পাশে গায়েনপাড়া। অন্ধ হাসিবুর গায়েনের একচিলতে ঘর। ঘর তো নয় যেন খণ্ডহর। সেথায় বসত করে কয়জনা। সরকারি সাহায্য নৈব নৈব চ। পরের বাড়ির কাজ করে অন্ধ স্বামীকে, ছেলেকে দু’মুঠো খাওয়ায় মুজিদা বিবি। নুন আনতে পান্তা ফুরোন সংসারে চোখ হারিয়ে বড় বিপদে আছে অন্ধ হাসিবুরের পরিবার। যারা জেনে গেছে তার কুকর্ম তারা আর পাশে থাকে না, এড়িয়ে যায়। সরলরেখায় ডবল লাইন দিয়ে চলে যায় শিয়ালদা-ডায়মন্ড হারবার লোকাল। জীবন থেমে থাকে না। সেও এগিয়ে যায় ঘড়ির কাঁটার সঙ্গে।