২১ অক্টোবর ২০২৫, মঙ্গলবার, ৩ কার্তিক ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

আবু সামা: বন্ধ হোক এই বিদ্বেষ

বিপাশা চক্রবর্তী
  • আপডেট : ২৭ মে ২০২৩, শনিবার
  • / 57

আহমদ হাসান:  আবু সামা নামে এক সদ্য তরুণ উচ্চমাধ্যমিকে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছে। এই খবরটি এখন প্রায় সকলেই জানেন। আবু সামার বাড়ি এবং স্কুল দু’টি উত্তর দিনাজপুরে। গণমাধ্যমের রিপোর্ট বলছে, আবু সামা খুবই দরিদ্র পরিবারের সন্তান।

বাবা, বড় ভাই সকলেই কৃষিকাজে দিনমজুরি করেন। এমনিতেই উত্তর দিনাজপুর দারিদ্র্যপীড়িত একটি জেলা। এখানে সাক্ষরতার হার থেকে শুরু করে স্কুল কলেজের প্রাপ্যতা তুলনামূলকভাবে খুবই কম। সাচার কমিটির রিপোর্টে পশ্চিমবাংলার জেলাগুলিতে সংখ্যালঘুদের যে করুণ অবস্থার কথা তুলে ধরা হয়েছে, উত্তর দিনাজপুর তার একটি সাক্ষাৎ নজির বলা যেতে পারে।

আরও পড়ুন: উচ্চ মাধ্যমিকে যুগ্ম দ্বিতীয় আবু সামা হতে চান রাজনীতিবিদ

তাই যখন উত্তর দিনাজপুরের চাকুলিয়া এলাকার আবু সামা উচ্চমাধ্যমিকে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে, তখন তা সত্যিই বাংলার জন্য অবশ্যই এক খুশির খবর। আর সকলেই খুবও হয়েছেন। তাঁর পরিবার, তাঁর শিক্ষকবৃন্দ এলাকার মানুষ, সব দলের রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরা আবু সামাকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। আবু সামা উচ্চমাধ্যমিকে ভূগোল, দর্শন ও ইংরেজিতে ৯৯ নম্বর, বাংলা ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানে পেয়েছে ৯৮ ও ৯৫ নম্বর। সবমিলিয়ে ৫০০-র মধ্যে আবু সামা ৪৯৫ নম্বর হাসিল করেছে। শতাংশ হিসেবে ৯৯.২। এই কৃতিত্বকে অবশ্যই সাধুবাদ দিতে হবে।

কিন্তু হলে কী হবে, আবু সামার সাফল্যে ঘৃণা-বিদ্বেষে আক্রান্ত বহু লোক ক্ষেপে আগুন। কারণ, আবু সামার জন্ম মুসলিম ঘরে। সে ইসলাম ধর্মাবলম্বী। তাই তাকে অভিনন্দন না জানিয়ে কুৎসিৎভাবে আক্রমণ করা হয়েছে। আর হামলাকারীরা এজন্য বেছে নিয়েছেন এই খবর প্রকাশকারী মিডিয়াকে। সেখানেই তারা তাদের হিংসা, ঘৃণা বিদ্বেষ উগরে দিয়েছেন। এখানে শুধু দুটি গণমাধ্যমের কথা বলা হচ্ছে, একটি হচ্ছে ‘নিউজ ১৮’ ও অন্যটি ‘এই সময়’।

আবু সামার খবরের নিচে এই উগ্রপন্থী ও সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ প্রচারকারীরা নানা ধরনের কমেন্ট লিখেছেন। যেমন সুভাষ কয়াল নামধারী একজনের মন্তব্য, ‘দেখো বাবা বিন লাদেনের মতো নিজের নাম উজ্জ্বল করতে যেও না’। সমর্থন এসেছে আর একজনের কাছ থেকে ‘লাদেনের অনুগামী হোস না’। স্বরূপ পাত্র তাঁর কমেন্টে ঘোষণাই করে দিয়েছেন ‘আইএসআইএস হবে’। পি কু নামে একজন কমেন্ট করেছেন ‘সেই তো কদিন পরে টেরারিস্ট হবে,’ কি হবে ভালো রেজাল্ট করে’। অভিজিৎ বিশ্বাস নামে একজন ভদ্রলোকের বক্তব্য হল ‘আজকের কৃতী আগামীদিনের লস্কর”।

‘এই সময়’এ খবরের নিচে পাঠকের কমেন্টে অনেক বিদ্বেষমূলক কমেন্ট উঠে এসেছে। আবু সামাকে উদ্দেশ্য করে সৌরভ ব্যানার্জি বলেছেন, ‘বোমা বাঁধা শিখতে হবে’। দেবজিৎ মজুমদারের বিস্ময়মাখা প্রশ্ন, ‘সে কি মাদ্রাসা ছেড়ে আবু স্কুলে কি করে’, সুরজিৎ নাগ রাখঢাক না রেখে সাফ বলেছেন, ‘এই মমিন মুসলিমদের বুদ্ধি বিকাশ তো ইসলামি নবী মুহাম্মদের মতোই নিচু লেভেলের হয়ে থাকে’।

এই ধরনের অসংখ্য কমেন্ট। অথচ সাচার রিপোর্টই বলেছে দেশে সংখ্যালঘুদের মাত্র ৪ শতাংশ ছাত্রছাত্রী মাদ্রাসায় পড়ে। বাকিরা পড়ে প্রাথমিক স্কুলে। পশ্চিমবাংলায় হয়তো সেটা ৪ শতাংশের পরিবর্তে ৮ শতাংশ হতে পারে। আর দিনাজপুরের যে স্কুলে আবু সামা পড়েছিল সেটির নাম ‘রামকৃষ্ণপুর প্রমোদ দাশগুপ্ত মেমোরিয়াল স্কুল’। এর শিক্ষকরাও বেশিরভাগই হিন্দু। বোঝাই যায়, এখানকার সংখ্যালঘুরা প্রকৃতপক্ষেই বিভিন্ন ক্ষেত্রে উন্নয়নের তলদেশে পড়ে আছে। আর সেখান থেকে তাদের উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা মোটেই পছন্দ হচ্ছে না বিদ্বেষান্ধ কিছু সাম্প্রদায়িক মানুষের। তারা নিজেরা তো বটেই, অন্যদেরকেও প্রভাবিত করার জন্য লিখিত কমেন্ট করছেন গণমাধ্যমে এবং সোশ্যাল মিডিয়ায়।

তাহলে প্রশ্ন জাগে, আমাদের বাংলাও কি ধীরে ধীরে এই সব সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর কাছে হেরে যাচ্ছে? এরা কি সমাজে আধিপত্য বিস্তারের পথে? নইলে এই ধরনের সাম্প্রদায়িক কমেন্ট করেও এরা কি করে পার পেয়ে যাচ্ছে? বেশ বোঝা যায়, এই মহাজনরা সাইবার সেলের দ্বারা ট্রেনিংপ্রাপ্ত এবং উদ্বুদ্ধ। আমাদের পুলিশ এবং সাইবার পুলিশ এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে কখনোই ময়দানে নামে না। আর যারা এইসব ঘৃণাযুক্ত কমেন্টে ক্ষুব্ধ হন, তারা শুধু হা-হুতাশ করেন। কেউই উদ্যোগী হয়ে এফআইআর করেন না বা করতে ভয় পান।

আর একটি কথা বলা প্রয়োজন, এই কমেন্টগুলির উদাহরণ যেখান থেকে দেওয়া হয়েছে দু’টি বিশিষ্ট গণমাধ্যম। তাদের সম্পাদনাকারীরাও তো এই ধরনের কমেন্ট ব্লক করতে কিংবা বাদ দিতে পারতেন। কিন্তু তাঁরা তা করেননি।

আমরা আশা করব, এই বিদ্বেষের স্রোত পেরিয়ে আবু সামা বা অর্জুন-মুর্মুরা সাফল্যের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছবে। কারণ,  আমাদের দেশে, আমাদের বাংলায় এখনও অসংখ্য ভালো মানুষ রয়েছেন।

 

Copyright © Puber Kalom All rights reserved.| Developed by eTech Builder

আবু সামা: বন্ধ হোক এই বিদ্বেষ

আপডেট : ২৭ মে ২০২৩, শনিবার

আহমদ হাসান:  আবু সামা নামে এক সদ্য তরুণ উচ্চমাধ্যমিকে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছে। এই খবরটি এখন প্রায় সকলেই জানেন। আবু সামার বাড়ি এবং স্কুল দু’টি উত্তর দিনাজপুরে। গণমাধ্যমের রিপোর্ট বলছে, আবু সামা খুবই দরিদ্র পরিবারের সন্তান।

বাবা, বড় ভাই সকলেই কৃষিকাজে দিনমজুরি করেন। এমনিতেই উত্তর দিনাজপুর দারিদ্র্যপীড়িত একটি জেলা। এখানে সাক্ষরতার হার থেকে শুরু করে স্কুল কলেজের প্রাপ্যতা তুলনামূলকভাবে খুবই কম। সাচার কমিটির রিপোর্টে পশ্চিমবাংলার জেলাগুলিতে সংখ্যালঘুদের যে করুণ অবস্থার কথা তুলে ধরা হয়েছে, উত্তর দিনাজপুর তার একটি সাক্ষাৎ নজির বলা যেতে পারে।

আরও পড়ুন: উচ্চ মাধ্যমিকে যুগ্ম দ্বিতীয় আবু সামা হতে চান রাজনীতিবিদ

তাই যখন উত্তর দিনাজপুরের চাকুলিয়া এলাকার আবু সামা উচ্চমাধ্যমিকে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে, তখন তা সত্যিই বাংলার জন্য অবশ্যই এক খুশির খবর। আর সকলেই খুবও হয়েছেন। তাঁর পরিবার, তাঁর শিক্ষকবৃন্দ এলাকার মানুষ, সব দলের রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরা আবু সামাকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। আবু সামা উচ্চমাধ্যমিকে ভূগোল, দর্শন ও ইংরেজিতে ৯৯ নম্বর, বাংলা ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানে পেয়েছে ৯৮ ও ৯৫ নম্বর। সবমিলিয়ে ৫০০-র মধ্যে আবু সামা ৪৯৫ নম্বর হাসিল করেছে। শতাংশ হিসেবে ৯৯.২। এই কৃতিত্বকে অবশ্যই সাধুবাদ দিতে হবে।

কিন্তু হলে কী হবে, আবু সামার সাফল্যে ঘৃণা-বিদ্বেষে আক্রান্ত বহু লোক ক্ষেপে আগুন। কারণ, আবু সামার জন্ম মুসলিম ঘরে। সে ইসলাম ধর্মাবলম্বী। তাই তাকে অভিনন্দন না জানিয়ে কুৎসিৎভাবে আক্রমণ করা হয়েছে। আর হামলাকারীরা এজন্য বেছে নিয়েছেন এই খবর প্রকাশকারী মিডিয়াকে। সেখানেই তারা তাদের হিংসা, ঘৃণা বিদ্বেষ উগরে দিয়েছেন। এখানে শুধু দুটি গণমাধ্যমের কথা বলা হচ্ছে, একটি হচ্ছে ‘নিউজ ১৮’ ও অন্যটি ‘এই সময়’।

আবু সামার খবরের নিচে এই উগ্রপন্থী ও সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ প্রচারকারীরা নানা ধরনের কমেন্ট লিখেছেন। যেমন সুভাষ কয়াল নামধারী একজনের মন্তব্য, ‘দেখো বাবা বিন লাদেনের মতো নিজের নাম উজ্জ্বল করতে যেও না’। সমর্থন এসেছে আর একজনের কাছ থেকে ‘লাদেনের অনুগামী হোস না’। স্বরূপ পাত্র তাঁর কমেন্টে ঘোষণাই করে দিয়েছেন ‘আইএসআইএস হবে’। পি কু নামে একজন কমেন্ট করেছেন ‘সেই তো কদিন পরে টেরারিস্ট হবে,’ কি হবে ভালো রেজাল্ট করে’। অভিজিৎ বিশ্বাস নামে একজন ভদ্রলোকের বক্তব্য হল ‘আজকের কৃতী আগামীদিনের লস্কর”।

‘এই সময়’এ খবরের নিচে পাঠকের কমেন্টে অনেক বিদ্বেষমূলক কমেন্ট উঠে এসেছে। আবু সামাকে উদ্দেশ্য করে সৌরভ ব্যানার্জি বলেছেন, ‘বোমা বাঁধা শিখতে হবে’। দেবজিৎ মজুমদারের বিস্ময়মাখা প্রশ্ন, ‘সে কি মাদ্রাসা ছেড়ে আবু স্কুলে কি করে’, সুরজিৎ নাগ রাখঢাক না রেখে সাফ বলেছেন, ‘এই মমিন মুসলিমদের বুদ্ধি বিকাশ তো ইসলামি নবী মুহাম্মদের মতোই নিচু লেভেলের হয়ে থাকে’।

এই ধরনের অসংখ্য কমেন্ট। অথচ সাচার রিপোর্টই বলেছে দেশে সংখ্যালঘুদের মাত্র ৪ শতাংশ ছাত্রছাত্রী মাদ্রাসায় পড়ে। বাকিরা পড়ে প্রাথমিক স্কুলে। পশ্চিমবাংলায় হয়তো সেটা ৪ শতাংশের পরিবর্তে ৮ শতাংশ হতে পারে। আর দিনাজপুরের যে স্কুলে আবু সামা পড়েছিল সেটির নাম ‘রামকৃষ্ণপুর প্রমোদ দাশগুপ্ত মেমোরিয়াল স্কুল’। এর শিক্ষকরাও বেশিরভাগই হিন্দু। বোঝাই যায়, এখানকার সংখ্যালঘুরা প্রকৃতপক্ষেই বিভিন্ন ক্ষেত্রে উন্নয়নের তলদেশে পড়ে আছে। আর সেখান থেকে তাদের উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা মোটেই পছন্দ হচ্ছে না বিদ্বেষান্ধ কিছু সাম্প্রদায়িক মানুষের। তারা নিজেরা তো বটেই, অন্যদেরকেও প্রভাবিত করার জন্য লিখিত কমেন্ট করছেন গণমাধ্যমে এবং সোশ্যাল মিডিয়ায়।

তাহলে প্রশ্ন জাগে, আমাদের বাংলাও কি ধীরে ধীরে এই সব সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর কাছে হেরে যাচ্ছে? এরা কি সমাজে আধিপত্য বিস্তারের পথে? নইলে এই ধরনের সাম্প্রদায়িক কমেন্ট করেও এরা কি করে পার পেয়ে যাচ্ছে? বেশ বোঝা যায়, এই মহাজনরা সাইবার সেলের দ্বারা ট্রেনিংপ্রাপ্ত এবং উদ্বুদ্ধ। আমাদের পুলিশ এবং সাইবার পুলিশ এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে কখনোই ময়দানে নামে না। আর যারা এইসব ঘৃণাযুক্ত কমেন্টে ক্ষুব্ধ হন, তারা শুধু হা-হুতাশ করেন। কেউই উদ্যোগী হয়ে এফআইআর করেন না বা করতে ভয় পান।

আর একটি কথা বলা প্রয়োজন, এই কমেন্টগুলির উদাহরণ যেখান থেকে দেওয়া হয়েছে দু’টি বিশিষ্ট গণমাধ্যম। তাদের সম্পাদনাকারীরাও তো এই ধরনের কমেন্ট ব্লক করতে কিংবা বাদ দিতে পারতেন। কিন্তু তাঁরা তা করেননি।

আমরা আশা করব, এই বিদ্বেষের স্রোত পেরিয়ে আবু সামা বা অর্জুন-মুর্মুরা সাফল্যের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছবে। কারণ,  আমাদের দেশে, আমাদের বাংলায় এখনও অসংখ্য ভালো মানুষ রয়েছেন।