২১ অক্টোবর ২০২৫, মঙ্গলবার, ৩ কার্তিক ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

দৌলত বেগম থেকে রোশনারা: মুঘল এই নারীরা ছিলেন স্বমহিমায় উজ্জ্বল

ইমামা খাতুন
  • আপডেট : ১৫ নভেম্বর ২০২২, মঙ্গলবার
  • / 282

পুবের কলম ওয়েব ডেস্কঃ মুঘল যুগের সম্রাটরাই যে কেবল পরাক্রমশালী ছিলেন, তা নয়। সেই যুগের  নারীরাও প্রবল বিক্রমের অধিকারী ছিলেন। অনেকেই পিছন থেকে শাসন পরিচালনা করেছিলেন। সম্রাটদের পরামর্শ দিয়েছিলেন। আপন চেতনা ও শিক্ষা দিয়ে বহু মহিলা মুঘল সম্রাটদের অভিভূত করেছিলেন।

দৌলত বেগম থেকে রোশনারা: মুঘল এই নারীরা ছিলেন স্বমহিমায় উজ্জ্বল

আরও পড়ুন: পড়ুয়াদের চাপ কমাতেই বাদ দেওয়া হয়েছে মুঘল ইতিহাস-গুজরাত দাঙ্গা : এনসিইআরটি

ইতিহাস তাঁদের মনে রেখেছে ঠিকই, কিন্তু চর্চায় তাঁরা তেমন একটা উঠে আসেন না। ফলে মুঘল যুগের এই মহিয়সী পরাক্রমশালীদের নাম তেমন প্রচার হয়নি। স্কুল পাঠ্যেও তাদের জায়গা হয়নি। তাঁরা থেকে  গিয়েছেন বিস্মৃতির আড়ালে। ইতিহাস  এমনভাবে বোনা হয়েছে যাতে মনে হবে মঘল যুগে মহিলাদের অন্তরীণ করে রাখাই ছিল দস্তুর। বহু মহিলা তাদের নিজ শিক্ষা, চেতনা ও বুদ্ধিমত্তা দিয়ে সম্রাট ও আমির-উমরাহদের মাঝে উজ্বল জায়গা করে নিয়েছিলেন। এখানে তেমন কয়েকজন নারীর পরিচয় সামনে আনা হল।

আরও পড়ুন: লালকেল্লার মালিকানার দাবি কলকাতার সুলতানা বেগমের, জেনে নিন কে তিনি



দৌলত বেগম থেকে রোশনারা: মুঘল এই নারীরা ছিলেন স্বমহিমায় উজ্জ্বল
দৌলত বেগম

দৌলত বেগম: আসিয়ান দৌলত বেগম ছিলেন মুঘল সম্রাটের প্রতিষ্ঠাতা সম্রাট বাবরের নানী (দিদিমা) । চাগাতাই খানের পূর্ব-পুরুষ ইউনুস খানের প্রথম স্ত্রী ছিলেন দৌলত বেগম।  একইসঙ্গে তিনি ছিলেন মোগলস্তানের রানি। সম্রাট বাবরের মা কুতলুঘ নিগার ছিলেন তাঁর মেয়ে। ১৪৯৪ থেকে ১৫০৫ পর্যন্ত তিনি কার্যত নাতি বাবরের পক্ষেই সরাসরি শাসন পরিচালনা করেছিলেন। তিনি ছিলেন বাবরের উপদেষ্টাও। দৌলত ছিলেন অসীম সাহসী। আত্মনির্ভরশীল। চরম প্রতিকূলতার মধ্যেও তিনি তাঁর সাহস ধরে রাখতে সক্ষম হতেন।  মরুভূমিতে জন্ম নেওয়া দৌলত বেগমের সাহসিকতার তারিফ করেছেন ঐতিহাসিকরা। এমনিতেই নাতিদের প্রতি নানীদের বিশেষ স্নেহ ও দুর্বলতা থেকেই থাকে, এক্ষেত্রে যেন খানিকটা বেশিই ছিল। তিনি বাবরকে কেবল স্নেহ করতেন তাই নয়, তিনি বিশ্বাস করতেন, এই ছেলে একদিন অনেক বড় হবে। বাবরের চারিত্রিক বিকাশে দৌলত বেগমের বিশেষ ভূমিকা ছিল। মাঝে মাঝে তিনি শত্রুদের মাঝে ধরা পড়েছেন। বহু যন্ত্রণা সহ্য করেছেন। তবে প্রতিবারই অক্ষত অবস্থায় শত্রুর চোখে ধুলো দিয়ে পালাতে সমক্ষম হয়েছিলেন।



দৌলত বেগম থেকে রোশনারা: মুঘল এই নারীরা ছিলেন স্বমহিমায় উজ্জ্বল
গুলবদন বেগম

গুলবদন বেগম : তিনি মুঘল ছিলেন সম্রাট বাবরের কন্যা। বিখ্যাত গ্রন্থ ‘হুমায়ুন-নামা’-র  রচয়িতা । সম্রাট আকবর পড়তে বা লিখতে জানতেন না। লিখতে পড়তে না জানা তাঁর জ্ঞান পিপাসাকে আরও বাড়িয়ে তুলেছিল। তিনি ফুপু (পিসি) গুলবদন বেগমকে অত্যন্ত পছন্দ করতেন। পছন্দ করতেন ফুপুর  গল্প বলার বিশেষ দক্ষতাকে। আকবর জানতেন তাঁর বাবা হুমায়ুনের জীবন ও সমসাময়িক ঘটনাকে গুলবদনের মতো এত ভালোভাবে আর কেউ তুলে ধরতে পারবেন না। শব্দ ও ভাষার দক্ষতায় যে  অসাধারণ সৃষ্টি গুলবদন রচনা করেন, তাতেই তিনি ইতিহাসে চিরকাল বেঁচে থাকবেন। মধ্য ভারতে তথ্য-নির্ভর এমন লেখা সত্যিই বিরল।



দৌলত বেগম থেকে রোশনারা: মুঘল এই নারীরা ছিলেন স্বমহিমায় উজ্জ্বল
হামিদা বানু বেগম

হামিদা বানু বেগম : সম্রাট আকবরের মায়ের নাম ছিল হামিদ বানু। স্বামী হুমায়ূনের মতো লেখা পড়ার প্রতি তাঁরও বিশেষ আগ্রহ ছিল। অত্যন্ত সৎ চরিত্র ও মানবিক গুনাবলীর জন্য তাঁকে ‘মরিয়াম মাকানি’ উপাধি দিয়েছিলেন পুত্র আকবর। মা মরিয়ম যেমন নিষ্পাপ ছিলেন, আকবর মনে করতেন তাঁর মাও আসলে তেমনই  মর্যাদাসম্পন্ন।  বিখ্যাত মেবারের রামায়ণ প্রচলিত হওয়ার অনেক আগে হামিদা বানু বেগম তার নিজের অনূদিত রামায়ণ সামনে এনেছিলেন। যা অনূদিত হয়েছিল ফারসি ভাষায়। অবশ্য গোটা রামায়ণ নয় ,হামিদা বানু রামায়ণের কিছু অংশ বেছে নিয়ে তার অনুবাদ করেছিলেন । সেই অনূদিত রামায়ণের অংশ আকবরের সভাসদদের মধ্যে বিতরণ করা হয়েছিল। সম্রাট আকবর ও তাঁর পুত্র সেলিমের মধ্যে যে দূরত্ব তৈরি হয়েছিল, সেই দূরত্বও ঘোচাতে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন হামিদা বানু।

 

 



দৌলত বেগম থেকে রোশনারা: মুঘল এই নারীরা ছিলেন স্বমহিমায় উজ্জ্বল
মাহম আনগা

মাহম আনগা : মুঘল রক্ত ছিলনা মহাম আনগার শরীরে। তিনি মুঘল রানিও ছিলেন না। এমনকি কোনও বড় মুঘল আমির-উমরাহর স্ত্রীও ছিলেন না। তারপরেও ইতিহাসে তিনি অবিস্মরণীয়। ‘আনগা’ শব্দটি তুর্কি, যার অর্থ স্নেহময়ী ধাত্রী। যিনি মায়ের স্নেহ দিয়ে অন্যের সন্তানকে লালন করেন। মাহম  মায়ের স্নেহ দিয়ে বড় করে তুলেছিলেন আকবরকে। ১৫৫৬ সালে সম্রাট হুমায়ুনের মৃত্যুর পর মাত্র ১৩ বছর বয়সে আকবর দিল্লির সিংহাসনের উত্তরাধিকারী হয়েছিলেন। তার কিছু সময় পূর্বে মাহম আনগাকে আকবরের প্রধান ধাত্রী হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। আকবর তাঁর দৈনন্দিন কাজ থেকে একটু অবসর পেলেই মাহম আনগা আকবরকে কবিতা আবৃত্তি করে শোনাতেন। বিভিন্ন সাহিত্য থেকে পাঠ করে শোনাতেন। আকবর একনিষ্ঠ ছাত্র হিসেবে সেসব মনোযোগ দিয়ে শুনতেন। মাহম আনগার মুখে শোনা অনেক কবিতা, গল্প, সংগীত আকবর শিখে নিয়েছিলেন। শিল্প, সাহিত্য, সংগীত প্রভৃতি বিষয়ে সম্রাট আকবের অনুরাগের বিষয়ে তাঁর এই ধাত্রী মায়ের অবদানের কথা অনেক ঐতিহাসিকেই স্বীকার করে থাকেন। আকবর এবং বৈরাম খাঁ’র মধ্যে তৈরি হওয়া দূরত্ব কমিয়ে আনতে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিলেন আনগা। তাঁকে মুগল সাম্রাজ্যের অন্যতম শক্তিশালী মহিলা হিসাবে বিবেচনা করা হয়।



দৌলত বেগম থেকে রোশনারা: মুঘল এই নারীরা ছিলেন স্বমহিমায় উজ্জ্বল
যোধা বাই (মরিয়ম-উজ-জামানি)

যোধা বাই (মরিয়ম-উজ-জামানি) : আকবরের প্রিয় রাজপূত স্ত্রীর নাম ছিল যোধা বাই। পরে তাঁর নাম হয়েছিল মরিয়ম-উজ-জামানি। আকবরের যে কয়েকজন স্ত্রী রাজসভায় অংশ নিতে পারতেন, তাঁর মধ্যে যোধা বাই ছিলেন অন্যতম। বহু অপরাধীকে ক্ষমা করে দেওয়ার জন্য তিনি সম্রাটের কাছে আবেদন জানতেন। তা মঞ্জুরও হ’ত। রাজসভায় তিনি নিজের মতামতও দিতেন। প্রভাব খাটিয়ে তিনি অনেকের অপরাধ মাফ করে দিতেন।



দৌলত বেগম থেকে রোশনারা: মুঘল এই নারীরা ছিলেন স্বমহিমায় উজ্জ্বল
নুরজাহান

নুরজাহান: নূরজাহান ছিলেন মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীরের প্রধান স্ত্রী এবং শেষ স্ত্রী। বিশেষ প্রভাবের জন্য তাঁর বাবা এবং ভাই মুঘল আদালতে বিশেষ পদ অধিকার করেছিলেন। তিনজন মিলে তাঁরা একটি শক্তিশালী লবি বানিয়ে জাহাঙ্গীরের সিদ্ধান্তকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছিলেন। তাঁর প্রভাব এমন বেড়েছিল যে, একসময় তিনি পিছনে থেকে শাসন পরিচালনা করতেন। জাহাঙ্গীর নূরজাহানকে প্রবলভাবে বিশ্বাস করেছিলেন।



দৌলত বেগম থেকে রোশনারা: মুঘল এই নারীরা ছিলেন স্বমহিমায় উজ্জ্বল
মমতাজ মহল

মমতাজ মহল: ১৬২৮  সালে শাহজাহানের সিংহাসন আরোহণ করেন। তিনি স্ত্রী মমতাজকে পাদশাহ বেগম (প্রথম মহিলা), মালেকা-ই-জাহান, মালেকা-উজ-জামানি এবং মালিকা-ই-হিন্দুস্তান উপাধি দিয়ে তাঁর প্রধান সম্রাজ্ঞী হিসাবে মনোনীত করেন। সম্রাজ্ঞী হিসাবে মমতাজের সময়কাল ছিল মাত্র তিন বছর। তাঁর অকাল মৃত্যু হয়। শাহজাহান ব্যক্তিগত এবং শাসন বিষয়ক উভয় ক্ষেত্রেই মুমতাজের সঙ্গে পরামর্শ করতেন।  তিনি সম্রাটের  ঘনিষ্ঠ আস্থাভাজন এবং বিশ্বস্ত উপদেষ্টা হিসাবে কাজ করেছিলেন।



দৌলত বেগম থেকে রোশনারা: মুঘল এই নারীরা ছিলেন স্বমহিমায় উজ্জ্বল
জাহানারা বেগম

জাহানারা বেগম: শাহজাহানের প্রিয় কন্যা ছিলেন জাহানারা বেগম। ফলে জীবনজুড়ে তিনি নানা সুবিধা পেয়েছিলেন। সাম্রাজ্যের অভ্যন্তরীণ প্রশাসনিক ও পররাষ্ট্র-সহ নানা বিষয়ে পরামর্শ দিয়ে পিতাকে সহযোগিতা করতেন তিনি। সেকালেই জাহানারার বার্ষিক আয় ছিল ৩০ লক্ষ ভারতীয় রুপি। আওরঙ্গজেব জাহানারাকে অসংখ্য উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন। যার থেকে বোঝা যায় যে, তিনি কতটা প্রভাবশালী এবং বুদ্ধিমান ছিলেন।



দৌলত বেগম থেকে রোশনারা: মুঘল এই নারীরা ছিলেন স্বমহিমায় উজ্জ্বল
রোশনারা বেগম

রোশনারা: ১৭ শতকে মুঘল আমলের সবচেয়ে প্রভাবশালী নারীদের মধ্যে অন্যতম  ছিলেন রোশনারা বেগম। সম্রাট অসুস্থ হয়ে পড়লে শাহজাহানের তৃতীয় পুত্র ও তাঁর ভাই আরঙ্গজেবকে মুঘল সিংহাসনে বসাতে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন রোশনারা। পাদশাহ বেগম উপাধিতে তাঁকে ভূষিত করা হয়েছিল। তিনি ছিলেন স্বাধীন, দৃঢ়চেতা ও বুদ্ধিমতী মহিলা। শুধু তাই নয় কবি হিসাবেও তাঁর পরিচয় ছিল। তিনি বিয়ে করেননি। যতদিন জীবিত ছিলেন, ততদিন তিনি আত্মমর্যাদার সঙ্গে কাটিয়েছেন।



দৌলত বেগম থেকে রোশনারা: মুঘল এই নারীরা ছিলেন স্বমহিমায় উজ্জ্বল
দিলরাস বানু

দিলরাস বানু বেগম:  আরঙ্গজেবের প্রথম স্ত্রীর নাম ছিল দিলরাস বানু। তাঁর বিশ্রামের জন্য মহারাষ্ট্রের আওরঙ্গবাদে তাজমলের আদলে আওরঙ্গজেব তৈরী করেছিলেন ‘বিবি কা মাকবারা’। মুঘল শাসনে তাঁর বিশেষ ক্ষমতা ছিল। আওরঙ্গজেবের দরবারে অন্যতম মর্যাদা সম্পন্ন মহিলা ছিলেন দিলরাস বানু।



দৌলত বেগম থেকে রোশনারা: মুঘল এই নারীরা ছিলেন স্বমহিমায় উজ্জ্বল

প্রতিবেদক

ইমামা খাতুন

২০২২ সাল থেকে সংবাদ জগতের সঙ্গে যুক্ত। আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাংবাদিকতাতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেছে। ডিজিটাল প্লাটফর্মে রিপোর্টার হিসেবে হাতেখড়ি। ২০২২ সালের শেষান্তে পুবের কলম-এর সঙ্গে যুক্ত হয়। ইমামার ভাষ্যে, The First Law of Journalism: to confirm existing prejudice, rather than contradict it.

Copyright © Puber Kalom All rights reserved.| Developed by eTech Builder

দৌলত বেগম থেকে রোশনারা: মুঘল এই নারীরা ছিলেন স্বমহিমায় উজ্জ্বল

আপডেট : ১৫ নভেম্বর ২০২২, মঙ্গলবার

পুবের কলম ওয়েব ডেস্কঃ মুঘল যুগের সম্রাটরাই যে কেবল পরাক্রমশালী ছিলেন, তা নয়। সেই যুগের  নারীরাও প্রবল বিক্রমের অধিকারী ছিলেন। অনেকেই পিছন থেকে শাসন পরিচালনা করেছিলেন। সম্রাটদের পরামর্শ দিয়েছিলেন। আপন চেতনা ও শিক্ষা দিয়ে বহু মহিলা মুঘল সম্রাটদের অভিভূত করেছিলেন।

দৌলত বেগম থেকে রোশনারা: মুঘল এই নারীরা ছিলেন স্বমহিমায় উজ্জ্বল

আরও পড়ুন: পড়ুয়াদের চাপ কমাতেই বাদ দেওয়া হয়েছে মুঘল ইতিহাস-গুজরাত দাঙ্গা : এনসিইআরটি

ইতিহাস তাঁদের মনে রেখেছে ঠিকই, কিন্তু চর্চায় তাঁরা তেমন একটা উঠে আসেন না। ফলে মুঘল যুগের এই মহিয়সী পরাক্রমশালীদের নাম তেমন প্রচার হয়নি। স্কুল পাঠ্যেও তাদের জায়গা হয়নি। তাঁরা থেকে  গিয়েছেন বিস্মৃতির আড়ালে। ইতিহাস  এমনভাবে বোনা হয়েছে যাতে মনে হবে মঘল যুগে মহিলাদের অন্তরীণ করে রাখাই ছিল দস্তুর। বহু মহিলা তাদের নিজ শিক্ষা, চেতনা ও বুদ্ধিমত্তা দিয়ে সম্রাট ও আমির-উমরাহদের মাঝে উজ্বল জায়গা করে নিয়েছিলেন। এখানে তেমন কয়েকজন নারীর পরিচয় সামনে আনা হল।

আরও পড়ুন: লালকেল্লার মালিকানার দাবি কলকাতার সুলতানা বেগমের, জেনে নিন কে তিনি



দৌলত বেগম থেকে রোশনারা: মুঘল এই নারীরা ছিলেন স্বমহিমায় উজ্জ্বল
দৌলত বেগম

দৌলত বেগম: আসিয়ান দৌলত বেগম ছিলেন মুঘল সম্রাটের প্রতিষ্ঠাতা সম্রাট বাবরের নানী (দিদিমা) । চাগাতাই খানের পূর্ব-পুরুষ ইউনুস খানের প্রথম স্ত্রী ছিলেন দৌলত বেগম।  একইসঙ্গে তিনি ছিলেন মোগলস্তানের রানি। সম্রাট বাবরের মা কুতলুঘ নিগার ছিলেন তাঁর মেয়ে। ১৪৯৪ থেকে ১৫০৫ পর্যন্ত তিনি কার্যত নাতি বাবরের পক্ষেই সরাসরি শাসন পরিচালনা করেছিলেন। তিনি ছিলেন বাবরের উপদেষ্টাও। দৌলত ছিলেন অসীম সাহসী। আত্মনির্ভরশীল। চরম প্রতিকূলতার মধ্যেও তিনি তাঁর সাহস ধরে রাখতে সক্ষম হতেন।  মরুভূমিতে জন্ম নেওয়া দৌলত বেগমের সাহসিকতার তারিফ করেছেন ঐতিহাসিকরা। এমনিতেই নাতিদের প্রতি নানীদের বিশেষ স্নেহ ও দুর্বলতা থেকেই থাকে, এক্ষেত্রে যেন খানিকটা বেশিই ছিল। তিনি বাবরকে কেবল স্নেহ করতেন তাই নয়, তিনি বিশ্বাস করতেন, এই ছেলে একদিন অনেক বড় হবে। বাবরের চারিত্রিক বিকাশে দৌলত বেগমের বিশেষ ভূমিকা ছিল। মাঝে মাঝে তিনি শত্রুদের মাঝে ধরা পড়েছেন। বহু যন্ত্রণা সহ্য করেছেন। তবে প্রতিবারই অক্ষত অবস্থায় শত্রুর চোখে ধুলো দিয়ে পালাতে সমক্ষম হয়েছিলেন।



দৌলত বেগম থেকে রোশনারা: মুঘল এই নারীরা ছিলেন স্বমহিমায় উজ্জ্বল
গুলবদন বেগম

গুলবদন বেগম : তিনি মুঘল ছিলেন সম্রাট বাবরের কন্যা। বিখ্যাত গ্রন্থ ‘হুমায়ুন-নামা’-র  রচয়িতা । সম্রাট আকবর পড়তে বা লিখতে জানতেন না। লিখতে পড়তে না জানা তাঁর জ্ঞান পিপাসাকে আরও বাড়িয়ে তুলেছিল। তিনি ফুপু (পিসি) গুলবদন বেগমকে অত্যন্ত পছন্দ করতেন। পছন্দ করতেন ফুপুর  গল্প বলার বিশেষ দক্ষতাকে। আকবর জানতেন তাঁর বাবা হুমায়ুনের জীবন ও সমসাময়িক ঘটনাকে গুলবদনের মতো এত ভালোভাবে আর কেউ তুলে ধরতে পারবেন না। শব্দ ও ভাষার দক্ষতায় যে  অসাধারণ সৃষ্টি গুলবদন রচনা করেন, তাতেই তিনি ইতিহাসে চিরকাল বেঁচে থাকবেন। মধ্য ভারতে তথ্য-নির্ভর এমন লেখা সত্যিই বিরল।



দৌলত বেগম থেকে রোশনারা: মুঘল এই নারীরা ছিলেন স্বমহিমায় উজ্জ্বল
হামিদা বানু বেগম

হামিদা বানু বেগম : সম্রাট আকবরের মায়ের নাম ছিল হামিদ বানু। স্বামী হুমায়ূনের মতো লেখা পড়ার প্রতি তাঁরও বিশেষ আগ্রহ ছিল। অত্যন্ত সৎ চরিত্র ও মানবিক গুনাবলীর জন্য তাঁকে ‘মরিয়াম মাকানি’ উপাধি দিয়েছিলেন পুত্র আকবর। মা মরিয়ম যেমন নিষ্পাপ ছিলেন, আকবর মনে করতেন তাঁর মাও আসলে তেমনই  মর্যাদাসম্পন্ন।  বিখ্যাত মেবারের রামায়ণ প্রচলিত হওয়ার অনেক আগে হামিদা বানু বেগম তার নিজের অনূদিত রামায়ণ সামনে এনেছিলেন। যা অনূদিত হয়েছিল ফারসি ভাষায়। অবশ্য গোটা রামায়ণ নয় ,হামিদা বানু রামায়ণের কিছু অংশ বেছে নিয়ে তার অনুবাদ করেছিলেন । সেই অনূদিত রামায়ণের অংশ আকবরের সভাসদদের মধ্যে বিতরণ করা হয়েছিল। সম্রাট আকবর ও তাঁর পুত্র সেলিমের মধ্যে যে দূরত্ব তৈরি হয়েছিল, সেই দূরত্বও ঘোচাতে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন হামিদা বানু।

 

 



দৌলত বেগম থেকে রোশনারা: মুঘল এই নারীরা ছিলেন স্বমহিমায় উজ্জ্বল
মাহম আনগা

মাহম আনগা : মুঘল রক্ত ছিলনা মহাম আনগার শরীরে। তিনি মুঘল রানিও ছিলেন না। এমনকি কোনও বড় মুঘল আমির-উমরাহর স্ত্রীও ছিলেন না। তারপরেও ইতিহাসে তিনি অবিস্মরণীয়। ‘আনগা’ শব্দটি তুর্কি, যার অর্থ স্নেহময়ী ধাত্রী। যিনি মায়ের স্নেহ দিয়ে অন্যের সন্তানকে লালন করেন। মাহম  মায়ের স্নেহ দিয়ে বড় করে তুলেছিলেন আকবরকে। ১৫৫৬ সালে সম্রাট হুমায়ুনের মৃত্যুর পর মাত্র ১৩ বছর বয়সে আকবর দিল্লির সিংহাসনের উত্তরাধিকারী হয়েছিলেন। তার কিছু সময় পূর্বে মাহম আনগাকে আকবরের প্রধান ধাত্রী হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। আকবর তাঁর দৈনন্দিন কাজ থেকে একটু অবসর পেলেই মাহম আনগা আকবরকে কবিতা আবৃত্তি করে শোনাতেন। বিভিন্ন সাহিত্য থেকে পাঠ করে শোনাতেন। আকবর একনিষ্ঠ ছাত্র হিসেবে সেসব মনোযোগ দিয়ে শুনতেন। মাহম আনগার মুখে শোনা অনেক কবিতা, গল্প, সংগীত আকবর শিখে নিয়েছিলেন। শিল্প, সাহিত্য, সংগীত প্রভৃতি বিষয়ে সম্রাট আকবের অনুরাগের বিষয়ে তাঁর এই ধাত্রী মায়ের অবদানের কথা অনেক ঐতিহাসিকেই স্বীকার করে থাকেন। আকবর এবং বৈরাম খাঁ’র মধ্যে তৈরি হওয়া দূরত্ব কমিয়ে আনতে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিলেন আনগা। তাঁকে মুগল সাম্রাজ্যের অন্যতম শক্তিশালী মহিলা হিসাবে বিবেচনা করা হয়।



দৌলত বেগম থেকে রোশনারা: মুঘল এই নারীরা ছিলেন স্বমহিমায় উজ্জ্বল
যোধা বাই (মরিয়ম-উজ-জামানি)

যোধা বাই (মরিয়ম-উজ-জামানি) : আকবরের প্রিয় রাজপূত স্ত্রীর নাম ছিল যোধা বাই। পরে তাঁর নাম হয়েছিল মরিয়ম-উজ-জামানি। আকবরের যে কয়েকজন স্ত্রী রাজসভায় অংশ নিতে পারতেন, তাঁর মধ্যে যোধা বাই ছিলেন অন্যতম। বহু অপরাধীকে ক্ষমা করে দেওয়ার জন্য তিনি সম্রাটের কাছে আবেদন জানতেন। তা মঞ্জুরও হ’ত। রাজসভায় তিনি নিজের মতামতও দিতেন। প্রভাব খাটিয়ে তিনি অনেকের অপরাধ মাফ করে দিতেন।



দৌলত বেগম থেকে রোশনারা: মুঘল এই নারীরা ছিলেন স্বমহিমায় উজ্জ্বল
নুরজাহান

নুরজাহান: নূরজাহান ছিলেন মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীরের প্রধান স্ত্রী এবং শেষ স্ত্রী। বিশেষ প্রভাবের জন্য তাঁর বাবা এবং ভাই মুঘল আদালতে বিশেষ পদ অধিকার করেছিলেন। তিনজন মিলে তাঁরা একটি শক্তিশালী লবি বানিয়ে জাহাঙ্গীরের সিদ্ধান্তকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছিলেন। তাঁর প্রভাব এমন বেড়েছিল যে, একসময় তিনি পিছনে থেকে শাসন পরিচালনা করতেন। জাহাঙ্গীর নূরজাহানকে প্রবলভাবে বিশ্বাস করেছিলেন।



দৌলত বেগম থেকে রোশনারা: মুঘল এই নারীরা ছিলেন স্বমহিমায় উজ্জ্বল
মমতাজ মহল

মমতাজ মহল: ১৬২৮  সালে শাহজাহানের সিংহাসন আরোহণ করেন। তিনি স্ত্রী মমতাজকে পাদশাহ বেগম (প্রথম মহিলা), মালেকা-ই-জাহান, মালেকা-উজ-জামানি এবং মালিকা-ই-হিন্দুস্তান উপাধি দিয়ে তাঁর প্রধান সম্রাজ্ঞী হিসাবে মনোনীত করেন। সম্রাজ্ঞী হিসাবে মমতাজের সময়কাল ছিল মাত্র তিন বছর। তাঁর অকাল মৃত্যু হয়। শাহজাহান ব্যক্তিগত এবং শাসন বিষয়ক উভয় ক্ষেত্রেই মুমতাজের সঙ্গে পরামর্শ করতেন।  তিনি সম্রাটের  ঘনিষ্ঠ আস্থাভাজন এবং বিশ্বস্ত উপদেষ্টা হিসাবে কাজ করেছিলেন।



দৌলত বেগম থেকে রোশনারা: মুঘল এই নারীরা ছিলেন স্বমহিমায় উজ্জ্বল
জাহানারা বেগম

জাহানারা বেগম: শাহজাহানের প্রিয় কন্যা ছিলেন জাহানারা বেগম। ফলে জীবনজুড়ে তিনি নানা সুবিধা পেয়েছিলেন। সাম্রাজ্যের অভ্যন্তরীণ প্রশাসনিক ও পররাষ্ট্র-সহ নানা বিষয়ে পরামর্শ দিয়ে পিতাকে সহযোগিতা করতেন তিনি। সেকালেই জাহানারার বার্ষিক আয় ছিল ৩০ লক্ষ ভারতীয় রুপি। আওরঙ্গজেব জাহানারাকে অসংখ্য উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন। যার থেকে বোঝা যায় যে, তিনি কতটা প্রভাবশালী এবং বুদ্ধিমান ছিলেন।



দৌলত বেগম থেকে রোশনারা: মুঘল এই নারীরা ছিলেন স্বমহিমায় উজ্জ্বল
রোশনারা বেগম

রোশনারা: ১৭ শতকে মুঘল আমলের সবচেয়ে প্রভাবশালী নারীদের মধ্যে অন্যতম  ছিলেন রোশনারা বেগম। সম্রাট অসুস্থ হয়ে পড়লে শাহজাহানের তৃতীয় পুত্র ও তাঁর ভাই আরঙ্গজেবকে মুঘল সিংহাসনে বসাতে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন রোশনারা। পাদশাহ বেগম উপাধিতে তাঁকে ভূষিত করা হয়েছিল। তিনি ছিলেন স্বাধীন, দৃঢ়চেতা ও বুদ্ধিমতী মহিলা। শুধু তাই নয় কবি হিসাবেও তাঁর পরিচয় ছিল। তিনি বিয়ে করেননি। যতদিন জীবিত ছিলেন, ততদিন তিনি আত্মমর্যাদার সঙ্গে কাটিয়েছেন।



দৌলত বেগম থেকে রোশনারা: মুঘল এই নারীরা ছিলেন স্বমহিমায় উজ্জ্বল
দিলরাস বানু

দিলরাস বানু বেগম:  আরঙ্গজেবের প্রথম স্ত্রীর নাম ছিল দিলরাস বানু। তাঁর বিশ্রামের জন্য মহারাষ্ট্রের আওরঙ্গবাদে তাজমলের আদলে আওরঙ্গজেব তৈরী করেছিলেন ‘বিবি কা মাকবারা’। মুঘল শাসনে তাঁর বিশেষ ক্ষমতা ছিল। আওরঙ্গজেবের দরবারে অন্যতম মর্যাদা সম্পন্ন মহিলা ছিলেন দিলরাস বানু।



দৌলত বেগম থেকে রোশনারা: মুঘল এই নারীরা ছিলেন স্বমহিমায় উজ্জ্বল