০১ জুলাই ২০২৫, মঙ্গলবার, ১৬ আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

HC নির্দেশ: বাঘের কামড়ে মৃত দুই পরিবারের হাতে ৫ লক্ষ টাকার ক্ষতিপূরন তুলে দিল বন দফতর

কিবরিয়া আনসারি
  • আপডেট : ৩ জুন ২০২৪, সোমবার
  • / 182

উজ্জ্বল বন্দ্যোপাধ্যায়, কুলতলি: কলকাতা হাইকোর্টের নির্দেশে সুন্দরবনে বাঘের কামড়ে মৃত দুই পরিবারের হাতে ক্ষতিপূরণ তুলে দিল রাজ্য সরকার। সোমবার মৃতদের পরিবারের হাতে ৫ লক্ষ টাকার ক্ষতিপূরণ তুলে দিল বন দফতর। জানা গিয়েছে, সুন্দরবনের মৎস্যজীবীদের ক্ষোভকে বাড়তে না দিয়ে বাঘের আক্রমনে নিহত মৎস্যজীবী অমল দন্ডপাটের বিধবা পত্নী তপতী দন্ডপাট ও বাঘের আক্রমণে নিহত আরেক মৎস্যজীবী দিলীপ সর্দারের বিধবা পত্নী শেফালি সর্দারের হাতে সোমবার ক্যানিং বনদপ্তরের অফিস থেকে ৫ লক্ষ টাকার চেক তুলে দেওয়া হয়। এর আগে আদালত আদেশ দেওয়ার কয়েক দিনের মধ্যেই ক্ষতিপূরণের চেক তুলে দিয়েছিলো বন দপ্তর। এবার দেরি করায় মৎস্যজীবীদের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার হয়।আর এই সব মৎস্যজীবি মানুষের পাশে থেকে তাদের প্রাপ্য অধিকারের লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে এপিডিআর নামে একটা মানবাধিকার সংগঠন।

 

আরও পড়ুন: পর্যটকদের জন্য উন্মুক্ত সুন্দরবন, জানাল বনদফতর

উল্লেখ্য, গত ৭ মে কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি সব্যসাচী ভট্টাচার্যের এজলাসে সুন্দরবনে বাঘের আক্রমণে নিহত দুজন মৎসজীবীর বিধবা (বাঘ বিধবা) স্ত্রীদের সরকারি ক্ষতিপূরণের দাবীতে মামলার শুনানি হয়। দুটি মামলাতেই বিচারপতি রাজ্য সরকারকে নির্দেশ দিয়েছিলেন, চার সপ্তাহের মধ্যে আবেদনকারী দের পাঁচ লক্ষ টাকা করে ক্ষতি পূরণ নি:শর্তে মিটিয়ে দিতে হবে। আবেদনকারীদের তরফে আইন জীবী ছিলেন কৌশিক গুপ্ত এবং শ্রীময়ী মুখার্জি। প্রথম আবেদন কারীর নাম শেফালী সর্দার। সুন্দরবনের কুলতলির কাটামারি এলাকার বাসিন্দা। তিনি আদালতে আবেদন করে জানান, তাঁর স্বামী দিলীপ সরদার সুন্দরবনের জঙ্গলে মাছ ও কাঁকড়া ধরতে গিয়ে ২০২২ সালের ১২ই নভেম্বর বাঘের আক্রমণে মারা গেছেন।তিনি সুন্দরবনের নদীতে মাছ ও কাঁকড়া ধরার জন্য বনদপ্তরের বৈধ অনুমতি পত্র (বিএলসি) নিয়ে মাছ ধরতে গিয়েছিলেন। সেখানে তিনি বাঘের আক্রমণে নিহত হন। কিন্তু প্রায় দু বছর ধরে বনদপ্তর সহ সমস্ত সরকারি দপ্তরে আবেদন নিবেদন করেও তিনি কিছুতেই কোনো রকম ক্ষতিপূরণ পাননি। তাই আদালতের দ্বারস্থ হয়েছেন।

আরও পড়ুন: সুন্দরবনে লোকালয়ে বার বার বাঘের ‘অনুপ্রবেশ’, চিন্তিত বন দফতর

 

আরও পড়ুন: বক্সা বনে ১০৪টি চিতল হরিণ ছাড়লো বন বিভাগ

আদালতে রাজ্য সরকারের আইনজীবী পোস্টমর্টেম রিপোর্ট দেখিয়ে বলেন যে পোস্টমর্টেম রিপোর্টে বলা আছে যে মাথায় আঘাত পেয়ে দিলীপ সরদার মারা গেছে। কাজেই বাঘের আক্রমণেই মারা গেছে এটা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। তাঁর এই বক্তব্যের উত্তরে বিচারপতি পোস্টমর্টেম রিপোর্টের পুরোটা পড়ে শোনান এবং পুলিশ রিপোর্ট পড়ে শোনান। পুলিশ রিপোর্টে পরিষ্কার বলা আছে, বাঘের আক্রমণে ওই ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে এবং পুলিশই মৃতদেহ উদ্ধার করে এনে হাসপাতালে ভর্তি করেছিলো। পোস্টমর্টেম রিপোর্টের অন্য অংশে এটাও পরিষ্কার করে দেওয়া আছে যে বাঘের আক্রমণে দিলীপ সরদারের মৃত্যু হয়েছে।কাজেই সরকারের ঘোষিত নীতি অনুযায়ী অবশ্যই পাঁচ লক্ষ টাকার ক্ষতি পূরণ দিলীপ সরদারের বিধবা স্ত্রীর প্রাপ্য। কাজেই আবেদনকারীকে আগামী চার সপ্তাহের মধ্যে প্রাপ্য ক্ষতিপূরণ ৫ লক্ষ টাকা অবশ্যই মিটিয়ে দিতে হবে। দ্বিতীয় মামলায় আবেদনকারী ছিলেন সুন্দরবনের কুলতলি ব্লকের মৈপীঠের বাঘ বিধবা তপতী দণ্ডপাট। তিনি আদালতে আবেদন করে জানান যে তাঁর স্বামী অমল দণ্ডপাট রাজ্য বনদপ্তরের অনুমতিপত্র (বিএলসি) নিয়ে মাছ ও কাঁকড়া ধরতে গিয়েছিলেন সুন্দরবনের নদীতে। কিন্তু ৩০ শে ডিসেম্বর ২০২১ তাদের নৌকাতে বাঘ হামলা চালায়। অন্যরা পালিয়ে গেলেও অমলবাবু বাঘের আক্রমণে গুরুতর আহত হন। তারপরে ২০২২ সালের পয়লা জানুয়ারি তিনি মারা যান। এই মামলার ক্ষেত্রে সরকারি উকিলের বক্তব্য ছিল যে অমল দণ্ডপাট সরকারি নিষেধাজ্ঞা অগ্রাহ্য করে নিষিদ্ধ ‘কোর’ এলাকায় ঢুকেছিল। কাজেই তাকে ক্ষতিপূরণ দেওয়া উচিত নয়।

 

এই পরিপ্রেক্ষিতে আবেদনকারীর আইনজীবী কৌশিক গুপ্ত আদালতকে স্মরণ করিয়ে দেন, এই আদালতের আদেশ আছে যে কোর এলাকা বা সাধারণ এলাকা যেখানেই বাঘের আক্রমণে কেউ মারা যাবে তারই সরকারি ক্ষতিপূরণ প্রাপ্য হবে। কাজেই তিনি ‘কোর’ এলাকায় ঢুকে ছিলেন কিনা বা ‘কোর’ এলাকায় মারা গেছিলেন কিনা বা তাঁর জঙ্গলের যাওয়া অনুমতি ছিল কি ছিল না – এটা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার জন্য এটা দেখার কোন ব্যাপার নেই। অমল দণ্ডপাট বাঘের আক্রমণেই মারা গিয়েছিল পোস্টমর্টেম রিপোর্ট এবং অন্য সমস্ত কাগজপত্র থেকে এটা পরিষ্কার। কাজেই ক্ষতিপূরণ তাঁর বিধবা স্ত্রী তপতীদেবীর অবশ্যই প্রাপ্য।

 

কৌশিক বাবুর এই সওয়াল মেনে বিচারপতি সব্যসাচী ভট্টাচার্য বলেন, সুন্দরবনের প্রান্তিক এলাকার দরিদ্র মানুষ জীবিকার প্রয়োজনে জঙ্গলে গিয়েছিল, মাছ ধরতে গিয়েছিল এটা পরিষ্কার। এবং এক্ষেত্রে সে অনুমতি নিয়েই গিয়েছিল। কাজেই সরকারি নিয়ম অনুযায়ী অবশ্যই তাঁর ক্ষতিপূরণ প্রাপ্য। বিচারপতি সব্যসাচীভট্টাচার্য তাঁর আদেশে বলেন,অমল দণ্ড পাটের বিধবা স্ত্রী তপতী দণ্ডপাটের সরকারি নিয়ম মত ক্ষতিপূরণ অবশ্যই প্রাপ্য এবং সরকারকে আগামী চার সপ্তাহের মধ্যে ঘোষিত পাঁচ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ অবশ্যই মিটিয়ে দিতে হবে।প্রসঙ্গত মানবাধিকার সংগঠন এপিডিআর এর দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা কমিটির উদ্যোগে এই মামলাগুলো পরিচালিত হয়। সুন্দরবনের প্রত্যন্ত এলাকা থেকে বাঘে আক্রান্ত পরিবার গুলোকে খুঁজে এনে আদালতের দরজায় পৌঁছে দেওয়ার অসাধারণ ও কষ্টকর কাজটি দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলা কমিটির সদস্যরা লাগাতার করে চলেছেন। এই এপিডিআর এর উদ্যোগেই গতবছর প্রথম কলকাতা হাইকোর্টে ক্ষতিপূরণের মামলা হয়েছিল এবং এই সব্যসাচী ভট্টাচার্যের এজলাসেই ৫ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণের আদেশ দেওয়া হয়েছিল এবং সেই আদেশে সব্যসাচী ভট্টাচার্য পরিষ্কার করে জানিয়ে দিয়েছিলেন কোর এলাকা হোক বা সাধারণ এলাকা হোক, বাঘের আক্রমণে মৃত্যু হলে ক্ষতি পূরণ দিতেই হবে। যদি জীবিকার প্রয়োজনে আইন ভেঙেও কোন মানুষ বনে ঢুকে থাকে বা নদীতে মাছ বা কাঁকড়া ধরতে গিয়ে থাকে এবং বাঘের আক্রমনে মারা যায় তাহলেও রাজ্য সরকারকে তাঁর মৃত্যুর জন্য ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। এক্ষেত্রে দ্বিধাদ্বন্দ্বের কোন অবকাশ নেই। তাঁর সেই আদেশ উদাহরণ হিসেবে সামনে এনেই এবারের এই মামলা দুটি পেশ হয়। এপিডিআর এর তরফে প্রথম মামলাটিও করেছিলেন আইন জীবী কৌশিক গুপ্ত এবং আইন জীবী শ্রীময়ী মুখার্জী।

 

এব্যাপারে এপিডিআরের দ:২৪ পরগনা জেলার সহ সম্পাদক মিঠুন মন্ডল বলেন, এখন ও বহু বাঘ-বিধবা বাকি আছেন যারা কোনো রকম ক্ষতিপূরণ পায়নি। মৃতদেহ খুঁজে পাওয়া যায়নি বলে এমনকি সরকারি বিধবা ভাতাটুকু ও পায় না তাঁরা।কাজেই সুন্দরবনের মানুষের মানবাধিকার রক্ষার জন্য এপিডিআর এর এই লড়াই চলবে। আদালতের লড়াই ও রাস্তায় আন্দোলন পাশাপাশি এগিয়ে নিয়ে যাবে এপিডিআর। আমরা চাই বাঘের আক্রমনে মৃত ও আহতের সংখ্যা কমানোর জন্য বন দপ্তর দ্রুত উদ্যোগ নিক। সরকার উদ্যোক নিক সুন্দরবনের মানুষের বিকল্প কাজের। নাহলে সুন্দরবনের মানুষের এই অধিকার ফেরানোর লড়াই তাঁরা চালিয়ে যাবে আগামীদিনেও।

প্রতিবেদক

কিবরিয়া আনসারি

Kibria obtained a master's degree in journalism from Aliah University. He has been in journalism since 2018, gaining work experience in multiple organizations. Focused and sincere about his work, Kibria is currently employed at the desk of Purber Kalom.

Copyright © Puber Kalom All rights reserved.| Developed by eTech Builder

HC নির্দেশ: বাঘের কামড়ে মৃত দুই পরিবারের হাতে ৫ লক্ষ টাকার ক্ষতিপূরন তুলে দিল বন দফতর

আপডেট : ৩ জুন ২০২৪, সোমবার

উজ্জ্বল বন্দ্যোপাধ্যায়, কুলতলি: কলকাতা হাইকোর্টের নির্দেশে সুন্দরবনে বাঘের কামড়ে মৃত দুই পরিবারের হাতে ক্ষতিপূরণ তুলে দিল রাজ্য সরকার। সোমবার মৃতদের পরিবারের হাতে ৫ লক্ষ টাকার ক্ষতিপূরণ তুলে দিল বন দফতর। জানা গিয়েছে, সুন্দরবনের মৎস্যজীবীদের ক্ষোভকে বাড়তে না দিয়ে বাঘের আক্রমনে নিহত মৎস্যজীবী অমল দন্ডপাটের বিধবা পত্নী তপতী দন্ডপাট ও বাঘের আক্রমণে নিহত আরেক মৎস্যজীবী দিলীপ সর্দারের বিধবা পত্নী শেফালি সর্দারের হাতে সোমবার ক্যানিং বনদপ্তরের অফিস থেকে ৫ লক্ষ টাকার চেক তুলে দেওয়া হয়। এর আগে আদালত আদেশ দেওয়ার কয়েক দিনের মধ্যেই ক্ষতিপূরণের চেক তুলে দিয়েছিলো বন দপ্তর। এবার দেরি করায় মৎস্যজীবীদের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার হয়।আর এই সব মৎস্যজীবি মানুষের পাশে থেকে তাদের প্রাপ্য অধিকারের লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে এপিডিআর নামে একটা মানবাধিকার সংগঠন।

 

আরও পড়ুন: পর্যটকদের জন্য উন্মুক্ত সুন্দরবন, জানাল বনদফতর

উল্লেখ্য, গত ৭ মে কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি সব্যসাচী ভট্টাচার্যের এজলাসে সুন্দরবনে বাঘের আক্রমণে নিহত দুজন মৎসজীবীর বিধবা (বাঘ বিধবা) স্ত্রীদের সরকারি ক্ষতিপূরণের দাবীতে মামলার শুনানি হয়। দুটি মামলাতেই বিচারপতি রাজ্য সরকারকে নির্দেশ দিয়েছিলেন, চার সপ্তাহের মধ্যে আবেদনকারী দের পাঁচ লক্ষ টাকা করে ক্ষতি পূরণ নি:শর্তে মিটিয়ে দিতে হবে। আবেদনকারীদের তরফে আইন জীবী ছিলেন কৌশিক গুপ্ত এবং শ্রীময়ী মুখার্জি। প্রথম আবেদন কারীর নাম শেফালী সর্দার। সুন্দরবনের কুলতলির কাটামারি এলাকার বাসিন্দা। তিনি আদালতে আবেদন করে জানান, তাঁর স্বামী দিলীপ সরদার সুন্দরবনের জঙ্গলে মাছ ও কাঁকড়া ধরতে গিয়ে ২০২২ সালের ১২ই নভেম্বর বাঘের আক্রমণে মারা গেছেন।তিনি সুন্দরবনের নদীতে মাছ ও কাঁকড়া ধরার জন্য বনদপ্তরের বৈধ অনুমতি পত্র (বিএলসি) নিয়ে মাছ ধরতে গিয়েছিলেন। সেখানে তিনি বাঘের আক্রমণে নিহত হন। কিন্তু প্রায় দু বছর ধরে বনদপ্তর সহ সমস্ত সরকারি দপ্তরে আবেদন নিবেদন করেও তিনি কিছুতেই কোনো রকম ক্ষতিপূরণ পাননি। তাই আদালতের দ্বারস্থ হয়েছেন।

আরও পড়ুন: সুন্দরবনে লোকালয়ে বার বার বাঘের ‘অনুপ্রবেশ’, চিন্তিত বন দফতর

 

আরও পড়ুন: বক্সা বনে ১০৪টি চিতল হরিণ ছাড়লো বন বিভাগ

আদালতে রাজ্য সরকারের আইনজীবী পোস্টমর্টেম রিপোর্ট দেখিয়ে বলেন যে পোস্টমর্টেম রিপোর্টে বলা আছে যে মাথায় আঘাত পেয়ে দিলীপ সরদার মারা গেছে। কাজেই বাঘের আক্রমণেই মারা গেছে এটা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। তাঁর এই বক্তব্যের উত্তরে বিচারপতি পোস্টমর্টেম রিপোর্টের পুরোটা পড়ে শোনান এবং পুলিশ রিপোর্ট পড়ে শোনান। পুলিশ রিপোর্টে পরিষ্কার বলা আছে, বাঘের আক্রমণে ওই ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে এবং পুলিশই মৃতদেহ উদ্ধার করে এনে হাসপাতালে ভর্তি করেছিলো। পোস্টমর্টেম রিপোর্টের অন্য অংশে এটাও পরিষ্কার করে দেওয়া আছে যে বাঘের আক্রমণে দিলীপ সরদারের মৃত্যু হয়েছে।কাজেই সরকারের ঘোষিত নীতি অনুযায়ী অবশ্যই পাঁচ লক্ষ টাকার ক্ষতি পূরণ দিলীপ সরদারের বিধবা স্ত্রীর প্রাপ্য। কাজেই আবেদনকারীকে আগামী চার সপ্তাহের মধ্যে প্রাপ্য ক্ষতিপূরণ ৫ লক্ষ টাকা অবশ্যই মিটিয়ে দিতে হবে। দ্বিতীয় মামলায় আবেদনকারী ছিলেন সুন্দরবনের কুলতলি ব্লকের মৈপীঠের বাঘ বিধবা তপতী দণ্ডপাট। তিনি আদালতে আবেদন করে জানান যে তাঁর স্বামী অমল দণ্ডপাট রাজ্য বনদপ্তরের অনুমতিপত্র (বিএলসি) নিয়ে মাছ ও কাঁকড়া ধরতে গিয়েছিলেন সুন্দরবনের নদীতে। কিন্তু ৩০ শে ডিসেম্বর ২০২১ তাদের নৌকাতে বাঘ হামলা চালায়। অন্যরা পালিয়ে গেলেও অমলবাবু বাঘের আক্রমণে গুরুতর আহত হন। তারপরে ২০২২ সালের পয়লা জানুয়ারি তিনি মারা যান। এই মামলার ক্ষেত্রে সরকারি উকিলের বক্তব্য ছিল যে অমল দণ্ডপাট সরকারি নিষেধাজ্ঞা অগ্রাহ্য করে নিষিদ্ধ ‘কোর’ এলাকায় ঢুকেছিল। কাজেই তাকে ক্ষতিপূরণ দেওয়া উচিত নয়।

 

এই পরিপ্রেক্ষিতে আবেদনকারীর আইনজীবী কৌশিক গুপ্ত আদালতকে স্মরণ করিয়ে দেন, এই আদালতের আদেশ আছে যে কোর এলাকা বা সাধারণ এলাকা যেখানেই বাঘের আক্রমণে কেউ মারা যাবে তারই সরকারি ক্ষতিপূরণ প্রাপ্য হবে। কাজেই তিনি ‘কোর’ এলাকায় ঢুকে ছিলেন কিনা বা ‘কোর’ এলাকায় মারা গেছিলেন কিনা বা তাঁর জঙ্গলের যাওয়া অনুমতি ছিল কি ছিল না – এটা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার জন্য এটা দেখার কোন ব্যাপার নেই। অমল দণ্ডপাট বাঘের আক্রমণেই মারা গিয়েছিল পোস্টমর্টেম রিপোর্ট এবং অন্য সমস্ত কাগজপত্র থেকে এটা পরিষ্কার। কাজেই ক্ষতিপূরণ তাঁর বিধবা স্ত্রী তপতীদেবীর অবশ্যই প্রাপ্য।

 

কৌশিক বাবুর এই সওয়াল মেনে বিচারপতি সব্যসাচী ভট্টাচার্য বলেন, সুন্দরবনের প্রান্তিক এলাকার দরিদ্র মানুষ জীবিকার প্রয়োজনে জঙ্গলে গিয়েছিল, মাছ ধরতে গিয়েছিল এটা পরিষ্কার। এবং এক্ষেত্রে সে অনুমতি নিয়েই গিয়েছিল। কাজেই সরকারি নিয়ম অনুযায়ী অবশ্যই তাঁর ক্ষতিপূরণ প্রাপ্য। বিচারপতি সব্যসাচীভট্টাচার্য তাঁর আদেশে বলেন,অমল দণ্ড পাটের বিধবা স্ত্রী তপতী দণ্ডপাটের সরকারি নিয়ম মত ক্ষতিপূরণ অবশ্যই প্রাপ্য এবং সরকারকে আগামী চার সপ্তাহের মধ্যে ঘোষিত পাঁচ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ অবশ্যই মিটিয়ে দিতে হবে।প্রসঙ্গত মানবাধিকার সংগঠন এপিডিআর এর দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা কমিটির উদ্যোগে এই মামলাগুলো পরিচালিত হয়। সুন্দরবনের প্রত্যন্ত এলাকা থেকে বাঘে আক্রান্ত পরিবার গুলোকে খুঁজে এনে আদালতের দরজায় পৌঁছে দেওয়ার অসাধারণ ও কষ্টকর কাজটি দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলা কমিটির সদস্যরা লাগাতার করে চলেছেন। এই এপিডিআর এর উদ্যোগেই গতবছর প্রথম কলকাতা হাইকোর্টে ক্ষতিপূরণের মামলা হয়েছিল এবং এই সব্যসাচী ভট্টাচার্যের এজলাসেই ৫ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণের আদেশ দেওয়া হয়েছিল এবং সেই আদেশে সব্যসাচী ভট্টাচার্য পরিষ্কার করে জানিয়ে দিয়েছিলেন কোর এলাকা হোক বা সাধারণ এলাকা হোক, বাঘের আক্রমণে মৃত্যু হলে ক্ষতি পূরণ দিতেই হবে। যদি জীবিকার প্রয়োজনে আইন ভেঙেও কোন মানুষ বনে ঢুকে থাকে বা নদীতে মাছ বা কাঁকড়া ধরতে গিয়ে থাকে এবং বাঘের আক্রমনে মারা যায় তাহলেও রাজ্য সরকারকে তাঁর মৃত্যুর জন্য ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। এক্ষেত্রে দ্বিধাদ্বন্দ্বের কোন অবকাশ নেই। তাঁর সেই আদেশ উদাহরণ হিসেবে সামনে এনেই এবারের এই মামলা দুটি পেশ হয়। এপিডিআর এর তরফে প্রথম মামলাটিও করেছিলেন আইন জীবী কৌশিক গুপ্ত এবং আইন জীবী শ্রীময়ী মুখার্জী।

 

এব্যাপারে এপিডিআরের দ:২৪ পরগনা জেলার সহ সম্পাদক মিঠুন মন্ডল বলেন, এখন ও বহু বাঘ-বিধবা বাকি আছেন যারা কোনো রকম ক্ষতিপূরণ পায়নি। মৃতদেহ খুঁজে পাওয়া যায়নি বলে এমনকি সরকারি বিধবা ভাতাটুকু ও পায় না তাঁরা।কাজেই সুন্দরবনের মানুষের মানবাধিকার রক্ষার জন্য এপিডিআর এর এই লড়াই চলবে। আদালতের লড়াই ও রাস্তায় আন্দোলন পাশাপাশি এগিয়ে নিয়ে যাবে এপিডিআর। আমরা চাই বাঘের আক্রমনে মৃত ও আহতের সংখ্যা কমানোর জন্য বন দপ্তর দ্রুত উদ্যোগ নিক। সরকার উদ্যোক নিক সুন্দরবনের মানুষের বিকল্প কাজের। নাহলে সুন্দরবনের মানুষের এই অধিকার ফেরানোর লড়াই তাঁরা চালিয়ে যাবে আগামীদিনেও।