সমাজের রুপরেখা পরিবর্তনে মুসলিম নেতাদের অবদান অনস্বীকার্য
স্বাধীনতা পর ভারতের ১০ অন্যতম মুসলিম নেতার নাম

- আপডেট : ৩ অগাস্ট ২০২৫, রবিবার
- / 33
পুবের কলম,ওয়েবডেস্ক: ‘ভারতীয় সংস্কৃতিতে মুসলিম অবদানের পরিমাণ নির্ণয় খুব সহজসাধ্য কাজ নহে’। উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা প্রায়শই বলে থাকে ভারত তথা গোটা বিশ্বে জ্ঞান-বিজ্ঞানে বা অন্য কোনও ক্ষেত্রে মুসলিমদের অবদান শূন্য। কারণ মুসলিমরা গোঁড়া। ওরা কুরআন ব্যতীত কিচ্ছুটি জানে না। মুসলিম ব্যতীত বাকি সবাই সমস্ত জ্ঞান-বিজ্ঞানের শিরোমণি।
সংঘের নব-নির্মিত ইতিহাস অনুযায়ী স্বাধীনতার পূর্বাপর ভারতে মুসলিমদের কোন অবদান ছিলনা? তারা এবিষয়ে কিছুই করেনি? তারা এদেশের কেবল খেয়েছে, দেশকে ভালোবাসেনি, দেশকে কিছু দেয়নি? তারা স্বার্থপর, অকৃতজ্ঞ? আর যদিও কিছু মুসলিম ব্যক্তিত্বের নাম শোনা যায় তাও বিকৃত ইতিহাসের চাপে পড়ে ম্লান হওয়ার পথে। তবে আসলেই কি মুসলিমরা এদেশ নির্মাণে শুধু লোকদর্শক হয়েছিল? কারণ আদি ইতিহাস তো বলছে ভিন্ন কথা।
ভারত উপমহাদেশে ৮০০ বছরের ইতিহাসে মুসলিমদের গৌরবদীপ্ত অবদান আছে। শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, লোকাঁচার ও বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর জীবনধারায় মুসলিমদের প্রভাব অস্বীকার করা যায় না। উপমহাদেশের জাতীয় উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির ক্রমবিকাশ ধারায় মুসলিমদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ও দেশমাতৃকার মুক্তি সংগ্রামে তাঁদের নজিরবিহীন বলিদান ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ। যদিও মুসলিম-বিদ্বেষীরা প্রচার করে থাকে মুসলিমরা আগ্রাসী, লুটেরা, হত্যাকারী ইত্যাদি।
কিন্তু এ অভিযোগ যে কাল্পনিক ও সংকীর্ণ মানসিকতা প্রণোদিত। সন্দেহাতীতভাবে স্বাধীনতা সংগ্রামে ভারতে মুসলিমদের অবদান অনস্বীকার্য। তবে স্বাধীনতাপর ভারতেও মুসলিমদের গৌরবদীপ্ত অবদান রয়েছে। স্বাধীন ভারতের মুসলিম নেতাদের কথা বলতে গেলেই প্রথমেই স্মরণে আসে মাওলানা আবুল কালাম আজাদের নাম। ভারতের প্রথম শিক্ষামন্ত্রী হিসেবে আজও ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ তার নাম। ভারত এমন অনেক মুসলিম নেতা দেখেছে যারা জনগণের ঐক্য, সম্প্রীতি রক্ষা, ধর্মনিরপেক্ষ মূল্যবোধ প্রচার এবং সংখ্যালঘুদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। তাঁদের কণ্ঠস্বর হয়েছে। আজকের প্রতিবেদনে এমনই ১০ মুসলিম নেতাদের নিয়ে আলোচনা করা হবে। যাদের অক্লান্ত পরিশ্রম বদলে দিয়েছে তৎকালীন সমাজের রুপচিত্র।
সৈয়দা আনোয়ারা তৈমুর
অসমের প্রথম মহিলা মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন সৈয়দা আনোয়ারা তৈমুর। ১৯৮০ সালের ৬ ডিসেম্বর থেকে ১৯৮১ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত অসমের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন সৈয়দা আনোয়ারা। তিনি তখন অসম প্রদেশ কংগ্রেস কমিটির একজন সক্রিয় সদস্য। ২০১১ সালে কংগ্রেস তাঁকে টিকিট দিতে অস্বীকার করায়, দলের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে বদরুদ্দিন আজমলের নেতৃত্বাধীন AIUDF-তে যোগ দেন। ভারতীয় ইতিহাসে তিনি কোনও রাজ্যের প্রথম মুসলিম মহিলা মুখ্যমন্ত্রী। চার বার ভোটে জিতে (১৯৭২, ১৯৭৮, ১৯৮৩ ও ১৯৯১) একজন বিধায়ক হিসেবে বিধানসভায় গিয়েছেন তৈমুর। এর মধ্যে দু-বার মন্ত্রীও হন। এ ছাড়া ১৯৮৮ ও ২০০৪ সালে রাজ্যসভার সাংসদ মনোনীত হয়েছেন। আনোয়ারা সে সময় রাজ্য সরকারের বেশ কয়েক’টি গুরুত্বপূর্ণ বিভাগের দায়িত্বে ছিলেন। গণপূর্ত বিভাগ, শিক্ষা বিভাগের দায়িত্ব পালন করেন নিষ্ঠা সহকারে। ১৯৮৩ থেকে ১৯৮৫ পর্যন্ত অসমের গণপূর্ত বিভাগের (পিডব্লিউডি) মন্ত্রী ছিলেন। তার আগে ১৯৭২ সালে শরৎচন্দ্র সিংহের মন্ত্রিসভায় রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রীর দায়িত্ব সামলেছেন।চার দশকেরও বেশি সময় ধরে সক্রিয় রাজনীতিতে ছিলেন আনোয়ারা। ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২০ সালে আল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়ে দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করেন তিনি।
ড. আবদুল জলিল ফরিদি
ড. আবদুল জলিল ফরিদি (১৯১৩–১৯৭৪), লখনউয়ের একজন বিখ্যাত হৃদরোগ ও যক্ষ্মা বিশেষজ্ঞ। শুধুমাত্র শহরের শীর্ষস্থানীয় চিকিৎসকই ছিলেন না, বরং একজন উৎসাহী সমাজ সংস্কারক এবং রাজনৈতিক কর্মী ছিলেন। চিকিৎসা জগতে তাঁর অসাধারণ সাফল্য সত্ত্বেও, ড. ফরিদি স্বাধীনতার পর দেশের নিপীড়িত, বিশেষ করে মুসলিম ও পশ্চাদপদ শ্রেণির সেবায় আগ্রহী ছিলেন। যখন তিনি দেখলেন মুসলিমরা রাজনৈতিকভাবে প্রান্তিক হয়ে পড়ছে, তখন তিনি তাদের অধিকারের জন্য রাজনৈতিক আন্দোলনে যুক্ত হন। প্রাথমিকভাবে তিনি মজলিস-ই-মুশারাতের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এবং ১৯৬৮ সালে তিনি মুসলিম মজলিস প্রতিষ্ঠা করেন, যা সংখ্যালঘুদের শিক্ষা, কর্মসংস্থান, সাংস্কৃতিক সুরক্ষা এবং রাজনৈতিক স্বায়ত্তশাসনের জন্য কাজ করে। ১৯৭৪ সালে একটি এক নির্বাচনী প্রচারণার সময় হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি।
ড. ফারুক আবদুল্লাহ
ফারুক আবদুল্লাহ (জন্ম: ২১ অক্টোবর ১৯৩৭) একজন কাশ্মীরি রাজনীতিবিদ এবং জম্মু ও কাশ্মীর জাতীয় সম্মেলনের চেয়ারম্যান। ১৯৮২ সাল থেকে তিনি বেশ কয়েকবার জম্মু ও কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছেন এবং ২০০৯ থেকে ২০১৪ সালে তিনি বিদ্যুৎ এবং জ্বালানি বিষয়ক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি জম্মু ও কাশ্মীরের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লাহর পিতা হিসেবেও অধিক পরিচিত।
গুলাম নবী আজাদ
১৯৪৯ সালের ৭ মার্চ জম্মুর একটি প্রত্যন্ত গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। ১৯৭৩ সালে কংগ্রেসের তৃণমূল নেতা হিসেবে তাঁর রাজনৈতিক যাত্রা শুরু করেন। তবে তাঁর অমানুষিক পরিশ্রমে তিনি শীঘ্রই জম্মু ও কাশ্মীর প্রদেশ যুব কংগ্রেসের সভাপতি এবং পরে ১৯৮০ সালে অল ইন্ডিয়া যুব কংগ্রেসের সভাপতি হন। একই বছর তিনি মহারাষ্ট্রের ওয়াশিম থেকে ৭ম লোকসভায় নির্বাচিত হন এবং ১৯৮২ সালে আইন, বিচার ও কোম্পানি বিষয়ক উপমন্ত্রী হিসেবে নিযুক্ত হন। বছরের পর বছর ধরে তিনি উভয় সংসদে কাজ করেছেন এবং সংসদীয় বিষয়, নাগরিক বিমান চলাচল এবং স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি ২০০৫ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত তৎকালীন জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছিলেন। ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২২ তারিখে, আজাদ ডেমোক্রেটিক প্রগ্রেসিভ আজাদ পার্টি নামে তার নিজস্ব রাজনৈতিক দল ঘোষণা করেন । তিনি ডেমোক্রেটিক প্রগ্রেসিভ আজাদ পার্টির প্রধান পৃষ্ঠপোষক ও প্রতিষ্ঠাতা। তবে সম্প্রতি তাঁর নতুন রাজনৈতিক সংগঠন, ডেমোক্রেটিক প্রোগ্রেসিভ পার্টি বন্ধ করে দিয়েছেন তিনি। তাঁর দশকব্যাপী জনসেবার স্বীকৃতিস্বরূপ সরকার তাঁকে পদ্মভূষণে ভূষিত করেছে।
গনি খান চৌধুরী
আবু বরকত আতাউর গনি খান চৌধুরী। মালদা আর বরকতদা এই নামদুটো যেন একে অপরের পরিপূরক। জাতীয় রাজনীতিতে বাংলার মুখ হিসেবে গানি খান চৌধুরি এক নামেই পরিচিত। আজও নামডাক তার। ৭০ দশকে রাজ্যে কংগ্রেস জামানায় একসময় তিনি বিধায়ক হিসেবে নির্বাচিত হয়ে বিভিন্ন দফতরের মন্ত্রীর দায়িত্ব পেয়েছিলেন। পরবর্তীতে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা ও তারপর রাজীব গান্ধির আমলে মালদা সাংসদ হিসেবে রেলমন্ত্রীর দায়িত্ব পান। রাজনীতিতে গণিখান চৌধুরী যবে থেকে সাংসদ পদে প্রার্থী হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন, তবে থেকেই মালদায় একাধিকবার জয়ী হয়েছেন। গনিখান চৌধুরীকে কোনদিন নির্বাচনে পিছনে ঘুরে তাকাতে হয় নি।
আবদুল গফুর
আব্দুল গফুর (১৯১৮ – ১০ জুলাই ২০০৪) ছিলেন একজন ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামী এবং রাজনীতিবিদ যিনি ২ জুলাই ১৯৭৩ থেকে ১১ এপ্রিল ১৯৭৫ পর্যন্ত বিহারের ১৩ তম মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন এবং রাজীব গান্ধির সরকারে মন্ত্রিপরিষদ মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন । তিনি স্বাধীনতা সংগ্রামে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন এবং জেল খেটেছিলেন। পরে তিনি রাজীব গান্ধী সরকারে মন্ত্রিসভার মন্ত্রী হন। বিহার বিধান পরিষদের প্রাক্তন চেয়ারম্যানও ছিলেন। ২০০৪ সালের ১০ জুলাই পাটনায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি।
জাফর শরীফ
চাল্লাকেরে করিম জাফর শরীফ (৩ নভেম্বর ১৯৩৩ – ২৫ নভেম্বর ২০১৮) একজন ভারতীয় রাজনীতিবিদ ছিলেন। তিনি ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের অন্যতম প্রবীণ নেতা ছিলেন । তিনি ১৯৯১ থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত ভারত সরকারের রেলমন্ত্রী ছিলেন। যখন কেন্দ্রীয় সরকার আর্থিক সংকটের মুখোমুখি হয়েছিল, তিনি রেলওয়ের স্ক্র্যাপ বিক্রি করে ২০০০ কোটি টাকা সংগ্রহ করেন। যা ট্র্যাক আপগ্রেড করতে ব্যবহৃত হয়। ভারতীয় রেলের উন্নয়নের জন্য দেশ তাঁকে এখনও স্মরণ করে।
আসাদুদ্দিন ওয়াইসি
আসাদউদ্দিন ওয়াইসি সর্বভারতীয় মজলিস-ই-ইত্তেহাদুল মুসলিমিনের (এআইএমআইএম) তৃতীয় এবং বর্তমান সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি ভারতীয় সংসদের নিম্নকক্ষ হায়দরাবাদের লোকসভা কেন্দ্রের নির্বাচনী এলাকা থেকে পাঁচবার সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন। বহু বছর ধরে, তিনি দ্য রয়েল ইসলামিক স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ সেন্টার (আরআইএসএসসি) কর্তৃক প্রকাশিত বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী ৫০০ জন মুসলিমদের তালিকায় নিয়মিতভাবে স্থান পেয়ে আসছেন।
নাজমা হেপতুল্লাহ
রাজনীতির প্রারম্ভিক পর্যায়ে নাজমা হেপতুল্লাহ কংগ্রেসের সদস্য ছিলেন । পরে বিজেপিতে যোগ দেন। ১৯৮০, ১৯৮৬, ১৯৯২ এবং ১৯৯৮ সালে মহারাষ্ট্র, মধ্যপ্রদেশ এবং রাজস্থান থেকে কংগ্রেসের রাজ্যসভার সদস্য ছিলেন। তিনি ১৬ বছর ধরে রাজ্যসভার ডেপুটি চেয়ারম্যান ছিলেন। পরে ২০০৪ সালে বিজেপিতে যোগ দেন। পরে তিনি ২০০৭ সালে ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) উপ-সভাপতি হিসেবে মনোনীত হন। তিনি নরেন্দ্র মোদির প্রথম সরকারে মন্ত্রী ছিলেন। ২০১৬ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত তিনি মণিপুরের ১৬তম গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
মোহসিনা কিদওয়াই
মোহসিনা কিদওয়াই, ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস পার্টির একজন বিশিষ্ট নেত্রী। তিনি ইন্দিরা গান্ধি এবং রাজীব গান্ধির প্রধানমন্ত্রিত্বে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন এবং বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। জরুরি অবস্থার পর কংগ্রেস দেশব্যাপী বিপর্যস্ত হয়ে পড়লেও মোহসিনা কিদওয়াই তাঁর নির্বাচনে জয়ী হন।