শেষ হয়ে গেল ইতিহাসের একটি অধ্যায়ের
প্রয়াত হলেন দেশভাগের একমাত্র সাক্ষী রাম কৃষণ সিং

- আপডেট : ৪ জুলাই ২০২৫, শুক্রবার
- / 208
দাঙ্গায় প্রাণ বাঁচিয়েছিলে এক মুসলিম, স্মৃতিতে জ্বলজ্বল করত দাঙ্গায় জীবন বদলে যাওয়ার কথা
পুবের কলম ওয়েবডেস্ক: স্বাধীনতার ৭৭ বছর পরেও দেশভাগের যন্ত্রণা দগদগে ঘা হয়ে রয়ে গেছে ভারতীয়দের মননে এবং জীবনে। কাঁটাতার পেরিয়ে দেশান্তর হওয়ার কষ্ট, দাঙ্গায় তছনছ হয়ে যাওয়া জীবনের স্মৃতি আজও অনেকেই বহন করে নিয়ে চলেছেন। সেই রমক একজন ছিলেন রাম কৃষণ সিং। পাঞ্জাবের পাতিয়ালা জেলার ধনথালের বাসিন্দা। দেশভাগের একমাত্র জীবিত সাক্ষী। গত মঙ্গলবার প্রয়াত হয়েছেন তিনি। বয়স হয়েছিল ১০২ বছর। শুধু তিনি নন, পাতিয়ালা জেলার এই গ্রাম ছিল রক্তক্ষয়ী সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সাক্ষী।
১৯২০ সালে ব্রিটিশ ভারতে জন্মগ্রহণ করেন রাম কৃষণ সিং। গোটা দেশ তখন পরাধীনতার জালে আবদ্ধ। দেশমাতৃকার পায়ের বেড়ি মুক্ত করতে প্রাণ বিসর্জন দিচ্ছেন দেশের বীররা। ১৯৪৭ সাল। দেশ তখন স্বাধীনতার দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে। ব্রিটিশ ভারত ছেড়ে যাবে যাবে করছে। যাওয়ার আগে ভারতবাসীকে দাঁড় করিয়ে দিয়ে যায় দেশভাগের মুখে। রাম কৃষণের বয়স তখন বাইশ বা তার কিছু বেশি। চাক্ষুষ করেন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। নিজের বাবাকে দাঙ্গাকারীদের হাতে নিহত হতে দেখেন। ধনথালে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা আছড়ে পড়ে। তাতেই প্রাণ হারান রাম কৃষণের বাবা জিওনা সিং। ছুতোরের কাজ করতেন তাঁর বাবা। মূলত গরুর গাড়ি তৈরি করতেন তিনি।
রাম কৃষণ একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, “আমার বাবা হিংসার শিকার হয়েছিলেন। দেশভাগের আগে আমাদের গ্রাম ছিল মুসলিম প্রধান অঞ্চল। গুটিকয়েক হিন্দু ও শিখ পরিবারের বাস ছিল। পড়শিদের বাড়ি যাতায়াত ছিল খুবই স্বাভাবিক। বাচ্চারা একে অপরের সঙ্গে খেলা করত। কিন্তু একদিন সকালে সব কিছু বদলে গেল।”
সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা গ্রামে আছড়ে পড়লে রাম কৃষণ ও অন্যান্য পরিবারের সদস্যরা পাশের গ্রাম তুলেওয়াল গিয়ে আশ্রয় নেন। তবে তাঁর বাবা জিওনা সিং বাড়ি পাহাড়া দিতে গ্রামে থেকে যান। জিওনা সিংয়ের বড়দাও ভাইয়ের সঙ্গে গ্রামে থাকেন। গ্রামের মুসলিম পরিবাররা পাকিস্তানে উদ্বাস্ত হয়ে চলে যায়। গ্রামে পাহাড়া দেওয়ার সময় কিছু দুষ্কৃতীর হাতে তাঁর বাবা জিওনা সিং খুন হন।
রাম কৃষণের নাতি হরদীপ সিং গহর বর্তমানে পাঞ্জাব সরকারের অতিরিক্ত জনসংযোগ আধিকারিক। তিনি জানিয়েছেন, নিহাং সিং দাঙ্গার সময় বেঁচে গিয়েছিলেন। তিনি তাঁর ঠাকুরদাকে বলেছিলেন, জিওনা সিংকে একটি তন্দুরের চুল্লিতে ঘুঁটে দিয়ে দাহ করা হয়েছিল। সৎকার করার মতো কোনও ব্যবস্থাই সেই সময় ছিল না।
রাম কৃষণের পরিবারের সদস্যেরা যখন দুষ্কৃতীদের হাতে পড়েছিলেন সেই সময় এক অজ্ঞাত পরিচয় মুসলিম ব্যক্তি তাঁদের বাঁচায়। রাম কৃষণ সেই ব্যক্তির কথা প্রায়শই বলতেন বলে জানিয়েছেন হরদীপ সিং। এমনকি এক বছর আগেও তাঁর দাদু সেই অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তিকে তাঁর জীবন বাঁচানোর জন্য কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন।
দাঙ্গার পরবর্তী সময়ে পাতিয়ালার সেই গ্রাম ধনথলার প্রতিটি পরিবারের জীবন একদম বদলে যায়। দাঙ্গার সময় জিওনা সিংয়ের স্ত্রী সন্তানসম্ভবা ছিলেন। দেশভাগের দু’মাস পর একটি কন্যা সন্তান মহিন্দর কোওরকে জন্ম দেন। তিরিশ বয়স পর্যন্ত রাম কৃষণ অবিবাহিত ছিলেন। এরপর তিনি বাবার পেশাতেই পা গলান। তাঁর ছেলে বলবিন্দর সিংও বাবার পেশাকেই বেছে নিয়েছিলেন। বর্তমানে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে এই কাজ করে চলেছেন তিনি।
রাম কৃষণ সিং ইতিহাসের এক কালো অধ্যায়ের সাক্ষী ছিলেন। যিনি পরবর্তী জীবন দেশভাগ ও দাঙ্গার ক্ষত বুকে নিয়ে নীরবে জীবন কাটিয়ে গেছেন। মৃত্যুর দিন পর্যন্ত সেই কালো দিনগুলি তাঁর স্মৃতিতে জ্বলজ্বল করেছে। সন্তান, নাতি-নাতনি এবং তাঁদের সন্তানদের নিয়ে ছিল তাঁর ভরা সংসার। জীবন্ত বিস্ময় এবং অতীত ও বর্তমানের মেলবন্ধনের একমাত্র সাক্ষী ছিলেন রাম কৃষণ সিং।