মুখ্যমন্ত্রী ঠিকই বলেছেন ‘আলোর দিনে অন্ধকার নেমে এলো’
- আপডেট : ৬ নভেম্বর ২০২১, শনিবার
- / 13
ডা. মানস ভুঁইঞা: সুব্রতদার প্রয়াণে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন ‘আলোর দিনে অন্ধকার নেমে এলো। সত্যিই আলোর অনুষ্ঠানের দিনে আমরা সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের মতো একজন বিজ্ঞ– প্রবীণ রাজনীতিবিদকে হারালাম। ১৯৬৮ সালে সবং -এর বসন্তপুর বাণীভবন স্কুল থেকে আমি উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে জুওলজি নিয়ে ভর্তি হয়েছিলাম। ইচ্ছা ছিল প্রশাসনে যাব বা অধ্যাপনা করব। বাবা স্বর্গীয় পুলিনবিহারী ভুঁইঞা চাইলেন ডাক্তার হতে হবে। তখন তো জয়েন্ট এন্ট্রাস ছিল না, সেসময় মার্কসের ভিত্তিতে ভর্তি হতো। সেইমতো আবেদন করলাম।
আমি আরজিকর মেডিক্যাল কলেজে সুযোগ পেলাম। আমাদের সময় এক বছর প্রি-মেডিক্যাল, পাঁচ বছর এমবিবিএস, এক বছর ইন্টার্ন, এক বছর জুনিয়র হাউস স্টাফ ও ছয় মাস সিনিয়র হাউজ স্টাফ করতে হতো। তারপর পোস্ট গ্রাজুয়েট পড়া যেত। তো একদিন খুব অত্যাচারিত হলাম হিন্দু হোস্টেলে। তখন আমি হোস্টেল থেকে বেরিয়ে সারা রাত্রি কলেজ স্কোয়ারে কাটালাম। সকালবেলা হাঁটতে হাঁটতে মহাজাতি সদন গেলাম। কেননা বাবা আমাকে বলেছিলেন কোনওরকম সমস্যা হলে প্রিয়বাবু, সুব্রতবাবুদের সঙ্গে দেখা করবি। বাবা কংগ্রেসের নেতা ছিলেন। সেই কথা মনে রেখে আমি মহাজাতি সদনে পৌঁছালাম। গিয়ে দেখি সুব্রতদা, প্রিয়দা জনতা স্টোভে জল গরম করছে চা বানাবে বলে। তো আমি গিয়ে সব ঘটনা জানালাম। ওনারা আমাকে আশ্বস্ত করেন।
প্রিয়দা সুব্রতদাকে বললেন, সুব্রত তুই মানসকে নিয়ে নির্মলচন্দ্র স্ট্রিটে প্রতাপদার (তৎকালীন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি) বাড়িতে যা। আমাকে নিয়ে সুব্রত দা মহাজাতি সদন থেকে হাঁটতে হাঁটতে প্রতাপ চন্দ্রর বাড়িতে নিয়ে গেল। ফিরে এলাম, তারপর সুযোগ পেয়ে গেলাম নীলরতন মেডিক্যাল কলেজে এমবিবিএস পড়ার জন্য। ১৯৬৮ সালে প্রিমেডিক্যাল শেষ করে ১৯৬৯ সালে নীলরতনে এলাম এমবিবিএস প্রথম বর্ষে। এসে দেখি নকশালদের, এসএফআই, এআইএসএফের তান্ডব। ছাত্র পরিষদের কোনও ইউনিট ছিল না। আমাদের সমভাবাপন্ন চার-পাঁচ জন বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে আমি আবার সেই মহাজাতি সদনের দিকে হাঁটলাম। প্রদীপ রায়, মনোরঞ্জন কর্মকার, শান্তি মাহাতো, অশোক মাঝি ও আমি। গিয়ে প্রিয়দাকে বললাম আমাদের অবস্থা তো খুব সঙ্গীন। আমাদের কলকাতায় থাকার জায়গা নেই। ডাক্তার কি আমাদের হওয়া হবে না। আপনি আমাদের মন্ত্র দিন, পতাকা দিন। বলেন তোরা পারবি। আমি বললাম চেষ্টা করে দেখব। এমনি মরেই আছি। বললো ঠিক আছি।
১৯৬৯ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর, বিশ্বকর্মা পুজোর দিন প্রিয় দা ও সুব্রত দা গোপনে কলেজে এসে ক্যান্টিনের একটা ঘরে ছাত্র পরিষদের একটা ইউনিট গড়ে দিলেন। আমাকে দায়িত্ব দিলেন কনভেনার হিসাবে। সেই থেকে পথচলা। তারপর ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে রাজনৈতিক মতপার্থক্য হওয়ায় প্রিয়দা নিজেকে গুটিয়ে নিলেও সুব্রতদা ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গেই ছিলেন। তাই সুব্রতদাকে ঘিরে একটা রাজনৈতিক বৃত্ত তৈরি হয়েছিল ছাত্র রাজনীতি, যুব রাজনীতির নেতাদের। আমিও তার একটা অংশ ছিলাম। দীর্ঘদিন সুব্রতদাকে কেন্দ্র করে রাজনীতি করেছি এবং আজকে যারা প্রতিষ্ঠিত নেতা তাঁরা সুব্রত দা, প্রিয়দার সঙ্গে কাজ করেছেন। কেউ কেউ আবার সোমেনদার সঙ্গেও কাজ করেছেন।
তারপর ১৯৭২ সালে সিদ্ধার্থ শংকর রায়ের নেতৃত্বে সরকার তৈরি হলে প্রথমে সুব্রত দা স্বরাস্ট্রমন্ত্রী, পরে পঞ্চায়েত ও নগরোন্নয়ন দফতরের দায়িত্বে ছিলেন। ১৯৮১ সালে সবং -এ যমুনা বালা সাউ নামে একটি মহিলা গণধর্ষিত হয়। তাঁকে মেরে দেওয়া হয়। তাঁর স্বামীকে কোপানো হয়। তাঁদের একটা ছোট্ট বাচ্চাকে ধানক্ষেতে ছুড়ে ফেলে দেয়। এই হাড়হিম করা ঘটনার প্রতিবাদে আমি সবং -এ একটা প্রতিবাদ সভা করেছিলাম। যার প্রধান বক্তা ছিলেন সুব্রতদা। তখন রাস্তাঘাটে কাঁদা। সে সময় সুব্রতদাকে নিয়ে মোটর সাইকেল ও সাইকেলে চেপে সভাস্থলে পৌঁছালাম– প্রচুর মানুষের সমাগম হয়েছিল। তারপর ১৯৮২ সালে আমি বিধায়ক হলাম। দীর্ঘপথ সুব্রতদার সঙ্গে আমি কাজ করেছি। মাঝখানে উনি একটু আমাকে ভুল বুঝেছিলেন। কারণ সোমেনবাবুর সঙ্গে আমাকে কাজ করতে হয়েছিল প্রদেশ কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক হিসাবে। কিন্তু মনেপ্রাণে আমি সুব্রতদার সঙ্গেই ছিলাম।
তারপর ১৯৮৩ সালে বাবা মারা গেলে সেসময় সুব্রত দা ও বৌদি ছন্দবানি মুখার্জী আমার বাড়িতে এসে পাশে ছিলেন। তারপর রাজনীতির নানা ঘাতপ্রতিঘাত আসে। উনি বহু বড় বড় পদে নেতৃত্ব দিয়েছেন। তারপর উনি তৃণমূলে গেলেন, আবার কংগ্রেসে এলেন। আবার তৃণমূলে গেলেন, আমিও ২০১৬ সালে তৃণমূলে এলাম। তারপর জননেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে আমরা কাজ করেছি। সুব্রতবাবু একজন দক্ষ সংগঠক ছিলেন। আগুন ঝরানো, আগুনের স্ফুলিঙ্গ ছিলেন। যেকোনও সময়, যেকোনও জায়গায় যেকোনও ইস্যু তৈরি করতে পারতেন এবং আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে পারতেন। দক্ষ প্রশাসক ছিলেন, মেয়র হয়েছিলেন এবং আমার মনে হয়, তিনি শ্রেষ্ট মেয়র আমার দৃষ্টিতে ছিলেন। পঞ্চায়েত মন্ত্রী হিসাবে তিনি দক্ষতার সঙ্গে কাজ সামলেছেন।
আমাদের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে পঞ্চায়েত দফতর ভাল কাজ করেছে বলে দেশের মধ্যে সেরা পুরস্কার পেয়েছে। এর কৃতিত্ব সুব্রতদারও। ১৯৯৫ সালে আমার মা মারা গেলে সোমেনদার সঙ্গে বৌদি ছন্দবানি মুখার্জী এসেছিলেন। তখন দাদা আসতে পারেন নি। সুব্রতদা একটা বর্ণময় চরিত্র। শুধু দারুণ প্রশাসক নয়– রসিক, হাস্যময় ছিলেন। মানুষকে হাসাতেন। খুব বকাঝকাও দিতেন আমাদের। আবার খুব ভালোওবাসতেন। আমি বৃহস্পতিবার আমার স্ত্রী গীতারাণী ভুঁইঞাকে নিয়ে পিজিতে দেখতে গিয়েছিলাম সুব্রতদার সঙ্গে। দুপুর তিনটার সময় গিয়ে তাঁর সঙ্গে ১ ঘন্টা কথা বলেছি। সেসময় বলছিলেন, মানস তোরা কোথায় থাকিস। আমার স্ত্রী গীতাকেও বললো তোমরা কোথায় থাকছো। আমি বললাম এমএলএ হোস্টেলে। আমাকে বললো কেন, তুই মন্ত্রীর কোয়াটারে যাস নি। আমি বললাম না, আমরা এমএলএ হোস্টেলেই থাকি। আমার কাছে কারণ জানতে চাইলে, আমি বলি না আমার বড় বড় ঘরে থাকতে ভূতের ভয় করে। বললো আমার মতো তোরও ভূতের ভয়! আমি বললাম, হ্যাঁ আমারও ভূতের ভয়।
তারপর তাঁর দীর্ঘ ৪০ বছরের সহকর্মী তাঁকে নিয়ে সিটি স্ক্যান করাতে নিয়ে যাচ্ছিলেন। দেখলাম তিনি হেঁটে গাড়িতে উঠলেন। আমি একটু বাদে এমএলএ হোস্টেলে ফিরে সন্ধ্যায় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ির পুজোয় গিয়েছিলাম। প্রায় ৮ টা ৩০ মিনিট নাগাদ মুখ্যমন্ত্রী তড়িঘড়ি উতালা হয়ে বেরিয়ে গেলেন। কি ব্যাপার, জানতে পারলাম নাকি উনি পিজি গেছেন। সুব্রতদার নাকি আবার হার্ট অ্যাটাক হয়েছে। আবার আমি এমএলএ হোস্টেলে ফিরে আসি। টিভি খুলতে দেরি হওয়ায় সময়মতো খবরটা জানতে পারে নি। পরে ৯ টা ৩০ মিনিটে টিভিতেই দেখি পঞ্চায়েত মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায় প্রয়াত। তখন বুকটা কেঁপে উঠল। বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। তড়িঘটি ওই রাতেই স্ত্রীকে গাড়িতে নিয়ে গেলাম পিজিতে। দুপুর ৩ টার সময় যে মানুষটা কথা বলছিলেন, গিয়ে দেখলাম সুব্রতদার নিথর দেহ শুয়ে আছে। আমার আর বলার মতো ভাষা ছিল না।
শুক্রবার সবংয়ে এসেছিলাম। তাঁর প্রতিকৃতিতে মাল্যদান করে নীরবতা পালন করলাম। কয়েকদিনের মধ্যেই আমরা সবংয়ে একটা ওনার স্মৃতি সভা করব। সবংয়ের মানুষকে উনি নাম ধরে চিনতেন। এখানে উনি কয়েকশো বার এসেছেন। সবংয়ের মানুষের সঙ্গে ওনার আত্মার সম্পর্ক ছিল। আমাকেও উনি মাঝেমাঝে রাগাতেন, ব্যাঙ্গ করতেন। আবার বুকে জড়িয়ে ধরে ভালোবাসতেন। এ এক অদ্ভুত বর্ণময় চরিত্র। একটা মহিরুহের পতন হয়েছে। একটা ভালো মানুষকে আমরা হারালাম।