০৩ নভেম্বর ২০২৫, সোমবার, ১৬ কার্তিক ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

ইরানী এক তরুণীর মৃত্যু ও উত্তাল পশ্চিমা বিশ্ব

অর্পিতা লাহিড়ী
  • আপডেট : ৬ অক্টোবর ২০২২, বৃহস্পতিবার
  • / 64

 

আহমদ হাসান

ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানে খুবই দুঃখজনক ও মর্মন্তুদ একটি ঘটনা ঘটেছে। আর তাহল, একজন ২২ বছরের তরুণী মাহশা আমিনীকে সম্প্রতি ইরানের নৈতিকতা বাস্তবায়ন পুলিশ আটক করে। এই তরুণীকে আটক করার তিনদিন পর ১৬ সেপ্টেম্বর সে মারা যায়।

যে কোনও মৃত্যুই দুঃখের। আর এক্ষেত্রে মাহশা আমিনীর মৃত্যু সকলের হৃদয়কেই ভারাক্রান্ত করেছে। আর প্রবল আপত্তির কারণ হল, মাহশা আমিনীর মৃত্যু হয়েছে পুলিশ হেফাজতে। তার পরিবারের অভিযোগ, মাহশা আমিনীকে পুলিশ মারধর করে, তারই পরিণতিতে এই ঘটনা ঘটেছে।

কিন্তু এই তরুণীর মৃত্যুকে কেন্দ্র করে পশ্চিমা বিশ্ব উত্তাল হয়ে উঠেছে। তারা এই ঘটনাকে ইরানের ইসলামপন্থী শাসক শ্রেণির নৃশংসতা, নারী অধিকার হরণ এবং ‘শরিয়তি আইনের নিষ্ঠুরতা’ বলে প্রচার করে চলেছে।

সকলেই জানেন, ইমাম আয়াতুল্লাহ খোমেইনি ১৯৭৮ সালে ইরানের রাজতন্ত্রী এবং ফ্যাসিবাদী শাসনের অবসানে যে সংগ্রাম ও গণবিপ্লব শুরু করেন, তা আমেরিকা ও ইউরোপের দেশগুলির মোটেই পছন্দ  ছিল না। তাদের সমর্থন ছিল বাদশাহ রেজা শাহ পাহলভির দিকে। শেষ পর্যন্ত তারা চেষ্টা করে, তাদের তাঁবেদার পাহলভিকে মসনদে টিকিয়ে রাখার। কিন্তু আয়াতুল্লাহ খোমেইনির নেতৃত্বে ইসলামী গণবিপ্লবে তাদের পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। ইরানে ক্ষমতাসীন হয় ইসলামপন্থীরা। আর তখন থেকেই ইরান আমেরিকা ও ইউরোপের দেশগুলির জাতশত্রুতে পরিণত হয়। এই সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য তারা বহুবার চেষ্টা করেছে। প্রথম চেষ্টাটি হয় ইরাকের রাষ্ট্রপতি সাদ্দাম হুসেনকে দিয়ে। তাঁকে তারা ইরান আক্রমণ করার জন্য অর্থ ও বিধ্বংসী অস্ত্রশস্ত্র প্রদান করে। ৮ বছর যুদ্ধ চললেও সাদ্দাম হুসেন কিন্তু ইরানকে পরাস্ত করতে পারেনি। তবে ইসরাইলের মোসাদ এবং আমেরিকার সিআইএ, ব্রিটিশ ও ফ্রান্সের এজেন্সিগুলি নানাভাবে ইরানের ইসলামী শাসকদের ক্ষমতাচ্যুত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

ইরানের নেতৃত্ব বলছেন, মাহশা আমিনীর দুর্ভাগ্যজনক ঘটনাকে তাঁরাও নি¨া করেন। আর এবিষয়ে ফরেন্সিকসহ সমস্ত ধরনের তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন তাঁরা। আর ওই অঞ্চলে নৈতিকতা বাস্তবায়ন পুলিশ প্রধানকে তদন্তের স্বার্থে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে।

মাহশা আমিনীর মৃত্যুর ঘটনাটি সম্পর্কে ইরানের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যে বক্তব্য দিচ্ছেন, তা কিন্তু পশ্চিমা প্রচারণা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। তেহরানের পুলিশ প্রধান বলেছেন, মহিলা পুলিশ মাহশা আমিনীকে আটক করেছিল ঠিকই, কিন্তু তাকে কোনওভাবে মারধর কিংবা নির্যাতন করা হয়নি। এই বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তপক্ষ তাদের বক্তব্যের সপক্ষে একটি প্রধান প্রমাণ দিচ্ছেন, তাহল সিসিটিভি ফুটেজ। সিসিটিভিতে দেখা যাচ্ছে, ওই তরুণী হেঁটেই পুলিশ থানায় এসেছেন এবং পরে অন্যান্য মহিলাদের সঙ্গে হিজাব ক্লাসে বসে রয়েছেন। কিছুক্ষণ পরেই তরুণীটি হঠাৎ জ্ঞান হারিয়ে মেঝেতে লুটিয়ে পড়ে। সেইসময় তরুণীটি একজন মহিলা পুলিশ অফিসারের সঙ্গে হিজাব নিয়ে কথা বলছিল। সিসিটিভিতে পুরো ঘটনাটির রেকর্ড রয়েছে। প্রাথমিক তদন্তে এটাও জানা গেছে, ওই তরুণীর হার্টে সমস্যা ছিল। ইরানে ফরেন্সিক বিভাগের পরীক্ষাতে দেখা গেছে, মাহশা আমিনীর শরীরে কোনও আঘাতের চিহ্ন নেই। মাহশা আমিনীর পরিবার অবশ্য দাবি করেছে, আগে তার কোনও অসুস্থতা ছিল না। কিন্তু ইরানি গণমাধ্যমের তদন্তে জানা যায়, ৮ বছর বয়সে মাহশা আমিনীকে ব্রেন টিউমারের জন্য সার্জারি করতে হয়েছিল। এরপর থেকে সে নিউরোলজিস্ট বা স্নায়ুবিশেষজ্ঞদের নিয়মিত চিকিৎসায় ছিল।

ইসলামী প্রজতন্ত্র ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি স্বয়ং ওই তরুণীর মৃত্যুর তদন্তের আদেশ দিয়েছেন। আর সেই অনুযায়ী সার্বিক তদন্তের কাজ চলছে। এছাড়া ইরানের ‘প্রেস টিভি’ জানিয়েছে, মাহশা আমিনীর সিটি স্ক্যানের রিপোর্টে বিশেষজ্ঞরা স্পষ্ট করে বলেছেন, তার মাথায় কিংবা শরীরে ক্ষত বা আঘাতের কোনও চিহ্ন নেই। অথচ ‘বিবিসি’ বলছে, একজন অফিসার মাহশা আমিনীর মাথায় ব্যাটন দিয়ে আঘাত করেন এবং তার মাথা নাকি দেওয়ালে ঠুকে দেয়। কিন্তু সিসিটিভির ফুটেজে এই ধরনের কোনও ঘটনার দৃশ্য নেই। তেহরানের ফরেন্সিক মেডিসিনের ডাইরেক্টর জেনারেল মেহেদি ফারুজেশ বলছেন, ময়নাতদন্তে মাহশা আমিনীর শরীরে কোনও রক্তপাত, মাংসপেশী বা আভ্যন্তরীণ প্রত্যঙ্গে আঘাত এসবের কোনও লক্ষণ পাওয়া যায়নি।

কিন্তু পশ্চিমা মিডিয়া এসব রিপোর্টকে বিন্দুমাত্র  গুরুত্ব না দিয়ে এক তরফা প্রচার করছে। ইসলামী হিজাব সঠিকভাবে না পরার কারণে পুলিশ মাহশা আমিনীর উপর নাকি প্রবল নির্যাতন করে। আর ইসলামী আইনের ঘেরাটোপে এই তরুণী প্রাণ হারায়। বিবিসি, রয়টার, এএফপি, এপি, গার্ডিয়ান, সিএনএন, নিউ ইয়র্ক টাইমস প্রভৃতি পশ্চিমা মিডিয়া সমানে ইরানের ইসলামী শাসনের নিন্দা  করে যাচ্ছে। তাদের আরও প্রচার হচ্ছে, ইরানে ‘রিজিম চেঞ্জ’ বা ইসলামপন্থী শাসকদের উৎখাত করার জন্য প্রবল আন্দোলন শুরু হয়ে গেছে। মেয়েরা হিজাব খুলে ফেলছে,  গণহারে চুল কেটে ফেলছে ইত্যাদি।

একথা সত্যি, ইরানে এই ঘটনা নিয়ে কিছু বিক্ষোভ হয়েছে। ফেসবুক, ট্যুইটার, ইনস্টাগ্রাম এসবের মাধ্যমেও পশ্চিমারা ইরানের মানুষকে ব্যাপক উসকানি দিয়েই চলেছে। এমনিতে ইরানে ইন্টারনেটের উপর আমেরিকার নিয়ন্ত্রণ ছিল। কিন্তু এই ঘটনার কথা সামনে আসতেই আমেরিকা ইরানের ইন্টারনেটের উপর সমস্ত বিধিনিষেধ তুলে দিয়ে তা অবাধ করে দেয়। আর ইন্টারনেট ব্যবহার করে ইরানের শাসক ও ইসলামী মূল্যবোধের বিরুদ্ধে প্রবল প্রচারণা চালানো হয়। লন্ডন ও আমেরিকা ভিত্তিক বেশকিছু প্রবাসী ইরানী পত্রপত্রিকা ও ইউটিউব চ্যানেলে রীতিমতো কুৎসা ও অপপ্রচারের মহাযুদ্ধ শুরু করে দেওয়া হয় বলে ইরানী কর্তৃপক্ষ বলছেন। চেষ্টা চলতে থাকে, মাহশা  আমিনীর জন্য ইরানের বাসিন্দাদের ক্ষেপিয়ে তোলারও। ফলে পশ্চিমা উসকানিতে তেহরানের কয়েকটি জায়গায় বিক্ষোভ, ভাঙচুর ও গুণ্ডামি শুরু হয়। অগ্নিসংযোগ করা হয় সম্পত্তিতে। আক্রমণ করা হয় পুলিশ ও নিরাপত্তাবাহিনীকে। তেহরান ও অন্য কয়েকটি শহরে অ্যাম্বুলেন্সকেও নিশানা করে হামলাকারীরা। কম করে ৬০টি অ্যাম্বুলেন্সের ক্ষতি করা হয়। কয়েকটি এলাকায় মেয়েরাও ইরানের শাসকদের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে।

কিন্তু প্রত্যেক ক্রিয়ারই বোধহয় প্রতিক্রিয়া থাকে। ইরানের ইসলামপন্থী নারীরা পশ্চিমা প্ররোচনার বিরুদ্ধে এবং ইসলামের সমর্থনে বড় বড় মিছিল সমাবেশের আয়োজন করে। তারা বলেন, বিদেশী এজেন্টদের প্ররোচনায় ইরানে অশান্তি সৃষ্টির প্রচেষ্টাকে তারা অবশ্যই রুখবেন। ইরানে পশ্চিমা সমর্থকরা নিরাপত্তাবাহিনীর সদস্যদের আক্রমণ করলে গুলি চলে। তাতে নিরাপত্তাবাহিনীর সদস্যসহ ৮০ জনেরও বেশি নিহত হয়েছে বলে রয়টার্সের দাবি।

তবে ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি কড়া হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, ‘কোনও ধরনের অশান্তি ও বিশৃঙ্খলাকে বরদাশ্ত করা হবে না। আমাদের শত্রুরা জাতীয় ঐক্যকে বিনষ্ট করতে চায় এবং ইরানী জনগণকে একে অপরের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে। প্রতিবাদ নয়, চেষ্টা করা হচ্ছে ব্যাপক দাঙ্গা করার।’ ইরানী কর্তৃপক্ষ আরও বলেছেন, যেহেতু মাহশা আমিনী একজন সম্প্রদায়ভুক্ত ইরানী, তাই ইরাক, তুরস্ক, সিরিয়া প্রভৃতি স্থানে পশ্চিমা সাহায্যপ্রাপ্ত কুর্দিস জাতির সশস্ত্র বিদ্রোহীরা রয়েছে তারাও এই দাঙ্গা, প্ররোচনার আগুনে ঘৃতাহুতি দিচ্ছে। ইরান বলছে, তারা এই ষড়যন্ত্রের সঠিক স্বরূপকে সামনে আনবে।

শেষ পর্ব

ইরান পশ্চিমাদের লক্ষ্য কি অর্জিত হবে!

একথা ঠিক, মাহশা আমিনী নামক তরুণীটির মৃত্যুকে কেন্দ্র করে ইরানের বেশকিছু শহরে বিক্ষোভ হচ্ছে। রাস্তায় নেমেও বিক্ষোভ-দাঙ্গা করছে একদল মানুষ। এরা আগে থেকেই ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের বিক্ষুব্ধ গোষ্ঠী হিসেবে পরিচিত। এদের মধ্যে একটি হচ্ছে, মুজাহিদিন-ই-খাল্ক্ব অর্গানাইজেশন (এমকেও)। এদের একটি বড় ঘাঁটি রয়েছে আলবানিয়ায়। এ ছাড়া আরও বেশকিছু সশস্ত্র গোষ্ঠী রয়েছে, এর মধ্যে রাজতন্ত্রীরাও রয়েছে, যারা শাহ পাহলভি পরিবারকে ইরানে ফিরিয়ে আনতে চায়। রয়েছে কুর্দি বিদ্রোহীরা।

 

 

ইরানী এক তরুণীর মৃত্যু ও উত্তাল পশ্চিমা বিশ্ব

এ কথা এখন সকলেই জানেন, কুর্দিরা ছড়িয়ে রয়েছে ইরান, তুরস্ক, সিরিয়া ও ইরাকে। তারা সশস্ত্র আন্দোলনের  মাধ্যমে কুর্দিস্থান গঠনের জন্য সক্রিয় রয়েছে। ইরান বলছে, ইরানে ও ইউরোপের বিভিন্ন শহরে যে বিক্ষোভ হচ্ছে, তার পিছনে রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটিশ, সউদি আরব। এ ছাড়া জার্মানি, নেদারল্যান্ড ও ফ্রান্সের দিকেও আঙুল তুলেছে ইরানি কর্তৃপক্ষ। এর মধ্যে কিছু দেশের রাষ্ট্রদূতদের ডেকে ইরান তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে উসকানি দেওয়ার জন্য তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে। আর ইরানের বিরুদ্ধে সবথেকে সক্রিয় হচ্ছে, জায়নবাদী রাষ্ট্র ইসরাইল। ইরানের ধ্বংসই হচ্ছে ইসরাইলের লক্ষ্য। কারণ, পশ্চিম এশিয়ায় এই উগ্র ইহুদি রাষ্ট্রের ‘ইরেজ ইসরাইল’ বা বৃহত্তর ইসরাইল গড়ার যে পরিকল্পনা রয়েছে, তার সবথেকে বড় বাধা হল ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান। ইরানের বিরুদ্ধে আমেরিকা ও ইউরোপ যে অবরোধ চালাচ্ছে, তার প্রধান উসকানিদাতা হচ্ছে এই জায়নবাদী রাষ্ট্র। তাদের বক্তব্য, ইরান যদি পরমাণু বোমা তৈরি করে তাহলে বিশ্বের মহাবিপদ। অথচ ইসরাইলের নিজেরই ২০০-র বেশি পরমাণু বোমা এবং নিক্ষেপ করার মিসাইল ও বিমান রয়েছে। ইসরাইলি সন্ত্রাসী গুপ্তচর সংস্থা মোসাদ আগে ইরানে বেশকিছু অর্ন্তঘাত চালিয়েছে। ইরানের বিজ্ঞানীদের হত্যা এবং বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে নাশকতার কাজ করেছে। মাহশা আমিনীকে নিয়ে বিক্ষোভে ইসরাইলের উসকানিও এক প্রধান ফ্যাক্টর বলে ইরানি নেতৃত্ব মনে করছে।

আবার ইরানে বর্তমান সব বিক্ষোভই যে হিজাবকে নিয়ে হচ্ছে, তা নয়। যেমন একটি বড় সশস্ত্র বিক্ষোভ হয়েছে জাহেদান শহরে। যা ইরানি বালুচিস্তান এবং সিস্তান প্রদেশের অন্তর্গত। পাক ও আফগান সীমান্তে অবস্থিত এখনকার বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী বহু আগে থেকেই ইরানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করে যাচ্ছে। এর আগেও তারা বেশ কয়েকবার ইরানি সেনার উপর হামলা চালিয়ে তাদের ক্ষয়ক্ষতি করেছে। শুক্রবার দিন তারা মসজিদের কাছে একটি থানা আক্রমণ করে। এই ঘটনা ইরানের একজন উচ্চপদস্থ সামরিক কর্তা মুহাম্মদ সাইয়েদ আলি মুসাভি নিহত হয়েছেন। নিহত হয়েছেন একজন কর্নেল-সহ নিরাপত্তাবাহিনীর আরও কয়েকজন। তবে হামলাকারী ও দাঙ্গাবাজদের বিরুদ্ধে ইরানি নিরাপত্তাবাহিনী গুলি চালালে বেশ কয়েকজন নিহত হয়েছেন। নিহতের সংখ্যা ১৯ এবং আহতের সংখ্যা ৬০-এর উপর।

তবে এই ঘটনার সঙ্গে হিজাব আন্দোলনের  সম্পর্ক নেই বলে মনে করা হচ্ছে। এটা ছিল সশস্ত্র বিচ্ছিন্নতাবাদীদের হামলা।

এখন প্রশ্ন উঠেছে, ট্যুইটার, ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, ইউটিউবে বিরতি বিহীনভাবে যা প্রচার করা হচ্ছে, তার অনেকটাই ফেক বলে ইরানি কর্তৃপক্ষের দাবি। কিন্তু তা প্রত্যাশিত ক্ষতি যে করছে, তাতে সন্দেহ  নেই।

ইরানিরা প্রশ্ন তুলছেন, যারা ইরানে অশান্তির আগুন জ্বালিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা তুলতে চাইছেন, তারা কতটা ইরানি জনগণকে ভালবাসেন? কারণ, আমেরিকা ও পশ্চিমা দেশগুলি ইরানের উপর বছরের পর বছর ধরে কঠোর অর্থনৈতিক ও সামরিক নিষেধাজ্ঞা জারি করে রেখেছে। আর এর ফলে ইরানে বহু জীবনদায়ী ওষুধ ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ পরিকাঠামোর জন্য অর্থ পাওয়া যাচ্ছে না। বহু ইরানি নাগরিক শুধু কষ্টে নয়, তারা অবরোধের ফলে জীবনও হারাচ্ছেন।

স্পষ্ট বোঝা যায়, ইরানি জনগণের জন্য আমেরিকা ও পশ্চিমা দেশগুলির বিন্দুমাত্র সহানুভূতি নেই। তাদের আসল লক্ষ্য হচ্ছে  রাজনৈতিক, সামরিক ও অর্থনৈতিক ফায়দা। আর সেজন্যই তারা নানাভাবে ইরানকে ঘিরতে চাইছে। মাহশা আমিনীর হিজাব নিয়ে পশ্চিমাদের কর্মকাণ্ডের সঠিক রূপ বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।

দ্বিতীয়ত, ইরানের মহিলাদের অধিকার নিয়ে কারও কিছু বলার প্রয়োজন নেই বলে মনে হয়। কারণ, ইরানের মেয়েরাই শুধু স্কুল -কলেজ নয়, বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা সংস্থাগুলিতেও নেতৃত্বের অবস্থানে রয়েছে। মহিলা ব্রিগেড রয়েছে সেনাবাহিনীতে এবং তা বড় সংখ্যায়। পাইলট থেকে প্রফেসর, বিজ্ঞানী, খেলাধুলা, ব্যবসা, শিল্প সব ক্ষেত্রেই মহিলারা নিজেদের অধিকার ও অংশগ্রহণ সুনিশ্চিত করেছে। মনে রাখতে হবে, ইরানের মহিলারা আফ্রিকার কোনও বনাঞ্চল অধ্যুষিত দেশ বা সউদি কবলিত আরব নয়। সউদিতে এতদিন ধরে দেখা গেছে মহিলাদের উপর তারা অন্যায় বিধিনিষেধ চাপিয়ে রেখেছিল। যেমন মহিলারা গাড়ি চালাতে পারবে না, আরও কত কী। অথচ ইসলাম এই ধরনের কোনও আদেশ দেয়নি। আর বর্তমানে সউদি প্রধানমন্ত্রী ও যুবরাজ মুহাম্মদ বিন সলমন সউদি আরবেকে পাশ্চাত্যের মূল্যবোধ ও জীবনাচরণে ঢালাই করতে চাইছেন। এজন্য তিনি ইসলাম-বিরোধী নানা পদক্ষেপ নিচ্ছেন যুব সমাজকে বিভ্রান্ত করতে। সউদির সঙ্গে ইরানের মহিলাদের তুলনা চলে না। কারণ, ইরানের মহিলারা প্রকৃতই ক্ষমতায়নের মধ্যে রয়েছেন।

সবশেষে বলতে হয়, পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলিতে সবথেকে বেশি মানুষের অধিকার হরণ করা হচ্ছে। নারীদের সেখানে পণ্য এবং যৌনতার প্রতীক হিসেবে শোষণ করা হয়। আর বহুজাতিক কোম্পানিগুলি ফ্যাশন, পোশাক প্রভৃতি ক্ষেত্রে মুনাফা অর্জনের জন্য নারী সমাজকেই ব্যবহার করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কৃষ্ণাঙ্গদের অধিকার যেভাবে হরণ করা হচ্ছে, তা গুগল করলে যেকোনও মানুষের সামনে আসবে। সাদা পুলিশরা কালো মানুষদের যেভাবে হত্যা করছে, তার কোনও বিচার শেষ পর্যন্ত এই কালো মানুষদের কপালে জোটে না। এ নিয়ে কিন্তু পাশ্চাত্যে মাঝেমধ্যে শুধু দুঃখ প্রকাশ করা ছাড়া তেমন কোনও বক্তব্য নেই।

আমাদের দেশ ভারতেও দলিত ও আদিবাসী নারীদের যেভাবে ধর্ষণ ও হত্যা চলছে, তা সংবাদপত্রে ও ইন্টারনেটে প্রতিনিয়তই দেখতে পাওয়া যায়। হাথরসের ঘটনাটি একটি নির্মম উদাহরণমাত্র। কই এদের নিয়ে তো পশ্চিমাদের কোনও মাথা ব্যথা, বাইডেন কিংবা অন্য বিশ্বনেতাদের কোনও বিবৃতি নেই, নেই কোনও প্রতিবাদ। শুধুই ইরানের নারীদের প্রতি তাদের এত সহানুভূতিকে তাই বলা যায় দু-মুখো নীতি। এর পিছনে রয়েছে রাজনৈতির স্বার্থ। আর ইরানের জনগণ অবশ্যই মাহশা আমিনীর হত্যার বিচার চায়। কিন্তু তারা এজন্য সমগ্র দেশের অশান্তি চায় না। অবরোধের মধ্যেও অগ্রগতির ধারাকে ধ্বংস করতে চায় না।

Copyright © Puber Kalom All rights reserved.| Developed by eTech Builder

ইরানী এক তরুণীর মৃত্যু ও উত্তাল পশ্চিমা বিশ্ব

আপডেট : ৬ অক্টোবর ২০২২, বৃহস্পতিবার

 

আহমদ হাসান

ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানে খুবই দুঃখজনক ও মর্মন্তুদ একটি ঘটনা ঘটেছে। আর তাহল, একজন ২২ বছরের তরুণী মাহশা আমিনীকে সম্প্রতি ইরানের নৈতিকতা বাস্তবায়ন পুলিশ আটক করে। এই তরুণীকে আটক করার তিনদিন পর ১৬ সেপ্টেম্বর সে মারা যায়।

যে কোনও মৃত্যুই দুঃখের। আর এক্ষেত্রে মাহশা আমিনীর মৃত্যু সকলের হৃদয়কেই ভারাক্রান্ত করেছে। আর প্রবল আপত্তির কারণ হল, মাহশা আমিনীর মৃত্যু হয়েছে পুলিশ হেফাজতে। তার পরিবারের অভিযোগ, মাহশা আমিনীকে পুলিশ মারধর করে, তারই পরিণতিতে এই ঘটনা ঘটেছে।

কিন্তু এই তরুণীর মৃত্যুকে কেন্দ্র করে পশ্চিমা বিশ্ব উত্তাল হয়ে উঠেছে। তারা এই ঘটনাকে ইরানের ইসলামপন্থী শাসক শ্রেণির নৃশংসতা, নারী অধিকার হরণ এবং ‘শরিয়তি আইনের নিষ্ঠুরতা’ বলে প্রচার করে চলেছে।

সকলেই জানেন, ইমাম আয়াতুল্লাহ খোমেইনি ১৯৭৮ সালে ইরানের রাজতন্ত্রী এবং ফ্যাসিবাদী শাসনের অবসানে যে সংগ্রাম ও গণবিপ্লব শুরু করেন, তা আমেরিকা ও ইউরোপের দেশগুলির মোটেই পছন্দ  ছিল না। তাদের সমর্থন ছিল বাদশাহ রেজা শাহ পাহলভির দিকে। শেষ পর্যন্ত তারা চেষ্টা করে, তাদের তাঁবেদার পাহলভিকে মসনদে টিকিয়ে রাখার। কিন্তু আয়াতুল্লাহ খোমেইনির নেতৃত্বে ইসলামী গণবিপ্লবে তাদের পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। ইরানে ক্ষমতাসীন হয় ইসলামপন্থীরা। আর তখন থেকেই ইরান আমেরিকা ও ইউরোপের দেশগুলির জাতশত্রুতে পরিণত হয়। এই সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য তারা বহুবার চেষ্টা করেছে। প্রথম চেষ্টাটি হয় ইরাকের রাষ্ট্রপতি সাদ্দাম হুসেনকে দিয়ে। তাঁকে তারা ইরান আক্রমণ করার জন্য অর্থ ও বিধ্বংসী অস্ত্রশস্ত্র প্রদান করে। ৮ বছর যুদ্ধ চললেও সাদ্দাম হুসেন কিন্তু ইরানকে পরাস্ত করতে পারেনি। তবে ইসরাইলের মোসাদ এবং আমেরিকার সিআইএ, ব্রিটিশ ও ফ্রান্সের এজেন্সিগুলি নানাভাবে ইরানের ইসলামী শাসকদের ক্ষমতাচ্যুত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

ইরানের নেতৃত্ব বলছেন, মাহশা আমিনীর দুর্ভাগ্যজনক ঘটনাকে তাঁরাও নি¨া করেন। আর এবিষয়ে ফরেন্সিকসহ সমস্ত ধরনের তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন তাঁরা। আর ওই অঞ্চলে নৈতিকতা বাস্তবায়ন পুলিশ প্রধানকে তদন্তের স্বার্থে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে।

মাহশা আমিনীর মৃত্যুর ঘটনাটি সম্পর্কে ইরানের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যে বক্তব্য দিচ্ছেন, তা কিন্তু পশ্চিমা প্রচারণা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। তেহরানের পুলিশ প্রধান বলেছেন, মহিলা পুলিশ মাহশা আমিনীকে আটক করেছিল ঠিকই, কিন্তু তাকে কোনওভাবে মারধর কিংবা নির্যাতন করা হয়নি। এই বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তপক্ষ তাদের বক্তব্যের সপক্ষে একটি প্রধান প্রমাণ দিচ্ছেন, তাহল সিসিটিভি ফুটেজ। সিসিটিভিতে দেখা যাচ্ছে, ওই তরুণী হেঁটেই পুলিশ থানায় এসেছেন এবং পরে অন্যান্য মহিলাদের সঙ্গে হিজাব ক্লাসে বসে রয়েছেন। কিছুক্ষণ পরেই তরুণীটি হঠাৎ জ্ঞান হারিয়ে মেঝেতে লুটিয়ে পড়ে। সেইসময় তরুণীটি একজন মহিলা পুলিশ অফিসারের সঙ্গে হিজাব নিয়ে কথা বলছিল। সিসিটিভিতে পুরো ঘটনাটির রেকর্ড রয়েছে। প্রাথমিক তদন্তে এটাও জানা গেছে, ওই তরুণীর হার্টে সমস্যা ছিল। ইরানে ফরেন্সিক বিভাগের পরীক্ষাতে দেখা গেছে, মাহশা আমিনীর শরীরে কোনও আঘাতের চিহ্ন নেই। মাহশা আমিনীর পরিবার অবশ্য দাবি করেছে, আগে তার কোনও অসুস্থতা ছিল না। কিন্তু ইরানি গণমাধ্যমের তদন্তে জানা যায়, ৮ বছর বয়সে মাহশা আমিনীকে ব্রেন টিউমারের জন্য সার্জারি করতে হয়েছিল। এরপর থেকে সে নিউরোলজিস্ট বা স্নায়ুবিশেষজ্ঞদের নিয়মিত চিকিৎসায় ছিল।

ইসলামী প্রজতন্ত্র ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি স্বয়ং ওই তরুণীর মৃত্যুর তদন্তের আদেশ দিয়েছেন। আর সেই অনুযায়ী সার্বিক তদন্তের কাজ চলছে। এছাড়া ইরানের ‘প্রেস টিভি’ জানিয়েছে, মাহশা আমিনীর সিটি স্ক্যানের রিপোর্টে বিশেষজ্ঞরা স্পষ্ট করে বলেছেন, তার মাথায় কিংবা শরীরে ক্ষত বা আঘাতের কোনও চিহ্ন নেই। অথচ ‘বিবিসি’ বলছে, একজন অফিসার মাহশা আমিনীর মাথায় ব্যাটন দিয়ে আঘাত করেন এবং তার মাথা নাকি দেওয়ালে ঠুকে দেয়। কিন্তু সিসিটিভির ফুটেজে এই ধরনের কোনও ঘটনার দৃশ্য নেই। তেহরানের ফরেন্সিক মেডিসিনের ডাইরেক্টর জেনারেল মেহেদি ফারুজেশ বলছেন, ময়নাতদন্তে মাহশা আমিনীর শরীরে কোনও রক্তপাত, মাংসপেশী বা আভ্যন্তরীণ প্রত্যঙ্গে আঘাত এসবের কোনও লক্ষণ পাওয়া যায়নি।

কিন্তু পশ্চিমা মিডিয়া এসব রিপোর্টকে বিন্দুমাত্র  গুরুত্ব না দিয়ে এক তরফা প্রচার করছে। ইসলামী হিজাব সঠিকভাবে না পরার কারণে পুলিশ মাহশা আমিনীর উপর নাকি প্রবল নির্যাতন করে। আর ইসলামী আইনের ঘেরাটোপে এই তরুণী প্রাণ হারায়। বিবিসি, রয়টার, এএফপি, এপি, গার্ডিয়ান, সিএনএন, নিউ ইয়র্ক টাইমস প্রভৃতি পশ্চিমা মিডিয়া সমানে ইরানের ইসলামী শাসনের নিন্দা  করে যাচ্ছে। তাদের আরও প্রচার হচ্ছে, ইরানে ‘রিজিম চেঞ্জ’ বা ইসলামপন্থী শাসকদের উৎখাত করার জন্য প্রবল আন্দোলন শুরু হয়ে গেছে। মেয়েরা হিজাব খুলে ফেলছে,  গণহারে চুল কেটে ফেলছে ইত্যাদি।

একথা সত্যি, ইরানে এই ঘটনা নিয়ে কিছু বিক্ষোভ হয়েছে। ফেসবুক, ট্যুইটার, ইনস্টাগ্রাম এসবের মাধ্যমেও পশ্চিমারা ইরানের মানুষকে ব্যাপক উসকানি দিয়েই চলেছে। এমনিতে ইরানে ইন্টারনেটের উপর আমেরিকার নিয়ন্ত্রণ ছিল। কিন্তু এই ঘটনার কথা সামনে আসতেই আমেরিকা ইরানের ইন্টারনেটের উপর সমস্ত বিধিনিষেধ তুলে দিয়ে তা অবাধ করে দেয়। আর ইন্টারনেট ব্যবহার করে ইরানের শাসক ও ইসলামী মূল্যবোধের বিরুদ্ধে প্রবল প্রচারণা চালানো হয়। লন্ডন ও আমেরিকা ভিত্তিক বেশকিছু প্রবাসী ইরানী পত্রপত্রিকা ও ইউটিউব চ্যানেলে রীতিমতো কুৎসা ও অপপ্রচারের মহাযুদ্ধ শুরু করে দেওয়া হয় বলে ইরানী কর্তৃপক্ষ বলছেন। চেষ্টা চলতে থাকে, মাহশা  আমিনীর জন্য ইরানের বাসিন্দাদের ক্ষেপিয়ে তোলারও। ফলে পশ্চিমা উসকানিতে তেহরানের কয়েকটি জায়গায় বিক্ষোভ, ভাঙচুর ও গুণ্ডামি শুরু হয়। অগ্নিসংযোগ করা হয় সম্পত্তিতে। আক্রমণ করা হয় পুলিশ ও নিরাপত্তাবাহিনীকে। তেহরান ও অন্য কয়েকটি শহরে অ্যাম্বুলেন্সকেও নিশানা করে হামলাকারীরা। কম করে ৬০টি অ্যাম্বুলেন্সের ক্ষতি করা হয়। কয়েকটি এলাকায় মেয়েরাও ইরানের শাসকদের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে।

কিন্তু প্রত্যেক ক্রিয়ারই বোধহয় প্রতিক্রিয়া থাকে। ইরানের ইসলামপন্থী নারীরা পশ্চিমা প্ররোচনার বিরুদ্ধে এবং ইসলামের সমর্থনে বড় বড় মিছিল সমাবেশের আয়োজন করে। তারা বলেন, বিদেশী এজেন্টদের প্ররোচনায় ইরানে অশান্তি সৃষ্টির প্রচেষ্টাকে তারা অবশ্যই রুখবেন। ইরানে পশ্চিমা সমর্থকরা নিরাপত্তাবাহিনীর সদস্যদের আক্রমণ করলে গুলি চলে। তাতে নিরাপত্তাবাহিনীর সদস্যসহ ৮০ জনেরও বেশি নিহত হয়েছে বলে রয়টার্সের দাবি।

তবে ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি কড়া হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, ‘কোনও ধরনের অশান্তি ও বিশৃঙ্খলাকে বরদাশ্ত করা হবে না। আমাদের শত্রুরা জাতীয় ঐক্যকে বিনষ্ট করতে চায় এবং ইরানী জনগণকে একে অপরের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে। প্রতিবাদ নয়, চেষ্টা করা হচ্ছে ব্যাপক দাঙ্গা করার।’ ইরানী কর্তৃপক্ষ আরও বলেছেন, যেহেতু মাহশা আমিনী একজন সম্প্রদায়ভুক্ত ইরানী, তাই ইরাক, তুরস্ক, সিরিয়া প্রভৃতি স্থানে পশ্চিমা সাহায্যপ্রাপ্ত কুর্দিস জাতির সশস্ত্র বিদ্রোহীরা রয়েছে তারাও এই দাঙ্গা, প্ররোচনার আগুনে ঘৃতাহুতি দিচ্ছে। ইরান বলছে, তারা এই ষড়যন্ত্রের সঠিক স্বরূপকে সামনে আনবে।

শেষ পর্ব

ইরান পশ্চিমাদের লক্ষ্য কি অর্জিত হবে!

একথা ঠিক, মাহশা আমিনী নামক তরুণীটির মৃত্যুকে কেন্দ্র করে ইরানের বেশকিছু শহরে বিক্ষোভ হচ্ছে। রাস্তায় নেমেও বিক্ষোভ-দাঙ্গা করছে একদল মানুষ। এরা আগে থেকেই ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের বিক্ষুব্ধ গোষ্ঠী হিসেবে পরিচিত। এদের মধ্যে একটি হচ্ছে, মুজাহিদিন-ই-খাল্ক্ব অর্গানাইজেশন (এমকেও)। এদের একটি বড় ঘাঁটি রয়েছে আলবানিয়ায়। এ ছাড়া আরও বেশকিছু সশস্ত্র গোষ্ঠী রয়েছে, এর মধ্যে রাজতন্ত্রীরাও রয়েছে, যারা শাহ পাহলভি পরিবারকে ইরানে ফিরিয়ে আনতে চায়। রয়েছে কুর্দি বিদ্রোহীরা।

 

 

ইরানী এক তরুণীর মৃত্যু ও উত্তাল পশ্চিমা বিশ্ব

এ কথা এখন সকলেই জানেন, কুর্দিরা ছড়িয়ে রয়েছে ইরান, তুরস্ক, সিরিয়া ও ইরাকে। তারা সশস্ত্র আন্দোলনের  মাধ্যমে কুর্দিস্থান গঠনের জন্য সক্রিয় রয়েছে। ইরান বলছে, ইরানে ও ইউরোপের বিভিন্ন শহরে যে বিক্ষোভ হচ্ছে, তার পিছনে রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটিশ, সউদি আরব। এ ছাড়া জার্মানি, নেদারল্যান্ড ও ফ্রান্সের দিকেও আঙুল তুলেছে ইরানি কর্তৃপক্ষ। এর মধ্যে কিছু দেশের রাষ্ট্রদূতদের ডেকে ইরান তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে উসকানি দেওয়ার জন্য তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে। আর ইরানের বিরুদ্ধে সবথেকে সক্রিয় হচ্ছে, জায়নবাদী রাষ্ট্র ইসরাইল। ইরানের ধ্বংসই হচ্ছে ইসরাইলের লক্ষ্য। কারণ, পশ্চিম এশিয়ায় এই উগ্র ইহুদি রাষ্ট্রের ‘ইরেজ ইসরাইল’ বা বৃহত্তর ইসরাইল গড়ার যে পরিকল্পনা রয়েছে, তার সবথেকে বড় বাধা হল ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান। ইরানের বিরুদ্ধে আমেরিকা ও ইউরোপ যে অবরোধ চালাচ্ছে, তার প্রধান উসকানিদাতা হচ্ছে এই জায়নবাদী রাষ্ট্র। তাদের বক্তব্য, ইরান যদি পরমাণু বোমা তৈরি করে তাহলে বিশ্বের মহাবিপদ। অথচ ইসরাইলের নিজেরই ২০০-র বেশি পরমাণু বোমা এবং নিক্ষেপ করার মিসাইল ও বিমান রয়েছে। ইসরাইলি সন্ত্রাসী গুপ্তচর সংস্থা মোসাদ আগে ইরানে বেশকিছু অর্ন্তঘাত চালিয়েছে। ইরানের বিজ্ঞানীদের হত্যা এবং বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে নাশকতার কাজ করেছে। মাহশা আমিনীকে নিয়ে বিক্ষোভে ইসরাইলের উসকানিও এক প্রধান ফ্যাক্টর বলে ইরানি নেতৃত্ব মনে করছে।

আবার ইরানে বর্তমান সব বিক্ষোভই যে হিজাবকে নিয়ে হচ্ছে, তা নয়। যেমন একটি বড় সশস্ত্র বিক্ষোভ হয়েছে জাহেদান শহরে। যা ইরানি বালুচিস্তান এবং সিস্তান প্রদেশের অন্তর্গত। পাক ও আফগান সীমান্তে অবস্থিত এখনকার বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী বহু আগে থেকেই ইরানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করে যাচ্ছে। এর আগেও তারা বেশ কয়েকবার ইরানি সেনার উপর হামলা চালিয়ে তাদের ক্ষয়ক্ষতি করেছে। শুক্রবার দিন তারা মসজিদের কাছে একটি থানা আক্রমণ করে। এই ঘটনা ইরানের একজন উচ্চপদস্থ সামরিক কর্তা মুহাম্মদ সাইয়েদ আলি মুসাভি নিহত হয়েছেন। নিহত হয়েছেন একজন কর্নেল-সহ নিরাপত্তাবাহিনীর আরও কয়েকজন। তবে হামলাকারী ও দাঙ্গাবাজদের বিরুদ্ধে ইরানি নিরাপত্তাবাহিনী গুলি চালালে বেশ কয়েকজন নিহত হয়েছেন। নিহতের সংখ্যা ১৯ এবং আহতের সংখ্যা ৬০-এর উপর।

তবে এই ঘটনার সঙ্গে হিজাব আন্দোলনের  সম্পর্ক নেই বলে মনে করা হচ্ছে। এটা ছিল সশস্ত্র বিচ্ছিন্নতাবাদীদের হামলা।

এখন প্রশ্ন উঠেছে, ট্যুইটার, ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, ইউটিউবে বিরতি বিহীনভাবে যা প্রচার করা হচ্ছে, তার অনেকটাই ফেক বলে ইরানি কর্তৃপক্ষের দাবি। কিন্তু তা প্রত্যাশিত ক্ষতি যে করছে, তাতে সন্দেহ  নেই।

ইরানিরা প্রশ্ন তুলছেন, যারা ইরানে অশান্তির আগুন জ্বালিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা তুলতে চাইছেন, তারা কতটা ইরানি জনগণকে ভালবাসেন? কারণ, আমেরিকা ও পশ্চিমা দেশগুলি ইরানের উপর বছরের পর বছর ধরে কঠোর অর্থনৈতিক ও সামরিক নিষেধাজ্ঞা জারি করে রেখেছে। আর এর ফলে ইরানে বহু জীবনদায়ী ওষুধ ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ পরিকাঠামোর জন্য অর্থ পাওয়া যাচ্ছে না। বহু ইরানি নাগরিক শুধু কষ্টে নয়, তারা অবরোধের ফলে জীবনও হারাচ্ছেন।

স্পষ্ট বোঝা যায়, ইরানি জনগণের জন্য আমেরিকা ও পশ্চিমা দেশগুলির বিন্দুমাত্র সহানুভূতি নেই। তাদের আসল লক্ষ্য হচ্ছে  রাজনৈতিক, সামরিক ও অর্থনৈতিক ফায়দা। আর সেজন্যই তারা নানাভাবে ইরানকে ঘিরতে চাইছে। মাহশা আমিনীর হিজাব নিয়ে পশ্চিমাদের কর্মকাণ্ডের সঠিক রূপ বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।

দ্বিতীয়ত, ইরানের মহিলাদের অধিকার নিয়ে কারও কিছু বলার প্রয়োজন নেই বলে মনে হয়। কারণ, ইরানের মেয়েরাই শুধু স্কুল -কলেজ নয়, বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা সংস্থাগুলিতেও নেতৃত্বের অবস্থানে রয়েছে। মহিলা ব্রিগেড রয়েছে সেনাবাহিনীতে এবং তা বড় সংখ্যায়। পাইলট থেকে প্রফেসর, বিজ্ঞানী, খেলাধুলা, ব্যবসা, শিল্প সব ক্ষেত্রেই মহিলারা নিজেদের অধিকার ও অংশগ্রহণ সুনিশ্চিত করেছে। মনে রাখতে হবে, ইরানের মহিলারা আফ্রিকার কোনও বনাঞ্চল অধ্যুষিত দেশ বা সউদি কবলিত আরব নয়। সউদিতে এতদিন ধরে দেখা গেছে মহিলাদের উপর তারা অন্যায় বিধিনিষেধ চাপিয়ে রেখেছিল। যেমন মহিলারা গাড়ি চালাতে পারবে না, আরও কত কী। অথচ ইসলাম এই ধরনের কোনও আদেশ দেয়নি। আর বর্তমানে সউদি প্রধানমন্ত্রী ও যুবরাজ মুহাম্মদ বিন সলমন সউদি আরবেকে পাশ্চাত্যের মূল্যবোধ ও জীবনাচরণে ঢালাই করতে চাইছেন। এজন্য তিনি ইসলাম-বিরোধী নানা পদক্ষেপ নিচ্ছেন যুব সমাজকে বিভ্রান্ত করতে। সউদির সঙ্গে ইরানের মহিলাদের তুলনা চলে না। কারণ, ইরানের মহিলারা প্রকৃতই ক্ষমতায়নের মধ্যে রয়েছেন।

সবশেষে বলতে হয়, পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলিতে সবথেকে বেশি মানুষের অধিকার হরণ করা হচ্ছে। নারীদের সেখানে পণ্য এবং যৌনতার প্রতীক হিসেবে শোষণ করা হয়। আর বহুজাতিক কোম্পানিগুলি ফ্যাশন, পোশাক প্রভৃতি ক্ষেত্রে মুনাফা অর্জনের জন্য নারী সমাজকেই ব্যবহার করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কৃষ্ণাঙ্গদের অধিকার যেভাবে হরণ করা হচ্ছে, তা গুগল করলে যেকোনও মানুষের সামনে আসবে। সাদা পুলিশরা কালো মানুষদের যেভাবে হত্যা করছে, তার কোনও বিচার শেষ পর্যন্ত এই কালো মানুষদের কপালে জোটে না। এ নিয়ে কিন্তু পাশ্চাত্যে মাঝেমধ্যে শুধু দুঃখ প্রকাশ করা ছাড়া তেমন কোনও বক্তব্য নেই।

আমাদের দেশ ভারতেও দলিত ও আদিবাসী নারীদের যেভাবে ধর্ষণ ও হত্যা চলছে, তা সংবাদপত্রে ও ইন্টারনেটে প্রতিনিয়তই দেখতে পাওয়া যায়। হাথরসের ঘটনাটি একটি নির্মম উদাহরণমাত্র। কই এদের নিয়ে তো পশ্চিমাদের কোনও মাথা ব্যথা, বাইডেন কিংবা অন্য বিশ্বনেতাদের কোনও বিবৃতি নেই, নেই কোনও প্রতিবাদ। শুধুই ইরানের নারীদের প্রতি তাদের এত সহানুভূতিকে তাই বলা যায় দু-মুখো নীতি। এর পিছনে রয়েছে রাজনৈতির স্বার্থ। আর ইরানের জনগণ অবশ্যই মাহশা আমিনীর হত্যার বিচার চায়। কিন্তু তারা এজন্য সমগ্র দেশের অশান্তি চায় না। অবরোধের মধ্যেও অগ্রগতির ধারাকে ধ্বংস করতে চায় না।