সমানে চলছে মোদি-শাহের বেহিসাব ঘৃণা ভাষণ

- আপডেট : ২৫ এপ্রিল ২০২৪, বৃহস্পতিবার
- / 2
আহমদ আবদুল্লাহ: বিজেপি নেতা ও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি রাজস্থানে তীব্র মুসলিম বিদ্বেষী ভাষণ দেওয়ার পরও অনেকে মনে করেছিলেন মোদিজির মুসলিম বিদ্বেষ, নফরত প্রচার এবং ভোটে স্বার্থ হাসিলের জন্য হয়তো তাঁর সাম্প্রদায়িক প্রচারণার তীব্রতা একটু হলেও হ্রাস করবেন। কিন্তু কে শোনে কার কথা! কারণ, মোদিজি ও তাঁর সহযোগীরা স্পষ্টই খুঁজে পেয়েছেন তুরুপের তাস। আর সেটা হচ্ছে, মুসলিমদের সম্পর্কে ঘৃণা প্রচার।
মোদিজি বুধবার ছত্তিশগড়ে এসে বলেছেন, কংগ্রেস পরিচালিত কর্নাটক সরকার বেআইনিভাবে মুসলিমদের ওবিসি কোটার অন্তর্ভুক্ত করেছে। তার ফলে ওবিসিদের বঞ্চিত করা হয়েছে। কংগ্রেস ওবিসিদের ভবিষ্যৎ নষ্ট করছে। আমাদের সংবিধান কখনই ধর্মের ভিত্তিতে সংরক্ষণকে স্বীকার করে না। আম্বেদকরও এর বিরোধী ছিলেন। কংগ্রেস এই সংরক্ষণ ব্যবস্থা চালু করে আম্বেদকরের পিঠে ছুরি মেরেছে বলে তোপ দাগেন মোদি।
মোদিজি খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধেও যে কতটা সক্রিয় তার প্রধান প্রমাণ পাওয়া গেছে মণিপুরে। সেখানে চার্চ জ্বালানো, গ্রাম থেকে উৎখাত, মহিলাদের উপর অত্যাচার কয়েক মাস ধরে এগুলি চললেও মোদিজি একবারও সেখানে গিয়ে নাগরিকদের সান্তনা বা দৃষ্টান্তমূলক কোনও পদক্ষেপ নেননি। মধ্যপ্রদেশ, বেঙ্গালুরু প্রভৃতি স্থানেও খ্রিস্টান ও চার্চের উপর হামলা চলছে। আর দেশের মুসলিমরা তো তাঁর নিশানা হয়ে রয়েছেন।
গুজরাতে কী করে মুসলিমদের নিকেশ করতে হয়, তার প্রমাণ রখেছেন মোদিজি। সেই ২০০২ সালে সহিংসতার সময় মোদিজির নানা বাক্যবাণ সহিংসতায় প্ররোচণা দিয়েছে বলে অনেকেই দাবি করেছেন। আর তিনি পুলিশ প্রশাসনকে নিস্ক্রিয় করে রেখেছিলেন বলে তাঁর মন্ত্রিসভার সদস্যরাও বলেছেন। সেই সময় গুজরাতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হরেন পান্ডায়ার নাম তার মধ্যে অগ্রগণ্য।
মনে হচ্ছে, মোদিজি এবার প্রধানমন্ত্রী হিসেবেও মুসলিম বিদ্বেষ প্রচার করে প্রায় সমগ্র দেশের পরিস্থিতিকে বিষিয়ে তুলতে চাইছেন। একে সম্বল করে তিনি ভোটযুদ্ধে জয়ী হওয়ার চেষ্টা করছেন! কিন্তু এর দ্বারা দেশে বিভাজন তৈরি করে মোদিজি রাষ্ট্রের ঐক্য বিনষ্ট করার পথে হাঁটছেন। আর সংরক্ষণ তো ধর্মের ভিত্তিতেই হয়েছে। হিন্দু ধর্মের মধ্যে যারা পিছিয়ে রয়েছেন, বঞ্চিত রয়েছেন তাঁদের জন্যই সংরক্ষণ। আদার ব্যাকওয়ার্ড ক্লাসকেও সংরক্ষণের আওতায় আনা হয়েছে। তার মধ্যে ব্যাকওয়ার্ড মুসলিমরা থাকলে অসুবিধা কোথায়? অর্থাৎ যেন তেন প্রকারণে মোদিজি মুসলিমদের টেনে এনে সাম্প্রদায়িকতার মশাল হাতে ভোটযুদ্ধে বিজয়ী হতে চাইছেন। কিন্তু কাশীরাম, মায়াবতী, মুলায়ম সিং যাদব, লালু প্রসাদ এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী ভি.পি সিং মন্ডল কমিশনের মাধ্যমে দলিত, ওবিসিদের যে সুযোগ করে দিয়েছিলেন, তা তো সকলেই জানেন।
মনুবাদীরা তাকে আটকাতে পারেনি। অবশ্য শেষ পর্যন্ত অম্বেদকর হিন্দু ধর্মকেই বর্জন করেছিলেন। তিনি অনুসারীদের সঙ্গে বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করেন। দ্বিতীয়ত, মোদিজির আর একটি বেশরম মিথ্যা হল, কর্নাটকে মুসলিমদের সংরক্ষণ দেওয়ার জন্য অন্য ওবিসি বা দলিতদের সংরক্ষণে কোনও হাত দেওয়া হয়নি, তাদের কোটা হ্রাস করা হয়নি। বরং মুসলিমদের জন্য এর বাইরে আলাদা সংরক্ষণ দেওয়া হয়েছে।
তবে দেশীয় মুসলিমদের বিরুদ্ধে ঘৃণা-বিদ্বেষ প্রচার করলেও বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিতে মুসলিমদের মসজিদ, মাদ্রাসা ও ঘরবাড়িতে বুলডোজার চালানো হলেও মোদিজি কিন্তু বিদেশী মুসলিম রাজা-বাদশাহ, সুলতানদের খুবই ভালোবাসেন। ইউ-এ-ই-র প্রেসিডেন্ট, কাতারের আমীর, সউদি বাদশাহ, ওমানের সুলতান সকলেই তাঁর ‘বিষম প্রিয়’। তাঁদের সঙ্গে গলাগলি ও কোলাকুলি করতে তিনি খুবই পছ¨ করেন। তাঁর আপত্তি কেবল ‘দেশী মুসলিমে’। ‘বিদেশী ব্র্যান্ড’ হলে তাঁর আপত্তি নয় বরং দেদার প্রেম রয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী মোদিজির দোসর অমিত শাহও কিন্তু কম যান না। মঙ্গলবার তিনি ভোট প্রচারে এসেছিলেন উত্তর দিনাজপুরের করণদিঘিতে। হেলিকপ্টারে এখানে নেমে তিনি ভাষড়ে বলেন, বাংলায় গতবার লোকসভা ভোটে পশ্চিমবাংলা আমাদের ১৮টি আসন দিয়েছিল। আর আমরা এর পরিবর্তে আপনাদের অযোধ্যায় রাম মন্দির উপহার দিয়েছি। আপনারা এবার আমাদের ৩০-৩৫টি আসন দিন, কথা দিচ্ছি, আমরা চিরতরে বাংলাদেশী অনুপ্রবেশ বা ‘ঘুসপেট’ বন্ধ করে দেব। অমিত শাহ আরও বলেন, মমতা দিদি অনুপ্রবেশকারীদের নিয়ে আসছেন এবং অন্যদিকে তিনি ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নাগরিকত্ব দিতে বাধা দিচ্ছেন। আপনাদের ভোট পেলে আমরা সিএএ করবই। কেউ বাধা দিতে পারবে না। আর সেক্ষেত্রে আমরা বাংলাদেশী অনুপ্রবেশ সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেব। এখানেও দেখা যাচ্ছে, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ নির্বাচনে নিষিদ্ধ ধর্মের তাস খেলছেন।
বলছেন, আমরা রাম মন্দির তৈরি করে দিয়েছি। তাই আমাদের ভোট দিন। এরপর তাঁর বক্তব্য, আপনাদের কাছ থেকে আরও আসন সংখ্যা পেলে আমরা এই অঞ্চলে বাংলাদেশী অনুপ্রবেশ সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেব। বর্তমানে সীমান্ত রক্ষার দায়িত্ব অমিত শাহের অধীন বিএসএফ-এর। তাহলে কী করে অনুপ্রবেশ ঘটছে? কতজন অনুপ্রবেশকারীকে ফেরত পাঠানো হয়েছে? আসলে তিনি বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারী বলতে মুসলিমদের বুঝিয়েছেন। দুঃখের কথা, দিনাজপুরে তাঁর শ্রোতা-দর্শকরা হয়তো তাঁর বক্তব্য পুরোপুরি বুঝতে পারেনি। সেখানে যারা বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন সময়ে এসেছেন তাদের অধিকাংশই হচ্ছেন হিন্দু।
অমিত শাহের বক্তব্য শুনে তাঁরা ভাবছেন, আমাদেরও না আবার ‘বাংলাদেশী’ আখ্যা দিয়ে তাড়িয়ে দেয়! ফলে বার বার জিজ্ঞাসা করা সত্ত্বেও অমিত শাহ করণদিঘিতে জমায়েত শ্রোতাদের তেমন কোনও সাড়া পাননি। হয়তো বা খানিকটা ‘উল্টো বুঝলি রাম’-এর মতো অবস্থা। মাঝেমধ্যে চালাকিও ব্যাক ফায়ার করে। আর অনুপ্রদেশের বিষয়টিও হয়তো বা তাই হয়েছে। কিন্তু মোদি, অমিত শাহদের সাম্প্রদায়িক ঘৃণা প্রচার দেশের আবহাওয়া কতটা কলূসিত করল তা হয়তো সামান্য কিছুদিনেই বোঝা যাবে।