০৪ নভেম্বর ২০২৫, মঙ্গলবার, ১৭ কার্তিক ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

রাশিয়া এবং ন্যাটোর হাতে কি ধরনের কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক অস্ত্র রয়েছে?

বিপাশা চক্রবর্তী
  • আপডেট : ১ ফেব্রুয়ারী ২০২২, মঙ্গলবার
  • / 51

প্রথম কিস্তির পর

রাশিয়ার মত সামরিক শক্তি কেন নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন?

আরও পড়ুন: Earthquake: রাশিয়ায় ৭.৪ মাত্রার শক্তিশালী ভূমিকম্প

 

আরও পড়ুন: প্রথমবার রুশ ড্রোন ভূপাতিত করল পোল্যান্ড

ব্রিটিশ সাংবাদিক টিম মার্শাল তার লেখা বেস্টসেলার ‘প্রিজনার্স অব জিওগ্রাফি’  বইতে এর বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, অনেকে ভাবতে পারেন, রাশিয়ার মতো এত বড় একটি সামরিক ক্ষমতাধর দেশকে আক্রমণ করতে চাইবে। কিন্তু রাশিয়া নিজে বিষয়টি সেভাবে দেখে না। এর যথেষ্ট ভিত্তিও আছে। গত পাঁচশো বছরে রাশিয়া বহু বিদেশি শক্তির আক্রমণের মুখে পড়েছে, আর এই সবগুলো আক্রমণই এসেছে উত্তর ইউরোপের সমতল ভূমি দিয়ে।

আরও পড়ুন: Ukraine War: শান্তি না হলে রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞার হুমকি ট্রাম্পের

 

১৬০৫ সালে পোলিশরা আক্রমণ চালিয়েছিল এই পথ ধরে। এর পরে আসে সুইডিশরা। ১৮১২ সালে নেপোলিয়নের নেতৃত্বে হামলা চালায় ফরাসীরা। জার্মানরা রাশিয়ায় অভিযান চালিয়েছে দু’বার ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় আবার ১৯৪১ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে।

১৮১২ সালে নেপোলিয়নের সময় হতে হিসেব করলে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত গড়ে প্রতি ৩৩ বছরে রাশিয়াকে উত্তর ইউরোপের সমতলভূমিতে একবার করে যুদ্ধ করতে হয়েছে। কাজেই রাশিয়ার ধারণা তাদের দেশের জন্য কোন নিরাপত্তা হুমকি যদি থেকে থাকে, সেটি এই পথেই আসবে।

১৯৯০ এর দশকের শুরুতে সোভিয়েত ইউনিয়ন যে ভেঙে গিয়েছিল সেটিকে প্রেসিডেন্ট পুতিন রাশিয়ার জন্য এক ভূ-রাজনৈতিক বিপর্যয় বলে মনে করেন। এরপর হতে রাশিয়া কেবল উদ্বেগের সঙ্গে দেখছে কীভাবে ধীরে ধীরে সামরিক জোট ন্যাটো চারদিক থেকে তাদের ঘিরে ফেলছে। ১৯৯৯ সালে চেক প্রজাতন্ত্র হাঙ্গেরি এবং পোল্যান্ড যোগ দিল ন্যাটোতে। ২০০৪ সালে তাদের পথ অনুসরণ করলো বুলগেরিয়া, এস্তোনিয়া, লাতভিয়া, লিথুয়েনিয়া,রোমানিয়া এবং স্লোভাকিয়া। ২০০৯ সালে যোগ দিল আলবেনিয়া। এই দেশগুলো এক সময় হয় ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ অথবা ওয়ারশ সামরিক জোটের সদস্য।

জর্জিয়া মলদোভা বা ইউক্রেনও পারলে ন্যাটো বা ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগ দেয় কিন্তু এখনও পর্যন্ত রাশিয়ার কারণেই তাদের যোগ দেওয়া হয়নি। কারণ এই তিনটি দেশেই রুশপন্থী মিলিশিয়াদের শক্ত অবস্থান আছে। এই দেশগুলোর যে কোন একটি যদি ন্যাটোতে যোগ দেয়, তা রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধের স্ফুলিঙ্গ হিসেবে কাজ করতে পারে।

টিম মার্শাল লিখেছেন গত শতকে স্নায়ুযুদ্ধের দিনগুলোতে কে ভাবতে পেরেছিল মস্কো হতে মাত্র কয়েকশো মাইল দূরে পোল্যান্ডের মাটিতে বা বাল্টিক দেশগুলোতে মার্কিন সেনা মোতায়েন করা থাকবে? তার মতে ইউক্রেনের ন্যাটোতে যোগ দেওয়া মানে যুক্তরাষ্ট্র বা ন্যাটোর সামরিক বাহিনী যেন একেবারে রাশিয়ার পেটের ভেতরে এসে অবস্থান নিল। নিজের দোরগোড়ায় প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী যুক্তরাষ্ট্র এবং তাদের মিত্র পশ্চিমা দেশগুলোর সামরিক উপস্থিতিকে রাশিয়া সঙ্গত কারণেই এক বিরাট নিরাপত্তা হুমকি হিসেবে বিবেচনা করে।

 

ইউক্রেন সংকটে রাশিয়ার গ্যাস কেন বড় ইস্যু?

 

পরমাণু অস্ত্রের কথা বাদ দিলে রাশিয়ার হাতে সবচেয়ে শক্তিশালী অস্ত্র কিন্তু তার সেনাবাহিনী বা বিমান বাহিনী নয়। রাশিয়ার সবচেয়ে শক্তিশালী অস্ত্র তার জ্বালানি। ইউরোপের মোট তেল এবং গ্যাস সরবরাহের ২৫ শতাংশ আসে রাশিয়া থেকে। লাতভিয়া, স্লোভাকিয়া, ফিনল্যান্ড এবং এস্তোনিয়ার মতো দেশগুলো রাশিয়ার জ্বালানির ওপর একশো ভাগ নির্ভরশীল।

জার্মানির প্রায় অর্ধেক গ্যাস সরবরাহ আসে রাশিয়া থেকে। জার্মানির রাজনীতিকরা কেন রাশিয়ার সমালোচনায় ততটা সরব নয়, এ তথ্য থেকেই তা বোঝা যায়। আর ইউরোপে গ্যাস সরবরাহের ক্ষেত্রে ইউক্রেন হচ্ছে রাশিয়ার প্রবেশ দ্বার। রাশিয়া থেকে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে প্রধান গ্যাস পাইপ লাইনগুলো গেছে ইউক্রেনের ভেতর দিয়ে। রাশিয়ার প্রায় ৪০ শতাংশ গ্যাসের সরবরাহ যায় এই পাইপলাইন দিয়ে।

কাজেই ইউক্রেন যদি রাশিয়ার প্রভাব বলয়ের বাইরে চলে যায়, তাহলে গ্যাস সরবরাহের ক্ষেত্রে রাশিয়া তার একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ হাতছাড়া হতে পারে বলে আশংকা করে। তবে ইউক্রেনকে পাশ কাটিয়ে রাশিয়া বাল্টিক সাগরের নীচ দিয়ে জার্মানি পর্যন্ত নর্ড স্ট্রিম নামে নতুন একটি গ্যাস পাইপলাইন বসিয়েছে। কিন্তু রাশিয়া যদি ইউক্রেনে অভিযান চালায়, তাহলে এই নর্ড স্ট্রিম২ গ্যাস পাইপলাইন প্রকল্প আর সামনে এগোবে না বলে এরই মধ্যে হুঁশিয়ারি দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।

ইউরোপ যেভাবে রাশিয়ার গ্যাসের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে, তাতে করে রাশিয়া অন্যান্য দেশগুলোর ওপর রাজনৈতিক চাপ প্রয়োগের সুযোগ পেয়ে যাবে বলে আশংকা করে যুক্তরাষ্ট্র। তারা মনে করে, রাশিয়া চাইলে যে কোন সময় এসব গ্যাস পাইপলাইন দিয়ে সরবরাহ বন্ধ করে দিতে পারে, সামনের দিনগুলোতে এই জ্বালানিকে একটা রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে বার বার ব্যবহার করতে পারে।

 

ইউক্রেন প্রশ্ন ন্যাটো কি ঐক্যবদ্ধ?

 

প্রেসিডেন্ট বাইডেন বলেছেন ইউক্রেন প্রশ্নে ইউরোপীয় নেতারা সবাই একমত। তবে বিভিন্ন দেশ যে ধরণের সমর্থন দেবে বলে কথা দিচ্ছে তার মধ্যে পার্থক্য আছে। যুক্তরাষ্ট্র জানিয়েছে, তারা ইউক্রেনে ৭০ টনের মতো ‘মারণঘাতী সামরিক সরঞ্জাম’ পাঠিয়েছে যাতে রণাঙ্গনের সামনের কাতারে প্রতিরোধ তৈরি করা যায়। যুক্তরাজ্য স্বল্পমাত্রার ট্যাংকবিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র দিচ্ছে ইউক্রেনকে। কিছু ন্যাটো দেশ যেমন ডেনমার্ক স্পেন ফ্রান্স এবং নেদারল্যান্ডস তাদের যুদ্ধবিমান এবং যুদ্ধজাহাজ পূর্ব ইউরোপে পাঠাচ্ছে সেখানকার প্রতিরক্ষাকে জোরালো করতে।

তবে জার্মানি ইউক্রেনের অনুরোধ সত্ত্বেও কোন অস্ত্রশস্ত্র দিতে অস্বীকৃতি করেছে। কারণ দেশটির নীতিই হচ্ছে কোন সংঘাতপূর্ণ এলাকায় কোন প্রাণঘাতী অস্ত্র না পাঠানো। পরিবর্তে জার্মানি মেডিক্যাল ত্রাণ পাঠাবে। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ম্যাক্র অবশ্য উত্তেজনা প্রশমনের জন্য রাশিয়ার সঙ্গে আলোচনা চালানোর আহ্বান জানিয়েছেন।

 

রাশিয়ার বিরুদ্ধে পশ্চিমা দেশগুলো কী ব্যবস্থা নিতে পারে?

পশ্চিমা দেশগুলো মূলত মারাত্মক অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপের কথাই বলছে, যদিও তারা খোলাখুলি স্পষ্ট করে বলছে না এই নিষেধাজ্ঞা ঠিক কেমন হবে। যে একটি ব্যবস্থা নেওয়া হতে পারে বলে শোনা যাচ্ছে সেটি হল একটি আন্তর্জাতিক আর্থিক বার্তা লেনদেন সার্ভিস ‘সুইফট’ থেকে রাশিয়াকে বাইরে রাখা। বিশ্বে দুশোর বেশি দেশের ব্যাংক এবং আর্থিক সেবা প্রতিষ্ঠানগুলো এটি ব্যবহার করে।

ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন বলেছেন, এটি একটি মারাত্মক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। এর ফলে রাশিয়ার ব্যাংকগুলোর পক্ষে কোন ধরণের আন্তর্জাতিক লেনদেন চালানো কঠিন হয়ে পড়বে। ২০১২ সালে এটি ইরানের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হয়েছিল। তবে এরকম নিষেধাজ্ঞায় উল্টো ফলও হতে পারে কারণ যুক্তরাষ্ট্র এবং জার্মান ব্যাংকগুলোর খুব ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে রাশিয়ার আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে।

যুক্তরাষ্ট্র চাইলে রাশিয়াকে আর্থিক লেনদেনের ক্ষেত্রে ডলার ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা দিতে পারে। এর মানে দাঁড়াবে রাশিয়ার আন্তর্জাতিক বাণিজ্য একেবারে সীমিত হয়ে পড়বে। এর বিরাট প্রভাব পড়তে পারে রুশ অর্থনীতিতে। আন্তর্জাতিক ঋণ বাজার থেকে যাতে রাশিয়া ঋণ করতে না পারে,  সেরকম নিষেধাজ্ঞাও দিতে পারে। নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হতে পারে প্রেসিডেন্ট পুতিন এবং তাঁর ঘনিষ্ঠজনদের বিরুদ্ধে। পশ্চিম ইউরোপে রাশিয়া যে জ্বালানি বিক্রি করে, সেটি বন্ধ করার কথাও আলোচনায় আসছে। কিন্তু এর কোন বিকল্প এখনও পর্যন্ত জার্মানি বা অন্যদেশগুলোর নেই। তবে পশ্চিমা দেশগুলোর নিজেদের মধ্যেই আসলে মতবিরোধ রয়েছে যে তারা রাশিয়াকে শাস্তি দিতে কতদূর পর্যন্ত যাবে।

 

 

 

Copyright © Puber Kalom All rights reserved.| Developed by eTech Builder

রাশিয়া এবং ন্যাটোর হাতে কি ধরনের কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক অস্ত্র রয়েছে?

আপডেট : ১ ফেব্রুয়ারী ২০২২, মঙ্গলবার

প্রথম কিস্তির পর

রাশিয়ার মত সামরিক শক্তি কেন নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন?

আরও পড়ুন: Earthquake: রাশিয়ায় ৭.৪ মাত্রার শক্তিশালী ভূমিকম্প

 

আরও পড়ুন: প্রথমবার রুশ ড্রোন ভূপাতিত করল পোল্যান্ড

ব্রিটিশ সাংবাদিক টিম মার্শাল তার লেখা বেস্টসেলার ‘প্রিজনার্স অব জিওগ্রাফি’  বইতে এর বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, অনেকে ভাবতে পারেন, রাশিয়ার মতো এত বড় একটি সামরিক ক্ষমতাধর দেশকে আক্রমণ করতে চাইবে। কিন্তু রাশিয়া নিজে বিষয়টি সেভাবে দেখে না। এর যথেষ্ট ভিত্তিও আছে। গত পাঁচশো বছরে রাশিয়া বহু বিদেশি শক্তির আক্রমণের মুখে পড়েছে, আর এই সবগুলো আক্রমণই এসেছে উত্তর ইউরোপের সমতল ভূমি দিয়ে।

আরও পড়ুন: Ukraine War: শান্তি না হলে রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞার হুমকি ট্রাম্পের

 

১৬০৫ সালে পোলিশরা আক্রমণ চালিয়েছিল এই পথ ধরে। এর পরে আসে সুইডিশরা। ১৮১২ সালে নেপোলিয়নের নেতৃত্বে হামলা চালায় ফরাসীরা। জার্মানরা রাশিয়ায় অভিযান চালিয়েছে দু’বার ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় আবার ১৯৪১ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে।

১৮১২ সালে নেপোলিয়নের সময় হতে হিসেব করলে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত গড়ে প্রতি ৩৩ বছরে রাশিয়াকে উত্তর ইউরোপের সমতলভূমিতে একবার করে যুদ্ধ করতে হয়েছে। কাজেই রাশিয়ার ধারণা তাদের দেশের জন্য কোন নিরাপত্তা হুমকি যদি থেকে থাকে, সেটি এই পথেই আসবে।

১৯৯০ এর দশকের শুরুতে সোভিয়েত ইউনিয়ন যে ভেঙে গিয়েছিল সেটিকে প্রেসিডেন্ট পুতিন রাশিয়ার জন্য এক ভূ-রাজনৈতিক বিপর্যয় বলে মনে করেন। এরপর হতে রাশিয়া কেবল উদ্বেগের সঙ্গে দেখছে কীভাবে ধীরে ধীরে সামরিক জোট ন্যাটো চারদিক থেকে তাদের ঘিরে ফেলছে। ১৯৯৯ সালে চেক প্রজাতন্ত্র হাঙ্গেরি এবং পোল্যান্ড যোগ দিল ন্যাটোতে। ২০০৪ সালে তাদের পথ অনুসরণ করলো বুলগেরিয়া, এস্তোনিয়া, লাতভিয়া, লিথুয়েনিয়া,রোমানিয়া এবং স্লোভাকিয়া। ২০০৯ সালে যোগ দিল আলবেনিয়া। এই দেশগুলো এক সময় হয় ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ অথবা ওয়ারশ সামরিক জোটের সদস্য।

জর্জিয়া মলদোভা বা ইউক্রেনও পারলে ন্যাটো বা ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগ দেয় কিন্তু এখনও পর্যন্ত রাশিয়ার কারণেই তাদের যোগ দেওয়া হয়নি। কারণ এই তিনটি দেশেই রুশপন্থী মিলিশিয়াদের শক্ত অবস্থান আছে। এই দেশগুলোর যে কোন একটি যদি ন্যাটোতে যোগ দেয়, তা রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধের স্ফুলিঙ্গ হিসেবে কাজ করতে পারে।

টিম মার্শাল লিখেছেন গত শতকে স্নায়ুযুদ্ধের দিনগুলোতে কে ভাবতে পেরেছিল মস্কো হতে মাত্র কয়েকশো মাইল দূরে পোল্যান্ডের মাটিতে বা বাল্টিক দেশগুলোতে মার্কিন সেনা মোতায়েন করা থাকবে? তার মতে ইউক্রেনের ন্যাটোতে যোগ দেওয়া মানে যুক্তরাষ্ট্র বা ন্যাটোর সামরিক বাহিনী যেন একেবারে রাশিয়ার পেটের ভেতরে এসে অবস্থান নিল। নিজের দোরগোড়ায় প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী যুক্তরাষ্ট্র এবং তাদের মিত্র পশ্চিমা দেশগুলোর সামরিক উপস্থিতিকে রাশিয়া সঙ্গত কারণেই এক বিরাট নিরাপত্তা হুমকি হিসেবে বিবেচনা করে।

 

ইউক্রেন সংকটে রাশিয়ার গ্যাস কেন বড় ইস্যু?

 

পরমাণু অস্ত্রের কথা বাদ দিলে রাশিয়ার হাতে সবচেয়ে শক্তিশালী অস্ত্র কিন্তু তার সেনাবাহিনী বা বিমান বাহিনী নয়। রাশিয়ার সবচেয়ে শক্তিশালী অস্ত্র তার জ্বালানি। ইউরোপের মোট তেল এবং গ্যাস সরবরাহের ২৫ শতাংশ আসে রাশিয়া থেকে। লাতভিয়া, স্লোভাকিয়া, ফিনল্যান্ড এবং এস্তোনিয়ার মতো দেশগুলো রাশিয়ার জ্বালানির ওপর একশো ভাগ নির্ভরশীল।

জার্মানির প্রায় অর্ধেক গ্যাস সরবরাহ আসে রাশিয়া থেকে। জার্মানির রাজনীতিকরা কেন রাশিয়ার সমালোচনায় ততটা সরব নয়, এ তথ্য থেকেই তা বোঝা যায়। আর ইউরোপে গ্যাস সরবরাহের ক্ষেত্রে ইউক্রেন হচ্ছে রাশিয়ার প্রবেশ দ্বার। রাশিয়া থেকে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে প্রধান গ্যাস পাইপ লাইনগুলো গেছে ইউক্রেনের ভেতর দিয়ে। রাশিয়ার প্রায় ৪০ শতাংশ গ্যাসের সরবরাহ যায় এই পাইপলাইন দিয়ে।

কাজেই ইউক্রেন যদি রাশিয়ার প্রভাব বলয়ের বাইরে চলে যায়, তাহলে গ্যাস সরবরাহের ক্ষেত্রে রাশিয়া তার একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ হাতছাড়া হতে পারে বলে আশংকা করে। তবে ইউক্রেনকে পাশ কাটিয়ে রাশিয়া বাল্টিক সাগরের নীচ দিয়ে জার্মানি পর্যন্ত নর্ড স্ট্রিম নামে নতুন একটি গ্যাস পাইপলাইন বসিয়েছে। কিন্তু রাশিয়া যদি ইউক্রেনে অভিযান চালায়, তাহলে এই নর্ড স্ট্রিম২ গ্যাস পাইপলাইন প্রকল্প আর সামনে এগোবে না বলে এরই মধ্যে হুঁশিয়ারি দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।

ইউরোপ যেভাবে রাশিয়ার গ্যাসের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে, তাতে করে রাশিয়া অন্যান্য দেশগুলোর ওপর রাজনৈতিক চাপ প্রয়োগের সুযোগ পেয়ে যাবে বলে আশংকা করে যুক্তরাষ্ট্র। তারা মনে করে, রাশিয়া চাইলে যে কোন সময় এসব গ্যাস পাইপলাইন দিয়ে সরবরাহ বন্ধ করে দিতে পারে, সামনের দিনগুলোতে এই জ্বালানিকে একটা রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে বার বার ব্যবহার করতে পারে।

 

ইউক্রেন প্রশ্ন ন্যাটো কি ঐক্যবদ্ধ?

 

প্রেসিডেন্ট বাইডেন বলেছেন ইউক্রেন প্রশ্নে ইউরোপীয় নেতারা সবাই একমত। তবে বিভিন্ন দেশ যে ধরণের সমর্থন দেবে বলে কথা দিচ্ছে তার মধ্যে পার্থক্য আছে। যুক্তরাষ্ট্র জানিয়েছে, তারা ইউক্রেনে ৭০ টনের মতো ‘মারণঘাতী সামরিক সরঞ্জাম’ পাঠিয়েছে যাতে রণাঙ্গনের সামনের কাতারে প্রতিরোধ তৈরি করা যায়। যুক্তরাজ্য স্বল্পমাত্রার ট্যাংকবিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র দিচ্ছে ইউক্রেনকে। কিছু ন্যাটো দেশ যেমন ডেনমার্ক স্পেন ফ্রান্স এবং নেদারল্যান্ডস তাদের যুদ্ধবিমান এবং যুদ্ধজাহাজ পূর্ব ইউরোপে পাঠাচ্ছে সেখানকার প্রতিরক্ষাকে জোরালো করতে।

তবে জার্মানি ইউক্রেনের অনুরোধ সত্ত্বেও কোন অস্ত্রশস্ত্র দিতে অস্বীকৃতি করেছে। কারণ দেশটির নীতিই হচ্ছে কোন সংঘাতপূর্ণ এলাকায় কোন প্রাণঘাতী অস্ত্র না পাঠানো। পরিবর্তে জার্মানি মেডিক্যাল ত্রাণ পাঠাবে। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ম্যাক্র অবশ্য উত্তেজনা প্রশমনের জন্য রাশিয়ার সঙ্গে আলোচনা চালানোর আহ্বান জানিয়েছেন।

 

রাশিয়ার বিরুদ্ধে পশ্চিমা দেশগুলো কী ব্যবস্থা নিতে পারে?

পশ্চিমা দেশগুলো মূলত মারাত্মক অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপের কথাই বলছে, যদিও তারা খোলাখুলি স্পষ্ট করে বলছে না এই নিষেধাজ্ঞা ঠিক কেমন হবে। যে একটি ব্যবস্থা নেওয়া হতে পারে বলে শোনা যাচ্ছে সেটি হল একটি আন্তর্জাতিক আর্থিক বার্তা লেনদেন সার্ভিস ‘সুইফট’ থেকে রাশিয়াকে বাইরে রাখা। বিশ্বে দুশোর বেশি দেশের ব্যাংক এবং আর্থিক সেবা প্রতিষ্ঠানগুলো এটি ব্যবহার করে।

ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন বলেছেন, এটি একটি মারাত্মক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। এর ফলে রাশিয়ার ব্যাংকগুলোর পক্ষে কোন ধরণের আন্তর্জাতিক লেনদেন চালানো কঠিন হয়ে পড়বে। ২০১২ সালে এটি ইরানের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হয়েছিল। তবে এরকম নিষেধাজ্ঞায় উল্টো ফলও হতে পারে কারণ যুক্তরাষ্ট্র এবং জার্মান ব্যাংকগুলোর খুব ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে রাশিয়ার আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে।

যুক্তরাষ্ট্র চাইলে রাশিয়াকে আর্থিক লেনদেনের ক্ষেত্রে ডলার ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা দিতে পারে। এর মানে দাঁড়াবে রাশিয়ার আন্তর্জাতিক বাণিজ্য একেবারে সীমিত হয়ে পড়বে। এর বিরাট প্রভাব পড়তে পারে রুশ অর্থনীতিতে। আন্তর্জাতিক ঋণ বাজার থেকে যাতে রাশিয়া ঋণ করতে না পারে,  সেরকম নিষেধাজ্ঞাও দিতে পারে। নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হতে পারে প্রেসিডেন্ট পুতিন এবং তাঁর ঘনিষ্ঠজনদের বিরুদ্ধে। পশ্চিম ইউরোপে রাশিয়া যে জ্বালানি বিক্রি করে, সেটি বন্ধ করার কথাও আলোচনায় আসছে। কিন্তু এর কোন বিকল্প এখনও পর্যন্ত জার্মানি বা অন্যদেশগুলোর নেই। তবে পশ্চিমা দেশগুলোর নিজেদের মধ্যেই আসলে মতবিরোধ রয়েছে যে তারা রাশিয়াকে শাস্তি দিতে কতদূর পর্যন্ত যাবে।