ফিলিস্তিন ও ইসরাইলের সংঘাত কেন?

- আপডেট : ১৫ অক্টোবর ২০২৩, রবিবার
- / 45
১৯৪৮ সালে যায়নবাদী ইসরাইল রাষ্ট্র গঠনের পরপরই ফিলিস্তিনি গ্রাম ও শহরগুলি ধ্বংস করতে উঠে পড়ে লাগে। যায়নবাদী রাষ্ট্রের সীমানা বাড়াতেই ছিল তাঁদের অভিযান। ১৯৪৮ সালের এপ্রিলে জেরুসালেমের উপকণ্ঠে দেইর ইয়াসিন গ্রামে ১০০ জনের বেশি ফিলিস্তিনি নারী, শিশুকে হত্যা করা হয়। এই হত্যাযজ্ঞই তাঁদের অভিযানের চরিত্র নির্ধারণ করে দেয়। ফিলিস্তিনিরা একে ‘নাকবা’ বা ‘বিপর্যয়’ বলে অভিহিত করেছে। তাঁদের জীবনই কাটে আক্রমণের ভয়ে। নিজ ভূমি থেকে তাদেরকে বিতাড়নের ইতিহাস কেউ বলে না। এ-নিয়ে পুবের কলম-এর বিশেষ প্রতিবেদন।
ইসরাইল- ফিলিস্তিন সংঘর্ষে হাজার হাজার মানুষের প্রাণহানি হয়েছে এবং কয়েক লক্ষ মানুষ ঘরছাড়া হয়েছেন। এই সংঘাতের শিকড় রয়েছে ঔপনিবেশিক ক্রিয়াকলাপের মধ্যে যা প্রায় এক শতক আগে শুরু হয়েছিল। ফিলিস্তিনের হামাস গোষ্ঠী শনিবার আকস্মিকভাবে হামলা চালানোর পর ইসরাইল গাজা স্ট্রিপে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। পরবর্তীতে কী হতে পারে সেদিকে গোটা বিশ্বের তীক্ষ্ণ নজর। হামাস যোদ্ধারা ৮০০-র বেশি ইসরাইলিকে হত্যা করেছে দক্ষিণ ইসরাইলের বিভিন্ন শহরে। এর জবাবে ইসরাইল গাজা স্ট্রিপে লাগাতার বোমাবর্ষণ শুরু করেছে এবং ৫০০-র বেশি ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে।
তবে আগামী দিনগুলিতে কী হতে চলেছে তার বীজ রয়েছে ইতিহাসের পাতায়। বহু দশক ধরে পশ্চিমা সংবাদ সংস্থা, শিক্ষাবিদ,সামরিক বিশেষজ্ঞ ও বিশ্বনেতারা ইসরাইল-ফিলিস্তিন দ্বন্দ্বকে জটিল ও সমাধান অযোগ্য বলে অভিহিত করেছেন। বিশ্বের অন্যতম দীর্ঘমেয়াদি সংঘাতকে বুঝতে একটি সহজ সহায়িকা দেওয়া হল।
বেলফোর ঘোষণাপত্র কী?
১০০ বছরেরও আগে, ১৯১৭ সালের ২ নভেম্বরে ব্রিটেনের তৎকালীন পররাষ্ট্র বিষয়ক সেক্রেটারি আর্থার বেলফোর ব্রিটিশ ইহুদি সম্প্রদায়ের নেতা লিওনেল ওয়াল্টার রথসচাইল্ডকে একটি চিঠি লেখেন। চিঠিটি ছিল ছোট্ট। মাত্র ৬৭ শধের। তবে, সেই চিঠির প্রভাব আজও ফিলিস্তিনে টের পাওয়া যায়।ইহুদিদের জন্য ফিলিস্তিনে ‘জাতীয় আবাসভূমি’ নির্মাণের জন্য ব্রিটিশ সরকার যে দায়বদ্ধ, তা বলা হয় এই চিঠিতে। এই লক্ষ্য পূরণে সমস্ত সহযোগিতা করার কথাও বলা হয়। এই চিঠিই বেলফোর ঘোষণাপত্র নামে পরিচিত। সংক্ষেপে বললে, ইউরোপীয় শক্তি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যে, যায়নবাদী আন্দোলনকারীদের একটি দেশ দেওয়া হবে সেই জায়গায় যেখানে ফিলিস্তিনি ও আরব জনজাতি জনসংখ্যার ৯০ শতাংশের বেশি দখল করে রয়েছে।
১৯২৩ সালে একটি ব্রিটিশ আদেশপত্র তৈরি করা হয় যেটি ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত বহাল ছিল। এই সময়কালে গণহারে ইহুদি অভিবাসনে সাহায্য করেছিল ব্রিটিশরা। অনেকে ইউরোপে নাৎসিবাদের ভয়ে পালিয়ে এসেছিল নতুন ভূমিতে। সেই সময় তারা প্রতিরোধ ও বিক্ষোভের মুখে পড়ে। ফিলিস্তিনিরা আতঙ্কিত হয়ে উঠেছিলেন, কেননা তাদের দেশের জনবিন্যাস বদলে যাচ্ছিল। ব্রিটিশরা তাদের ভূমি কেড়ে নিয়ে ইহুদি বসতিস্থাপনকারীদের হাতে তুলে দিয়েছিল।
১৯৩০-এর দশকে কী ঘটল?
এই অঞ্চলে উত্তেজনা বৃদ্ধি পায় এবং অবশেষে আরব বিদ্রোহ শুরু হয়। এই বিদ্রোহ ১৯৩৬ থেকে ১৯৩৯ সাল পর্যন্ত চলেছিল।১৯৩৬ সালের এপ্রিলে নতুন গঠিত আরব ন্যাশনাল কমিটি ফিলিস্তিনিদের ধর্মঘট করতে আহ্বান জানায়। কর দিতে নিষেধ করে এবং ইহুদি পণ্য বয়কট করতে বলে। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতাবাদ ও ক্রমবর্ধমান ইহুদি অভিবাসনের প্রতিবাদে এগুলি করতে বলা হয়েছিল। ছয় মাস ধরে চলা ধর্মঘটকে নৃশংস ভাবে দমন করে ব্রিটিশরা। তারা গণহারে গ্রেফতারি কর্মসূচি নেয় এবং ফিলিস্তিনিদের বাড়িঘর ভেঙে দিতে শুরু করে। ইসরাইল আজও এই পদ্ধতি ফিলিস্তিনিদের উপর জারি রেখেছে। ১৯৩৭ সালের শেষভাগে বিদ্রোহের দ্বিতীয় পর্ব শুরু হয়। ফিলিস্তিনের কৃষকরাই এর নেতৃত্ব দেন। তারা ব্রিটিশ বাহিনী ও ঔপনিবেশিকতাবাদকে নিশানা করে। ১৯৩৯ সালের দ্বিতীয় ভাগে ব্রিটিশরা ৩০ হাজার সেনা জড়ো করে ফিলিস্তিনে। গ্রামের পর গ্রাম বোমা মেরে উড়িয়ে দেওয়া হয়। কারফিউ জারি করা করা হয়। বাড়িঘর ধ্বংস করে দেওয়া হয়। নিরপরাধ ফিলিস্তিনিদের প্রশাসনিকভাবে আটক করা হতে থাকে এবং ব্যাপক হারে হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়।
ইহুদি বসতিস্থাপনকারী গোষ্ঠীর সঙ্গে হাত মেলায় ব্রিটিশরা এবং গঠন করে সশস্ত্র বাহিনী। ব্রিটিশের নেতৃত্বে তৈরি হয় ‘বিদ্রোহ-বিরোধী বাহিনী’। এই বাহিনীতে ছিল ইহুদি জঙ্গিরা। এর নাম দেওয়া হয় ‘বিশেষ নৈশকালীন স্কোয়াড’। প্রাক্-রাষ্ট্র বসতিস্থাপনকারী সম্প্রদায় ইশুভের মধ্যে গোপনে অস্ত্র আমদানি করা হতে থাকে। ইহুদি আধাসামরিক বাহিনী হাগানাকে আরও বাড়াতে অস্ত্র কারখানা স্থাপন করা হয়। এটাই পরে ইসরাইলি সেনার মূল কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল। বিদ্রোহের ওই তিন বছরে ৫ হাজার ফিলিস্তিনিকে হত্যা করা হয়েছিল। ১৫ থেকে ২০ হাজার ফিলিস্তিনি আহত হয়েছিলেন এবং ৫৬০০ জনকে বন্দি করা হয়েছিল।
রাষ্ট্রসংঘের দেশভাগ পরিকল্পনা কী ছিল?
১৯৪৭ সালের মধ্যে ইহুদি জনসংখ্যা বেলুনের মতো ফুলে-ফেঁপে উঠতে থাকে। ফিলিস্তিনের জনসংখ্যার ৩৩ শতাংশই তখন ইহুদি। তবে মোট ভূমির মাত্র ৬ শতাংশ ছিল তাদের হাতে। রাষ্ট্রসংঘ ‘প্রস্তাব ১৮১’ গ্রহণ করে। এই প্রস্তাবে ফিলিস্তিনকে আরব ও ইহুদি রাষ্ট্রে ভাগ করার কথা বলা হয়। ফিলিস্তিনিরা এই পরিকল্পনাকে অস্বীকার করে কেননা এই প্রস্তাবে ফিলিস্তিনের ৫৬ শতাংশ বরাদ্দ করা হয় ইহুদি রাষ্ট্রকে। এর মধ্যে ছিল উপকূলের সবচেয়ে উর্বর ভূমিও। সেই সময় ফিলিস্তিনিরা ঐতিহাসিক ফিলিস্তিনের ৯৪ শতাংশের মালিক ছিল এবং জনসংখ্যার ৬৭ শতাংশ জুড়ে ছিল তারা।
১৯৪৮ সালের নাকবা বা ফিলিস্তিনিদের সাফাই অভিযান
১৯৪৮ সালের ১৪ মে-তে ব্রিটিশ আদেশপত্রের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই যায়নবাদী আধা-সামরিক বাহিনী সামরিক অভিযান শুরু করে দেয়। ফিলিস্তিনি গ্রাম ও শহরগুলি ধ্বংস করতে উঠে পড়ে লাগে। যায়নবাদী রাষ্ট্রের সীমানা বাড়াতেই তাদের এই অভিযান। ১৯৪৮ সালের এপ্রিলে জেরুসালেমের উপকণ্ঠে দেইর ইয়াসিন গ্রামে ১০০ জনের বেশি ফিলিস্তিনি নারী, শিশুকে হত্যা করা হয়। এই হত্যাযজ্ঞই তাদের অভিযানের চরিত্র নির্ধারণ করে দেয়। ১৯৪৭ থেকে ১৯৪৯ সালে ৫০০-র বেশি ফিলিস্তিনি গ্রাম ও শহর ধ্বংস করে দেওয়া হয়। ফিলিস্তিনিরা একে ‘নাকবা’ বা ‘বিপর্যয়’ বলে অভিহিত করেছে। আনুমানিক ১৫ হাজার ফিলিস্তিনিকে হত্যা করা হয়েছিল। কয়েক ডজন ম্যাসাকার চালানো হয়। যায়নবাদী আন্দোলন ঐতিহাসিক ফিলিস্তিনের ৭৮ শতাংশ দখল করে নেয়। বাকি ২২ শতাংশ দুই ভাগে ভাগ করা হয়-বর্তমানে যা অধিগৃহীত ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক ও অবরুদ্ধ গাজা স্ট্রিপ। আনুমানিক ৭৫০০০০ ফিলিস্তিনিকে জোর করে ঘরছাড়া করে দেওয়া হয়েছিল। বর্তমানে তাদের বংশধররা ফিলিস্তিন জুড়ে ৫৮টি দুর্বিষহ শিবিরে শরণার্থী হয়ে জীবন-যাপন করছে। এদের সংখ্যা ছয় মিলিয়ন। অনেকে প্রতিবেশী দেশ লেবানন, সিরিয়া, জর্ডন ও মিশরে চলে গেছে। ১৯৪৮ সালের ১৫ মে ইসরাইল তাদের প্রতিষ্ঠার কথা ঘোষণা করে।
এর পরদিনই প্রথম আরব-ইসরাইলি যুদ্ধের সূচনা হয়। ১৯৪৯ সালের জানুয়ারি মাসে এই লড়াই শেষ হয়। ইসরাইল এবং মিশর, লেবানন, জর্ডন ও সিরিয়ার মধ্যে যুদ্ধ-বিরতি ঘোষণা করা হয়। ১৯৪৮ সালের ডিসেম্বরে রাষ্ট্রসংঘের সাধারণ পরিষদ ‘প্রস্তাব ১৯৪’ পাশ করে। এতে বলা হয়, ফিলিস্তিনি উদ্বাস্তুদের ফিরে আসার অধিকার রয়েছে।
নাকবা-পরবর্তী কয়েক বছর
নব্য প্রতিষ্ঠিত ইসরাইলে অন্তত ১ লক্ষ ৫০ হাজার ফিলিস্তিনি রয়ে গিয়েছিল। প্রায় ২০ বছর ধরে কঠোর সেনা নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে তারা জীবন কাটায়। এরপর তাদের ইসরাইলি নাগরিকত্ব দেওয়া হয়। মিশর গাজা স্ট্রিপের দখল নেয় এবং ১৯৫০ সালে ওয়েস্ট ব্যাঙ্কের উপর প্রশাসনিক শাসন চালাতে শুরু করে জর্ডন। ১৯৬৪ সালে ফিলিস্তিনি লিবারেশন অর্গানাইজেশন বা পিএলও গঠিত হয়। এরও এক বছর পর রাজনৈতিক দল ‘ফাতাহ’ প্রতিষ্ঠিত হয়।
নাকসা বা ছয়দিনব্যাপী যুদ্ধ ও বসতি
১৯৬৭ সালের ৫ জুন ইসরাইল দখল করে নেয় ঐতিহাসিক ফিলিস্তিনের বাকি অংশ। এর মধ্যে ছিল গাজা স্ট্রিপ, পশ্চিম তীর, পূর্ব জেরুসালেম, সিরীয় গোলান হাইটস ও মিশরীয় সিনাই উপদ্বীপ। আরব সেনা জোটের সঙ্গে ছয়দিনব্যাপী যুদ্ধে ইসরাইল এই সব অঞ্চল অধিগ্রহণ করে। কিছু ফিলিস্তিনির কাছে এটা ছিল নাকসা, যার অর্থ ‘আঘাত’। তারা বাস্তুহারা হতে বাধ্য হয়।
১৯৬৭ সালের ডিসেম্বরে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার জন্য মার্কসবাদী-লেনিনবাদী পপুলার ফ্রন্ট গঠিত হয়। পরের কয়েক দশক ধরে বামপন্থী এই গোষ্ঠী বেশ কয়েকবার হামলা চালায়, বিমান অপহরণ করে। এর ফলে বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করে দুর্দশাগ্রস্ত ফিলিস্তিনিরা।
অধিগৃহীত পশ্চিম তীর ও গাজা স্ট্রিপে বসতি স্থাপনের জন্য নির্মাণ কাজ শুরু হয়। দুই স্তরীয় ব্যবস্থা চালু করা হয়। ইসরাইলের নাগরিক হওয়ার কারণে ইহুদি বসতিস্থাপনকারীরা সমস্ত অধিকার ও সুবিধা ভোগ করে এবং ফিলিস্তিনিরা কঠোর সামরিক চাপের মধ্যে জীবন অতিবাহিত করতে থাকে। তাদের কোনও রাজনৈতিক অধিকার ছিল না। ছিল না নাগরিক মত প্রকাশের স্বাধীনতা। তাদের সঙ্গে বৈষম্যমূলক আচরণ করা হত।
প্রথম ইন্তিফাদা ১৯৮৭-১৯৯৩
১৯৮৭ সালের ডিসেম্বরে চারজন ফিলিস্তিনিকে হত্যার প্রতিবাদে গাজা স্ট্রিপে প্রথম ফিলিস্তিনি ইন্তিফাদা শুরু হয়। এই বিক্ষোভ দ্রুত পশ্চিম তীরে ছড়িয়ে পড়ে। তরুণ ফিলিস্তিনিরা ইসরাইলি সামরিক ট্যাঙ্ক ও সেনাদের দিকে পাথর ছুঁড়তে শুরু করে।হামাস আন্দোলনেরও সূচনা হয় এর ফলে। ইসরাইলি অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধের পথ বেছে নেয় এই গোষ্ঠী।
ইসরাইলি সেনা কড়া হাতে এই বিক্ষোভ দমন করতে লেগে পড়ে। তারা ‘হাড় ভেঙে দাও’ নীতি নেয়। এই নীতির হয়ে ওকালতি করে তৎকালীন ইসরাইলি প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়াঝাক রবিন। এর ফলে অনেককে হত্যা করা হয়, বিশ্ববিদ্যালয়গুলি বন্ধ হয়ে যায়, সমাজকর্মীদের নির্বাসন দেওয়া হয় এবং বাড়িঘর ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়।
এই ইন্তিফাদা প্রাথমিক ভাবে পরিচালনা করেছিল তরুণ ফিলিস্তিনিরা। তাদের নির্দেশনা দিত ইউনিফায়েড ন্যাশনাল লিডারশিপ অফ দ্য আপস্প্রিং। ফিলিস্তিনের এই রাজনৈতিক জোটের লক্ষ্য ছিল ইসরাইলি অধিগ্রহণ বন্ধ করা এবং স্বাধীন ফিলিস্তিন প্রতিষ্ঠা করা। ১৯৮৮ সালে আরব লিগ পিএলও-কে স্বীকৃতি দেয়। ফিলিস্তিনের মানুষের একমাত্র প্রতিনিধি হিসেবে স্বীকৃতি পায় পিএলও। ইন্তিফাদার বৈশিষ্ট্য ছিল সর্বসাধারণের সক্রিয়তা, গণ-বিক্ষোভ, আইন অমান্য, সুসংগঠিত ধর্মঘট ও সাম্প্রদায়িক সমন্বয়। ইসরাইলি মানবাধিকার সংগঠন বি’টিসেলেমের বক্তব্য অনুযায়ী, এই ইন্তিফাদার সময় ইসরাইলি বাহিনী ১০৭০ জন ফিলিস্তিনিকে হত্যা করে। এদের মধ্যে ছিল ২৩৭ জন শিশু। ১ লক্ষ ৭৫ হাজার ফিলিস্তিনিকে গ্রেফতার করা হয়। এই ইন্তিফাদার ফলে আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীগুলি নড়েচড়ে বসে। এই দ্বন্দ্বের একটা সমাধান-সূত্র বের করার জন্য তারা দ্রুত পথ খুঁজতে শুরু করে।
অসলো চুক্তি ও ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ
১৯৯৩ সালে অসলো চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে প্রথম ইন্তিফাদা শেষ হয়। গঠিত হয় ফিলিস্তিনি অথরিটি বা পিএ। এটা ছিল এক অন্তর্র্বতী সরকার। অধিগৃহীত পশ্চিম তীর ও গাজা স্ট্রিপের কিছু অংশে স্ব-শাসনের কিছু সীমাবদ্ধ ক্ষমতা দেওয়া হয়েছিল এই সরকারকে।
দ্বি-রাষ্ট্রের সমাধানের ভিত্তিতে পিএলও স্বীকৃতি দেয় ইসরাইলকে এবং কার্যকরীভাবে চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। এর ফলে পশ্চিম তীর, এই অঞ্চলের ভূমি ও জলসম্পদের ৬০ শতাংশের উপর নিয়ন্ত্রণ লাভ করে ইসরাইল। প্রথম নির্বাচিত ফিলিস্তিনি সরকার গঠনের পথ প্রশস্ত করার কথা ছিল ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের। এই সরকার পশ্চিম তীর ও গাজা স্ট্রিপে স্বাধীনভাবে শাসন করবে এবং তাদের রাজধানী হবে পূর্ব জেরুসালেম। কিন্তু এ আর কখনও হয়ে ওঠেনি। ১৯৯৫ সালে গাজা স্ট্রিপের চারধারে ইসরাইল বৈদ্যুতিন কাঁটাতার ও কংক্রিটের দেওয়াল তুলে দেয়। বিভক্ত ফিলিস্তিন অঞ্চলের মধ্যে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়।এরপর শুরু হয় দ্বিতীয় ইন্তিফাদা।
দ্বিতীয় ইন্তিফাদা
২০০০ সালের ২৮ সেপ্টেম্বরে শুরু হয় দ্বিতীয় ইন্তিফাদা। ইসরাইলের বিরোধী দল লিকুদের নেতা এরিয়েল শ্যারন উস্কানি দিতে আল আকসা মসজিদে যান এবং প্রাচীন শহর জেরুসালেমের বাইরে ও ভেতরে হাজার হাজার নিরাপত্তা বাহিনী মোতায়েন করা হয়। এর ফলে সূচনা হয় দ্বিতীয় ইন্তিফাদার। ফিলিস্তিনি বিক্ষোভকারী ও ইসরাইলি বাহিনীর মধ্যে সংঘর্ষে দুই দিনের মধ্যে পাঁচজন ফিলিস্তিনি নিহত হন এবং ২০০ জন আহত হন। এই ঘটনা ব্যাপক সশস্ত্র বিদ্রোহের জন্ম দেয়। ইন্তিফাদার সময় ফিলিস্তিনের অর্থনীতি ও পরিকাঠামোকে অভূতপূর্বভাবে ক্ষতি করে ইসরাইল। ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের শাসিত এলাকা দখল করে ইসরাইল এবং বিভাজন-দেওয়াল নির্মাণ করতে শুরু করে তারা। সেইসঙ্গে যথেচ্ছে বসতি তৈরি করা হয়। ফিলিস্তিনিদের জীবন-জীবিকা ধ্বংস করে দেওয়া হয়।
আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী- এই বসতি অবৈধ, কিন্তু বছরের পর বছর ধরে হাজার হাজার ইহুদি বসতিস্থাপনকারীরা ফিলিস্তিনের কাছ থেকে চুরি করা জমিতে কলোনি গড়ে তোলে। এর ফলে ফিলিস্তিনিদের পরিসর সংকুচিত হয়ে আসতে থাকে। কেবলমাত্র বসতিস্থাপনকারীদের জন্য রাস্তা ও পরিকাঠামো পশ্চিম তীরকে বিভক্ত করে ফেলে।
অসলো চুক্তি স্বাক্ষরের সময় পূর্ব জেরুসালেম-সহ পশ্চিম তীরে ১লক্ষ ১০ হাজার ইহুদি বসবাস করত। বর্তমানে এই সংখ্যা ৭ লক্ষ-র বেশি। ফিলিস্তিনের কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া ১ লক্ষ হেক্টর (৩৯০ বর্গ মাইল) জমিতে তারা আস্তানা তৈরি করেছে।
ফিলিস্তিন বিভাজন ও গাজা অবরোধ
পিএলও নেতা ইয়াসির আরাফাত প্রয়াত হন ২০০৪ সালে। এর এক বছর পর দ্বিতীয় ইন্তিফাদা সমাপ্ত হয়। গাজা স্ট্রিপে ইসরাইলি বসতি নির্মাণ বানচাল হয়ে যায় এবং ইসরাইলি সেনাবাহিনী ও ৯ হাজার বসতিস্থাপনকারী ছিটমহল ছেড়ে চলে যায়।
এক বছর পর প্রথমবার ফিলিস্তিনিরা সাধারণ নির্বাচনে ভোট দেয়। হামাস সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। ফাতাহ-হামাস গৃহযুদ্ধ শুরু হয় এবং কয়েক মাস ধরে এই লড়াই চলে। এর ফলে কয়েকশো ফিলিস্তিনির মৃত্যু হয়। গাজা স্ট্রিপ থেকে ফাতাহ-কে বিতাড়িত করে হামাস। ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের প্রধান দল ফাতাহ পশ্চিম তীরের নিয়ন্ত্রণ পুনরায় দখল করে। ২০০৭ সালের জুন মাসে হামাসের ‘সন্ত্রাসবাদে’র অভিযোগে গাজা স্ট্রিপে স্থল-জল-আকাশপথে অবরোধ আরোপ করে ইসরাইল।
গাজা স্ট্রিপে যুদ্ধ
ইসরাইল চারবার প্রলম্বিত সামরিক হামলা চালায় গাজায়। ২০০৮, ২০১২, ২০১৪ ও ২০২১ সালে। অসংখ্য শিশুসহ হাজার হাজার ফিলিস্তিনিকে হত্যা করা হয়। কয়েক হাজার বাড়িঘর, স্কুল, অফিস ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়।
এগুলি পুনরায় নির্মাণ করা প্রায় অসম্ভব কারণ অবরোধের জন্য নির্মাণ কাজে প্রয়োজনীয় সামগ্রী যেমন লোহা, সিমেন্ট ইত্যাদি গাজায় প্রবেশ করতে দেওয়া হচ্ছে না। ২০০৮ সালের হামলায় ইসরাইল আন্তর্জাতিকভাবে নিষিদ্ধ অস্ত্র ব্যবহার করে। এই অস্ত্র হল ফসফরাস গ্যাস। ২০১৪ সালে ৫০ দিনের মধ্যে ইসরাইল ২১০০ জনের বেশি ফিলিস্তিনিকে হত্যা করে। এর মধ্যে ছিল ১৪৬২ জন বেসামরিক নাগরিক ও প্রায় ৫০০ জন শিশু।
ইসরাইল এই হামলার নাম দেয় ‘অপারেশন প্রটেক্টিভ এজ’। প্রায় ১১ হাজার ফিলিস্তিনি আহত হন। ২০ হাজার বাড়িঘর ধ্বংস করে দেওয়া হয় এবং প্রায় ৫ লক্ষ ফিলিস্তিনি বাস্তুচ্যুত হয়ে পড়েন।