০১ মে ২০২৫, বৃহস্পতিবার, ১৮ বৈশাখ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

১৯৯২-এর জয়ী কাপ্তানের কামব্যাক চাইছে পাকিস্তান!, একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনে ব্যর্থ নওয়াজরা

কিবরিয়া আনসারি
  • আপডেট : ১১ ফেব্রুয়ারী ২০২৪, রবিবার
  • / 11

ইসলামাবাদ, ১০ ফেব্রুয়ারি: পাকিস্তানের নির্বাচনী ফলাফল দেখে ১৯৯২ সালের ক্রিকেট বিশ্বকাপের কথা মনে পড়ে গেল। একটি ধরাশায়ী দলকে স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন ‘কাপ্তান’ ইমরান খান। তিনি তখন তরুণ। দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই করে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে পাকিস্তানকে এনে দিয়েছিলেন প্রথম বিশ্বকাপ। তারপর ৩২ বছর কেটে গেছে। রাজনীতির ময়দানে নেমে দেশের ‘কাপ্তানি’ও করে ফেলেছেন ইমরান। কিন্তু সেই লড়াইটা থামেনি। এক অদম্য তেজ, সাহসী পদক্ষেপ। সেনাবাহিনী নওয়াজ শরীফদের সুবিধা করে দিতে জেলে ভরে রেখেছে ইমরানকে। তাঁর দল পিটিআইয়ের প্রতীক ‘ব্যাট’ও কেড়ে নেওয়া হয়েছে। এই নির্বাচনে স্বতন্ত্রভাবে লড়েছেন পিটিআই প্রার্থীরা। গুরুত্বপূর্ণ নেতারা জেলে বন্দি। জেলে বসেই এআইয়ের মাধ্যমে ভাষণ দিয়েছেন ইমরান খান। দেশের জনতাকে রুখে দাঁড়ানোর শক্তি জুগিয়েছেন। ফলত জনগণ ১০০-র বেশি আসনে জিতিয়েছে ইমরান-সমর্থিত প্রার্থীদের। তারাই চালকের আসনে। তবে নওয়াজের মুসলিম লিগ ও বিলাওয়ালের পিপিপি জোট সরকার গড়ে ইমরানের জয়যাত্রা রুখতে চাইছে। এমনকি এতে সাথ দিচ্ছে সেনাবাহিনীও। পিটিআই সমর্থকরা রাস্তায় নেমে উল্লাস প্রকাশ করছে। এসব সহ্য হচ্ছে না বিরোধী পক্ষের। বহু জায়গায় ‘রিগিং’ করে, পিটিআই কর্মীদের মারধর করে হারিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছে। চেষ্টা হচ্ছে যাতে ফলাফল ঘোষণার শেষ পর্যন্ত কোনওভাবেই ইমরানের দল ম্যাজিক ফিগারে (১৩৩) না পৌঁছাতে পারে। এটা রুখতে পারলেই ফের সেনা-সমর্থিত ‘পুতুল’ সরকার বসবে পাকিস্তানের মসনদে। তবে পাক-জনতা যে ইমরানকেই চায়, সেটা ভোটের ফলাফলেই স্পষ্ট। ইমরানের বিশ্বস্ত সঙ্গী, যারা দুর্দিনেও তাকে ছেড়ে যায়নি, তারা এই নির্বাচনে বড় জয় পেয়েছে।

 

অন্যদিকে যারা সরকারি চাপে পিটিআই ছেড়েছিল, তারা হেরেছে। দুটি সিটে দাঁড়িয়ে একটিতে হেরেছেন প্রধানমন্ত্রী পদের অন্যতম দাবিদার নওয়াজ শরীফ। সবমিলিয়ে পাকিস্তান যেন ১৯৯২-এর সেই জয়ী কাপ্তানেরই ‘কামব্যাক’ দেখতে চাইছে। ইমরান খানের দল পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফের চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার গওহর আলি খান দাবি করেছেন যে, প্রেসিডেন্ট আরিফ আলভি তাদেরকে সরকার গঠনের আমন্ত্রণ জানাবেন, কারণ তারা জাতীয় পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছেন।

 

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ‘ভিক্টরি ফ্রম জেল’ অর্থাৎ জেলে থেকেই জয়। প্রাক্তন পাক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের দল পিটিআই সমর্থিত স্বতন্ত্র প্রার্থীরা জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সবাইকে চমকে দিয়েছেন। একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেলেও পিটিআই সমর্থিত প্রার্থীরা অন্তত ১০০টি আসনে জয়লাভ করেছে। এর ফলে শাহবাজ ও নওয়াজ শরিফের সব হিসাব-নিকেশ গুলিয়ে গিয়েছে। কারণ, পাকিস্তান মুসলিম লীগ নওয়াজ পেয়েছে মাত্র ৭১টি আসন, আর বিলাওয়াল ভুট্টো জারদারির দল পাকিস্তান পিপলস পার্টি পেয়েছে ৫৩টি। জাতীয় সংসদে মোট আসন সংখ্যা ২৬৬। ভোট হচ্ছে ২৬৫ আসনে। কোনও দলই ১৩৩ আসন না পাওয়ায় পাকিস্তানের রাজনীতিতে ঘোলাটে পরিস্থিতি তৈরি হল। এখন কে বা কারা ক্ষমতায় আসবেন, এবং কীভাবেই বা তারা আসবেন তা নিয়ে সর্বত্র আলোচনা চলছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, এই নির্বাচনে সেনাবাহিনীর প্রভাব কমার ইঙ্গিত মিলেছে। নির্বাচনের ফলাফল অনুসারে, সেনা সমর্থিত দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে ব্যর্থ হয়েছে, এমনকি ইমরান খানের পিটিআই, যাদের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনী অবস্থান নিয়েছিল, তারাই সবচেয়ে বেশি আসনে জয়লাভ করেছে। বিশ্লেষকদের মতে, এই নির্বাচনে সবচেয়ে বড় পরাজিত পক্ষ হল সেনাবাহিনী।

 

মিডল ইস্ট ইনস্টিটিউটের আফগানিস্তান ও পাকিস্তান স্টাডিজের পরিচালক মারভিন ওয়েইনবাউম বলেন, ‘এ নির্বাচনে সেনাবাহিনী একপ্রকার তাদের সুনাম বাজি ধরেছিল। কিন্তু তারা ব্যর্থ হয়েছে।’ ২০২২ সালের এপ্রিলে আস্থা ভোটে হেরে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার আগেও প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের বিভিন্ন বক্তব্য সেনার বিরুদ্ধে গেছে। বিভিন্ন সময় তাঁর বক্তব্যে সেনাবাহিনীর বিভিন্ন ত্রুটির কথা উঠে এসেছে। হয়তো একারণেই সেনার সমর্থনপুষ্ট শাহবাজ সরকার ইমরান খানের বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা করে। এসব মামলার মাধ্যমে ইমরানকে নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করা হয় ও তাঁর দলকেও নির্বাচন থেকে সরানো হয়। পিটিআই’র অনেক গুরুত্বপূর্ণ নেতাকে বিভিন্ন ভয়-প্রলোভন দেখিয়ে দলত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়। এতকিছু করেও শেষপর্যন্ত যে কোনও লাভ হয়নি তা পানির মতো সাফ হয় ভোটের ফলাফলের খবরে। কোনও ভাবেই পিটিআই ও তার সমর্থকদের দমানো যায়নি। বাধ্য হয়েই পিটিআই প্রার্থীরা বিভিন্ন প্রতীকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ভালো ফল করেছেন। স্বতন্ত্রপ্রার্থীরা শতাধিক আসনে জয়লাভ করায় পেছনে পড়েছে নওয়াজ শরিফের পিএলএম-এন ও বিলাওয়াল ভুট্টোর পিপিপি। ফলে নির্ঘাত জোট সরকারের দিকে এগোচ্ছে পাক রাজনীতি। শনিবার দুপুরে ভোট নিয়ে প্রকাশ্যে কথা বলেন পাক সেনাপ্রধান জেনারেল আসিম মুনির। তাঁর বত্তৃতা শুনে বোঝা যায়, এবার কোনও একটি দলের ওপর আস্থা দেখাতে পারছেন না তিনি। পাক সেনার ‘ইন্টার সার্ভিসেস পাবলিক রিলেশনস’-এর তরফে জেনারেল মুনিরের একটি বিবৃতি প্রকাশ হয়। তিনি বলেছেন, ‘নির্বাচন ও গণতন্ত্রের অর্থ হল, পাকিস্তানের জনগণের সেবা করা, তাঁদের ব্যবহার করা নয়। ২৫ কোটি জনসংখ্যার উন্নয়নশীল দেশে বিশৃঙ্খলা ও মেরুকরণের রাজনীতি মানায় না। এগুলিকে দূরে সরিয়ে দেশে সুস্থির নেতৃত্ব প্রয়োজন। যে নেতৃত্বের ছোঁয়ায় পরিস্থিতি স্থির হবে।’

 

২০২২ সালের এপ্রিলে প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে পিটিআই প্রধান ইমরান খানের বিদায়ের সময় আলোচনায় এসেছিল ‘পাক সেনার ভূমিকা’। একদা প্রবল দুই প্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তান মুসলিম লীগ-নওয়াজ ও পাকিস্তান পিপলস পার্টিকে একসঙ্গে এনে জোট গড়ার ক্ষেত্রেও তৎকালীন পাক সেনাপ্রধান বাজওয়ার তৎপরতা চোখ এড়ায়নি। এ বারের ভোটে পাক সংসদে ‘ত্রিশঙ্কু’ হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিতেই তাই বাজওয়ার ঘনিষ্ঠ জেনারেল মুনির সক্রিয় হয়ে উঠেছেন বলে মত বিশ্লেষেকদের। জেনারেল মুনির তার বিবৃতিতে বলেছেন, ‘নির্বাচন শুধুমাত্র জয়-পরাজয় নির্ধারণের প্রতিযোগিতা নয়, বরং জনমত যাচাইয়ের পরীক্ষা। রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং তাঁদের কর্মীদের অবশ্যই ক্ষুদ্র স্বার্থের ওপরে উঠে কাজ করতে হবে এবং যৌথ প্রচেষ্টার মাধ্যমে শাসনক্ষমতা পরিচালনা ও জনগণের সেবা করতে হবে। কার্যকর ও স্থিতিশীল গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য এটাই একমাত্র পথ।’ এ ক্ষেত্রে ‘যৌথ প্রচেষ্টা’র উল্লেখ করে পাক সেনাপ্রধান পিএমএলএন প্রধান নওয়াজ ও পিপিপি নেতা বিলাওয়ালের জোটের ক্ষমতাসীন হওয়ার বার্তা দিয়েছেন বলেই জল্পনা।

 

এদিকে, পিটিআই প্রথমে কোনও দলের সঙ্গে জোট না করার কথা বললেও পরিস্থিতি বিচারে সিদ্ধান্ত বদলাতে পারে তারা। জানা গেছে, অন্যান্য দলের সঙ্গে জোট নিয়ে আলোচনার জন্য বৈঠক ডেকেছে পিটিআই। বৈঠকে প্রাক্তন ক্ষমতাসীন দল ও অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জোট গঠনের বিষয়ে আলোচনা হবে বলে জানা গেছে। বৈঠকে পিটিআই চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার গওহর খান, আসাদ কায়সার, আলী মুহাম্মদ খান এবং অন্যরা যোগ দেবেন। নতুন কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সরকার গঠন নিয়ে আলোচনা হওয়ার কথা এতে। এদিকে, নওয়াজ শরিফের পাকিস্তান মুসলিম লীগ নওয়াজ (পিএমএ-এন) ও বিলাওয়াল ভুট্টোর পিপিপি জোট সরকার গঠনে রাজি হয়েছে। পিএমএল-এন প্রেসিডেন্ট ও নওয়াজ শরিফের ভাই শাহবাজ শরিফ বিলওয়াল ভুট্টো ও প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট আসিফ আলী জারদারির সঙ্গে বৈঠক করেছেন এবং এক সঙ্গে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছেন।

 

সূত্রের খবর, পঞ্জাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধানের বাসায় শাহবাজ শরিফ পাকিস্তান পিপলস পার্টির শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। এ সময় সরকার গঠনের প্রক্রিয়া নিয়ে তাদের মধ্যে আলোচনা হয়েছে। এখন প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, পিটিআই সমর্থিত স্বতন্ত্র প্রার্থীরা আলাদাভাবে সরকার গঠন করতে পারবে কি না? এ বিষয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, নির্বাচনে পিটিআই সমর্থিত প্রার্থীরা সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করলেও বড় ধরনের ঘাটতি আছে তাদের। সেটি হল, নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে তাদের প্রতীক বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। এছাড়া দলটির সিনিয়র নেতারাও জেলে। সেজন্য তারা চাইলেও আলাদা সরকার গঠন করতে পারবে না।

প্রতিবেদক

কিবরিয়া আনসারি

Kibria obtained a master's degree in journalism from Aliah University. He has been in journalism since 2018, gaining work experience in multiple organizations. Focused and sincere about his work, Kibria is currently employed at the desk of Purber Kalom.

Copyright © Puber Kalom All rights reserved.| Developed by eTech Builder

১৯৯২-এর জয়ী কাপ্তানের কামব্যাক চাইছে পাকিস্তান!, একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনে ব্যর্থ নওয়াজরা

আপডেট : ১১ ফেব্রুয়ারী ২০২৪, রবিবার

ইসলামাবাদ, ১০ ফেব্রুয়ারি: পাকিস্তানের নির্বাচনী ফলাফল দেখে ১৯৯২ সালের ক্রিকেট বিশ্বকাপের কথা মনে পড়ে গেল। একটি ধরাশায়ী দলকে স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন ‘কাপ্তান’ ইমরান খান। তিনি তখন তরুণ। দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই করে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে পাকিস্তানকে এনে দিয়েছিলেন প্রথম বিশ্বকাপ। তারপর ৩২ বছর কেটে গেছে। রাজনীতির ময়দানে নেমে দেশের ‘কাপ্তানি’ও করে ফেলেছেন ইমরান। কিন্তু সেই লড়াইটা থামেনি। এক অদম্য তেজ, সাহসী পদক্ষেপ। সেনাবাহিনী নওয়াজ শরীফদের সুবিধা করে দিতে জেলে ভরে রেখেছে ইমরানকে। তাঁর দল পিটিআইয়ের প্রতীক ‘ব্যাট’ও কেড়ে নেওয়া হয়েছে। এই নির্বাচনে স্বতন্ত্রভাবে লড়েছেন পিটিআই প্রার্থীরা। গুরুত্বপূর্ণ নেতারা জেলে বন্দি। জেলে বসেই এআইয়ের মাধ্যমে ভাষণ দিয়েছেন ইমরান খান। দেশের জনতাকে রুখে দাঁড়ানোর শক্তি জুগিয়েছেন। ফলত জনগণ ১০০-র বেশি আসনে জিতিয়েছে ইমরান-সমর্থিত প্রার্থীদের। তারাই চালকের আসনে। তবে নওয়াজের মুসলিম লিগ ও বিলাওয়ালের পিপিপি জোট সরকার গড়ে ইমরানের জয়যাত্রা রুখতে চাইছে। এমনকি এতে সাথ দিচ্ছে সেনাবাহিনীও। পিটিআই সমর্থকরা রাস্তায় নেমে উল্লাস প্রকাশ করছে। এসব সহ্য হচ্ছে না বিরোধী পক্ষের। বহু জায়গায় ‘রিগিং’ করে, পিটিআই কর্মীদের মারধর করে হারিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছে। চেষ্টা হচ্ছে যাতে ফলাফল ঘোষণার শেষ পর্যন্ত কোনওভাবেই ইমরানের দল ম্যাজিক ফিগারে (১৩৩) না পৌঁছাতে পারে। এটা রুখতে পারলেই ফের সেনা-সমর্থিত ‘পুতুল’ সরকার বসবে পাকিস্তানের মসনদে। তবে পাক-জনতা যে ইমরানকেই চায়, সেটা ভোটের ফলাফলেই স্পষ্ট। ইমরানের বিশ্বস্ত সঙ্গী, যারা দুর্দিনেও তাকে ছেড়ে যায়নি, তারা এই নির্বাচনে বড় জয় পেয়েছে।

 

অন্যদিকে যারা সরকারি চাপে পিটিআই ছেড়েছিল, তারা হেরেছে। দুটি সিটে দাঁড়িয়ে একটিতে হেরেছেন প্রধানমন্ত্রী পদের অন্যতম দাবিদার নওয়াজ শরীফ। সবমিলিয়ে পাকিস্তান যেন ১৯৯২-এর সেই জয়ী কাপ্তানেরই ‘কামব্যাক’ দেখতে চাইছে। ইমরান খানের দল পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফের চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার গওহর আলি খান দাবি করেছেন যে, প্রেসিডেন্ট আরিফ আলভি তাদেরকে সরকার গঠনের আমন্ত্রণ জানাবেন, কারণ তারা জাতীয় পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছেন।

 

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ‘ভিক্টরি ফ্রম জেল’ অর্থাৎ জেলে থেকেই জয়। প্রাক্তন পাক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের দল পিটিআই সমর্থিত স্বতন্ত্র প্রার্থীরা জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সবাইকে চমকে দিয়েছেন। একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেলেও পিটিআই সমর্থিত প্রার্থীরা অন্তত ১০০টি আসনে জয়লাভ করেছে। এর ফলে শাহবাজ ও নওয়াজ শরিফের সব হিসাব-নিকেশ গুলিয়ে গিয়েছে। কারণ, পাকিস্তান মুসলিম লীগ নওয়াজ পেয়েছে মাত্র ৭১টি আসন, আর বিলাওয়াল ভুট্টো জারদারির দল পাকিস্তান পিপলস পার্টি পেয়েছে ৫৩টি। জাতীয় সংসদে মোট আসন সংখ্যা ২৬৬। ভোট হচ্ছে ২৬৫ আসনে। কোনও দলই ১৩৩ আসন না পাওয়ায় পাকিস্তানের রাজনীতিতে ঘোলাটে পরিস্থিতি তৈরি হল। এখন কে বা কারা ক্ষমতায় আসবেন, এবং কীভাবেই বা তারা আসবেন তা নিয়ে সর্বত্র আলোচনা চলছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, এই নির্বাচনে সেনাবাহিনীর প্রভাব কমার ইঙ্গিত মিলেছে। নির্বাচনের ফলাফল অনুসারে, সেনা সমর্থিত দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে ব্যর্থ হয়েছে, এমনকি ইমরান খানের পিটিআই, যাদের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনী অবস্থান নিয়েছিল, তারাই সবচেয়ে বেশি আসনে জয়লাভ করেছে। বিশ্লেষকদের মতে, এই নির্বাচনে সবচেয়ে বড় পরাজিত পক্ষ হল সেনাবাহিনী।

 

মিডল ইস্ট ইনস্টিটিউটের আফগানিস্তান ও পাকিস্তান স্টাডিজের পরিচালক মারভিন ওয়েইনবাউম বলেন, ‘এ নির্বাচনে সেনাবাহিনী একপ্রকার তাদের সুনাম বাজি ধরেছিল। কিন্তু তারা ব্যর্থ হয়েছে।’ ২০২২ সালের এপ্রিলে আস্থা ভোটে হেরে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার আগেও প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের বিভিন্ন বক্তব্য সেনার বিরুদ্ধে গেছে। বিভিন্ন সময় তাঁর বক্তব্যে সেনাবাহিনীর বিভিন্ন ত্রুটির কথা উঠে এসেছে। হয়তো একারণেই সেনার সমর্থনপুষ্ট শাহবাজ সরকার ইমরান খানের বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা করে। এসব মামলার মাধ্যমে ইমরানকে নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করা হয় ও তাঁর দলকেও নির্বাচন থেকে সরানো হয়। পিটিআই’র অনেক গুরুত্বপূর্ণ নেতাকে বিভিন্ন ভয়-প্রলোভন দেখিয়ে দলত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়। এতকিছু করেও শেষপর্যন্ত যে কোনও লাভ হয়নি তা পানির মতো সাফ হয় ভোটের ফলাফলের খবরে। কোনও ভাবেই পিটিআই ও তার সমর্থকদের দমানো যায়নি। বাধ্য হয়েই পিটিআই প্রার্থীরা বিভিন্ন প্রতীকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ভালো ফল করেছেন। স্বতন্ত্রপ্রার্থীরা শতাধিক আসনে জয়লাভ করায় পেছনে পড়েছে নওয়াজ শরিফের পিএলএম-এন ও বিলাওয়াল ভুট্টোর পিপিপি। ফলে নির্ঘাত জোট সরকারের দিকে এগোচ্ছে পাক রাজনীতি। শনিবার দুপুরে ভোট নিয়ে প্রকাশ্যে কথা বলেন পাক সেনাপ্রধান জেনারেল আসিম মুনির। তাঁর বত্তৃতা শুনে বোঝা যায়, এবার কোনও একটি দলের ওপর আস্থা দেখাতে পারছেন না তিনি। পাক সেনার ‘ইন্টার সার্ভিসেস পাবলিক রিলেশনস’-এর তরফে জেনারেল মুনিরের একটি বিবৃতি প্রকাশ হয়। তিনি বলেছেন, ‘নির্বাচন ও গণতন্ত্রের অর্থ হল, পাকিস্তানের জনগণের সেবা করা, তাঁদের ব্যবহার করা নয়। ২৫ কোটি জনসংখ্যার উন্নয়নশীল দেশে বিশৃঙ্খলা ও মেরুকরণের রাজনীতি মানায় না। এগুলিকে দূরে সরিয়ে দেশে সুস্থির নেতৃত্ব প্রয়োজন। যে নেতৃত্বের ছোঁয়ায় পরিস্থিতি স্থির হবে।’

 

২০২২ সালের এপ্রিলে প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে পিটিআই প্রধান ইমরান খানের বিদায়ের সময় আলোচনায় এসেছিল ‘পাক সেনার ভূমিকা’। একদা প্রবল দুই প্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তান মুসলিম লীগ-নওয়াজ ও পাকিস্তান পিপলস পার্টিকে একসঙ্গে এনে জোট গড়ার ক্ষেত্রেও তৎকালীন পাক সেনাপ্রধান বাজওয়ার তৎপরতা চোখ এড়ায়নি। এ বারের ভোটে পাক সংসদে ‘ত্রিশঙ্কু’ হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিতেই তাই বাজওয়ার ঘনিষ্ঠ জেনারেল মুনির সক্রিয় হয়ে উঠেছেন বলে মত বিশ্লেষেকদের। জেনারেল মুনির তার বিবৃতিতে বলেছেন, ‘নির্বাচন শুধুমাত্র জয়-পরাজয় নির্ধারণের প্রতিযোগিতা নয়, বরং জনমত যাচাইয়ের পরীক্ষা। রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং তাঁদের কর্মীদের অবশ্যই ক্ষুদ্র স্বার্থের ওপরে উঠে কাজ করতে হবে এবং যৌথ প্রচেষ্টার মাধ্যমে শাসনক্ষমতা পরিচালনা ও জনগণের সেবা করতে হবে। কার্যকর ও স্থিতিশীল গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য এটাই একমাত্র পথ।’ এ ক্ষেত্রে ‘যৌথ প্রচেষ্টা’র উল্লেখ করে পাক সেনাপ্রধান পিএমএলএন প্রধান নওয়াজ ও পিপিপি নেতা বিলাওয়ালের জোটের ক্ষমতাসীন হওয়ার বার্তা দিয়েছেন বলেই জল্পনা।

 

এদিকে, পিটিআই প্রথমে কোনও দলের সঙ্গে জোট না করার কথা বললেও পরিস্থিতি বিচারে সিদ্ধান্ত বদলাতে পারে তারা। জানা গেছে, অন্যান্য দলের সঙ্গে জোট নিয়ে আলোচনার জন্য বৈঠক ডেকেছে পিটিআই। বৈঠকে প্রাক্তন ক্ষমতাসীন দল ও অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জোট গঠনের বিষয়ে আলোচনা হবে বলে জানা গেছে। বৈঠকে পিটিআই চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার গওহর খান, আসাদ কায়সার, আলী মুহাম্মদ খান এবং অন্যরা যোগ দেবেন। নতুন কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সরকার গঠন নিয়ে আলোচনা হওয়ার কথা এতে। এদিকে, নওয়াজ শরিফের পাকিস্তান মুসলিম লীগ নওয়াজ (পিএমএ-এন) ও বিলাওয়াল ভুট্টোর পিপিপি জোট সরকার গঠনে রাজি হয়েছে। পিএমএল-এন প্রেসিডেন্ট ও নওয়াজ শরিফের ভাই শাহবাজ শরিফ বিলওয়াল ভুট্টো ও প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট আসিফ আলী জারদারির সঙ্গে বৈঠক করেছেন এবং এক সঙ্গে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছেন।

 

সূত্রের খবর, পঞ্জাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধানের বাসায় শাহবাজ শরিফ পাকিস্তান পিপলস পার্টির শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। এ সময় সরকার গঠনের প্রক্রিয়া নিয়ে তাদের মধ্যে আলোচনা হয়েছে। এখন প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, পিটিআই সমর্থিত স্বতন্ত্র প্রার্থীরা আলাদাভাবে সরকার গঠন করতে পারবে কি না? এ বিষয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, নির্বাচনে পিটিআই সমর্থিত প্রার্থীরা সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করলেও বড় ধরনের ঘাটতি আছে তাদের। সেটি হল, নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে তাদের প্রতীক বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। এছাড়া দলটির সিনিয়র নেতারাও জেলে। সেজন্য তারা চাইলেও আলাদা সরকার গঠন করতে পারবে না।