২০ জুন ২০২৫, শুক্রবার, ৫ আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

সুন্দরবনে লোকালয়ে বার বার বাঘের ‘অনুপ্রবেশ’, চিন্তিত বন দফতর

সুস্মিতা
  • আপডেট : ১৭ ফেব্রুয়ারী ২০২৫, সোমবার
  • / 644

মধুছন্দা চক্রবর্তী: শুধু মানুষই ‘অনুপ্রবেশ’ করে না সীমান্তে, জঙ্গল থেকে লোকালয়ের সীমানা দিয়ে বাঘও ‘অনুপ্রবেশ’ করে। যেমন সুন্দরবনের গভীর জঙ্গলে নিজের বাসস্থান ছেড়ে জল পাড়ি দিয়ে কখনও কখনও মানুষের বাসভূমিতে ঢুকে পড়ে বাঘ।
বিশেষত গত আড়াই মাসের মধ্যে সুন্দরবনের নির্দিষ্ট জঙ্গল লাগোয়া কয়েকটি গ্রামে প্রায় আঠেরো থেকে কুড়িবার বাঘের ‘অনুপ্রবেশ’ প্রবেশ ঘটায় চিন্তিত বন দফতরেরও। হ্যাঁ, সচেতনভাবেই এই ঘটনাকে লোকালয়ে বাঘের ‘হানা’ না বলে ‘অনুপ্রবেশ’ শধটাই ব্যবহার করা হল। কারণ এতবার লোকালয়ে ঢুকে বাঘ, যত গবাদি পশু বাঘ শিকার করতে পারত, যত মানুষকে আক্রমণ করতে পারত; তা কিন্তু করেনি। যে কয়েকটি প্রানহানি হয়েছে বা বনকর্মী আহত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে মানুষই হয় বাঘের এলাকায় ঢুকে পড়েছে অথবা বাঘের সঙ্গে নিরাপদ দূরত্ব না রেখে কোনও না কোনও পরিস্থিতিতে বাঘের সামনাসামনি চলে এসেছে। সুতরাং বাঘ শুধু শিকার করবার উদ্দেশ্য নিয়ে লোকালয়ে হানা দিচ্ছে, অন্তত সাম্প্রতিক কালের ঘটনায় এ কথা বলা যায় না। বরং কাঁকড়া বা মাছ ধরতে মানুষই অবৈধভাবে বাঘের এলাকায় ঢুকে পড়ছে। চোরাপথে জঙ্গলের কাঠ কাটতে বা মধু খুঁজতে চলে যাচ্ছে। আরও একটা বিষয় হল, সম্প্রতি সুন্দরবন সংলগ্ন বিভিন্ন বাজারে এমনকী সদর বারুইপুরেও প্রকাশ্যে না হলেও হরিণের মাংস বিক্রি বেড়ে গিয়েছে। যার অর্থ মানুষই সুন্দরবনের জঙ্গলে বাঘের খাদ্যে ভাগ বসাচ্ছে। সেক্ষেত্রে মানুষ আর বাঘ, কে কার এলাকায় ‘অনুপ্রবেশ’ করছে, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়।
বনমন্ত্রী বীরবাহা হাঁসদা বলছেন, বাঘ তো জঙ্গলে থাকবেই। বাঘের সংখ্যাও বাড়বে। সুন্দরবনে বন্যপ্রাণ সংরক্ষণের জন্য অনেক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। কোর এরিয়া নির্দিষ্ট করা হয়েছে। নিষেধাজ্ঞা জারি করে প্ল্যাকার্ড লাগানো হয়েছে। জাল লাগানো হয়েছে। কিন্তু নিয়ম ভেঙে মানুষ কেন বাঘের এলাকায় ঢুকে পড়ছে? এই বিষয়ে মানুষকেই সচেতন থাকতে হবে।
আসলে জল-জঙ্গল-জলাভূমির সুন্দরবনে মানুষ এবং বন্যপ্রাণীর সহাবস্থান। কবি শামসুর রহমানের কথায়, ‘পশুদের সঙ্গে মানুষের সহ-বাস’। সুন্দরবনের ভৌগোলিক অঞ্চল পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যাবে, উত্তর এবং দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার বিস্তীর্ণ অঞ্চল ছুয়ে ছড়িয়ে রয়েছে সুন্দরবন। বহু নদী-নালা, খাল-খাঁড়ি আর তার ধারে সুন্দরী, গর্জন, গরাণ, গেঁওয়া, হেতাল গাছের জঙ্গলের সুন্দরবন, ইউনেস্কো স্বীকৃত বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানেগ্রাভ বনভূমি। বনভূমি সংরক্ষণের সুবিধের জন্য এই ম্যানগ্রোভকে সুন্দরবন টাইগার রিজার্ভ (এসটিএর) এবং বায়োস্ফিয়ার রিজার্ভ, এই দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে। এই ম্যানগ্রোভ বনভূমির গায়ে লাগোয়া গ্রামগুলি দুই চব্বিশ পরগনার অন্তর্ভুক্ত। এর মধ্যে উত্তর চব্বিশ পরগনার অন্তর্গত গ্রামগুলির মধ্যে রয়েছে, হেমনগর, বাগনান, কুমিরমারি, মরিচঝাঁপি, সামশেরগঞ্জ, ছোট মোল্লাখালি ইত্যাদি। আর দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার ম্যানগ্রোভ লাগোয়া গ্রামগুলির মধ্যে সুন্দরবন টাইগার রিজার্ভ ফরেস্ট এলাকা অন্তর্ভুক্ত গ্রামগুলি হল বড় মোল্লাখালি, দয়াপুর, পখিরালয়, সোনাগাঁও, বিজয়নগর, বালি এক এবং দুই, আমলামেথি, ত্রিদিবনগর ইত্যাদি। আর এই জেলারই বায়োস্ফিয়ার রিজার্ভ ফরেস্ট এলাকার অন্তর্ভুক্ত গ্রামগুলি হল ঝড়খালি, কৈখালি, কাঁটামারি, গুড়গুড়িয়া, নগেদাবাদ, দেউলবাড়ি ইত্যাদি। এর মধ্যে কুলতলি ব্লকের দেউলবাড়ি থেকে মৈপীঠের কিশোরীমোহনপুর পর্যন্ত এলাকায় গত দু-আড়াই মাসের মধ্যে আঠেরো থেকে কুড়িবার পর্যন্ত বাঘ ঢুকে পড়ার ঘটনা ঘটছে। গ্রামবাসীদের অনুমান, দেউলবাড়ির কাছে কম চওড়া চিতুরির খালটি পেরিয়েই বাঘ এই শীতকালে লোকালয়ে ঢুকে পড়ছে।
কিন্তু কী কারণে বাঘ জঙ্গল ছেড়ে এতবার লোকালয়ে চলে আসছে? এই নিয়ে নানা মুনির নানা মত। বার বার লোকালয়ে বাঘ ঢুকে পড়ার ঘটনায় বিট অফিসারা ব্যতিব্যস্ত। বাঘের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায়, বনে খাদ্যভাণ্ডারে টান পড়ার কারণেই বাঘ শিকারের খোঁজে লোকালয়ে চলে আসছে বলে মনে করছেন বিট অফিসাররা।
অন্যদিকে সুন্দরবনের এক রেঞ্জ অফিসার জানাচ্ছেন, শীতের কুয়াশায় বার বার দিগ্ভ্রষ্ট হয়ে বাঘ লোকালয়ে চলে আসছে। আর এতে বাঘের লাভই হচ্ছে। কারণ ঘন কুয়াশায় ছোট তৃণভোজী পশুদের তুলনায় বাঘ একটু বেশিই দেখতে পায়। তাই কুয়াশার মধ্যে বাঘ একদম কাছাকাছি না আসা পর্যন্ত তাঁরা প্রাণরক্ষার জন্য পালাতে পারে না। ফলে বাঘেরও শিকার ধরতে সুবিধে হয়।
সুন্দরবন বায়োস্ফিয়ার রিজার্ভ-এর ডিরেক্টর নীলাঞ্জন মল্লিক জানাচ্ছেন, গত কয়েক বছরের মধ্যে বাঘের সংখ্যা এক লাফে অনেকটাই বেড়েছে। সুন্দরবনে শেষ ব্যাঘ্রশুমারি অনুযায়ী এখন বাঘ রয়েছে ১০১টি। প্রতিটি বাঘের স্বাধীন বিচরণক্ষেত্রের জন্য মোটামুটিভাবে ৫ বর্গ কিলোমিটার জায়গা লাগে। এটা আবার কোন বনে কতটা খাদ্য অর্থাৎ শিকার পাওয়া যায় তার এপর কম-বেশি হতে পারে। সুন্দরবনের বাঘ মূলত বুনো শূকর এবং হরিণকেই খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে। বাঘ সবসময় চায়, তার এলাকা বাড়িয়ে নিতে। নীলাঞ্জনবাবু জানান, বয়সে অপেক্ষাকৃত নবীন মানে চার-পাঁচ বছর বয়সি বাঘ সবসময়ই চায়, অপেক্ষাকৃত প্রবীণ মানে আট-নয় বছর বয়সি বাঘকে এলাকাচ্যুত করতে। নীলাঞ্জনবাবু বলেন, সাম্প্রতিককালে যে বাঘগুলিকে খাঁচায় ধরা গিয়েছে, তাদের বেশিরভাগই বয়স্ক বাঘ। তাদেরই স্বজাতির দ্বারা বিতাড়িত হয়ে লোকালয়ে আসার প্রবণতা বাড়ছে বলে মত, নীলাঞ্জন মল্লিকের। তাঁর এই বক্তব্য ডারউইনবাদের যোগ্যতমের জয় তথা সারভাইভাল অফ দ্য ফিটেস্ট-এর তত্ত্বকেই প্রতিষ্ঠা করে।
তবে ব্যাঘ্র বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাঘের বার বার লোকালয়ে চলে আসার পেছনে মানুষের বড় ভূমিকা রয়েছে। বিনা অনুমতিতে মাছ-কাঁকড়া ধরতে, কিংবা জঙ্গলের কাঠ কাটতে অথবা মধু সংগ্রহ করতে মানুষই বাঘের জন্য সংরক্ষিত এলাকায় ঢুকে পড়ছে। কোথাও কোথাও নাইলনের জাল কেটেই। ফলে বাঘের স্বাভাবিক পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। এইজন্যই বাঘও জঙ্গল থেকে বেরিয়ে মানুষের গন্ধে লোকালয়ে চলে আসছে। আসলে বন দফতরের নিষেধ থাকলেও পেটের টানেই মানুষ বাঘের সংরক্ষিত অঞ্চলে গিয়ে বাঘের পেটে চলে যাচ্ছে। এ এক অদ্ভুত প্যারাডক্স।
আসলে সুন্দরবনে মানুষই হোক কিংবা বন্যপ্রাণ, সকলেরই জীবনরক্ষার জন্য দায়িত্ব রয়েছে বন দফতরের ওপর। তাই যাতে ‘বন্যরা বনে সুন্দর’ থাকতে পারে আর মানুষও যাতে প্রকৃতির কোলে জীবন কাটাতে পারে মাতৃক্রোড়ের নিশ্চিন্ততায়, সেই দায় আমাদের ওপরেও বর্তায়।

 

আরও পড়ুন: অবশেষে কুলতলিতে খাঁচা বন্দি সুন্দরবনের বাঘ

আরও পড়ুন: সল্টলেক থেকে সুন্দরবনের নয়া বাস রুট চালু

Copyright © Puber Kalom All rights reserved.| Developed by eTech Builder

সুন্দরবনে লোকালয়ে বার বার বাঘের ‘অনুপ্রবেশ’, চিন্তিত বন দফতর

আপডেট : ১৭ ফেব্রুয়ারী ২০২৫, সোমবার

মধুছন্দা চক্রবর্তী: শুধু মানুষই ‘অনুপ্রবেশ’ করে না সীমান্তে, জঙ্গল থেকে লোকালয়ের সীমানা দিয়ে বাঘও ‘অনুপ্রবেশ’ করে। যেমন সুন্দরবনের গভীর জঙ্গলে নিজের বাসস্থান ছেড়ে জল পাড়ি দিয়ে কখনও কখনও মানুষের বাসভূমিতে ঢুকে পড়ে বাঘ।
বিশেষত গত আড়াই মাসের মধ্যে সুন্দরবনের নির্দিষ্ট জঙ্গল লাগোয়া কয়েকটি গ্রামে প্রায় আঠেরো থেকে কুড়িবার বাঘের ‘অনুপ্রবেশ’ প্রবেশ ঘটায় চিন্তিত বন দফতরেরও। হ্যাঁ, সচেতনভাবেই এই ঘটনাকে লোকালয়ে বাঘের ‘হানা’ না বলে ‘অনুপ্রবেশ’ শধটাই ব্যবহার করা হল। কারণ এতবার লোকালয়ে ঢুকে বাঘ, যত গবাদি পশু বাঘ শিকার করতে পারত, যত মানুষকে আক্রমণ করতে পারত; তা কিন্তু করেনি। যে কয়েকটি প্রানহানি হয়েছে বা বনকর্মী আহত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে মানুষই হয় বাঘের এলাকায় ঢুকে পড়েছে অথবা বাঘের সঙ্গে নিরাপদ দূরত্ব না রেখে কোনও না কোনও পরিস্থিতিতে বাঘের সামনাসামনি চলে এসেছে। সুতরাং বাঘ শুধু শিকার করবার উদ্দেশ্য নিয়ে লোকালয়ে হানা দিচ্ছে, অন্তত সাম্প্রতিক কালের ঘটনায় এ কথা বলা যায় না। বরং কাঁকড়া বা মাছ ধরতে মানুষই অবৈধভাবে বাঘের এলাকায় ঢুকে পড়ছে। চোরাপথে জঙ্গলের কাঠ কাটতে বা মধু খুঁজতে চলে যাচ্ছে। আরও একটা বিষয় হল, সম্প্রতি সুন্দরবন সংলগ্ন বিভিন্ন বাজারে এমনকী সদর বারুইপুরেও প্রকাশ্যে না হলেও হরিণের মাংস বিক্রি বেড়ে গিয়েছে। যার অর্থ মানুষই সুন্দরবনের জঙ্গলে বাঘের খাদ্যে ভাগ বসাচ্ছে। সেক্ষেত্রে মানুষ আর বাঘ, কে কার এলাকায় ‘অনুপ্রবেশ’ করছে, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়।
বনমন্ত্রী বীরবাহা হাঁসদা বলছেন, বাঘ তো জঙ্গলে থাকবেই। বাঘের সংখ্যাও বাড়বে। সুন্দরবনে বন্যপ্রাণ সংরক্ষণের জন্য অনেক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। কোর এরিয়া নির্দিষ্ট করা হয়েছে। নিষেধাজ্ঞা জারি করে প্ল্যাকার্ড লাগানো হয়েছে। জাল লাগানো হয়েছে। কিন্তু নিয়ম ভেঙে মানুষ কেন বাঘের এলাকায় ঢুকে পড়ছে? এই বিষয়ে মানুষকেই সচেতন থাকতে হবে।
আসলে জল-জঙ্গল-জলাভূমির সুন্দরবনে মানুষ এবং বন্যপ্রাণীর সহাবস্থান। কবি শামসুর রহমানের কথায়, ‘পশুদের সঙ্গে মানুষের সহ-বাস’। সুন্দরবনের ভৌগোলিক অঞ্চল পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যাবে, উত্তর এবং দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার বিস্তীর্ণ অঞ্চল ছুয়ে ছড়িয়ে রয়েছে সুন্দরবন। বহু নদী-নালা, খাল-খাঁড়ি আর তার ধারে সুন্দরী, গর্জন, গরাণ, গেঁওয়া, হেতাল গাছের জঙ্গলের সুন্দরবন, ইউনেস্কো স্বীকৃত বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানেগ্রাভ বনভূমি। বনভূমি সংরক্ষণের সুবিধের জন্য এই ম্যানগ্রোভকে সুন্দরবন টাইগার রিজার্ভ (এসটিএর) এবং বায়োস্ফিয়ার রিজার্ভ, এই দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে। এই ম্যানগ্রোভ বনভূমির গায়ে লাগোয়া গ্রামগুলি দুই চব্বিশ পরগনার অন্তর্ভুক্ত। এর মধ্যে উত্তর চব্বিশ পরগনার অন্তর্গত গ্রামগুলির মধ্যে রয়েছে, হেমনগর, বাগনান, কুমিরমারি, মরিচঝাঁপি, সামশেরগঞ্জ, ছোট মোল্লাখালি ইত্যাদি। আর দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার ম্যানগ্রোভ লাগোয়া গ্রামগুলির মধ্যে সুন্দরবন টাইগার রিজার্ভ ফরেস্ট এলাকা অন্তর্ভুক্ত গ্রামগুলি হল বড় মোল্লাখালি, দয়াপুর, পখিরালয়, সোনাগাঁও, বিজয়নগর, বালি এক এবং দুই, আমলামেথি, ত্রিদিবনগর ইত্যাদি। আর এই জেলারই বায়োস্ফিয়ার রিজার্ভ ফরেস্ট এলাকার অন্তর্ভুক্ত গ্রামগুলি হল ঝড়খালি, কৈখালি, কাঁটামারি, গুড়গুড়িয়া, নগেদাবাদ, দেউলবাড়ি ইত্যাদি। এর মধ্যে কুলতলি ব্লকের দেউলবাড়ি থেকে মৈপীঠের কিশোরীমোহনপুর পর্যন্ত এলাকায় গত দু-আড়াই মাসের মধ্যে আঠেরো থেকে কুড়িবার পর্যন্ত বাঘ ঢুকে পড়ার ঘটনা ঘটছে। গ্রামবাসীদের অনুমান, দেউলবাড়ির কাছে কম চওড়া চিতুরির খালটি পেরিয়েই বাঘ এই শীতকালে লোকালয়ে ঢুকে পড়ছে।
কিন্তু কী কারণে বাঘ জঙ্গল ছেড়ে এতবার লোকালয়ে চলে আসছে? এই নিয়ে নানা মুনির নানা মত। বার বার লোকালয়ে বাঘ ঢুকে পড়ার ঘটনায় বিট অফিসারা ব্যতিব্যস্ত। বাঘের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায়, বনে খাদ্যভাণ্ডারে টান পড়ার কারণেই বাঘ শিকারের খোঁজে লোকালয়ে চলে আসছে বলে মনে করছেন বিট অফিসাররা।
অন্যদিকে সুন্দরবনের এক রেঞ্জ অফিসার জানাচ্ছেন, শীতের কুয়াশায় বার বার দিগ্ভ্রষ্ট হয়ে বাঘ লোকালয়ে চলে আসছে। আর এতে বাঘের লাভই হচ্ছে। কারণ ঘন কুয়াশায় ছোট তৃণভোজী পশুদের তুলনায় বাঘ একটু বেশিই দেখতে পায়। তাই কুয়াশার মধ্যে বাঘ একদম কাছাকাছি না আসা পর্যন্ত তাঁরা প্রাণরক্ষার জন্য পালাতে পারে না। ফলে বাঘেরও শিকার ধরতে সুবিধে হয়।
সুন্দরবন বায়োস্ফিয়ার রিজার্ভ-এর ডিরেক্টর নীলাঞ্জন মল্লিক জানাচ্ছেন, গত কয়েক বছরের মধ্যে বাঘের সংখ্যা এক লাফে অনেকটাই বেড়েছে। সুন্দরবনে শেষ ব্যাঘ্রশুমারি অনুযায়ী এখন বাঘ রয়েছে ১০১টি। প্রতিটি বাঘের স্বাধীন বিচরণক্ষেত্রের জন্য মোটামুটিভাবে ৫ বর্গ কিলোমিটার জায়গা লাগে। এটা আবার কোন বনে কতটা খাদ্য অর্থাৎ শিকার পাওয়া যায় তার এপর কম-বেশি হতে পারে। সুন্দরবনের বাঘ মূলত বুনো শূকর এবং হরিণকেই খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে। বাঘ সবসময় চায়, তার এলাকা বাড়িয়ে নিতে। নীলাঞ্জনবাবু জানান, বয়সে অপেক্ষাকৃত নবীন মানে চার-পাঁচ বছর বয়সি বাঘ সবসময়ই চায়, অপেক্ষাকৃত প্রবীণ মানে আট-নয় বছর বয়সি বাঘকে এলাকাচ্যুত করতে। নীলাঞ্জনবাবু বলেন, সাম্প্রতিককালে যে বাঘগুলিকে খাঁচায় ধরা গিয়েছে, তাদের বেশিরভাগই বয়স্ক বাঘ। তাদেরই স্বজাতির দ্বারা বিতাড়িত হয়ে লোকালয়ে আসার প্রবণতা বাড়ছে বলে মত, নীলাঞ্জন মল্লিকের। তাঁর এই বক্তব্য ডারউইনবাদের যোগ্যতমের জয় তথা সারভাইভাল অফ দ্য ফিটেস্ট-এর তত্ত্বকেই প্রতিষ্ঠা করে।
তবে ব্যাঘ্র বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাঘের বার বার লোকালয়ে চলে আসার পেছনে মানুষের বড় ভূমিকা রয়েছে। বিনা অনুমতিতে মাছ-কাঁকড়া ধরতে, কিংবা জঙ্গলের কাঠ কাটতে অথবা মধু সংগ্রহ করতে মানুষই বাঘের জন্য সংরক্ষিত এলাকায় ঢুকে পড়ছে। কোথাও কোথাও নাইলনের জাল কেটেই। ফলে বাঘের স্বাভাবিক পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। এইজন্যই বাঘও জঙ্গল থেকে বেরিয়ে মানুষের গন্ধে লোকালয়ে চলে আসছে। আসলে বন দফতরের নিষেধ থাকলেও পেটের টানেই মানুষ বাঘের সংরক্ষিত অঞ্চলে গিয়ে বাঘের পেটে চলে যাচ্ছে। এ এক অদ্ভুত প্যারাডক্স।
আসলে সুন্দরবনে মানুষই হোক কিংবা বন্যপ্রাণ, সকলেরই জীবনরক্ষার জন্য দায়িত্ব রয়েছে বন দফতরের ওপর। তাই যাতে ‘বন্যরা বনে সুন্দর’ থাকতে পারে আর মানুষও যাতে প্রকৃতির কোলে জীবন কাটাতে পারে মাতৃক্রোড়ের নিশ্চিন্ততায়, সেই দায় আমাদের ওপরেও বর্তায়।

 

আরও পড়ুন: অবশেষে কুলতলিতে খাঁচা বন্দি সুন্দরবনের বাঘ

আরও পড়ুন: সল্টলেক থেকে সুন্দরবনের নয়া বাস রুট চালু