০৯ অগাস্ট ২০২৫, শনিবার, ২৩ শ্রাবণ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

জলবায়ু সংকটে বিপর্যস্ত সিরিয়ার গোলাপ বাগান

সুস্মিতা
  • আপডেট : ৭ জুন ২০২৫, শনিবার
  • / 103

পুবের কলম ওয়েবডেস্ক: সিরিয়ার উষ্ণ বাতাসে যখন মে মাসের সূর্য ধীরে ধীরে চড়তে শুরু করে, তখনই আল-মরাহ গ্রামের পাহাড়ি ঢালে দেখা মেলে এক অভূতপূর্ব দৃশ্যের; বিস্তীর্ণ গোলাপ বাগানজুড়ে ফুটে ওঠে গোলাপি দামাস্ক রোজ। এই ফুল শুধু একটি গাছের শোভা নয়, বরং হাজার বছরের ইতিহাস, সংস্কৃতি, সুরভি ও সংগ্রামের এক জীবন্ত প্রতীক।

‘দামাস্ক রোজ’ নামটি এসেছে সিরিয়ার রাজধানী দামেস্ক শহর থেকে, যা প্রাচীনকাল থেকেই সুবাসিত গোলাপ ও সুগন্ধির জন্য বিশ্ববিখ্যাত।

আরও পড়ুন: জার্মানিতে সিরিয়ার শরণার্থী ও ইউক্রেনিয়ানদের জন্য অভ্যর্থনা আলাদা

ধারণা করা হয়, এই ফুলের উৎপত্তি আনুমানিক ১০০০ খ্রিস্টাধে, এবং পরবর্তীকালে এটি ত্রু«সেডারদের মাধ্যমে ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে।

২০১৯ সালে দামাস্ক রোজ সংগ্রহ এবং তা থেকে সুগন্ধি ও অন্যান্য পণ্য তৈরির ঐতিহ্যকে ইউনেস্কো ‘ইন্ট্যাঞ্জিবল কালচারাল হেরিটেজ’ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়;যা সিরিয়ার সাংস্কৃতিক পরিচয়ের একটি গৌরবজনক অধ্যায়।

প্রতি বছর মে মাসে ফুল সংগ্রহের মৌসুম শুরু হলে, আল-মরাহ গ্রামের মাঠগুলো পরিণত হয় যেন এক উৎসবের মঞ্চে। ভোরের আলো ফোটার আগেই নারীরা ঝুড়ি হাতে রওনা দেন। তারা হাত দিয়ে যত্ন করে তুলে নেন দামাস্ক রোজের কোমল পাঁপড়িগুলি। সংগ্রহের সময় চলে ঐতিহ্যবাহী গান, হাসি-আনন্দ। যেন যুগ যুগ ধরে চলে আসা এই প্রক্রিয়াটি শুধুই কৃষিকাজ নয়, এক জীবন্ত সংস্কৃতি।

দামাস্ক রোজ শুধু সৌন্দর্য ও সুবাসে সীমাবদ্ধ নয়। এর পাঁপড়ি থেকে তৈরি হয় রোজ ওয়াটার, রোজ অয়েল, জ্যাম, সিরাপ, এমনকী চিকিৎসায় ব্যবহৃত ঔষধি উপাদানও। আন্তর্জাতিক বাজারে সিরিয়ার দামাস্ক রোজ তেলের কদর এতটাই বেশি যে এক লিটার খাঁটি রোজ অয়েল বিক্রি হয় কয়েক হাজার ডলারে।

তবে এই ফুলের ভবিষ্যৎ আজ আর কেবল প্রকৃতির উপর নির্ভর করছে না। দীর্ঘ গৃহযুদ্ধ, জলবায়ু পরিবর্তন, খরা ও আর্থিক সংকটের কারণে দামাস্ক রোজ উৎপাদন বিপদের মুখে পড়েছে। যেখানে ২০১০ সালে প্রায় ৮০ টন ফুল সংগ্রহ হত, তা ২০১৬ সালে নেমে আসে মাত্র ২০ টনে।

তবুও আশার আলো এখনও নিভে যায়নি। বিভিন্ন স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক সংগঠন, এমনকী সিরিয়ার সরকারও, নতুন কূপ খনন, আধুনিক কৃষিপদ্ধতি ও কৃষকদের সহায়তা প্রদানের মাধ্যমে এই ঐতিহ্য ধরে রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

দামাস্ক রোজ আজ আর কেবল একটি ফুল নয়; এটি সিরিয়ার আধ্যাত্মিকতা, নারীদের জীবনযাপন, যুদ্ধের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ, এবং ঘ্রাণে মোড়ানো আত্মপরিচয়ের গল্প। যুদ্ধ ও ধ্বংসের মাঝেও যখন একটি জাতি তার মাটি ও ফুলকে ভালোবেসে আগলে রাখে, তখন তা হয়ে ওঠে এক প্রতিরোধের প্রতীক। সিরিয়ার দামাস্ক রোজ তাই কেবল একটি ফুল নয়; এটি এক জীবন্ত ইতিহাস, এক ঘ্রাণময় উত্তরাধিকার।

Copyright © Puber Kalom All rights reserved.| Developed by eTech Builder

জলবায়ু সংকটে বিপর্যস্ত সিরিয়ার গোলাপ বাগান

আপডেট : ৭ জুন ২০২৫, শনিবার

পুবের কলম ওয়েবডেস্ক: সিরিয়ার উষ্ণ বাতাসে যখন মে মাসের সূর্য ধীরে ধীরে চড়তে শুরু করে, তখনই আল-মরাহ গ্রামের পাহাড়ি ঢালে দেখা মেলে এক অভূতপূর্ব দৃশ্যের; বিস্তীর্ণ গোলাপ বাগানজুড়ে ফুটে ওঠে গোলাপি দামাস্ক রোজ। এই ফুল শুধু একটি গাছের শোভা নয়, বরং হাজার বছরের ইতিহাস, সংস্কৃতি, সুরভি ও সংগ্রামের এক জীবন্ত প্রতীক।

‘দামাস্ক রোজ’ নামটি এসেছে সিরিয়ার রাজধানী দামেস্ক শহর থেকে, যা প্রাচীনকাল থেকেই সুবাসিত গোলাপ ও সুগন্ধির জন্য বিশ্ববিখ্যাত।

আরও পড়ুন: জার্মানিতে সিরিয়ার শরণার্থী ও ইউক্রেনিয়ানদের জন্য অভ্যর্থনা আলাদা

ধারণা করা হয়, এই ফুলের উৎপত্তি আনুমানিক ১০০০ খ্রিস্টাধে, এবং পরবর্তীকালে এটি ত্রু«সেডারদের মাধ্যমে ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে।

২০১৯ সালে দামাস্ক রোজ সংগ্রহ এবং তা থেকে সুগন্ধি ও অন্যান্য পণ্য তৈরির ঐতিহ্যকে ইউনেস্কো ‘ইন্ট্যাঞ্জিবল কালচারাল হেরিটেজ’ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়;যা সিরিয়ার সাংস্কৃতিক পরিচয়ের একটি গৌরবজনক অধ্যায়।

প্রতি বছর মে মাসে ফুল সংগ্রহের মৌসুম শুরু হলে, আল-মরাহ গ্রামের মাঠগুলো পরিণত হয় যেন এক উৎসবের মঞ্চে। ভোরের আলো ফোটার আগেই নারীরা ঝুড়ি হাতে রওনা দেন। তারা হাত দিয়ে যত্ন করে তুলে নেন দামাস্ক রোজের কোমল পাঁপড়িগুলি। সংগ্রহের সময় চলে ঐতিহ্যবাহী গান, হাসি-আনন্দ। যেন যুগ যুগ ধরে চলে আসা এই প্রক্রিয়াটি শুধুই কৃষিকাজ নয়, এক জীবন্ত সংস্কৃতি।

দামাস্ক রোজ শুধু সৌন্দর্য ও সুবাসে সীমাবদ্ধ নয়। এর পাঁপড়ি থেকে তৈরি হয় রোজ ওয়াটার, রোজ অয়েল, জ্যাম, সিরাপ, এমনকী চিকিৎসায় ব্যবহৃত ঔষধি উপাদানও। আন্তর্জাতিক বাজারে সিরিয়ার দামাস্ক রোজ তেলের কদর এতটাই বেশি যে এক লিটার খাঁটি রোজ অয়েল বিক্রি হয় কয়েক হাজার ডলারে।

তবে এই ফুলের ভবিষ্যৎ আজ আর কেবল প্রকৃতির উপর নির্ভর করছে না। দীর্ঘ গৃহযুদ্ধ, জলবায়ু পরিবর্তন, খরা ও আর্থিক সংকটের কারণে দামাস্ক রোজ উৎপাদন বিপদের মুখে পড়েছে। যেখানে ২০১০ সালে প্রায় ৮০ টন ফুল সংগ্রহ হত, তা ২০১৬ সালে নেমে আসে মাত্র ২০ টনে।

তবুও আশার আলো এখনও নিভে যায়নি। বিভিন্ন স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক সংগঠন, এমনকী সিরিয়ার সরকারও, নতুন কূপ খনন, আধুনিক কৃষিপদ্ধতি ও কৃষকদের সহায়তা প্রদানের মাধ্যমে এই ঐতিহ্য ধরে রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

দামাস্ক রোজ আজ আর কেবল একটি ফুল নয়; এটি সিরিয়ার আধ্যাত্মিকতা, নারীদের জীবনযাপন, যুদ্ধের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ, এবং ঘ্রাণে মোড়ানো আত্মপরিচয়ের গল্প। যুদ্ধ ও ধ্বংসের মাঝেও যখন একটি জাতি তার মাটি ও ফুলকে ভালোবেসে আগলে রাখে, তখন তা হয়ে ওঠে এক প্রতিরোধের প্রতীক। সিরিয়ার দামাস্ক রোজ তাই কেবল একটি ফুল নয়; এটি এক জীবন্ত ইতিহাস, এক ঘ্রাণময় উত্তরাধিকার।