ইমরান খানের প্রথম ইনিংস কি শেষ হচ্ছে!

- আপডেট : ৩১ মার্চ ২০২২, বৃহস্পতিবার
- / 30
বিশেষ প্রতিবেদকঃ পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ইমরান খান যতটা না বিখ্যাত তার আগে পাকিস্তানের ক্রিকেট দলের বিশ্বকাপ জয়ী টিমের ক্যাপ্টেন হিসেবে সারা পৃথিবীতে তাঁর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল। এরপর ইংল্যান্ডের ধনকুবের কন্যা জেমিমা খানের সঙ্গে তাঁর বিয়ের জন্য বিশ্বজুড়ে তিনি আলোচিত হয়েছিলেন। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার জন্য তাঁকে দীর্ঘদিন লড়াই করতে হয়েছিল। পাকিস্তানে তখন শীর্ষপদের রাজনীতিবিদ্ এবং বড় বড় সেনা জেনারেলদের দুর্নীতি ছেয়ে গিয়েছিল। ইমরান এদের হাত থেকে পাকিস্তানকে মুক্তির আশ্বাস দিয়েছিলেন, যা সাধারণ মানুষকে উৎসাহিত করেছিল।
বর্তমানে এই ইমরান খানের বিরুদ্ধে পাক সংসদে রয়েছে অনাস্থা প্রস্তাব। এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহে এই অনাস্থা প্রস্তাবের উপর আলোচনা শেষে ভোট হবে বলে স্থির রয়েছে।
হঠাৎ কি করে পাকিস্তানে অচলাবস্থার সৃষ্টি হল?
বিরোধী দলগুলি পার্লামেন্টে ইমরান খান ও তাঁর সরকারের উপর এক অনাস্থা প্রস্তাব এনেছে। তাঁদের বক্তব্য, ইমরান খানের আমলে পাকিস্তানের অর্থনীতিতে ব্যাপক অব্যবস্থা দেখা দিয়েছে। এছাড়া পাকিস্তানের বিদেশ নীতি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আর এই দুই অভিযোগের উপর কেন্দ্র করেই পাকিস্তানী সংসদে ইমরান খানের পিটিআই সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব আনা হয়েছে।
একথা ঠিক, ইমরান খান যখন ক্ষমতায় আসেন তখনই পাকিস্তানের অর্থনীতি টলমল অবস্থায় ছিল। আশা করা হচ্ছিল, ইমরানের ‘নয়া পাকিস্তান’ অর্থনীতিকে সামলে নিতে পারবে। কিন্তু পাকিস্তানের উপর যে দেনার বোঝা ছিল, তা ছিল বিরাট। যদিও ইমরান খান চিনের সাহায্য এবং পরবর্তীতে সউদি আরবের সঙ্গে সমঝোতার পথে গিয়ে অর্থনীতিকে খানিকটা মজবুত ভিতের উপর দাঁড় করানোর চেষ্টা করেছিলেন, আর সেই সময়তেই তাঁর উপর বিরোধী দলগুলি অনাস্থা প্রস্তাব নিয়ে আসে।
একে তো কাশ্মীর নিয়ে ভারতের পদক্ষেপের বিরুদ্ধে ইমরান তেমন কিছুই করতে পারেননি, আন্তর্জাতিক সমর্থনও তেমন হাসিল করতে পারেননি। আর এর ফলে পাকিস্তানের জনগণ খানিকটা ক্ষুব্ধ হয়েছিল। ইমরান খানও আমেরিকা, আরব দুনিয়া এবং ইউরোপের সমর্থন হাসিল করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন।
আর এরপরই ইমরান খান আমেরিকার বিরুদ্ধে খানিকটা সুর চড়াতে আরম্ভ করেন। এর মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তান থেকে চলে যেতে বাধ্য হয়েছে। ইমরান খান বলেন, আমেরিকার আফগান নীতিকে সমর্থন করার জন্যই পাকিস্তানের অর্থনীতি দুর্দশাগ্রস্ত হয়েছে। আফগান রিফিউজিদের চাপ ও যুদ্ধের খানিকটা দায়ভার পাকিস্তানের উপর আমেরিকা চাপিয়ে দেয়। এর অন্যতম পরিণতি হয় জঙ্গি গোষ্ঠীগুলি পাকিস্তানের ভেতর শক্তিশালী হয়ে ওঠে। তাদের সন্ত্রাস ও জঙ্গিপনার বিরুদ্ধে পাকিস্তানকেই মোকাবিলা করতে হচ্ছে। আর এতেও পাকিস্তানের সমাজকে খানিকটা অস্থিরতা ও ব্যাপক আর্থিক ব্যয়ের সম্মুখীণ হতে হয়। ইমরান খান এজন্য আমেরিকা ও তার পশ্চিমা মিত্রসমূহকে দায়ী করে বেশ কয়েকবার বক্তব্যও রেখেছেন।
বিষয়টি স্বাভাবিক কারণে আমেরিকার পছন্দ হয়নি। আমেরিকা এও লক্ষ্য করেছে, ইমরানের বিদেশ নীতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ছেড়ে বেশ খানিকটা চিন ও রাশিয়ার দিকে ঝুঁকে পড়েছে। তখনই অনেকে আশঙ্কা করেছিলেন, ২০ বছরে আফগানিস্তানে নাস্তানাবুদ হয়ে আফগান জমিন ছেড়ে চলে গেলেও পাকিস্তানকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সহজে ছেড়ে দেবে না। তার কারণ, জন্মের প্রায় প্রথম থেকেই পাকিস্তান ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রর প্রভাব বলয়ে। রাশিয়া ও চিনের বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সবসময় পাকিস্তানকে ব্যবহার করতে চেয়েছে। তাই হঠাৎ পাকিস্তান চিন ও রাশিয়ার দিকে ঝুঁকে পড়বে, বিশেষ করে যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রর মিত্রদের সঙ্গে রাশিয়ার সামরিক যুদ্ধ এবং চিনের বিরুদ্ধে অর্থনীতির যুদ্ধ প্রবল হয়ে উঠেছে, তখন পাকিস্তানের এই গতি পরিবর্তনকে আমেরিকা মেনে নেয়নি।
ইমরান খান সম্প্রতি অভিযোগ করে চলেছেন যে, তাঁর কাছে লিখিত প্রমাণ রয়েছে তাঁর সরকারকে সরাতে বিদেশীরা ষড়যন্ত্র করছে, বিরোধী দলগুলিকে নাকি অর্থ সরবরাহ করছে।
এদিকে গাণিতিক অঙ্কেও ইমরান খানের মুশকিল বাড়ছে বই কমছে না। তাঁর তেহরিক-ই-ইসলাম (পিটিআই) কোয়ালিশনের জেরেই সরকার গঠন করতে পেরেছে। পিটিআই-এ রয়েছে ১৫৫জন সদস্য। সংখ্যাগরিষ্ঠতার জন্য প্রয়োজন ১৭২ জন সদস্য। কোয়ালিশনের মাধ্যমেই ইমরান খান সংখ্যাগরিষ্ঠতা হাসিল করে ২০১৮ সালে সরকার গঠন করেছিলেন। এখন ইমরান খানের সবথেকে বড় কোয়ালিশন পার্টনার ও আরও কয়েকটি দল তাঁকে ছেড়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। এছাড়া তাঁর নিজের দল থেকেও কয়েকজন মন্ত্রী ও কিছু সংসদ সদস্য ভোটাভুটিতে তাঁকে সমর্থন করবে না বলে জানিয়েছেন। ইমরান খান আদালতের সাহায্যে দলত্যাগীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার চেষ্টা করছেন। তবে সরকার তিনি বাঁচাতে পারবেন না অধিকাংশ বিশেষজ্ঞ মনে করছেন। পাকিস্তানের এক মন্ত্রী বলেছে, ইমরান পদত্যাগ করবেন না, কিংবা পার্লামেন্টও ভেঙে দেবেন না। ইমরান একজন খেলোয়াড়, তিনি শেষ বলটি অবধি খেলবেন।
ইমরানের স্বপক্ষে শুধু এটুকু বলা যায়, তিনি পাকিস্তানের বিখ্যাত দুর্নীতি-রাজত্বে নিজেকে জড়াননি। সম্প্রতি তাঁর পক্ষে যের্ যালি তিনি আহ্বান করেছিলেন তাতে জনতার ভিড় সবপক্ষকেই চমকে দিয়েছিল। ইমরানের চলে যাওয়া প্রায় নিশ্চিত। তবে তারপর যারা আসবে, তারা পাকিস্তানকে কিভাবে সামলাবে, তার কোনও নকশা কিন্তু কারও সামনেই নেই।