রাসূল সা.-এর কুৎসাকারী হয়ে গেলেন নবীজি’র রক্ষাকারী
- আপডেট : ১৭ অগাস্ট ২০২২, বুধবার
- / 90
মুহিউদ্দিন গাজীঃ আবদুল মুত্তালিবের কয়েকটি পুত্র ছিল। তাঁর মধ্যে একজনের নাম হা-রিস। মুগীরাহ্ নামে হা-রিসের একটি পুত্র ছিল। আবদুল মুত্তালিবের আরেক পুত্রের নাম ছিল আবদুল্লাহ্। তাঁর একমাত্র সন্তান হলেন মুহাম্মাদ রাসূলুল্লাহ্ স্বল্লাল্ল-হু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। মুগীরাহ্ এবং মুহাম্মদ দু’জনেই ছিলেন সমবয়স্ক, দু’জনেই ছিলেন দুধ ভাই, দাইমা হালিমা দু’জনকে দুধ পান করিয়েছিলেন। দুই চাচাতো ভাইয়ের মধ্যে ছিল সখ্যতা ও সম্প্রীতি। দু’জনে দেখতেও প্রায় একই রকম ছিল।
মুগীরাহ্ পরে আবু সুফিয়ান নামে প্রসিদ্ধি লাভ করে। তবে এই সেই আবু সুফিয়ান ইবনে হারব নয়, যে উহুদ-যুদ্ধে মুশরিকদের সেনাপতি ছিল এবং মক্কা বিজয়ের সময় ঈমান এনেছিলেন। এই আবু সুফিয়ান হল প্রিয় নবী সা.-এর খুল্লতাত আবু সুফিয়ান ইবনে হা-রিস। হযরত মুহাম্মাদ সা. যখন আল্লাহ্র রাসূল মনোনীত হলেন, তখন এই ব্যক্তি তাঁর কট্টর দুশমন হয়ে গেল। সে রাসূল সা.-এর শানে বেয়াদবি ও অসভ্যতা করত এবং কবিতার মাধ্যমে তাঁকে বিদ্রুপ করত, তাঁর সঙ্গী-সাথীদের কষ্ট দিত এবং কবিতার মাধ্যমে তাঁদের বিরুদ্ধে মিথ্যা অপবাদ রচনা করত।

এককথায়, রাসূল সা.-এর বিরুদ্ধে শত্রুতা করার ব্যাপারে কোনওরকম ত্রুটি করত না। কুরাইশরা যখনই মদিনা আক্রমণ করতে যেত, এই আবু সুফিয়ানও অবশ্যই তাদের সঙ্গে থাকত। আল্লাহ্র রাসূল সা.-এ সম্পর্কে বেয়াদবি ও অভব্যতা পূর্ণ কবিতা লিখে আরব গোত্রগুলোর মধ্যে ছড়িয়ে দিত। হযরত হাসসান বিন সা-বিত রা. প্রিয় নবী রাসূল সা.-এর হয়ে এই ধরনের বেয়াদব কবিদের বিদ্রুপের উত্তর দিতেন। শত্রুতার আগুনে জ্বলতে এবং বেয়াদবির অভিশাপে দগ্ধ হতে হতে কুড়িটা বছর কেটে গেল।
ইতিমধ্যে মক্কায় এই খবর দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ল যে হযরত মুহাম্মাদ সা. একটি বৃহৎ বাহিনী নিয়ে মদিনা থেকে মক্কা অভিমুখে রওনা হয়েছেন। এতে মক্কায় ডামাডোলের পরিস্থিতি বিরাজ করতে লাগল। এদের মধ্যে এমন বহু ভয়ানক অপরাধী এবং রাসূল সা.-এর প্রতি বেয়াদবি করা ব্যক্তিও ছিল, যারা নিশ্চিত ছিল যে তাদের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড ছাড়া আর কিছু হবে না। ওই দুর্বৃত্তদের প্রত্যেকেই কোথাও-না-কোথাও পালাবার পরিকল্পনা করছিল।

আবু সুফিয়ান ইবনু হা-রিস বাড়ি ফিরে সপরিবারে মক্কা ছেড়ে পালাতে সেই রাস্তা ধরে বের হয়ে পড়ল, যেদিক দিয়ে মুসলমান বাহিনী মক্কা অভিমুখে আসছিলেন। আবু সুফিয়ান ‘আবওয়া’ নামক স্থানে পৌঁছে দেখে প্রিয় নবী রাসূল সা. ও তাঁর বাহিনীর প্রথম বহর নিয়ে সেখানে পৌঁছে গিয়েছেন।
আবু সুফিয়ান ছদ্মবেশে পুত্র জা’ফারকে সঙ্গে নিয়ে প্রিয় নবী সা.-এর তাঁবুতে পৌঁছে ভিতরে আসার অনুমতি চাইল। উম্মুল মুমিনীন হযরত উম্মু সালামাহ্ রা. বললেন: ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ্ সা.! আপনার চাচাতো ভাই এসেছে। সে আপনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চায়।’ রাসূল সা. বললেন: ‘ও আমার চাচাতো ভাই, ও আমার প্রভূত সম্মান হানি করেছে। ওর সঙ্গে আমার কোনও কথা বলার নেই।’
এই উত্তর শুনে আবু সুফিয়ান বলল, ‘আল্লাহ্র কসম উনি আমাকে সাক্ষাৎ করতে না দিলে আমি আমার এই ছেলের হাত ধরে মরুপ্রান্তরে বের হয়ে পড়ব এবং অনশনে আমরা আমাদের প্রাণ বিসর্জন দেবো।’ এই কথা প্রিয় নবী সা.-এর কর্ণগোচর হলে তাঁর মন ভারাক্রান্ত হয়ে উঠল এবং তাকে সাক্ষাতের অনুমতি দিলেন। আবু সুফিয়ান ভিতরে এসে সপুত্র ইসলাম কবুল করলেন।

রাসূলুল্লাহ্ সা. হযরত আলী রা.-কে বললেন: ‘তোমার চাচাতো ভাইকে ওজু করা ও নামায পড়া শিখিয়ে দিয়ে আমার কাছে নিয়ে এসো। আবু সুফিয়ান ওজু করে তাঁর কাছে এসে তাঁর সঙ্গে নামায আদায় করলেন। অতঃপর তিনি হযরত আলী রা.-কে জনসমক্ষে ঘোষণা দিতে নির্দেশ দিতে বললে তিনি বললেন: ‘আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূল সা. আবু সুফিয়ানের প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন। অতএব, এখন তোমরাও তার প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে যাও।’
আবু সুফিয়ান প্রাণের নিরাপত্তা লাভ করলেন এবং ঈমানের অমূল্য সম্পদ অর্জন করলেন। তাঁর মন আরও কিছু কামনা করছিল, আর সেজন্য তিনি অস্থির ও উদ্বিগ্ন ছিলেন। অচিরেই সে সুযোগও তাঁর নাগালে এসে গেল। আল্লাহ্র রাসূল সা. মক্কা বিজয়ের পর ‘ত্ব-য়িফ’ অভিমুখে যাত্রা করলেন। পথিমধ্যে ‘হুনাইন’ নামক উপত্যকায় শত্রুরা তাঁদের উপর আক্রমণ হানল। মুসলমানরা পরাজয়ের মুখে পড়লেন, তাঁদের মধ্যে বিশৃঙ্খলা দেখা দিল।

এই সময় আবু সুফিয়ান ঘোড়া থেকে নেমে তরবারি কোষমুক্ত করে তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে পড়লেন। আবু সুফিয়ানের মনের ইচ্ছা ছিল, তিনি রাসূল সা.-এর সুরক্ষার কাজ আঞ্জাম দিবেন। নবী সা. তাঁর রোমান্টিকতা দেখে অবাক হলেও তিনি জানতে পারছেন না যে লোকটা কে! দুর্যোগ কেটে যেতে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘যে লোকটি নিজের জীবনকে বাজি রেখে আমার সামনে অবিচল ভাবে দাঁড়িয়ে ছিল সে লোকটি কে?’ হযরত আব্বাস রা. বললেন: ‘ইয়া রাসূলুল্লাহ্ সা.! আপনার ভাই আবু সুফিয়ান ইবনু হা-রিস। আপনি ওর প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে যান।’ রাসূলুল্লাহ্ সা. বললেন : ‘আমি ওর প্রতি সন্তুষ্ট। আল্লাহ্ সুবহা-নাহু ওয়া তায়ালা আমার প্রতি ওর ইতিপূর্বের কৃতসমূহ শত্রুতা ক্ষমা করে দিয়েছেন। অতঃপর আবু সুফিয়ানকে সম্বোধন করে অত্যন্ত ভালোবেসে বললেন: আমার ভাই!’
আবু সুফিয়ানের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হয়েছে। তিনি খচ্চরের রেকাবে থাকা রাসূল সা.-এর কদম চুম্বন করলেন।
প্রিয় নবী সা. আবু সুফিয়ান রা.-র আত্মত্যাগের স্বীকৃতি জানিয়ে বললেন- ‘আবু সুফিয়ান আমার ভাই ও আমার পরিবারের সবচেয়ে সেরা ব্যক্তি। আল্লাহ্ সুবহা-নাহু ওয়া তায়ালা চাচা হামযাহ্ রা.-এর শহিদ হওয়ার পর তাঁর বিকল্প হিসেবে আবু সুফিয়ানকে দান করেছেন। এরপর তাঁকে আল্লাহ্র সিংহ ও রাসূল সা.-এর সিংহ নামে ডাকা হত। হ্যাঁ, ইনি সেই আবু সুফিয়ান, যিনি কুড়ি বছর পর্যন্ত রাসূল সা.-এর সবচেয়ে বড় বেয়াদব শত্রু ছিলেন।

ইনি যতক্ষণ কুফরীর ঘেরাটোপে আবদ্ধ ছিলেন, ইসলামের সবচেয়ে বড় শত্রু হিসেবেই ছিলেন। তবে ইসলাম কবুল করে ইসলামের সর্বোচ্চ মঞ্জিলে উন্নীত হতে থাকেন।
হযরত আবু সুফিয়ান রা.-এর ইন্তেকালের সময় ঘনিয়ে আসতে তিনি তাঁর পরিবারের লোকজনদের বলেছিলেন: ‘আমার মৃত্যুতে তোমরা কাঁদবে না। ইসলাম কবুল করার পর থেকে আমি একটাও পাপ করিনি।’
ইবাদাত-বন্দেগীতে তাঁর আগ্রহ এতটাই ছিল যে তীব্র দাবদাহের মরশুমেও ফজর থেকে যাওয়ালের পূর্ব পর্যন্ত নামাযে মশগুল থাকতেন, আবার যোহরের পর থেকে আসর পর্যন্ত নামায পড়তেন।

এটা দ্বীনি দাওয়াতের পরিপূর্ণতাই বলতে হবে যে, যে ব্যক্তি কুড়ি বছর যাবত রাসূল সা.-এর পাকের শানে বেয়াদবি করে এসেছে, সেই ব্যক্তি ইসলাম কবুল করার পর আল্লাহ্র সিংহ ও রাসূল সা.-এর সিংহ এবং জান্নাতের যুবকদের অন্যতম নেতা হিসেবে আখ্যায়িত হয়েছেন।
রাসূল সা.-এর ক্ষমার মহিমা বলতে হবে যে, তাঁরই শানে অসভ্য ও অভব্য আচরণকারীকে তিনি তাওবাহ্ করার সুযোগ দিয়ে নিজের ভাই হিসেবে বরণ করে নিয়েছিলেন।ইসলামের ধ্বজাধারী ও রাসূল সা. প্রেমিকদের জন্য এতে উপদেশ গ্রহণের প্রভূত উপাদান নিহিত রয়েছে।
গ্রন্থপঞ্জীঃ সীরাতে ইবনু হিশাম, ইবনু সা’দ রচিত আত্ব্ত্ববাক্ব-তুল কুবর, এবং ইমাম যাহাবী রচিত সিয়ারু আ’লা-মিন নুবালা।
তরজমাঃ এ এফ এম খালিদ










































