পুবের কলম প্রতিবেদকঃ একটা সময় এমন ছিল পশ্চিমবাংলা, অসম ও বাংলাদেশে মুসলিম নারী শিক্ষার অগ্রদূত বেগম রোকেয়াকে এপার বাংলার মানুষ ভুলে যেতে বসেছিল। ৮০-র দশকে বেগম রোকেয়া সম্পর্কে পর পর দু’টি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। এর একটি হল, গৌরী আইয়ুব আনন্দবাজারের চারের পাতায় লেখেন বেগম রোকেয়াকে নিয়ে একটি নিবন্ধ।

আর অন্যটি প্রকাশিত হয় মাসিক কলম-এ আহমদ হাসান লিখিত ‘বেগম রোকেয়া, একটি জীবন, একটি ইতিহাস ও একটি দীর্ঘশ্বাস’। এরপর বেগম রোকেয়াকে নিয়ে এপার বাংলাতেও চর্চা শুরু হয় নানাভাবে। সেইসময় বাংলায় মুসলিম মেয়েদের শিক্ষার অবস্থা ছিল খুবই শোচনীয়। দেশভাগ, ৬৪-র দাঙ্গা এইসবের প্রভাবে মুসলিম ছেলেমেয়েরা শিক্ষায় খুবই পিছিয়ে পড়েছিল। তারপরে গত ৪০ বছরে অবস্থার কিন্তু ব্যাপক ইতিবাচক পরিবর্তন হয়েছে। বিশেষ করে মুসলিম নারী শিক্ষায়।

তবে বাংলার মানুষ যে বেগম রোকেয়াকে ভুলে যায়নি, তার প্রমাণ পাওয়া গেল পানিহাটির সোদপুরের কাছে ঘোলা মুসলমান পাড়ায়। সেখানকার অধিবাসীরা বেগম রোকেয়ার নামে গড়ে তুলেছেন একটি লাইব্রেরি। আর তাঁরা প্রতি বছর আয়োজন করে থাকেন বেগম রোকেয়া উৎসব। এই উৎসবে ‘মহিয়সী বেগম রোকেয়ার জীবনযুদ্ধ ও কার্যকলাপ’ তুলে ধরার জন্য বেগম রোকেয়া লাইব্রেরির পক্ষ থেকে ১০ ও ১১ সেপ্টেম্বর এই রোকেয়া উৎসবের আয়োজন করা হয়। এতে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে বর্ণাঢ্য র্যালি, ফর্টিস হসপিটাল ও অ্যাপোলো হাসপাতালের সহযোগীতায় স্বাস্থ্য শিবির, শিক্ষা সামগ্রী ও বৃক্ষ বিতরণ, শিক্ষাক্ষেত্রে পথ নির্দেশনা, বেগম রোকেয়া সম্পর্কে আলোচনা, নাটক, বসে আঁকো প্রতিযোগীতা, রোকেয়া সম্মান প্রদান ইত্যাদি।

ঘোলার এই এলাকাটি খুব বড় নয়। কিন্তু এখানে রয়েছে মনোরম পরিবেশ ও সচেতনতার ছোঁয়া। স্থানীয়রা একটি সুন্দর মসজিদও পরিচালনা করেন। নবী দিবস, বেগম রোকেয়া উৎসব প্রভৃতির মাধ্যমে তাঁরা শিক্ষা, সংস্কৃতি ও ধর্মীয় অনুষঙ্গগুলিকে পালন করে থাকেন। এই কাজে এলাকার অনেকে অগ্রণী। তার মধ্যে রয়েছেন পল্লীমঙ্গল সোসাইটির সভাপতি জনাব শেখ ইসমাইল হোসেন ও সম্পাদক শেখ আবুল কালাম। রয়েছেন শেখ শাহনওয়াজ মোল্লা ও আজাহারউদ্দীন মোল্লা প্রমুখ। তাঁদের এই রোকেয়া উৎসব ও কর্মকাণ্ডে স্থানীয় সাংসদ সৌগত রায় এবং বিধায়ক নির্মল ঘোষের রয়েছে স্বতঃস্ফূর্ত সহায়তা ও অংশগ্রহণ।
অনুষ্ঠান মঞ্চে বক্তব্য রাখেন হাজি রহিমবখ্শ্ ওয়াকফ স্টেটের সম্পাদক কুতুবউদ্দীন তরফদার। তিনি বলেন, বেগম রোকেয়া ছিলেন একজন সমাজ সংস্কারক। আমাদের সমাজে আরও বেগম রোকেয়া তৈরি করতে হবে। আর তার জন্য আমাদের মায়েদেরই এগিয়ে আসতে হবে। বেগম রোকেয়ার আদর্শ সমাজে নারীশিক্ষার প্রসার ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির সৃষ্টি করবে।
পুবের কলম পত্রিকার সম্পাদক আহমদ হাসান ইমরান তাঁর বক্তব্যে বলেন, আপনাদের আয়োজিত বেগম রোকেয়া উৎসব আরও গুরুত্ব রাখে এই জন্য যে, সোদপুরের এই অঞ্চলেই বেগম রোকেয়ার আত্মীয় জনাব আবদুল রহমান খাঁ সাহেবের বাগান বাড়িতে তাঁকে সমাধিস্থ করা হয়।
ইমরান বলেন, আমার এখানে আসা সম্ভব হয়েছে কুতুবউদ্দীন তরফদার সাহেবের আন্তরিক আমন্ত্রণে। কুতুবউদ্দীন সাহেব ও তাঁর সহযোগীরা প্রখ্যাত সুফি সাধক হযরত ফতেহ আলি ওয়েসি-র মানিকতলার মাজারে যে বড় ওয়াকফ সম্পত্তি রয়েছে তার পুর্নগঠন ও সেখানে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের কাজকর্মের সূচনা করে বাংলার মানুষের মন জয় করে নিয়েছেন। জনাব ইমরান বেগম রোকেয়াকে নারীশিক্ষা প্রসারের আইকন হিসেবে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সঙ্গে তুলনা করেন। তিনি বলেন, বিদ্যাসাগরের মতো বেগম রোকেয়াও শিক্ষা ও চিন্তার প্রসারে কলম ধরেছেন।
স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছেন, সমাজ সংস্কারে চেষ্টা করেছেন। বিদ্যাসাগরের সৌভাগ্য যে তাঁকে সমাজের বেশ কয়েকজন গণ্যমান্য ব্যক্তি তাঁর সহযোগিতায় এগিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু তাঁর এই যুদ্ধে বেগম রোকেয়া ছিল সম্পূর্ণ একাকিনী। কেমব্রিজ, অক্সফোর্ড থেকে পাশ করা ব্যক্তিরাও তাঁর বিরোধিতা করেন। কিন্তু নারীশিক্ষা প্রসারে তাঁকে সহযোগিতা করেছিলেন কয়েকজন মাওলানা। এরা হচ্ছেন মাওলানা আকরম খান, মাওলানা মুজিবর রহমান খান প্রমুখ। বেগম রোকেয়ার কর্মপ্রচেষ্টার প্রভাব শুধু তাঁর কর্মভূমি কলকাতাতেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, বরং তা বিরাট পরিবর্তন এনেছিল বাংলা, অসম ও বাংলাদেশের মুসলিম সমাজ জীবনে। ইমরান দুঃখ করে বলেন, বেগম রোকেয়ার কবরটি এখন আর খুঁজে পাওয়া যায় না। তবে তা চিহ্নিত করা প্রয়োজন। এলাকার একটি স্কুল যে দাবি করে, বেগম রোকেয়ার কবর নাকি ছিল তাদের স্কুলের মধ্যে, এই তথ্যের সপক্ষে কোনও প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

আহমদ হাসান ইমরান এবং জনাব কুতুবউদ্দীন তরফদার বেগম রোকেয়া লাইব্রেরিটি পরিদর্শন করেন। আহমদ হাসান ইমরান তাঁর লিখিত এবং সংখ্যালঘু উন্নয়ন ও বিত্ত নিগম প্রকাশিত ‘বেগম রোকেয়াঃ একটি জীবন, একটি ইতিহাস’ পুস্তিকাটির কয়েকটি কপি লাইব্রেরি ও এলাকার বিশিষ্ট ব্যক্তিদের হাতে তুলে দেন।






























