প্রভাবশালী গোষ্ঠীর মতই প্রাধান্য পায় আইন তৈরিতে: প্রধান বিচারপতি চন্দ্রচূড়

- আপডেট : ১৯ ডিসেম্বর ২০২২, সোমবার
- / 37
পুবের কলম, ওয়েবডেস্ক: ‘ডমিন্যান্ট গ্রুপ’ বা প্রভাবশালী গোষ্ঠী সমাজবিজ্ঞানে ব্যাপক আলোচিত একটি বিষয়। সমাজের বিভিন্ন নীতি-নির্ধারণে এইসব ধর্মীয়, অর্থনৈতিক বা সামাজিক ক্ষেত্রে উচ্চবর্ণের গোষ্ঠীগুলির ব্যাপক প্রভাব লক্ষ করা যায়। দেশ স্বাধীন হয়েছে ৭৫ বছর হয়ে গেল। তারপরও তথাকথিত উঁচু জাতের দাপট বা কর্তৃত্ব এখনও সামাজিক বৈষম্য জিইয়ে রেখেছে ভারতীয় সমাজে।
এই প্রতিপত্তিসম্পন্ন গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সহজে কেউ মুখ খুলতে চান না। সবাই তাদের চোখে ‘গুডবয়’ হিসেবে থাকতে চান। তবে এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রমী নজির দেখালেন সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড়। মাঝেমধ্যেই বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে তাঁকে সরব হতে দেখা গিয়েছে। শনিবার মুম্বইয়ে অশোক দেশাই মেমোরিয়াল লেকচার দিতে গিয়ে প্রভাবশালী গোষ্ঠীকে সজোরে বিঁধলেন তিনি।
এ ক্ষেত্রে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য, ‘দেশে আধিপত্যবাদী গোষ্ঠীর নীতি-আদর্শ আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে প্রভাব সৃষ্টি করে। তবুও সাধারণ মানুষ তাদের স্বাধীনতার সুরক্ষার জন্য বিচারব্যবস্থার উপরেই আস্থা রাখে। সেই বিচারব্যবস্থার আইনগুলি তৈরির সময় ডমিন্যান্ট গ্রুপ তাদের আধিপত্য বজায় রাখে। সমাজের অপেক্ষাকৃত দুর্বল শ্রেণির এখান থেকেই বঞ্চনার শুরু। আইনি ক্ষেত্রে দলিত বা সমাজের নিচু স্তরে বসবাসকারীদের বিরুদ্ধে উচ্চশ্রেণির সঙ্গে চিরস্থায়ী পক্ষপাতের সূচনা এভাবেই। আইন তৈরি হচ্ছে যখন উঁচু জাতের মন মতো, তখন দুর্বল শ্রেণি তার ফল ভোগ করছে।’
এ প্রসঙ্গে তিনি ভিন্জাতে বিয়ের ক্ষেত্রে ‘অনার কিলিং’-য়ের ঘটনাও সামনে তুলে আনেন।
এদিন প্রধান বিচারপতি ‘আইন ও নৈতিকতা’ নিয়ে বলতে গিয়ে জানান, আইন শুধু বাইরের সম্পর্কগুলি নিয়ন্ত্রণ করে। কিন্তু নৈতিকতা বা আদর্শবোধ আমাদের অন্তরকে নিয়ন্ত্রণ করে। আচরণকে প্রভাবিত করে। আর এ ক্ষেত্রে আধিপত্যকামী গোষ্ঠীগুলির নৈতিকতা প্রাধান্য পায়।
খেদের সঙ্গে তিনি বলেন, ‘এই প্রভাবশালী গোষ্ঠীগুলি দুর্বল গোষ্ঠীগুলির উপর আক্রমণ করে তাদের নিজস্ব আইডেন্টিটি বা পরিচিতি তৈরিতে বাধা দেয়।’ নৈতিকতার কোনও সর্বজনীন সূত্র নেই।
এ ক্ষেত্রে তাঁর মন্তব্য, কোনও একটি গোষ্ঠীর ক্ষেত্রে যা নৈতিক অন্য গোষ্ঠীর ক্ষেত্রে তা নাও হতে পারে। তাই সাংবিধানিক মূল্যবোধ নিয়ে আমাদের আলোচনা চালিয়ে যেতে হবে। ব্যক্তির পরিবর্তে প্রাধান্য দিতে হবে সাংবিধানিক নৈতিকতাকে। আমাদের গণতন্ত্রের সংসদীয় সিস্টেমে আইনগুলি পাশ হয় সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোটে। তাই যে পাবলিক মরালিটির কথা বলা হয়, তা আসলে সকলের নীতি নয়। শুধুমাত্র সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতই এতে প্রতিফলিত হয়।
এদিনের ভাষণে ভিন্ জাতে বিয়ের প্রসঙ্গটিও উঠে আসে। পরিবারের ইচ্ছার বিরুদ্ধে অন্য জাত-ধর্মের কাউকে বিয়ে করলে শত শত জনকে এ দেশে খুন করা হয় ‘অনার কিলিং’য়ের নামে।
প্রধান বিচারপতি চন্দ্রচূড় এ প্রসঙ্গে তুলে ধরেন উত্তরপ্রদেশে এক উচ্চবর্ণের মেয়ের সঙ্গে এক নিম্নবর্ণের ছেলের ভালোবাসার ঘটনা। এই ঘটনায় উচ্চবর্ণের লোকেরা তাদের হত্যা করেছিল। তিনি বলেন, এমন জঘন্য কাজকে ন্যায়সঙ্গত মনে করা হয়। এটা ধরে নেওয়া হয় যে সামাজিক পরম্পরা ও আচরণবিধি অনুযায়ী এটাই ঠিক।
‘লাভ জিহাদ’ নিয়ে বিজেপিশাসিত রাজ্যগুলি এখন বাড়াবাড়ি শুরু করেছে। ধর্মান্তরণের বিরুদ্ধে উত্তরপ্রদেশ, কর্নাটকের মতো বিজেপিশাসিত রাজ্যগুলি আইনও এনেছে। এই প্রেক্ষিতে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির মন্তব্য অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এই ধরনের আইন সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতকেই তুলে ধরছে এবং ধর্মীয় পক্ষপাতকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে বলে তিনি মনে করেন।