১০ মে ২০২৫, শনিবার, ২৭ বৈশাখ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

চলে গেলেন নজরুল গবেষক আজহারউদ্দীন খান

বিপাশা চক্রবর্তী
  • আপডেট : ২৪ জুন ২০২১, বৃহস্পতিবার
  • / 16

কামরুজ্জামান

আরও পড়ুন: মাদ্রাজ আইআইটিতে গবেষকের রহস্যমৃত্যু

দুই বাংলার সাহিত্য চর্চায় আজহারউদ্দীন খান এক গুরুত্বপূর্ণ নাম। তাঁর লেখা প্রবন্ধ ও গবেষণা গ্রন্থ বাংলায় তুলনামূলক সমালোচনা সাহিত্যের মহাসম্পদ।

অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলার বরণীয় সাহিত্যিক এবং দুই বাংলায় প্রথম নজরুল বিশেষজ্ঞ হিসেবে স্বীকৃত এবং উভয় বাংলায় পুরস্কৃত আজহারউদ্দীন খান ২২ জুন রাত ১১টা ৫০ মিনিটে নিজ বাসভবনে (সুদীপা) ইন্তেকাল করেছেন। ১৩ বছর ধরে প্রস্টেট ক্যান্সার ও দীর্ঘ বার্ধক্য জনিত সমস্যা ভোগের পর তিনি ইন্তেকাল করেন। মেদিনীপুর কুইকোটাস্থিত কবরস্থানে ২টো ৩০ মিনিটে তাঁকে দাফন করা হয়।

আজহারউদ্দীন খানের জন্ম ১৯৩০ সালের ১ জানুয়ারিমাতামহ দাদ আলি খানের মেদিনীপুরে অবস্থিত পীরবাজারের বাড়িতে। মা কামরুননেসা, বাবা নাসরুল্লাহ খান ওড়িষার কটকের বাসিন্দা হলেও কর্মসূত্রে থাকতেন খড়গপুরে। মামার বাড়িতে থেকেই বড় হয়েছেন তিনি। তাঁর হাতেখড়ি হয় বাড়ির মাতামহীর কাছে। বর্ণপরিচয় প্রথম ও দ্বিতীয় ভাগবোধোদয় পড়েছেন তাঁর কাছে। মাতামহী খুব যত্ন করে তাঁকে উর্দু কায়দা-ও শিখিয়েছিলেন। অতঃপর পাঁচ বছর বয়সে প্রাণকৃষ্ণ রানা-র পাঠশালায় ভর্তি হন। মাতামহীর আগ্রহে ১৯৩৮ সালের কলেজিয়েট স্কুলের সর্বনিম্ন ক্লাস তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তি হন। এই স্কুলেই চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ার সময়ই রবীন্দ্রনাথকে দেখেছিলেন।

১৯৩৯ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিদ্যাসাগর স্মৃতি মন্দিরের দ্বারোদ্ঘাটন করতে এসেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ছাত্রাবস্থায় রবীন্দ্রনাথকে দেখা এইভাবে বর্ণনা করেছেনরবীন্দ্রনাথকে দেখা এক পুণ্য সঞ্চয়। রবীন্দ্রনাথকে সরাসরি দেখা মেদিনীপুরের শেষ সাহিত্যিক চলে গেলেন। নানিআম্মার আগ্রহে কানাই ভৌমিক নামের একজন গৃহ শিক্ষকের কাছে পড়তেন। কানাই ভৌমিক পরবর্তীকালে জেলার অন্যতম কমিউনিস্ট নেতা ও পশ্চিমবঙ্গ সরকারের একাধিক দফতরের মন্ত্রী হন। কানাই ভৌমিকের প্রভাব তাঁর মনে স্থায়ী ছাপ ফেলে যায়। এভাবেই কৈশোর থেকে তিনি বামপন্থী মনোভাবাপন্ন হয়ে পড়েন।

১৯৪৬ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করে আজহারউদ্দীন খান মেদিনীপুর কলেজে আই.এ-তে ও পরে ১৯৪৮ সালে বি.এ ক্লাসে ভর্তি হলেন। ১৯৪৭ থেকে পাঠ্য বইয়ের ছাড়াও অন্য বিষয়ের পড়াশোনাপত্রিকা প্রকাশ নজরুল সম্পর্কে তথ্য-তালাশ করতে গিয়ে পরীক্ষার পড়া হয়ে ওঠেনি। ফলে বি.এ পরীক্ষা সম্পূর্ণ করতে পারেননি। বি.এ পাশ না করেই তিনি কলেজ ছাড়েন। আর এই সময় থেকে শুরু হয় তাঁর সাহিত্য প্রীতি।

লেখালেখিতে মনোনিবেশ করার আগে আজহারউদ্দীন খান-এর প্রধান নেশা ছিল বইপড়া। মুদ্রিত আকারে তাঁর প্রথম লেখা প্রকাশিত হয় ১৯৫০ সালের ২৯ জানুয়ারি রবিবারের যুগান্তর সাময়িকী কবি দর্শনে। যদিও তিনি প্রথম লেখাটি লেখেন মেদিনীপুরের রবীন্দ্রনাথ। মেদিনীপুরের কলেজ পত্রিকাটি ১৯৪৯ সালের পরিবর্তে প্রকাশিত হয় মার্চ ১৯৫০ সালে। তাই মুদ্রিত হিসেবে ‘কবি দর্শনে’ লেখাটি প্রথম প্রকাশিত রচনার মর্যাদা পেয়েছে। ১৯৫১ সালের যুগান্তর সাময়িকীর রবিবারে কায়কোবাদ এবং এস ওয়াজেদ আলিকে নিয়ে তাঁর দু’টি লেখা প্রকাশিত হয়।

সোশাল ক্যাডার শিক্ষক হিসেবে আজহারউদ্দীন খান ১৯৫৪ সালের জানুয়ারিতে ‘আধারনয়ন’ জুনিয়র হাই স্কুলেযোগ দেন মাসিক ৮০ টাকা বেতনে। এই কাজ তাঁর পছন্দ ছিল না। শহর ছেড়ে গ্রামে থাকানিজের পড়াশোনার কোনও সুযোগ না পাওয়াই ছিল এর প্রধান কারণ। আধারনয়নে সে সময় কোনও ডাকঘর ছিল না। তখন তাঁর প্রথম গ্রন্থ ‘বাংলা সাহিত্যে নজরুল’ প্রকাশের কাজ চলছে কলকাতায়। ৮টি প্রবন্ধ নিয়ে ডিমাই সাইজের ২১২ পৃষ্ঠার বহটিz মে মাসে প্রকাশিত হল। এখান থেকে কলকাতার সঙ্গে যোগাযোগ করাও কষ্টসাধ্য হচ্ছিল। সুযোগ খুঁজছিলেন মেদিনীপুরে চলে আসার। অচিরে মনের মতো কাজের সুযোগ এল। এক বিজ্ঞাপনে দেখলেনমেদিনীপুর জেলা গ্রন্থাগারে কর্মী নেওয়া হবে। আবেদন করলেন কর্মপ্রার্থী হিসাবে। মনোনীত হয়ে ১৯৫৭ সালের আগস্টে মাসিক ৭৫ টাকা বেতনে কাজে যোগ দেন। কাজের সঙ্গে প্রচুর বই পড়ার অফুরন্ত সুযোগজ্ঞানের দরজা হল অবাধ ও উন্মুক্ত। জেলা গ্রন্থাগারে কাজ করতে এসে ১৯৭২ সালে বি.এ এবং ১৯৭৭ সালে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি.লিব.এস.সি পাশ করলেন। অবশ্য ১৯৫৯ সালে বেঙ্গল লাইব্রেরি অ্যাসোসিয়েশন থেকে Lib.Sc সার্টিফিকেট কোর্স করেছিলেন।

পঞ্চাশের দশক থেকে তিনি লিখছেন। দীর্ঘ ষাট বছরের সময়কালে তিনি প্রায় দেড় শতাধিক মূল্যবান প্রবন্ধ লিখেছেন। রচনা করেছেন ১৭টি গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ-গ্রন্থ১৫টি গ্রন্থ এবং ৩টি পত্রিকা সম্পাদনায় তিনি নিবিড়ভাবে যুক্ত ছিলেন। লিখেছেন ৩৩টি গ্রন্থের ভূমিকা। ১০ জন লেখক ১০টি গ্রন্থ তাঁকে উৎসর্গ করেছেন। সাহিত্যিক আজাহারউদ্দীন খানের লেখার বৈশিষ্ট্য, প্রধানত সাহিত্য চর্চার যে সমস্ত দিক অনালোচিত বা যেসব প্রতিভাবান সারস্বত ব্যক্তি সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ আলোচনা বা গ্রন্থ রচনায় কেউ উৎসাহবোধ করেননিসেসব বিষয়ে তিনি গবেষণামূলক বই লিখেছেন। যেমনবাংলা সাহিত্যে নজরুলবাংলা সাহিত্যে মোহিতলালবাংলা সাহিত্যে মুহাম্মদ শহীদুল্লাহবাংলা সাহিত্যে মুহাম্মদ আবদুল হাইগ্যেটে ও বাংলা সাহিত্য ইত্যাদি। ‘বিলুপ্ত হৃদয়’ (মীর মোশারফ হোসেনমোজাম্মেল হক প্রমুখের জীবনী)‘রক্তাক্ত প্রান্তর’ (মুনীর চৌধুরী)‘মাঘ নিশীথের কোকিল’ ,(আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ)‘অফুরন্ত রৌদ্রের তিমির’ (শাহাদাত হোসেন)‘মেধাবী নীলিমা'(মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ)‘দীপ্ত আলোর বন্যা'(আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদমুহাম্মদ শহীদুল্লাহমুহাম্মদ আবদুল হাইমুনীর চৌধুরী)। লিখেছেনসাহিত্য সাধনায় বিদ্যাসাগরবঙ্কিমচন্দ্র অন্য ভাবনায়।

দু’পার বাংলায় নানাবিধ সাহিত্য পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছেন— নজরুল পুরস্কার (১৯৮২)মুহাম্মদ আবদুল হাই পুরস্কার (১৯৮৩) বাংলাদেশবঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ (১৯৯৭)নজরুল পুরস্কার (২০০৩) পশ্চিমবঙ্গ সরকার২০০৭ সালে বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক ডি.লিট সাম্মানিক। ১৯৮৩ সালে পশ্চিমবঙ্গ গণতান্ত্রিক লেখক-শিল্পী সংঘের সভাপতি নির্বাচিত (আমৃত্যু)১৯৮৯-২০১৪ রাজ্য হজ কমিটির সহ-সভাপতি।

২২ জুন মৃত্যুকালে রেখে গেলেন স্ত্রী হাসনা বানু ও দুই পুত্র আরিফ খান (রিপন)আসিফ খান (সুমন)-কে। তাঁর মৃত্যুকে ‘বাংলা প্রবন্ধ ও জীবনী সাহিত্যে’ অপূরণীয় শূন্যস্থান তৈরি হল।

ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ছিলেন খুবই বিনয়ী। পাণ্ডিত্যের কোনও গর্ব বা নিজেকে তুলে ধরার কোনও প্রচেষ্টাই তাঁর মধ্যে ছিল না। নজরুল চর্চার ক্ষেত্রে আজহারউদ্দীন খান ছিলেন পথিকৃতদের একজন।

পুবের কলম পত্রিকার সম্পাদক আমহদ হাসান ইমরান তাঁর প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করে বলেন এই গুণী ও আমৃত্যু গবেষক বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন। বিনয়ী এই মানুষটির ইন্তেকালে আমি তাঁর রুহের মাগফেরাত কামনা করছি এবং তাঁর শোক সন্তপ্ত পরিবারকে সমবেদনা জানাচ্ছি।

Copyright © Puber Kalom All rights reserved.| Developed by eTech Builder

চলে গেলেন নজরুল গবেষক আজহারউদ্দীন খান

আপডেট : ২৪ জুন ২০২১, বৃহস্পতিবার

কামরুজ্জামান

আরও পড়ুন: মাদ্রাজ আইআইটিতে গবেষকের রহস্যমৃত্যু

দুই বাংলার সাহিত্য চর্চায় আজহারউদ্দীন খান এক গুরুত্বপূর্ণ নাম। তাঁর লেখা প্রবন্ধ ও গবেষণা গ্রন্থ বাংলায় তুলনামূলক সমালোচনা সাহিত্যের মহাসম্পদ।

অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলার বরণীয় সাহিত্যিক এবং দুই বাংলায় প্রথম নজরুল বিশেষজ্ঞ হিসেবে স্বীকৃত এবং উভয় বাংলায় পুরস্কৃত আজহারউদ্দীন খান ২২ জুন রাত ১১টা ৫০ মিনিটে নিজ বাসভবনে (সুদীপা) ইন্তেকাল করেছেন। ১৩ বছর ধরে প্রস্টেট ক্যান্সার ও দীর্ঘ বার্ধক্য জনিত সমস্যা ভোগের পর তিনি ইন্তেকাল করেন। মেদিনীপুর কুইকোটাস্থিত কবরস্থানে ২টো ৩০ মিনিটে তাঁকে দাফন করা হয়।

আজহারউদ্দীন খানের জন্ম ১৯৩০ সালের ১ জানুয়ারিমাতামহ দাদ আলি খানের মেদিনীপুরে অবস্থিত পীরবাজারের বাড়িতে। মা কামরুননেসা, বাবা নাসরুল্লাহ খান ওড়িষার কটকের বাসিন্দা হলেও কর্মসূত্রে থাকতেন খড়গপুরে। মামার বাড়িতে থেকেই বড় হয়েছেন তিনি। তাঁর হাতেখড়ি হয় বাড়ির মাতামহীর কাছে। বর্ণপরিচয় প্রথম ও দ্বিতীয় ভাগবোধোদয় পড়েছেন তাঁর কাছে। মাতামহী খুব যত্ন করে তাঁকে উর্দু কায়দা-ও শিখিয়েছিলেন। অতঃপর পাঁচ বছর বয়সে প্রাণকৃষ্ণ রানা-র পাঠশালায় ভর্তি হন। মাতামহীর আগ্রহে ১৯৩৮ সালের কলেজিয়েট স্কুলের সর্বনিম্ন ক্লাস তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তি হন। এই স্কুলেই চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ার সময়ই রবীন্দ্রনাথকে দেখেছিলেন।

১৯৩৯ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিদ্যাসাগর স্মৃতি মন্দিরের দ্বারোদ্ঘাটন করতে এসেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ছাত্রাবস্থায় রবীন্দ্রনাথকে দেখা এইভাবে বর্ণনা করেছেনরবীন্দ্রনাথকে দেখা এক পুণ্য সঞ্চয়। রবীন্দ্রনাথকে সরাসরি দেখা মেদিনীপুরের শেষ সাহিত্যিক চলে গেলেন। নানিআম্মার আগ্রহে কানাই ভৌমিক নামের একজন গৃহ শিক্ষকের কাছে পড়তেন। কানাই ভৌমিক পরবর্তীকালে জেলার অন্যতম কমিউনিস্ট নেতা ও পশ্চিমবঙ্গ সরকারের একাধিক দফতরের মন্ত্রী হন। কানাই ভৌমিকের প্রভাব তাঁর মনে স্থায়ী ছাপ ফেলে যায়। এভাবেই কৈশোর থেকে তিনি বামপন্থী মনোভাবাপন্ন হয়ে পড়েন।

১৯৪৬ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করে আজহারউদ্দীন খান মেদিনীপুর কলেজে আই.এ-তে ও পরে ১৯৪৮ সালে বি.এ ক্লাসে ভর্তি হলেন। ১৯৪৭ থেকে পাঠ্য বইয়ের ছাড়াও অন্য বিষয়ের পড়াশোনাপত্রিকা প্রকাশ নজরুল সম্পর্কে তথ্য-তালাশ করতে গিয়ে পরীক্ষার পড়া হয়ে ওঠেনি। ফলে বি.এ পরীক্ষা সম্পূর্ণ করতে পারেননি। বি.এ পাশ না করেই তিনি কলেজ ছাড়েন। আর এই সময় থেকে শুরু হয় তাঁর সাহিত্য প্রীতি।

লেখালেখিতে মনোনিবেশ করার আগে আজহারউদ্দীন খান-এর প্রধান নেশা ছিল বইপড়া। মুদ্রিত আকারে তাঁর প্রথম লেখা প্রকাশিত হয় ১৯৫০ সালের ২৯ জানুয়ারি রবিবারের যুগান্তর সাময়িকী কবি দর্শনে। যদিও তিনি প্রথম লেখাটি লেখেন মেদিনীপুরের রবীন্দ্রনাথ। মেদিনীপুরের কলেজ পত্রিকাটি ১৯৪৯ সালের পরিবর্তে প্রকাশিত হয় মার্চ ১৯৫০ সালে। তাই মুদ্রিত হিসেবে ‘কবি দর্শনে’ লেখাটি প্রথম প্রকাশিত রচনার মর্যাদা পেয়েছে। ১৯৫১ সালের যুগান্তর সাময়িকীর রবিবারে কায়কোবাদ এবং এস ওয়াজেদ আলিকে নিয়ে তাঁর দু’টি লেখা প্রকাশিত হয়।

সোশাল ক্যাডার শিক্ষক হিসেবে আজহারউদ্দীন খান ১৯৫৪ সালের জানুয়ারিতে ‘আধারনয়ন’ জুনিয়র হাই স্কুলেযোগ দেন মাসিক ৮০ টাকা বেতনে। এই কাজ তাঁর পছন্দ ছিল না। শহর ছেড়ে গ্রামে থাকানিজের পড়াশোনার কোনও সুযোগ না পাওয়াই ছিল এর প্রধান কারণ। আধারনয়নে সে সময় কোনও ডাকঘর ছিল না। তখন তাঁর প্রথম গ্রন্থ ‘বাংলা সাহিত্যে নজরুল’ প্রকাশের কাজ চলছে কলকাতায়। ৮টি প্রবন্ধ নিয়ে ডিমাই সাইজের ২১২ পৃষ্ঠার বহটিz মে মাসে প্রকাশিত হল। এখান থেকে কলকাতার সঙ্গে যোগাযোগ করাও কষ্টসাধ্য হচ্ছিল। সুযোগ খুঁজছিলেন মেদিনীপুরে চলে আসার। অচিরে মনের মতো কাজের সুযোগ এল। এক বিজ্ঞাপনে দেখলেনমেদিনীপুর জেলা গ্রন্থাগারে কর্মী নেওয়া হবে। আবেদন করলেন কর্মপ্রার্থী হিসাবে। মনোনীত হয়ে ১৯৫৭ সালের আগস্টে মাসিক ৭৫ টাকা বেতনে কাজে যোগ দেন। কাজের সঙ্গে প্রচুর বই পড়ার অফুরন্ত সুযোগজ্ঞানের দরজা হল অবাধ ও উন্মুক্ত। জেলা গ্রন্থাগারে কাজ করতে এসে ১৯৭২ সালে বি.এ এবং ১৯৭৭ সালে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি.লিব.এস.সি পাশ করলেন। অবশ্য ১৯৫৯ সালে বেঙ্গল লাইব্রেরি অ্যাসোসিয়েশন থেকে Lib.Sc সার্টিফিকেট কোর্স করেছিলেন।

পঞ্চাশের দশক থেকে তিনি লিখছেন। দীর্ঘ ষাট বছরের সময়কালে তিনি প্রায় দেড় শতাধিক মূল্যবান প্রবন্ধ লিখেছেন। রচনা করেছেন ১৭টি গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ-গ্রন্থ১৫টি গ্রন্থ এবং ৩টি পত্রিকা সম্পাদনায় তিনি নিবিড়ভাবে যুক্ত ছিলেন। লিখেছেন ৩৩টি গ্রন্থের ভূমিকা। ১০ জন লেখক ১০টি গ্রন্থ তাঁকে উৎসর্গ করেছেন। সাহিত্যিক আজাহারউদ্দীন খানের লেখার বৈশিষ্ট্য, প্রধানত সাহিত্য চর্চার যে সমস্ত দিক অনালোচিত বা যেসব প্রতিভাবান সারস্বত ব্যক্তি সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ আলোচনা বা গ্রন্থ রচনায় কেউ উৎসাহবোধ করেননিসেসব বিষয়ে তিনি গবেষণামূলক বই লিখেছেন। যেমনবাংলা সাহিত্যে নজরুলবাংলা সাহিত্যে মোহিতলালবাংলা সাহিত্যে মুহাম্মদ শহীদুল্লাহবাংলা সাহিত্যে মুহাম্মদ আবদুল হাইগ্যেটে ও বাংলা সাহিত্য ইত্যাদি। ‘বিলুপ্ত হৃদয়’ (মীর মোশারফ হোসেনমোজাম্মেল হক প্রমুখের জীবনী)‘রক্তাক্ত প্রান্তর’ (মুনীর চৌধুরী)‘মাঘ নিশীথের কোকিল’ ,(আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ)‘অফুরন্ত রৌদ্রের তিমির’ (শাহাদাত হোসেন)‘মেধাবী নীলিমা'(মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ)‘দীপ্ত আলোর বন্যা'(আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদমুহাম্মদ শহীদুল্লাহমুহাম্মদ আবদুল হাইমুনীর চৌধুরী)। লিখেছেনসাহিত্য সাধনায় বিদ্যাসাগরবঙ্কিমচন্দ্র অন্য ভাবনায়।

দু’পার বাংলায় নানাবিধ সাহিত্য পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছেন— নজরুল পুরস্কার (১৯৮২)মুহাম্মদ আবদুল হাই পুরস্কার (১৯৮৩) বাংলাদেশবঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ (১৯৯৭)নজরুল পুরস্কার (২০০৩) পশ্চিমবঙ্গ সরকার২০০৭ সালে বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক ডি.লিট সাম্মানিক। ১৯৮৩ সালে পশ্চিমবঙ্গ গণতান্ত্রিক লেখক-শিল্পী সংঘের সভাপতি নির্বাচিত (আমৃত্যু)১৯৮৯-২০১৪ রাজ্য হজ কমিটির সহ-সভাপতি।

২২ জুন মৃত্যুকালে রেখে গেলেন স্ত্রী হাসনা বানু ও দুই পুত্র আরিফ খান (রিপন)আসিফ খান (সুমন)-কে। তাঁর মৃত্যুকে ‘বাংলা প্রবন্ধ ও জীবনী সাহিত্যে’ অপূরণীয় শূন্যস্থান তৈরি হল।

ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ছিলেন খুবই বিনয়ী। পাণ্ডিত্যের কোনও গর্ব বা নিজেকে তুলে ধরার কোনও প্রচেষ্টাই তাঁর মধ্যে ছিল না। নজরুল চর্চার ক্ষেত্রে আজহারউদ্দীন খান ছিলেন পথিকৃতদের একজন।

পুবের কলম পত্রিকার সম্পাদক আমহদ হাসান ইমরান তাঁর প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করে বলেন এই গুণী ও আমৃত্যু গবেষক বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন। বিনয়ী এই মানুষটির ইন্তেকালে আমি তাঁর রুহের মাগফেরাত কামনা করছি এবং তাঁর শোক সন্তপ্ত পরিবারকে সমবেদনা জানাচ্ছি।