বস্তি থেকে কাতারের বিশ্বকাপ মঞ্চ, বিশ্ব মাতাচ্ছেন ঘানার মুহাম্মদ কুদুস

- আপডেট : ৩০ নভেম্বর ২০২২, বুধবার
- / 13
বিশেষ প্রতিবেদন: সোমবার এডুকেশন সিটি স্টেডিয়ামে কাতার বিশ্বকাপে টিকে থাকার লড়াইয়ে নেমেছিল টিম ঘানা। ফিফা ranking ২৮ নম্বরে থাকা দক্ষিণ কোরিয়ার মুখোমুখি হয়েছিল ৬১ নম্বরে থাকা আফ্রিকা মহাদেশের এই দলটি।
যদিও শেষ পর্যন্ত একটা উত্তেজনাপূর্ণ ম্যাচে তুলনায় শক্তিশালী দক্ষিণ কোরিয়ারকে ৩-২ গোলে হারিয়ে দিল ঘানা। মুহাম্মদ সালিসু ও কুদুস মুহাম্মদের গোলে এগিয়ে থেকে বিরতিতে যায় ঘানা। বিরতি থেকে ফিরেই দুই গোল শোধ করে দক্ষিণ কোরিয়া। তবে শেষ পর্যন্ত সেই মুহাম্মদ কুদুসের জোড়া গোলের ওপর ভর করে অসম্ভবকে সম্ভব করল ঘানা। জয় নিয়ে মাঠ ছাড়ে ঘানা। আর এতে তাদের নকআউটে যাওয়ার রাস্তা অনেকটাই প্রশস্ত হয়ে যায়।
এবারের ঘানার বিশ্বকাপ দলে যতজন মুসলিম ফুটবলার খেলছেন, তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য পারফরম্যান্স করছেন আবদুল ফাতাউ, উসমান বুখারি, ইব্রাহিম দানলাদ, আবদুল মুনাফ নুরুদ্দিন, বাবা রহমান, মুহাম্মদ সালিসু।
আগের ম্যাচগুলিতে উসমান বুখারি ও মুহাম্মদ সালিসুকে গোল করতে দেখা গেলেও, নজরকাড়া পারফরম্যান্স করে সবার নজর কেড়েছেন মুহাম্মদ কুদুস। শেষ ম্যাচে কোরিয়ার জালে জোড়া বল ঠেলে নেদারল্যান্ডসের ক্লাব আয়াক্সের এই ফুটবলারকে এরইমধ্যে চিনে গিয়েছেন ফুটবলপ্রেমীরা।
ক্লাবের হয়ে কঠিন মুহূর্তে গোল করা, প্রতিপক্ষের ডিফেন্ডারদের বিরুদ্ধে ড্রিবলিং, গোলের সুযোগ তৈরি করা এবং মাঝেমধ্যে মাঠে দুর্দান্ত নৈপুণ্যের পরিচয় দিয়ে ভক্তদের কাছে ক্রমে জনপ্রিয় হয়ে উঠছেন তিনি। ঘানার গর্বের প্রতীক এই ফুটবলারের সামনে ছিল বিশ্বকাপ মঞ্চে নিজেকে প্রমাণ করার। পর্তুগালের বিপক্ষে তিনি গোল না পেলেও নজরকাড়া ফুটবল খেলে সবার মন জেতেন। তার ওপর বিশ্বের অন্যতম সেরা ফুটবলার ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোর বিরুদ্ধে খেলতে নেমে যেন বাড়তি আত্মবিশ্বাস পেয়ে গিয়েছিলেন। তাই তো শান্তশিষ্ট চেহারের নিমার এই তরুণ ফুটবলার কোরিয়া ম্যাচে জোড়া গোল করে নিজের ফুটবল জাত চিনিয়ে দিলেন।
ঘানার রাজধানী আক্রার জনবহুল এলাকা নিমার বাসিন্দা মুহাম্মদ কুদুসের একসময়ের জীবন ছিল খানাখন্দে ভরা। নিমা এমন একটি এলাকা যা মাদক কারবারি, অপরাধ গ্যাংস্টার ও নানা ধরনের অনৈতিক কার্যক্রমের আখড়া। সেই জায়গায় জন্ম নেওয়া যেকোনও শিশু স্বাভাবিকভাবে অপরাধের জগতের দিকে এগিয়ে যাবে। তবে কুদুসের ক্ষেত্রে তেমনটা ঘটেনি। শিক্ষা ও ফুটবলকে সঙ্গে নিয়ে সমাজের একেবারে নিচুতলা থেকে উঠে এসেছেন আলোয় উদ্ভাসিত হতে। তরুণ কুদুসের মধ্যে যেমন ছিল ফুটবল প্রতিভা, তেমনই ক্লাসরুমে পড়ালেখায়ও ছিলেন মেধাবী।
‘বুকস অ্যান্ড বুটস’ নামক একটি এনজিওর সাহায্যে নিমায় ফুটবলের সঙ্গে লেখাপড়া চালিয়ে যান তিনি। যার ফলও তিনি পেলেন হাতে নাতে। জীর্ণদশার কাওউকুডি পার্ক মাঠে ফুটবল নিয়ে বেড়ে ওঠা কুদুস এখন নিজের বাঁ-পায়ের জাদুতে মুগ্ধ করেছে গোটা বিশ্বকে।
শৈশবে কুদুস মুহাম্মদ স্ট্রং টাওয়ার এফসির হয়ে খেলতেন। জুনিয়র লেভেলে একবার পাওয়ারলাইনস এফসি ক্লাবের বিপক্ষে এক হাইপ্রোফাইল ম্যাচে খেলার পর সতীর্থরা ১১ বছর বয়সি কিশোর কুদুসকে তার দুর্দান্ত পারফরম্যান্সের জন্য কাঁধে তুলে হইহই করেছিল। সেই থেকেই খেলার মাঠে প্রভাব বিস্তার করা শুরু করে নিজের লক্ষ্যে অটুট থাকতেন। পূর্ব ঘানার রাইট টু ড্রিম অ্যাকাডেমিতে যেতেন কুদুস। সেই অ্যাকাডেমির পরিচালক কিং ওসেই গিয়ান বলেন, ‘কুদুস মুহাম্মদ আফ্রিকার পরবর্তী প্রজন্মের উজ্জ্বল তারকা হতে চলেছেন।’
অ্যাকাডেমির ডেভালপমেন্ট বিভাগের কোচ ওমান আবদুল রবি বলেন, ‘প্রথম দিনে কুদুস অ্যাকাডেমিতে পা রেখেই নিজের প্রতিভা চিনিয়েছিলেন। যেভাবে সে বল নিয়ে দৌড়াচ্ছিল, তার প্রতিটি টাচে বোঝা যাচ্ছিল যে সে একদিন ঘানাকে বিশ্বকাপের মঞ্চে তুলে ধরবেন। আজ সেটাই হতে দেখলাম।’
রাইট টু ড্রিম অ্যাকাডেমিতে তার খেলার ধরনে বৈচিত্র্যতা থাকার সুবাদে মিডফিল্ড এবং কখনও কখনও উপরের দিকে উঠে এসেও খেলেছেন। যার ফলে সহজে সতীর্থদের কাছেও তারকায় পরিণত হন কুদুস। সেই অ্যাকাডেমির পরিচালক গিয়ান নিজেও ঘানার জাতীয় দল এবং ফুলহ্যামের হয়ে খেলেছেন। তিনি বুঝেছিলেন, কুদুসের মধ্যে যোগ্যতা, সামর্থ্য ও পরিশ্রমের অপূর্ব মিলন রয়েছে। তার মধ্যেই ১৮-র কুদুস ডাক পেলেন ড্যানিশ ক্লাব এফসি নরশাইলান্ডে।
এক মরশুম খেলে ১১টি গোল পান। ডেনমার্কে ১৮ মাস কাটানোর পর ২০২০ সালে আয়াক্সের যোগ দেন। ২০২০ সালে ইউরোপে খেলা ‘মোস্ট ইমপ্রেসিভ ইয়ংস্টার হিসেবে ‘গোল্ডেন বয় অ্যাওয়ার্ড’ এর জন্য মনোনীত হন।
চলতি মরশুমে আয়াক্সের হয়ে ১০টি গোল ও দুটি অ্যাসিস্ট করেছেন কুদুস। তার খ্যাতি এতটাই বেড়েছে যে লিভারপুলের কোচ জুরগেন ক্লপ এখন কুদুসকে চাইছেন সাদিও মানের জায়গায়। ফরাসি কিংবদন্তি থিয়েরি অঁরিও কুদুসে মুগ্ধ। এখন দেখার, বিশ্বকাপের মঞ্চে কীভাবে নিজের পাশাপাশি কীভাবে নিজের দেশ ঘানাকেও একটা আলাদা উচ্চতায় তুলে নিয়ে গিয়ে নতুন ভোরের / স্বপ্নের উপখ্যান লেখেন এই ২২ বছরের কুদুস।