বিশেষ প্রতিবেদন: বিশ্বজুড়ে ধনী-দরিদ্রদের মধ্যে বৈষম্য ক্রমশই প্রকট হচ্ছে। আর এই বৈষম্যের কারণে প্রায় ২৫ কোটির বেশি মানুষ চরম দারিদ্র্যের মুখোমুখি হতে চলেছে আগামীদিনে, এমনটাই জানানো হয়েছে অক্সফামের একটি রিপোর্টে। দুনিয়াকে সতর্ক করে দিয়ে অক্সফামের গবেষণামূলক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এখন থেকে যদি সচেতন হওয়া না যায়, তাহলে বিশ্ব চরম দারিদ্র্য ও দুর্ভোগের ইতিহাসের সাক্ষী থাকবে।
প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, বিশ্বজুড়ে ধনী এবং দরিদ্রের মধ্যে ব্যবধান হাতের বাইরে চলে যাওয়ায়, এই অবস্থা কয়েক কোটি মানুষের জীবনকে বিপন্ন করে তুলেছে। গত আড়াই দশকে চরম দারিদ্র্যের ধারাবাহিকভাবে পতন ঘটেছে।
অক্সফামের বৈশ্বিক বৈষম্য গবেষণা সমন্বয়কারী অ্যান্থনি কামান্দে বলেন, এই অবস্থার অন্যতম কারণ করোনা। এই মহামারির সঙ্গে লড়াই করতে করতে বিশেষ দরিদ্র দেশগুলিতে এর মারাত্মক প্রভাব পড়েছে। ২৫ বছরের মধ্যে প্রথমবারের মতো, চরম সম্পদ এবং চরম দারিদ্র্য একই সঙ্গে তীব্রভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০১৯ এ থেকে ২০২০ সালে দারিদ্রতা ১২ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। যা ৯ কোটি মানুষকে চরম দারিদ্র্যের দিকে ঠেলে দিয়েছে। ২০২২-এ ৬৭ কোটি মানুষ চরম দারিদ্র্যের মধ্যে বসবাস করছে, যার মধ্যে প্রায় ৪১ কোটি মানুষের সংখ্যা রয়েছে শুধুমাত্র আফ্রিকার সাহারানে। যারা এই চরম দারিদ্র্যের শিকার তাদের প্রতিদিনের আয় ভারতীয় মুদ্রায় ১৭৬ টাকারও কম। এর ফলে ক্ষুধা, অপুষ্টিজনিত সমস্যা, মানব উন্নয়ন হ্রাস পেয়েছে। ২০৩০ সালের মধ্যে যে লক্ষ্য পূরণের লক্ষ্যমাত্রা নেওয়া হয়েছিল সেখান থেকে ক্রমশ পিছিয়ে যাচ্ছে দেশগুলি।
সাম্প্রতিক সংকটগুলি ‘দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বিশাল বিপর্যয়’ সৃষ্টি করেছে। মানুষের দলে দলে চাকরি হারানো থেকে, মজুরি হ্রাস, কাজের মান খারাপের সমস্যা আরও প্রকট হচ্ছে। বিশেষ করে দরিদ্র দেশগুলি আর্থিক সংকোচনের সম্মুখীন হচ্ছে, এই সমস্ত পরিস্থিতিই বিশ্বের দরিদ্রতম মানুষের জীবন ও জীবিকাকে হুমকির সামনে ফেলে দিচ্ছে।
অক্সফাম সতর্ক করেছে যে, কোভিড-১৯-এর কারণে তৈরি হওয়া অর্থনৈতিক সংকটের উপর দাঁড়িয়ে, ইউক্রেনের যুদ্ধের কারণে খাদ্যের দাম এবং জ্বালানি খরচ আকাশছোঁয়া পর্যায়ে গেছে, যা আরও ১০০ কোটি মানুষকে চরম দারিদ্র্যের দিকে ঠেলে দিতে পারে। এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণে আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপের দাবি জানিয়েছেন গবেষকেরা।
অক্সফাম আন্তর্জাতিক এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর গাব্রিয়েলা বুচার, মূল সমস্যা অনুসন্ধান করে গোটা বিশ্বকেই সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন। ২০২০ সাল থেকে সবচেয়ে ধনীদের মধ্য ১ শতাংশ নতুন সম্পদের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ সম্পদ দখল করেছে, যা বিশ্বের ৯৯ শতাংশ জনসংখ্যার তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ অর্থ। ২০২২ সালে যখন খাদ্য ও শক্তি কোম্পানিগুলি দ্বিগুণ মুনাফা লুটেছে, শেয়ার হোল্ডারগুলি টাকা কামিয়েছে, সেই সময় প্রায় ৮ কোটির মতো মানুষ ক্ষুধার যন্ত্রণায় ভুগেছে। এর থেকে বোঝা যায়, জীবনযাত্রার সংকটের সময়ে বিশ্ব নির্দিষ্ট গতিপথে চলতে পারছে না।
কামান্দে আহ্বান জানিয়েছেন, করোনা, ইউক্রেন যুদ্ধ পরিস্থিতি থেকে যে সংস্থাগুলি লাভবান হয়েছে তাদের এই সংকটের মুহূর্তে আরও বেশি করে কর প্রদান করা উচিৎ।
কিন্তু দেখা যাচ্ছে, ধনীরা কর কমিয়ে লাভবান হচ্ছে আর দরিদ্রদের ঘাড়ে করের বোঝা ক্রমশ বাড়ছে। এই অবস্থায় আরও দেখা যায়, স্বাস্থ্য পরিষেবার মৌলিক সুবিধা থেকে দরিদ্ররা বঞ্চিত হওয়া ছাড়াও শিক্ষা এখন ধনীদের একচেটিয়া অধিকার হয়ে দাঁড়িয়েছে। নতুন উদারনৈতিক অর্থনৈতিক নীতির সঙ্গে আবদ্ধ হয়েছে বাজারের উদারীকরণের সমস্যা, যা দরিদ্র দেশগুলির দরিদ্র জনগণকে নেতিবাচক দিকে ঠেলে দিচ্ছে। সেই সঙ্গে দুর্নীতি, সরকারি সম্পত্তির নয়ছয়, গোষ্ঠী দ্বন্দ্ব এই ঝুঁকির দিকগুলিকে আরও বাড়িয়ে তুলছে।
একটি দেশ বা সমাজের অগ্রগতির প্রাথমিক শর্তই হল সুশাসন থাকা। সব সমস্যার মূল কারণ হল সুশাসনের অভাব। সেটা না থাকলে উন্নয়নে অর্থই ব্যয় হবে, উন্নয়ন হবে না। জিডিপি, মাথাপিছু আয় বাড়লেও বৈষম্যের কারণে বিপুল মানুষ তার প্রাপ্য সুফল থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। ফলসরূপ শ্রেণীসহ বিভিন্ন বৈষম্য, বেকারত্ব, দরিদ্রতা, সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতা, দুর্নীতি ও অর্থের অপচয় এবং লুটপাট বেড়েছে। তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়ন ও শাসন প্রক্রিয়ায় সুশাসন এক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। নাগরিক অধিকার প্রতিষ্ঠা, নারীর ক্ষমতায়ন, দুর্নীতি রোধ বা নির্মূল, অর্থনৈতিক উন্নয়ন, শিল্পায়ন সব ক্ষেত্রেই সুশাসন জরুরি। আর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বৈষম্যের কারণে কাঙ্ক্ষিত হারে দেশের দারিদ্র্য কমছে না। এই বৈষম্য যেমন আয়ের ক্ষেত্রে, তেমনি রয়েছে জীবন ধারণের নানা বিষয়ের ক্ষেত্রেও।