০৩ জুলাই ২০২৫, বৃহস্পতিবার, ১৮ আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

‘ছেলে নির্দোষ, ছাড়ানোর ব্যবস্থা করো বাপ’ বাড়িতে কেউ এলেই কাতর আর্জি ইউয়ানের মায়ের

পুবের কলম
  • আপডেট : ১৮ নভেম্বর ২০২১, বৃহস্পতিবার
  • / 16

জঙ্গি সন্দেহে মুর্শিদাবাদের ডোমকল থেকে ছ’জন ও কেরল থেকে আরও তিনজনকে গ্রেফতার করেছিল জাতীয় তদন্তকারী সংস্থা এনআইএ। তারপর কেটে গিয়েছে প্রায় সাড়ে তেরো মাস। গ্রেফতার হওয়া যুবকদের পরিজনদের সঙ্গে কথা বলে ধারাবাহিকভাবে লিখছেন ‘পুবের কলম’ প্রতিনিধি জিশান আলি মিঞা। আজ চতুর্থ কিস্তি।

মুর্শিদাবাদের জঙ্গিযোগে নাম জড়ানোর প্রায় সাড়ে তেরো মাস হয়ে গেল। কেরলের এরনাকুলাম থেকে তিনজন ডোমকলের পরিযায়ী শ্রমিককে গ্রেফতার করার পাশাপাশি ডোমকল– রানিনগর– জলঙ্গির বিভিন্ন গ্রামে অভিযান চালিয়ে আরও ছয় সন্দেভাজনকে গ্রেফতার করে জাতীয় তদন্তকারী সংস্থা এনআইএ। তাদের মধ্যে অন্যতম ডোমকলের বাসিন্দা বছর পঁচিশের লি ইউয়ান আহমেদ। গতবছর ১৯ সেপ্টেম্বর ভোরে ডোমকলের বাড়ি থেকে তাকে গ্রেফতার করেন তদন্তকারীরা। তাঁর কাছ থেকে একটি পিস্তল ও বুলেট প্রুফ জ্যাকেট পায় বলে দাবি করেন তাঁরা। গ্রেফতারের প্রায় দশ দিন পর তাঁকে নিয়ে ফের ডোমকলের বাড়িতে তল্লাশি চালান তদন্তকারীরা। জলঙ্গির বিএসএফ ক্যাম্পে বসিয়ে তাঁকে জেরাও করা হয়। জানা গিয়েছে– বর্তমানে ধৃত বাকিদের সঙ্গে তাঁরও ঠাঁই হয়েছে দিল্লির তিহার জেলে।

আরও পড়ুন: হাজারও মুসল্লির ঢল, উৎসবের আবহে ঈদ-উল-আযহা’র নামায সম্পন্ন লোহরপুর ঈদগাহ ময়দানে

এলাকায় ভালো ছেলে হিসেবেই পরিচিত ছিলেন তিনি। ডোমকলের এক বেসরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের আংশিক সময়ের কর্মী ছিলেন লি ইউয়ান আহমেদ। এলাকায় ভালো ইলেকট্রিক মিস্ত্রি হিসেবেও খ্যাতি রয়েছে তাঁর। জানা গিয়েছে– ধৃত মেধাবী পড়ুয়া নাজমুস সাকিবের সঙ্গে বন্ধুত্ব ছিল তাঁর। তবে লি ইউয়ানের কাছ থেকে আগ্নেয়াস্ত্র বা বুলেট প্রুফ জ্যাকেট পাওয়ার যে দাবি এনআইএ করেছে– তা মানতে নারাজ পরিবারের লোকেরা। আপত্তি জানিয়েছেন প্রতিবেশীরাও।

আরও পড়ুন: মুর্শিদাবাদে কোহিতুর, নবাবপাসন্দ, রানিপাসন্দ আমে মাতবে ১ মাসব্যাপী আম উৎসব

জানা গিয়েছে, লি ইউয়ান ছিলেন পরিবারের একমাত্র রোজগেরে। বড় তিন বোনের বিয়ে হয়ে গিয়েছে আগেই। বাড়িতে সত্তরোর্ধ্ব বৃদ্ধা মাকে নিয়ে ছিল তাঁর সংসার। ছেলে দীর্ঘদিন জেলে থাকায় কার্যত বাড়িতে একাই থাকতে হয় লি ইউয়ানের মাকে। রেশন দোকান থেকে পাওয়া চাল– আটা আর মেয়েদের দেওয়া খাদ্যসামগ্রীতেই কোনওরকমে দিন চলছে তাঁর।

আরও পড়ুন: মুর্শিদাবাদে সমবায় নির্বাচন ঘিরে ধুন্ধুমার, দফায় দফায় সংঘর্ষ-হাতাহাতি

বাড়িতে কোনও অপরিচিত লোক এলেই লি ইউয়ানের মা মালা বিবির আকুতি– ‘আমার ছেলে নির্দোষ– তাকে ছাড়ানোর ব্যবস্থা করো বাপ!’ মালা বিবি এ দিন কাঁদতে কাঁদতে বলেন– ‘আমার ছেলেকে ওরা খুব মেরেছে। শুনেছি ওর চোখে– কানে এখন সমস্যা হয়ে গিয়েছে। ঠিকমতো ছেলের চিকিৎসাও হয়নি। আমরা গরিব মানুষ। উকিল ধরতেও পারিনি। ছেলেকে ছাড়াব কী করে? তিনি এও বলেন– ‘আমার ছেলে জঙ্গি হলে কি আর আমাদের বাড়িঘরের অবস্থা এই থাকত?

লি ইউয়ানের এক ভাগ্নে বলেন– মামার মোটরসাইকেলে কোনও টুলবক্সই নেই অথচ এনআইএ বলে দিল– টুলবক্স থেকে আগ্নেয়াস্ত্র পাওয়া গিয়েছে। এর আসল তদন্ত হল না।

দিল্লির তিহার জেলে গিয়ে ছেলেকে দেখা করার সামর্থ্য নেই বৃদ্ধা মালা বিবির। যেদিন ফোন বা ভিডিয়ো কল করার দিন থাকে সেদিন লি ইউয়ানের দিদি– ভাগ্নেরা বাড়িতে এসে লি ইউয়ানের মায়ের সঙ্গে কথা বলিয়ে দেন। ছেলে কবে ছাড়া পাবে– সেই আশায় পথ চেয়ে বসে রয়েছেন বৃদ্ধা মা।
এনআইয়ের হাতে দেশজুড়ে বহু যুবক ও তরুণ বিনা বিচারে আটকে রয়েছে। তাদের অধিকাংশই যে মুসলিম– সে-কথা বলার অপেক্ষা রাখে না।

এনআইএ কাউকে ধরলেই মূলস্রোতের মিডিয়া রাতারাতি তাদের জঙ্গি বানিয়ে ছাড়ে। মুসলিমদের জঙ্গি বানানোর এই পুরনো নকশায় মিডিয়ার টিআরপি বাড়ে। দেশজুড়ে অসহায় দরিদ্র মুসলিম পরিবারগুলির জন্য আইনি সহায়তার বন্দোবস্ত করে চলেছে কেন্দ্রীয় জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ। তবে মুর্শিদাবাদের এই ঘটনায় কোনও পরিবার তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করেননি। ‘পুবের কলম’কে প্রতিক্রিয়ায় এ কথা জানান জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের সাধারণ সম্পাদক ক্বারী শামসুদ্দিন।

তিনি বলেন, কেন্দ্রীয় জমিয়ত এরকম ক্ষেত্রে হতদরিদ্র মুসলিম পরিবারগুলিকে আইনি সহায়তা দিয়ে থাকে। আমার জানা মতে– মুর্শিদাবাদের এই পরিবারগুলি কেন্দ্রীয় জমিয়তের সঙ্গে কথা বলেনি।

Copyright © Puber Kalom All rights reserved.| Developed by eTech Builder

‘ছেলে নির্দোষ, ছাড়ানোর ব্যবস্থা করো বাপ’ বাড়িতে কেউ এলেই কাতর আর্জি ইউয়ানের মায়ের

আপডেট : ১৮ নভেম্বর ২০২১, বৃহস্পতিবার

জঙ্গি সন্দেহে মুর্শিদাবাদের ডোমকল থেকে ছ’জন ও কেরল থেকে আরও তিনজনকে গ্রেফতার করেছিল জাতীয় তদন্তকারী সংস্থা এনআইএ। তারপর কেটে গিয়েছে প্রায় সাড়ে তেরো মাস। গ্রেফতার হওয়া যুবকদের পরিজনদের সঙ্গে কথা বলে ধারাবাহিকভাবে লিখছেন ‘পুবের কলম’ প্রতিনিধি জিশান আলি মিঞা। আজ চতুর্থ কিস্তি।

মুর্শিদাবাদের জঙ্গিযোগে নাম জড়ানোর প্রায় সাড়ে তেরো মাস হয়ে গেল। কেরলের এরনাকুলাম থেকে তিনজন ডোমকলের পরিযায়ী শ্রমিককে গ্রেফতার করার পাশাপাশি ডোমকল– রানিনগর– জলঙ্গির বিভিন্ন গ্রামে অভিযান চালিয়ে আরও ছয় সন্দেভাজনকে গ্রেফতার করে জাতীয় তদন্তকারী সংস্থা এনআইএ। তাদের মধ্যে অন্যতম ডোমকলের বাসিন্দা বছর পঁচিশের লি ইউয়ান আহমেদ। গতবছর ১৯ সেপ্টেম্বর ভোরে ডোমকলের বাড়ি থেকে তাকে গ্রেফতার করেন তদন্তকারীরা। তাঁর কাছ থেকে একটি পিস্তল ও বুলেট প্রুফ জ্যাকেট পায় বলে দাবি করেন তাঁরা। গ্রেফতারের প্রায় দশ দিন পর তাঁকে নিয়ে ফের ডোমকলের বাড়িতে তল্লাশি চালান তদন্তকারীরা। জলঙ্গির বিএসএফ ক্যাম্পে বসিয়ে তাঁকে জেরাও করা হয়। জানা গিয়েছে– বর্তমানে ধৃত বাকিদের সঙ্গে তাঁরও ঠাঁই হয়েছে দিল্লির তিহার জেলে।

আরও পড়ুন: হাজারও মুসল্লির ঢল, উৎসবের আবহে ঈদ-উল-আযহা’র নামায সম্পন্ন লোহরপুর ঈদগাহ ময়দানে

এলাকায় ভালো ছেলে হিসেবেই পরিচিত ছিলেন তিনি। ডোমকলের এক বেসরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের আংশিক সময়ের কর্মী ছিলেন লি ইউয়ান আহমেদ। এলাকায় ভালো ইলেকট্রিক মিস্ত্রি হিসেবেও খ্যাতি রয়েছে তাঁর। জানা গিয়েছে– ধৃত মেধাবী পড়ুয়া নাজমুস সাকিবের সঙ্গে বন্ধুত্ব ছিল তাঁর। তবে লি ইউয়ানের কাছ থেকে আগ্নেয়াস্ত্র বা বুলেট প্রুফ জ্যাকেট পাওয়ার যে দাবি এনআইএ করেছে– তা মানতে নারাজ পরিবারের লোকেরা। আপত্তি জানিয়েছেন প্রতিবেশীরাও।

আরও পড়ুন: মুর্শিদাবাদে কোহিতুর, নবাবপাসন্দ, রানিপাসন্দ আমে মাতবে ১ মাসব্যাপী আম উৎসব

জানা গিয়েছে, লি ইউয়ান ছিলেন পরিবারের একমাত্র রোজগেরে। বড় তিন বোনের বিয়ে হয়ে গিয়েছে আগেই। বাড়িতে সত্তরোর্ধ্ব বৃদ্ধা মাকে নিয়ে ছিল তাঁর সংসার। ছেলে দীর্ঘদিন জেলে থাকায় কার্যত বাড়িতে একাই থাকতে হয় লি ইউয়ানের মাকে। রেশন দোকান থেকে পাওয়া চাল– আটা আর মেয়েদের দেওয়া খাদ্যসামগ্রীতেই কোনওরকমে দিন চলছে তাঁর।

আরও পড়ুন: মুর্শিদাবাদে সমবায় নির্বাচন ঘিরে ধুন্ধুমার, দফায় দফায় সংঘর্ষ-হাতাহাতি

বাড়িতে কোনও অপরিচিত লোক এলেই লি ইউয়ানের মা মালা বিবির আকুতি– ‘আমার ছেলে নির্দোষ– তাকে ছাড়ানোর ব্যবস্থা করো বাপ!’ মালা বিবি এ দিন কাঁদতে কাঁদতে বলেন– ‘আমার ছেলেকে ওরা খুব মেরেছে। শুনেছি ওর চোখে– কানে এখন সমস্যা হয়ে গিয়েছে। ঠিকমতো ছেলের চিকিৎসাও হয়নি। আমরা গরিব মানুষ। উকিল ধরতেও পারিনি। ছেলেকে ছাড়াব কী করে? তিনি এও বলেন– ‘আমার ছেলে জঙ্গি হলে কি আর আমাদের বাড়িঘরের অবস্থা এই থাকত?

লি ইউয়ানের এক ভাগ্নে বলেন– মামার মোটরসাইকেলে কোনও টুলবক্সই নেই অথচ এনআইএ বলে দিল– টুলবক্স থেকে আগ্নেয়াস্ত্র পাওয়া গিয়েছে। এর আসল তদন্ত হল না।

দিল্লির তিহার জেলে গিয়ে ছেলেকে দেখা করার সামর্থ্য নেই বৃদ্ধা মালা বিবির। যেদিন ফোন বা ভিডিয়ো কল করার দিন থাকে সেদিন লি ইউয়ানের দিদি– ভাগ্নেরা বাড়িতে এসে লি ইউয়ানের মায়ের সঙ্গে কথা বলিয়ে দেন। ছেলে কবে ছাড়া পাবে– সেই আশায় পথ চেয়ে বসে রয়েছেন বৃদ্ধা মা।
এনআইয়ের হাতে দেশজুড়ে বহু যুবক ও তরুণ বিনা বিচারে আটকে রয়েছে। তাদের অধিকাংশই যে মুসলিম– সে-কথা বলার অপেক্ষা রাখে না।

এনআইএ কাউকে ধরলেই মূলস্রোতের মিডিয়া রাতারাতি তাদের জঙ্গি বানিয়ে ছাড়ে। মুসলিমদের জঙ্গি বানানোর এই পুরনো নকশায় মিডিয়ার টিআরপি বাড়ে। দেশজুড়ে অসহায় দরিদ্র মুসলিম পরিবারগুলির জন্য আইনি সহায়তার বন্দোবস্ত করে চলেছে কেন্দ্রীয় জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ। তবে মুর্শিদাবাদের এই ঘটনায় কোনও পরিবার তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করেননি। ‘পুবের কলম’কে প্রতিক্রিয়ায় এ কথা জানান জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের সাধারণ সম্পাদক ক্বারী শামসুদ্দিন।

তিনি বলেন, কেন্দ্রীয় জমিয়ত এরকম ক্ষেত্রে হতদরিদ্র মুসলিম পরিবারগুলিকে আইনি সহায়তা দিয়ে থাকে। আমার জানা মতে– মুর্শিদাবাদের এই পরিবারগুলি কেন্দ্রীয় জমিয়তের সঙ্গে কথা বলেনি।