দেহ ফেরাতে কোনও সাহায্যই করেনি মোদির গুজরাত সরকার, অভিযোগ ক্ষুব্ধ হাবিবুলের দুই ভাইয়ের

- আপডেট : ২ নভেম্বর ২০২২, বুধবার
- / 22
সফিকুল ইসলাম (দুলাল), পূর্ব বর্ধমান: বাবা-মায়ের একমাত্র ছেলে। ইচ্ছা ছিল গুজরাত থেকে সোনার কাজ শিখে এসে পরিবারের পাশে দাঁড়াবে। অসুস্থ মায়ের চিকিৎসার ব্যবস্থা করবে। সেইমতো মাত্র ১০ মাস আগে কাকা সহিবুলের সঙ্গে কাজে গিয়েছিল সে। কিন্তু, গুজরাতের মোরবিতে সেতুর ভেঙে পড়া চিরকালের মতো ভেঙে দিল হাবিবুলের (১৭) পরিবারকে। অকালে ছেলেকে হারিয়ে শোকে পাথর হাবিবুলের বাবা-মা।
একদিকে, একমাত্র সন্তান হারানোর তীব্র শোক, অন্যদিকে গুজরাত সরকার ও স্থানীয় প্রশাসনের চরম উদাসীনতা, ভিনরাজ্যে অনেক প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে চোখের পানি চেপে, দাঁতে দাঁত চেপে ছেলের লাশ ঘরে ফেরাতে লড়তে হয়েছে হাবিবুলের পরিবারকে।
ভিনরাজ্যের নিষ্ঠুর পরিস্থিতি কান্নার সময়টুকু পর্যন্ত দেয়নি। হাবিবুলের আত্মীয় ইউসুফ শেখ সহ অন্যান্যরা জানাচ্ছেন, গুজরাতের স্থানীয় প্রশাসন এতটুকু সাহায্য করেনি। তাঁদের দিকে ফিরেও পর্যন্ত তাকায়নি। বিমানে করে লাশ নিয়ে আসার অনুমতি জোগাড় করা থেকে শুরু করে সরকারি বাধ্যবাধ্যকতা ও আনুষঙ্গিক অন্যান্য নিয়ম-কানুন পালন সবটাই তাঁদেরকেই করতে হয়েছে। বাইরের রাজ্য থেকে কাজ শিখতে আসা এক তরতাজা কিশোরের মৃত্যুতে কীভাবে একটি রাজ্যের সরকার এতটা নির্লিপ্ত থাকতে পারে, সেই প্রশ্নও তুলেছেন তাঁরা।
রবিবার গুজরাতে মোরবিতে সেতু দুর্ঘনায় পূর্ব বর্ধমানের পূর্বস্থলীর ১৭ বছরের কিশোর হাবিবুল সেখের মৃত্যু হয়। রবিবার ছিল ছুটির দিন। বন্ধুদের সঙ্গে একটু ঘুরতে ব্রিজের উপর উঠেছিল। বন্ধুদের সঙ্গে সেই বেড়াতেই যাওয়াই যেন কাল হল। হাবিবুলের কাকা সহিবুল শেখও গুজরাতে সোনার কাজ করে। সহিবুলই রবিবার রাতে ফোন করে বাড়ির লোককে এই মর্মান্তিক খবরটি দেন। শুধু হাবিবুল নয়দুই বর্ধমানের অনেক গরিব পরিবারের সদস্য ভিনরাজ্যে কাজে যায় একটু উপার্জনের আশায়। সংসারের হাল ধরতে ভিনরাজ্যে কাজে গিয়ে যে এভাবে লাশ হয়ে ফিরতে হবে পরিবারের একমাত্র সন্তানকে, ভাবতেই পারছেন কেউ।
সোমবার রাত আড়াইটে নাগাদ হাবিবুলের নিথর দেহ এসে পৌঁছায় পূর্বস্থলীর কেশববাটির গ্রামের বাড়িতে। লাশ বাড়িতে ফিরতেই কান্নায় ভেঙে পড়েন তার পরিবার-পরিজনরা। মঙ্গলবার ভোর ৫.৫০ নাগাদ দাফন করা হয় হাবিবুলকে।
এ দিকে, সোমবার গভীর রাতে কফিনবন্দি মরদেহ পৌঁছয় কেশববাটির গ্রামে। ছেলের মুখ দেখেই আঁতকে ওঠেন মা লুৎফা বিবি। চেনার উপায় নেই। সারাশরীরে রক্ত। গুজরাতে সোনার কাজ শিখতে যাওয়া হাবিবুলকে নিয়ে এসেছেন অন্য দুই ভাই ইউসুফ ও সাবির। গ্রামে ফিরে তাদের অভিযোগ, খারাপভাবে দেহ ফেরত পাঠানো হয়েছে। ভালো কোনও ব্যবস্থাই ছিল না। বিমানভাড়া পর্যন্ত পাওয়া যায়নি সরকারের পক্ষ থেকে। ধার করে তবে দেহ ফেরানো হয়েছে। গুজরাত থেকে হাবিবুলের লাশ যেভাবে ফিরেছে, তা দেখে আঁতকে উঠেছেন তাঁর পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা।
গ্রামের লোকজনরা। অভিযোগ, নদী থেকে লাশ উদ্ধার করে দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। এতটুকু পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করেও দেওয়ার প্রয়োজনও বোধ করেনি গুজরাতের মোরবির প্রশাসন। পোশাক দেখে ছেলেকে চিনতে পারেন মা। ছেলে হারানোর শোকে মাঝেমধ্যেই জ্ঞান হারাচ্ছেন তিনি। চোখের পানি বাধ মানছে না বাবা মহিবুল সেখের। অঝোরে কেঁদে চলেছেন তাঁরা।
গুজরাত থেকে মৃত হাবিবুলকে সঙ্গে নিয়ে যারা এ দিন পূর্বস্থলীতে ফিরেছিলেন তাঁদের অভিযোগ, কোনও সাহায্যই করেনি গুজরাত সরকার। বিমান ভাড়া পর্যন্ত দেওয়া হয়নি তাঁদের। ধারদেনা করে কোনওক্রমে লাশ ফেরাতে পেরেছেন দেশে।
কান্নাভেজা গলায় মা লুৎফা বিবির আক্ষেপ, ‘ছেলেটা ছোট হলে কী হবে সংসারের অভাব-অনটন বুঝত। তাই বাইরে কাজে গিয়েছিল একটু ভালোভাবে খেয়ে-পরে বাঁচার জন্য। সংসারে একটু স্বচ্ছলতা আনার জন্য। কিন্তু ছেলেটা যে অকালে চলে যাবে, ভাবতেও পারিনি।’ সোমবার রাতেই হাবিবুলের বাড়িতে গিয়েছিলেন রাজ্যের মন্ত্রী স্বপন দেবনাথ, স্থানীয় বিধায়ক তপন চট্টোপাধ্যায়, জেলা তৃণমূল সভাপতি রবীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়, পূর্বস্থলী-২ তৃণমূল ব্লক সভাপতি বদরুল আলম মণ্ডল, বিডিও, আইসি-সহ জেলা ও পুলিশ প্রশাসনের আধিকারিকরা। জেলা প্রশাসন সব রকমভাবে পরিবারের পাশে থাকার আশ্বাস দিয়েছে। আপৎকালীন পরিস্থিতির জন্য অর্থসাহায্যও তুলে দেওয়া হয়েছে পরিবারের হাতে।