মূল অভিযুক্ত বিজেপি যুব মোর্চার নেতা পারি জাত এখনো অধরা
বুজুর্গ মুসলিম গরু ব্যবসায়ীদের নির্যাতন-অপমানে ক্ষুব্ধ সচেতন মানুষ

- আপডেট : ৩ অগাস্ট ২০২৫, রবিবার
- / 15
পুবের কলম প্রতিবেদক : বিজেপি-শাসিত রাজ্যগুলোতে সংখ্যালঘুদের উপর হামলা, নিপীড়ন এবং মারধরের ঘটনা খুবই চেনা ছবি। কিন্তু ধর্মীয় ভেদাভেদে হামলা-হাঙ্গামার ঊর্ধ্বে থাকা সম্প্রীতির অন্যতম রাজ্য পশ্চিমবঙ্গে এমন ঘটনা খুব একটা দেখা যায় না। তবে সম্প্রতি কিছু বিজেপি উগ্রবাদী ঘৃণা-বিভাজন ছড়াচ্ছে শুধু নয়, তাঁরা সংখ্যালঘুদের উপর নির্দয় আক্রমণ, নির্যাতনও করছে।এরই এক সাম্প্রতিক ঘটনা নিয়ে পশ্চিমবঙ্গে ব্যাপক উত্তেজনা তৈরি হয়েছে।
কিভাবে বিজেপির নেতা এবং কর্মীবৃন্দ কয়েকজন বুজুর্গ মুসলিমের ওপর আক্রমণ জানিয়ে শুরু তাদের নির্যাতন এবং বরং অপমান করার চেষ্টা করছে, তার ভিডিও ছড়িয়েছে পশ্চিমবঙ্গ ও পশ্চিমবঙ্গের বাইরে। ঘটনাটি পশ্চিম বর্ধমানের দুর্গাপুর শহরের মধ্যে ঘটেছে। এখানে দুর্গাপুর গেমন ব্রিজ এলাকার একটু দূরেই রয়েছে বাঁকুড়ার হাট আশুরিয়া। এখানে গরু বিক্রয়ের জন্য সপ্তাহে দুদিন হাট বসে। এই হাট থেকে বিভিন্ন গ্রামের লোক এবং ব্যবসায়ীরা গরু কিনে নিয়ে যান। এই হাটটি খুবই পুরনো এবং এলাকায় গরু কেনাবেচার জন্য বিখ্যাত।
এখানেই বিজেপির নেতা এবং বেশ কিছু কর্মী সংখ্যালঘুদের উপর হামলা চালায়। এই সংখ্যালঘুরা একটি ভ্যানে করে আশুরিয়া হাট থেকে গরু কিনে নিজেদের গ্রামে ফিরে যাচ্ছিল। এদের বেশিরভাগই ঐ এলাকার জেমুয়া গ্রামের বাসিন্দা এবং পেশাগতভাবে তারা গরুর ব্যবসায়ী। তবে এই গরু জবাই করার জন্য কেনা-বেচা করা হয় মনে করলে ভুল করা হবে। গরুগুলিকে কৃষিকাজ ও দুধ উৎপাদনের জন্য বেশি ব্যবহার করা হয়ে থাকে। কিভাবে সংখ্যালঘুদের উপর অত্যাচারের ঘটনা ঘটল, তার বিবরণ দিয়েছেন পশ্চিম বর্ধমান জেলার পুলিশ সুপার নিজেই।
তিনি বলেছেন গরুর ব্যবসায়ীরা যখন ভ্যানে করে ফিরছিল তখন বিজেপি নেতা ও মস্তান বাহিনীর নেতৃত্বদানকারী পারিজাত গাঙ্গুলি এবং আরো ১৫-২০ জন গেরুয়া সমর্থক তাদেরকে আটকায়। জানা যাচ্ছে, তারা ওই গরুগুলিকে হয় লুঠ করেছে অথবা ছেড়ে দিয়েছে। এরপর এই গেরুয়া বাহিনী ওই সংখ্যালঘু মুসলিমদের ওপর পাশবিক অত্যাচার করে। দড়ি দিয়ে তাদের বাঁধে এবং লাঠি দিয়ে অমানবিকভাবে মারতে থাকে। এছাড়া ছিল অকথ্য গালাগাল।
বৈধ চালান থাকা সত্ত্বেও গরু ব্যবসায়ীদের ‘পাচারকারী’ তকমা লাগিয়ে গলায় দড়ি বেঁধে অপদস্থ করার ঘটনায় চমকে গেছে সচেতন মানুষ ও সমাজ। তাদের জোর করে জয় শ্রীরাম বলানো হয়। আক্রান্তরা সকলে মুসলিম। এ ঘটনায় দীপক দাস ও অনীশ ভট্টাচার্য নামে দুজনকে কোক-ওভেন থানার পুলিশ গ্রেফতার করেছে। মূল অভিযুক্ত বিজেপির যুব মোর্চার নেতা পারিজাত গাঙ্গুলি সহ বাকি অভিযুক্তরা কিন্তু এখনও ধরা পড়েনি।
পুলিশ অবশ্য বলেছে, তাদের খোঁজে তল্লাশি চলছে। ঘটনায় ১৫ জন বিজেপি এবং গেরুয়াপন্থীর বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের হয়েছে। তাদের মধ্যে ছিলেন শেখ জহিরুল, সাজমান খান, শেখ আজিম, আতিকুর রহমান, শেখ লখাই প্রমুখ। গত বৃহস্পতিবার বাঁকুড়ার বড়জোড়া ব্লকের হাট আশুরিয়া থেকে বৈধ চালান ও রসিদ-সহ গরু কিনে ফিরছিলেন জেমুয়া গ্রামের বেশ কয়েকজন বৃদ্ধ গরু ব্যবসায়ী। দামোদর ব্যারাজ হয়ে দুর্গাপুরে ঢোকার পর বিজেপি যুব মোর্চার নেতা পারিজাত গাঙ্গুলির নেতৃত্বে একদল বিজেপি কর্মী তাদের পথ আটকে নৃশংসভাবে নির্যাতন করে।
ভাইরাল হওয়া ভিডিওতে দেখা যায়, কয়েকজন প্রবীণ ব্যক্তির গলায় দড়ি বাঁধা অবস্থায় মাটিতে বসে আছেন এবং কেউ কেউ কান ধরে আছেন। কাউকে লাঠিপেটা করা হচ্ছে আর তারা অত্যাচার থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য কাকুতি-মিনতি করছেন। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেছেন, এ সময় তাদের জোর-জবরদস্তি জয় শ্রীরাম বলানো হয় আরো জানা গিয়েছে, ট্রাকে প্রায় ২২ টি গরু ছিল। পারিজাত গাঙ্গুলি ও তার অনুগামীরা ওই ট্রাকে থাকা কয়েকজনকে টেনে-হিঁচড়ে গাড়ি থেকে নামিয়ে রাস্তার ওপর বসায়। কান ধরে উঠবস করারও নিদান দেয়। তাদের কান ধরে রাস্তায় হাঁটানো হয়। উল্লেখযোগ্য হল, এই গরু ব্যবসায়ীদের বেশিরভাগই ছিলেন বুজুর্গ ব্যক্তি।
এই সাধারণ গরিব ব্যবসায়ীদের পক্ক কেশ ও সাদা দাড়ি বিজেপির এই ঠ্যাঙাড়ে বাহিনীকে তাদের স্বাভাবিকভাবে নির্যাতন করতে আরো উৎসাহিত করে। দড়ি বাঁধা ও হাত দিয়ে কান ধরা অবস্থায় এই সংখ্যালঘু ব্যক্তিদের কাকুতি-মিনতি সকলেরই হৃদয়ে দাগ কেটেছে। তাদের চোর, ডাকাত এবং বাংলাদেশী বলেও বিজেপির এই নেতা-কর্মীরা গালাগাল দিতে থাকে। এদের উদ্ধার করার জন্য কেউই অবশ্য এগিয়ে আসেনি। সংখ্যালঘুদের মনে আতঙ্ক সৃষ্টি করার জন্য বিজেপি নেতা-কর্মীরাই এই ঘটনার ভিডিও করে এবং তা নিয়ে দুনিয়ায় ছড়িয়ে দেয়।
এখানে কোক-ওভেন থানার ওসি ইদানিং কারো ফোন ধরার প্রয়োজন বোধ করছেন না। সম্ভবত তার বক্তব্য, এই ঘটনার জন্য তার কোন দায়িত্ব নেই। যদিও পারিজাত গাঙ্গুলি ওই এলাকায় খুবই পরিচিত। তাঁকেও কোক-ওভেন থানার ওসি মহাশয় গ্রেফতার করতে পারেননি। দু-একজনকে ওসি বলেছেন, আমরা তো তল্লাশি চালাচ্ছি। ওই এলাকার স্থানীয় মানুষরা পরে বুজুর্গ অসহায় বৃদ্ধদের এই ধরনের অপমান-নির্যাতনের বিরুদ্ধে থানায় বিক্ষোভ প্রদর্শন করেছেন। জেলা পুলিশ সুপার অবশ্য বলেছেন, এই গরুর ব্যবসায়ীদের কাছে যে সমস্ত টাকা-পয়সা ছিল তা গেরুয়া পন্থীরা লুঠ করে নিয়ে গেছে।
ঘটনার পর পরই তৃণমূল বিধায়ক নরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী কোক-ওভেন থানায় উপস্থিত হয়ে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন। তিনি বলেন, ‘কিছু গরিব মানুষ হাট থেকে গরু কিনে ফিরছিলেন। যাদের মারধর করা হয়েছে তারা পাণ্ডবেশ্বর বিধানসভা কেন্দ্রের জেমুয়া গ্রামের বাসিন্দা। ওরা বৈধভাবে গরু কিনে ফিরছিল। তাদের কাছে হাটের রসিদ ছিল। তবু তাদের ‘গরু পাচারকারী’ বলে অপবাদ দিয়ে মারধর করা হয় এবং টাকাপয়সা কেড়ে নেওয়া হয়। এটা চরম অমানবিক ও ভয়াবহ।
অভিযুক্তরা সকলে বিজেপি কর্মী।’ পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, ইতিমধ্যে দুই অভিযুক্ত দীপক দাস ও অনীশ ভট্টাচার্যকে গ্রেফতার করা হয়েছে। দু’জনই স্থানীয় বিজেপি কর্মী বলে পুলিশ নিশ্চিত করেছে। মূল অভিযুক্ত পারিজিত গাঙ্গুলির খোঁজে তল্লাশি চলছে। আসানসোল, দুর্গাপুরের পুলিশ কমিশনার সুনীল চৌধুরী শুক্রবার রাতে সাংবাদিক সম্মেলনে জানান, ‘যারা এই কাজ করেছে, তাদের রাজনৈতিক পরিচয় যাই হোক, কাউকে রেয়াত করা হবে না। ১৫ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের হয়েছে। অভিযুক্তদের চিহ্নিত করে গ্রেপ্তার করা হবে।’
কমিশনার আরো জানান, ‘গরু বোঝায় গাড়িটির সমস্ত কাগজপত্র বৈধ ছিল। কোনও গরু পাচারের প্রমাণ পাওয়া যায়নি। পারিজাতকে এখনও গ্রেফতার না করতে পারার কারণ হিসেবে পুলিশ কমিশনারবলেন, ‘পুলিশ তার বাড়িতে অভিযান চালিয়েছিল। তবে তাকে বাড়িতে পাওয়া যায়নি। তিনি গা ঢাকা দিয়েছেন।খুব শীঘ্রই তাকে ধরা হবে।’