০১ অগাস্ট ২০২৫, শুক্রবার, ১৬ শ্রাবণ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

নামায হিন্দু-বিরোধী নয়, দেশ-বিরোধীও নয়, মুসলিমদের ‘নয়া অস্পৃশ্য’ বানাবার অপচেষ্টা

বিপাশা চক্রবর্তী
  • আপডেট : ২ নভেম্বর ২০২১, মঙ্গলবার
  • / 42

গুরুগ্রামে ফাঁকা স্থানে নামাজ পড়ায় বাধা।

ইদানিং প্রায় দেখা যাচ্ছে– পার্ক বা নির্জন ফাঁকা জায়গা মুসলিমরা শুক্রবারের নামায আদায় করতে গেলেই বজরং দল– বিশ্বহিন্দু পরিষদ জাতীয় সংগঠনগুলি তাদের শান্তিপূর্ণ নামাযে হামলা চালাচ্ছে। কিন্তু কেন? নামায কি হিন্দু-বিরোধী? না দেশ-বিরোধী? না কি আসলে মুসলিমদের ‘নয়া অস্পৃশ্য’ হিসেবে প্রতিভাত করার চেষ্টা চলছে! এই নিয়ে আলোচনা করেছেন হিলাল আহমেদ

নামায পড়ার জন্য মুসলিমদের শান্তিপূর্ণভাবে জড়ো হওয়া জমায়েতকে হিন্দুত্ববাদীদের আগ্রাসী ক্যাম্পেন ছত্রভঙ্গ করে দিচ্ছে। এখন বিভিন্ন স্থানে এটি একটি সাধারণ দৃশ্যে পরিণত হয়েছে। বিশেষ করে দিল্লির নিকটস্থত গুরুগ্রামে (গুরগাঁও) প্রায় প্রতি জুম্মাবারেই এই ধরনের ঘটনা ঘটছে। বিষয়টি আমাকে তীব্রভাবে বিচলিত করেছে। আমি যে দু’টি নীতি-আদর্শে বিশ্বাস রাখি– উগ্রবাদীদের এই ধরনের আচরণ তা সম্পূর্ণ বিরোধী। আধ্যাত্মিক দিক থেকে আমি সবসময় সর্বশক্তিমান আল্লাহ্তে বিশ্বাস রাখি। এছাড়া গান্ধির আদর্শ ‘সর্বধর্ম সম্ভব’ এও আমার আস্থা রয়েছে। একজন বিশ্বাসী ও পালনকারী মুসলিম হিসাবে আমার নামায সবসময় আমার আধ্যাত্মিকতারই প্রতিফলন। আমার সহকর্মী– বন্ধু– শিক্ষক ও ছাত্ররা নিয়তই আমাকে উৎসাহ দিয়েছে। কেউই একে কখনও হিন্দুবিরোধী কিংবা দেশদ্রোহীতা মনে করেনি। অপরিচিত লোকেরাও যাদের বেশিরভাগই হিন্দু তারা ঈশ্বরের প্রতি নত হয়ে আমার নামায পড়াকে শ্রদ্ধা জানিয়েছে। বিষয়টি এতই হৃদয়গ্রাহী যে আমি চলন্ত ট্রেনে– ব্যস্ত রাস্তায়– হাসপাতালের বারান্দায়– এমনকি হিন্দু মন্দিরের ভেতরেও নামায আদায় করেছি। বিষয়টিকে সকলেই শ্রদ্ধার নজরে দেখেছে।

একজন গবেষক হিসেবে আমি সমানভাবে আশ্বস্ত হওয়ার মতো কিছু আবিষ্কারও করেছি। সিএসডিএসএনইএস-২০১৯ সমীক্ষা ও পিউ জরিপে দেখা গেছে– ভারতের অধিকাংশ হিন্দু এখনও ইসলামকে এক ধর্ম হিসেবে শ্রদ্ধা করে। প্রকৃতপক্ষে এটা জোরের সঙ্গে বলা হয় যে– ইসলাম-সহ ভারতের অন্যান্য ধর্মকে শ্রদ্ধা না জানালে হিন্দু কখনও ‘ভাল হিন্দু’র স্বীকৃতি পেতে পারে না।

তাহলে কি বদলে গেছে? হিন্দু কমিউনালিজম নামাযকে সমস্যা হিসাবে কিভাবে সাম্প্রদায়িকীকরণ ঘটাতে পারছে? কিভাবে তারা নামাযকে ‘হিন্দু বিরোধী’ বলে এক ধারণা গড়ে তুলতে সক্ষম হচ্ছে?
কেন নামায?

উল্লেখ করা জরুরি যে– নামায (আরবিতে সালাত) ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের একটি। আর চারটি স্তম্ভ হল শাহাদত– সওম বা রোযা– জাকাত এবং হজ। কিন্তু তারপরও বলতে হবে নামায হচ্ছে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ ও পালনকারী ধর্মীয় কাজ। ৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে ভারতে তবলিগি জামাতের উত্থান ঘটেছে। তারা নামাযের উপর যথেষ্ট গুরুত্ব দেয়। তারা নামাযকে আরও জনপ্রিয় করে তুলতে বড় ভূমিকা পালন করেছে। সুন্নি মুসলিমদের মধ্যে একটা জোরালো ধারণা রয়েছে যে– মুসলিম হিসাবে তাদের নৈতিকতা ও ধর্মীয় চরিত্রের মূল্যায়নের একমাত্র মানদণ্ড নামায। নামাযের উপর বাড়তি জোর দেওয়ার ফলে দু’টি জিনিস ঘটেছে।

প্রথমত– নামাযীদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। এতটাই বেড়েছে যে মসজিদে জায়গা দেওয়া যাচ্ছে না। বিশেষত বড় শহর ও মফস্বলগুলিতে। ফলস্বরূপ নতুন মসজিদ নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা বেড়েছে। ইসলামি ধার্মিকতার প্রতীক হিসাবে এই মসজিদগুলি কাজ করতে শুরু করেছে।

দ্বিতীয়ত– গ্রাম থেকে শহরে শ্রমিকদের চলে আসাও এই নামাযকেন্দ্রিক ধার্মিকতায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। গ্রাম থেকে আসা মুসলিম শ্রমিক– কারিগর– দক্ষ বা আধপটু কর্মীরা শিল্পাঞ্চলের নানা কারখানায় নিযুক্ত হচ্ছে– কিন্তু তাদের যথাযথ কোনও মসজিদ নেই। এই শ্রমজীবী মুসলিমরা ঘটনাচক্রে ফাঁকা জায়গায় বা নির্জন রাস্তায় নামায আদায় করে।

বিশেষত করে শুক্রবারের ১৫-২০ মিনিটের নামাযে বড় জমায়েত হচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরে এই দৃশ্য ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতার একটি প্রতীক হিসাবে দেখা হয়েছে। গান্ধির কল্পনা– সেইসঙ্গে নেহরুর ‘বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যে’র ধারণাও প্রতিফলিত হয় এর মাধ্যমে।

নামাযীরা এখন ‘নয়া অস্পৃশ্য’

নামায পড়া নিয়ে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির সব সময় গাত্রদাহ রয়েছে। তাদের এটা মেনে নিতে অসুবিধা হয়। হিন্দুত্ববাদী যুক্তি হল– সমস্ত ভারতীয়ই হিন্দু যদিও তাদের উপাসনার পদ্ধতির মধ্যে ফারাক রয়েছে। এই যুক্তি থেকে প্রমাণ হয় যে– নামায নিয়ে হিন্দুত্ববাদীদের অস্বস্তি রয়েছে। মুখে বললেও নিজেদের কথিত বাণী অনুযায়ীই মুসলিমদের মেনে নিতে এদের যথেষ্ট অসুবিধা। এই ইস্যু নিয়ে হিন্দুত্ববাদীদের কৌশলী নীরবতার পিছনে রয়েছে নামাযের প্রতি সাধারণ হিন্দুদের মনোভাব। শুধুমাত্র নামায পড়ার কারণে মুসলিমদের ‘বিপজ্জনক’ হিসাবে তুলে ধরা যেকোনও হিন্দুত্ববাদী দলের কাছে ছিল কঠিন। কারণ– একজন সাধারণ হিন্দুর কাছে নামায আর পাঁচটা হিন্দু ধর্মীয় আচার ঈশ্বর আরাধনা হিসেবেই গণ্য। ধর্মবিশ্বাসের একটি আধ্যাত্মিক প্রকাশ হিসাবেই সাধারণ হিন্দুরা নামাযকে দেখে।

Copyright © Puber Kalom All rights reserved.| Developed by eTech Builder

নামায হিন্দু-বিরোধী নয়, দেশ-বিরোধীও নয়, মুসলিমদের ‘নয়া অস্পৃশ্য’ বানাবার অপচেষ্টা

আপডেট : ২ নভেম্বর ২০২১, মঙ্গলবার

ইদানিং প্রায় দেখা যাচ্ছে– পার্ক বা নির্জন ফাঁকা জায়গা মুসলিমরা শুক্রবারের নামায আদায় করতে গেলেই বজরং দল– বিশ্বহিন্দু পরিষদ জাতীয় সংগঠনগুলি তাদের শান্তিপূর্ণ নামাযে হামলা চালাচ্ছে। কিন্তু কেন? নামায কি হিন্দু-বিরোধী? না দেশ-বিরোধী? না কি আসলে মুসলিমদের ‘নয়া অস্পৃশ্য’ হিসেবে প্রতিভাত করার চেষ্টা চলছে! এই নিয়ে আলোচনা করেছেন হিলাল আহমেদ

নামায পড়ার জন্য মুসলিমদের শান্তিপূর্ণভাবে জড়ো হওয়া জমায়েতকে হিন্দুত্ববাদীদের আগ্রাসী ক্যাম্পেন ছত্রভঙ্গ করে দিচ্ছে। এখন বিভিন্ন স্থানে এটি একটি সাধারণ দৃশ্যে পরিণত হয়েছে। বিশেষ করে দিল্লির নিকটস্থত গুরুগ্রামে (গুরগাঁও) প্রায় প্রতি জুম্মাবারেই এই ধরনের ঘটনা ঘটছে। বিষয়টি আমাকে তীব্রভাবে বিচলিত করেছে। আমি যে দু’টি নীতি-আদর্শে বিশ্বাস রাখি– উগ্রবাদীদের এই ধরনের আচরণ তা সম্পূর্ণ বিরোধী। আধ্যাত্মিক দিক থেকে আমি সবসময় সর্বশক্তিমান আল্লাহ্তে বিশ্বাস রাখি। এছাড়া গান্ধির আদর্শ ‘সর্বধর্ম সম্ভব’ এও আমার আস্থা রয়েছে। একজন বিশ্বাসী ও পালনকারী মুসলিম হিসাবে আমার নামায সবসময় আমার আধ্যাত্মিকতারই প্রতিফলন। আমার সহকর্মী– বন্ধু– শিক্ষক ও ছাত্ররা নিয়তই আমাকে উৎসাহ দিয়েছে। কেউই একে কখনও হিন্দুবিরোধী কিংবা দেশদ্রোহীতা মনে করেনি। অপরিচিত লোকেরাও যাদের বেশিরভাগই হিন্দু তারা ঈশ্বরের প্রতি নত হয়ে আমার নামায পড়াকে শ্রদ্ধা জানিয়েছে। বিষয়টি এতই হৃদয়গ্রাহী যে আমি চলন্ত ট্রেনে– ব্যস্ত রাস্তায়– হাসপাতালের বারান্দায়– এমনকি হিন্দু মন্দিরের ভেতরেও নামায আদায় করেছি। বিষয়টিকে সকলেই শ্রদ্ধার নজরে দেখেছে।

একজন গবেষক হিসেবে আমি সমানভাবে আশ্বস্ত হওয়ার মতো কিছু আবিষ্কারও করেছি। সিএসডিএসএনইএস-২০১৯ সমীক্ষা ও পিউ জরিপে দেখা গেছে– ভারতের অধিকাংশ হিন্দু এখনও ইসলামকে এক ধর্ম হিসেবে শ্রদ্ধা করে। প্রকৃতপক্ষে এটা জোরের সঙ্গে বলা হয় যে– ইসলাম-সহ ভারতের অন্যান্য ধর্মকে শ্রদ্ধা না জানালে হিন্দু কখনও ‘ভাল হিন্দু’র স্বীকৃতি পেতে পারে না।

তাহলে কি বদলে গেছে? হিন্দু কমিউনালিজম নামাযকে সমস্যা হিসাবে কিভাবে সাম্প্রদায়িকীকরণ ঘটাতে পারছে? কিভাবে তারা নামাযকে ‘হিন্দু বিরোধী’ বলে এক ধারণা গড়ে তুলতে সক্ষম হচ্ছে?
কেন নামায?

উল্লেখ করা জরুরি যে– নামায (আরবিতে সালাত) ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের একটি। আর চারটি স্তম্ভ হল শাহাদত– সওম বা রোযা– জাকাত এবং হজ। কিন্তু তারপরও বলতে হবে নামায হচ্ছে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ ও পালনকারী ধর্মীয় কাজ। ৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে ভারতে তবলিগি জামাতের উত্থান ঘটেছে। তারা নামাযের উপর যথেষ্ট গুরুত্ব দেয়। তারা নামাযকে আরও জনপ্রিয় করে তুলতে বড় ভূমিকা পালন করেছে। সুন্নি মুসলিমদের মধ্যে একটা জোরালো ধারণা রয়েছে যে– মুসলিম হিসাবে তাদের নৈতিকতা ও ধর্মীয় চরিত্রের মূল্যায়নের একমাত্র মানদণ্ড নামায। নামাযের উপর বাড়তি জোর দেওয়ার ফলে দু’টি জিনিস ঘটেছে।

প্রথমত– নামাযীদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। এতটাই বেড়েছে যে মসজিদে জায়গা দেওয়া যাচ্ছে না। বিশেষত বড় শহর ও মফস্বলগুলিতে। ফলস্বরূপ নতুন মসজিদ নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা বেড়েছে। ইসলামি ধার্মিকতার প্রতীক হিসাবে এই মসজিদগুলি কাজ করতে শুরু করেছে।

দ্বিতীয়ত– গ্রাম থেকে শহরে শ্রমিকদের চলে আসাও এই নামাযকেন্দ্রিক ধার্মিকতায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। গ্রাম থেকে আসা মুসলিম শ্রমিক– কারিগর– দক্ষ বা আধপটু কর্মীরা শিল্পাঞ্চলের নানা কারখানায় নিযুক্ত হচ্ছে– কিন্তু তাদের যথাযথ কোনও মসজিদ নেই। এই শ্রমজীবী মুসলিমরা ঘটনাচক্রে ফাঁকা জায়গায় বা নির্জন রাস্তায় নামায আদায় করে।

বিশেষত করে শুক্রবারের ১৫-২০ মিনিটের নামাযে বড় জমায়েত হচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরে এই দৃশ্য ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতার একটি প্রতীক হিসাবে দেখা হয়েছে। গান্ধির কল্পনা– সেইসঙ্গে নেহরুর ‘বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যে’র ধারণাও প্রতিফলিত হয় এর মাধ্যমে।

নামাযীরা এখন ‘নয়া অস্পৃশ্য’

নামায পড়া নিয়ে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির সব সময় গাত্রদাহ রয়েছে। তাদের এটা মেনে নিতে অসুবিধা হয়। হিন্দুত্ববাদী যুক্তি হল– সমস্ত ভারতীয়ই হিন্দু যদিও তাদের উপাসনার পদ্ধতির মধ্যে ফারাক রয়েছে। এই যুক্তি থেকে প্রমাণ হয় যে– নামায নিয়ে হিন্দুত্ববাদীদের অস্বস্তি রয়েছে। মুখে বললেও নিজেদের কথিত বাণী অনুযায়ীই মুসলিমদের মেনে নিতে এদের যথেষ্ট অসুবিধা। এই ইস্যু নিয়ে হিন্দুত্ববাদীদের কৌশলী নীরবতার পিছনে রয়েছে নামাযের প্রতি সাধারণ হিন্দুদের মনোভাব। শুধুমাত্র নামায পড়ার কারণে মুসলিমদের ‘বিপজ্জনক’ হিসাবে তুলে ধরা যেকোনও হিন্দুত্ববাদী দলের কাছে ছিল কঠিন। কারণ– একজন সাধারণ হিন্দুর কাছে নামায আর পাঁচটা হিন্দু ধর্মীয় আচার ঈশ্বর আরাধনা হিসেবেই গণ্য। ধর্মবিশ্বাসের একটি আধ্যাত্মিক প্রকাশ হিসাবেই সাধারণ হিন্দুরা নামাযকে দেখে।