১৬ জুলাই ২০২৫, বুধবার, ৩১ আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

ইসলামে অর্থনৈতিক ন্যায়বিচার ও সুদ বিহীন সমাজ ব্যবস্থার প্রস্তাবনা

ইমামা খাতুন
  • আপডেট : ১৫ জুলাই ২০২৫, মঙ্গলবার
  • / 29

আয়াজ আহমদ বাঙালি: মানব ইতিহাসের অর্থনৈতিক অবিচার, শোষণ ও বৈষম্যের মূল কারণগুলোর একটি হলো সুদ। আধুনিক পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় সুদের ভিত্তিতে পরিচালিত ব্যাংকিং ও বাণিজ্যিক কাঠামো ধনীদের আরও ধনী আর দরিদ্রদের আরও নিঃস্ব করে তুলছে। এই ব্যবস্থার বিপরীতে ইসলাম প্রস্তাব করে এক ন্যায়ভিত্তিক, সুদমুক্ত এবং সহানুভূতিশীল অর্থনৈতিক কাঠামো।

 

আরও পড়ুন: আযানের জবাব কীভাবে দেবেন

পবিত্র আল-কুরআন সুদের বিষয়ে কঠোর ভাষায় ঘোষণা করে,  ‘যারা সুদ খায়, তারা তার ন্যায় (কবর থেকে) উঠবে, যাকে শয়তান স্পর্শ করে পাগল বানিয়ে দেয়। এটা এ জন্য যে, তারা বলে, বেচা-কেনা সুদের মতোই। অথচ আল্লাহ্ বেচা-কেনা হালাল করেছেন এবং সুদ হারাম করেছেন। অতএব, যার কাছে তার রবের পক্ষ থেকে উপদেশ আসার পর সে বিরত হল, যা গত হয়েছে তা তার জন্যই ইচ্ছাধীন। আর তার ব্যাপারটি আল্লাহর হাওলায়। আর যারা ফিরে গেল, তারা আগুনের অধিবাসী। তারা সেখানে স্থায়ী হবে।’ ( সূরা বাকারাহ্, আয়াত: ২৭৫)

আরও পড়ুন: ইসলামের দাওয়াত সবার জন্য

সুদ একটি আর্থিক পাপ, যার মাধ্যমে ধন-সম্পদ কেবল একটি ক্ষুদ্র গোষ্ঠীর হাতে কেন্দ্রীভূত হয় এবং দরিদ্র জনগোষ্ঠী চিরকাল ঋণের দাসত্বে আবদ্ধ থাকে। এর বিপরীতে ইসলামিক অর্থনীতি একটি ব্যতিক্রমী দৃষ্টিভঙ্গি দেয়— যেখানে ব্যবসা, মুনাফাভাগ, দান, যাকাত ও সদকার মাধ্যমে সম্পদের প্রবাহ নিচের দিকে গমন করে।

আরও পড়ুন: জীবনকে বদলে দিতে পারে সুরা লোকমান!

যাকাত ইসলামের আর্থিক ন্যায়নীতির একটি কেন্দ্রীয় স্তম্ভ। ধনী মানুষের সম্পদের নির্দিষ্ট একটি অংশ গরিব, এতিম, নিঃস্ব, ঋণগ্রস্ত ও মুসাফিরদের জন্য নির্ধারিত করে দিয়ে ইসলাম একটি আর্থিক ভারসাম্যের পথ রচনা করেছে। শুধু মাত্র যাকাত ব্যবস্থাই যথাযথভাবে কার্যকর হলে বিশ্বে দারিদ্র্য সমস্যার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ দূর করা সম্ভব।

ইসলামে সম্পদের মালিকানা এককভাবে ব্যক্তির হাতে নয়, বরং সামষ্টিক কল্যাণে ব্যবহারের নির্দেশনা রয়েছে। পবিত্র কুরআন বলে,  ‘আল্লাহ্ জনপদবাসীদের নিকট থেকে তাঁর রাসূলকে ফায় হিসেবে যা দিয়েছেন তা আল্লাহর, রাসূলের, আত্মীয়-স্বজনদের, ইয়াতীমদের, মিসকীন ও মুসাফিরদের এটি এজন্য যে, যাতে ধন-সম্পদ তোমাদের মধ্যকার বিত্তশালীদের মাঝেই কেবল আবর্তিত না থাকে। রাসূল তোমাদের যা দেয় তা গ্রহণ কর, আর যা থেকে সে তোমাদের নিষেধ করে তা থেকে বিরত হও এবং আল্লাহকেই ভয় কর, নিশ্চয় আল্লাহ্ শাস্তি প্রদানে কঠোর।’ (সূরা হাশর, আয়াত : ৭)

এই দৃষ্টিভঙ্গি সম্পদকে জনসাধারণের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে উৎসাহিত করে এবং একচেটিয়া ধনসঞ্চয়ের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। আধুনিক বিশ্বব্যবস্থায় সুদের নামে যে বেআব্রু শোষণ চলছে, তা আজ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থাও উপলব্ধি করছে। IMF ও World Bank-এর সুদভিত্তিক ঋণ ব্যবস্থাপনা অনেক দেশকে ঋণ-দাসত্বের জালে ফেলে রেখেছে। মুসলিম দুনিয়া এর শিকার সবচেয়ে বেশি— যেখানে ধর্ম অনুযায়ী চলার কথা থাকলেও অর্থনীতিতে পশ্চিমা মডেলই অনুসৃত হচ্ছে।

 

ইসলামী ব্যাংকিং ও শরিয়াহ-ভিত্তিক অর্থনীতি আজ বিশ্বব্যাপী একটি গ্রহণযোগ্য বিকল্প ব্যবস্থায় পরিণত হচ্ছে। মালয়েশিয়া, কাতার, সৌদি আরব, এমনকি যুক্তরাজ্যেও ইসলামি অর্থনীতি অনুসরণ করে বিভিন্ন ফাইন্যান্স প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। এতে মূলত মুদারাবা, মুশারাকা, ইজারা, বাই মুয়াজ্জাল ইত্যাদি পদ্ধতিতে বিনিয়োগ হয়, যেখানে ঝুঁকিও যৌথভাবে ভাগ করা হয়, সুদের অস্তিত্ব নেই।

 

ইসলাম চায়— ধনবান ও দরিদ্রের মাঝে শোষণ নয়, সহযোগিতা হোক। দান ও সদকার মাধ্যমে সমাজে এক মানবিক অর্থনীতির ভিত্তি গড়ে উঠুক। রাসূলুল্লাহ্ সা. বলেন,  ‘ঊর্ধ্বতন হাত (দানকারী) নিম্নতর হাতের (গ্রহণকারী) চেয়ে উত্তম।’ (সহিহ্ বুখারী) এই নৈতিকতা-ভিত্তিক আর্থিক দর্শনই পারে দারিদ্র্য, বৈষম্য ও ঋণের দাসত্ব থেকে মানবজাতিকে মুক্তি দিতে।

 

Copyright © Puber Kalom All rights reserved.| Developed by eTech Builder

ইসলামে অর্থনৈতিক ন্যায়বিচার ও সুদ বিহীন সমাজ ব্যবস্থার প্রস্তাবনা

আপডেট : ১৫ জুলাই ২০২৫, মঙ্গলবার

আয়াজ আহমদ বাঙালি: মানব ইতিহাসের অর্থনৈতিক অবিচার, শোষণ ও বৈষম্যের মূল কারণগুলোর একটি হলো সুদ। আধুনিক পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় সুদের ভিত্তিতে পরিচালিত ব্যাংকিং ও বাণিজ্যিক কাঠামো ধনীদের আরও ধনী আর দরিদ্রদের আরও নিঃস্ব করে তুলছে। এই ব্যবস্থার বিপরীতে ইসলাম প্রস্তাব করে এক ন্যায়ভিত্তিক, সুদমুক্ত এবং সহানুভূতিশীল অর্থনৈতিক কাঠামো।

 

আরও পড়ুন: আযানের জবাব কীভাবে দেবেন

পবিত্র আল-কুরআন সুদের বিষয়ে কঠোর ভাষায় ঘোষণা করে,  ‘যারা সুদ খায়, তারা তার ন্যায় (কবর থেকে) উঠবে, যাকে শয়তান স্পর্শ করে পাগল বানিয়ে দেয়। এটা এ জন্য যে, তারা বলে, বেচা-কেনা সুদের মতোই। অথচ আল্লাহ্ বেচা-কেনা হালাল করেছেন এবং সুদ হারাম করেছেন। অতএব, যার কাছে তার রবের পক্ষ থেকে উপদেশ আসার পর সে বিরত হল, যা গত হয়েছে তা তার জন্যই ইচ্ছাধীন। আর তার ব্যাপারটি আল্লাহর হাওলায়। আর যারা ফিরে গেল, তারা আগুনের অধিবাসী। তারা সেখানে স্থায়ী হবে।’ ( সূরা বাকারাহ্, আয়াত: ২৭৫)

আরও পড়ুন: ইসলামের দাওয়াত সবার জন্য

সুদ একটি আর্থিক পাপ, যার মাধ্যমে ধন-সম্পদ কেবল একটি ক্ষুদ্র গোষ্ঠীর হাতে কেন্দ্রীভূত হয় এবং দরিদ্র জনগোষ্ঠী চিরকাল ঋণের দাসত্বে আবদ্ধ থাকে। এর বিপরীতে ইসলামিক অর্থনীতি একটি ব্যতিক্রমী দৃষ্টিভঙ্গি দেয়— যেখানে ব্যবসা, মুনাফাভাগ, দান, যাকাত ও সদকার মাধ্যমে সম্পদের প্রবাহ নিচের দিকে গমন করে।

আরও পড়ুন: জীবনকে বদলে দিতে পারে সুরা লোকমান!

যাকাত ইসলামের আর্থিক ন্যায়নীতির একটি কেন্দ্রীয় স্তম্ভ। ধনী মানুষের সম্পদের নির্দিষ্ট একটি অংশ গরিব, এতিম, নিঃস্ব, ঋণগ্রস্ত ও মুসাফিরদের জন্য নির্ধারিত করে দিয়ে ইসলাম একটি আর্থিক ভারসাম্যের পথ রচনা করেছে। শুধু মাত্র যাকাত ব্যবস্থাই যথাযথভাবে কার্যকর হলে বিশ্বে দারিদ্র্য সমস্যার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ দূর করা সম্ভব।

ইসলামে সম্পদের মালিকানা এককভাবে ব্যক্তির হাতে নয়, বরং সামষ্টিক কল্যাণে ব্যবহারের নির্দেশনা রয়েছে। পবিত্র কুরআন বলে,  ‘আল্লাহ্ জনপদবাসীদের নিকট থেকে তাঁর রাসূলকে ফায় হিসেবে যা দিয়েছেন তা আল্লাহর, রাসূলের, আত্মীয়-স্বজনদের, ইয়াতীমদের, মিসকীন ও মুসাফিরদের এটি এজন্য যে, যাতে ধন-সম্পদ তোমাদের মধ্যকার বিত্তশালীদের মাঝেই কেবল আবর্তিত না থাকে। রাসূল তোমাদের যা দেয় তা গ্রহণ কর, আর যা থেকে সে তোমাদের নিষেধ করে তা থেকে বিরত হও এবং আল্লাহকেই ভয় কর, নিশ্চয় আল্লাহ্ শাস্তি প্রদানে কঠোর।’ (সূরা হাশর, আয়াত : ৭)

এই দৃষ্টিভঙ্গি সম্পদকে জনসাধারণের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে উৎসাহিত করে এবং একচেটিয়া ধনসঞ্চয়ের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। আধুনিক বিশ্বব্যবস্থায় সুদের নামে যে বেআব্রু শোষণ চলছে, তা আজ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থাও উপলব্ধি করছে। IMF ও World Bank-এর সুদভিত্তিক ঋণ ব্যবস্থাপনা অনেক দেশকে ঋণ-দাসত্বের জালে ফেলে রেখেছে। মুসলিম দুনিয়া এর শিকার সবচেয়ে বেশি— যেখানে ধর্ম অনুযায়ী চলার কথা থাকলেও অর্থনীতিতে পশ্চিমা মডেলই অনুসৃত হচ্ছে।

 

ইসলামী ব্যাংকিং ও শরিয়াহ-ভিত্তিক অর্থনীতি আজ বিশ্বব্যাপী একটি গ্রহণযোগ্য বিকল্প ব্যবস্থায় পরিণত হচ্ছে। মালয়েশিয়া, কাতার, সৌদি আরব, এমনকি যুক্তরাজ্যেও ইসলামি অর্থনীতি অনুসরণ করে বিভিন্ন ফাইন্যান্স প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। এতে মূলত মুদারাবা, মুশারাকা, ইজারা, বাই মুয়াজ্জাল ইত্যাদি পদ্ধতিতে বিনিয়োগ হয়, যেখানে ঝুঁকিও যৌথভাবে ভাগ করা হয়, সুদের অস্তিত্ব নেই।

 

ইসলাম চায়— ধনবান ও দরিদ্রের মাঝে শোষণ নয়, সহযোগিতা হোক। দান ও সদকার মাধ্যমে সমাজে এক মানবিক অর্থনীতির ভিত্তি গড়ে উঠুক। রাসূলুল্লাহ্ সা. বলেন,  ‘ঊর্ধ্বতন হাত (দানকারী) নিম্নতর হাতের (গ্রহণকারী) চেয়ে উত্তম।’ (সহিহ্ বুখারী) এই নৈতিকতা-ভিত্তিক আর্থিক দর্শনই পারে দারিদ্র্য, বৈষম্য ও ঋণের দাসত্ব থেকে মানবজাতিকে মুক্তি দিতে।